রাজনৈতিক ফাটল by ড. মাহফুজ পারভেজ
সুপ্রাচীন
আমলে ভারতবর্ষে রাজা বিন্দুসারের রাজত্বে এক শ্মশানচারী ব্রাহ্মণের নাম
ছিল দ্বৈপায়ন ঠাকুর। শ্মশানে শ্মশানে ঘুরে শবদেহের সঙ্গে বয়ে আনা মৃতের
ভালবাসার দ্রব্যসামগ্রীর মধ্যে সেই বস্তুটি খুঁজে বেড়াতেন দ্বৈপায়ন ঠাকুর,
যা আপন হৃদয়ে ঢেউ তোলে। খুঁজতে খুঁজতে দ্বৈপায়নের সংগ্রহ বৃদ্ধি পায়। তাঁর
প্রধান দ্রষ্টব্যের মধ্যে অন্যতম: একটি গোবৎস, এক গৃহস্থ্যের লক্ষ্মীর
ঝাঁপি আর একটি কন্যাসন্তান। নিরাপত্তার জন্য ব্রাহ্মণ রাজা বিন্দুসারের
কাছে তাঁর প্রিয় বস্তু তিনটি গচ্ছিত রাখেন। দায়িত্বজ্ঞানহীন রাজা চরম
বিশ্বাসহীনতার পরিচয় দেন। কাহিনীর বর্ণনা মতে, রাজা বিন্দুসার দ্বৈপায়ন
ঠাকুরের গোবৎসটিকে বলি দিয়ে খায়, লক্ষ্মীর ঝাঁপিটিকে আবর্জনার মধ্যে ছুড়ে
ফেলে এবং কালক্রমে তাঁর সেই কন্যা সুভদ্রাঙ্গিকে পৈশাচিকভাবে ভোগ করে। এমন
ভয়ানক দুরাচারের সময়ে বিন্দুসার-পুত্র অশোকের জন্ম হয়। পিতার অন্যায়ের
কলঙ্কিত দুঃশাসনকে যুদ্ধ আর রক্তের সাগর পেরিয়ে অশোক নিরাপত্তা ও শান্তির
ঠিকানায় নিয়ে যান। ইতিহাস এই কাহিনী থেকে এই উপসংহারে পৌঁছায় যে, রাজারা
বিনষ্ট করলেই বিজয়ী হতে পারে না। মানুষের রক্ষণ আর নিরাপত্তা বিধানের
মাধ্যমেই তাদের পক্ষে জয়ী এবং ইতিহাসখ্যাত হওয়া সম্ভব হয়। রাজা বিন্দুসার ও
অশোকের সহস্র বছর পরের পৃথিবীতে রাজাদের দিন আর নেই; এখন চলছে রাজনীতিবিদ
আর নেতাদের আমল। কিন্তু রাজ্যশাসন ও রাজনীতিতে প্রাচীন আমল থেকে
প্রতিষ্ঠিত-পরীক্ষিত মূল্যবোধ ও আদর্শসমূহের মতো চিরায়ত বিষয়গুলো এখনও
প্রাসঙ্গিক। প্রজাহিত, নাগরিক নিরাপত্তা, কল্যাণ, শান্তি, সুশাসন এখনও
রাজ্য-রাজা-রাজনীতির মূল চালিকা শক্তি। শুভবোধ, সৌন্দর্যবোধ, সত্যোপলব্ধির
হাত ধরেই ইতিহাসে স্থান পাওয়া প্রাচীন ও একালের রাজনেতারা রাজনৈতিক
প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে সক্ষম হয়েছেন। এমন রাজা বা রাজনীতিবিদের তালিকা
কম-দীর্ঘ নয়। এই কল্যাণকর পথে চলেই তারা তাদের কৃতিত্ব ইতিহাসের পৃষ্ঠায়
অঙ্কিত করেছেন। কাজটি করা অবশ্যই সকল রাজনীতিবিদের পক্ষে সহজ বা সম্ভব হয়
না। সকল রাজনীতিবিদই স্বকীয় দক্ষতায়-সাফল্যে ইতিহাসের শীর্ষচূড়ায় আরোহণ
করতে পারেন না। কেউ হন রাজা বিন্দুসার; কেউবা সম্রাট অশোক। সহিষ্ণুতা,
উদারতা ইত্যাদির বিবেচনায় লিপিবদ্ধ হয় সাফল্য; আত্মকলহ, উগ্রতা, একগুঁয়েমি,
হটকারিতায় নয়। প্রসঙ্গত রাজনীতির রণাঙ্গনে আত্মকলহ, উগ্রতা, একগুঁয়েমি আর
হটকারিতার বিস্তার লাভ করলে কেউই জিততে পারে না। শুধু বিপুল ক্ষতিই হয়। বহু
মানুষ মারা যায়। রাজনৈতিক-সামাজিক-সাংস্কৃতিক-মতাদর্শিক সঙ্কট তীব্রতর হয়।
সমাজ আর মানুষের মর্মমূলে আশার বদলে নৈরাশ্যই বৃদ্ধি পেতে থাকে। এমনই
রাজনৈতিক সঙ্কট আর সংঘাত থেকে উৎসারিত নৈরাশ্যকে ভর করেই পৃথিবীতে ভয়াবহ
যুদ্ধ, মহাযুদ্ধ, বিপ্লব হয়েছে। রাজনীতিবিদদের অসতর্কতা বা উদাসীনতা বা
একগুঁয়েমির স্থানে সংলাপ, সমঝোতা, সম্প্রীতি থাকলে পৃথিবীর দেশে দেশে
সাধারণ মানুষকে এত মূল্য দিতে হতো না। প্রথম বিশ্বযুদ্ধকে সমীক্ষা করে রচিত
ক্যামব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসবিদ লোয়েম ডিকিনসন-এর বই ‘দ্য
ইন্টারন্যাশনাল এনার্কি (১৯০৪-১৯১৪) দাবি করেছে যে, যুদ্ধ ও সংঘাতের জন্য
দায়ী রাজনীতিবিদগণ এবং তাদের মাধ্যমে ছড়িয়ে দেয়া এনার্কি বা নৈরাশ্য। তিনি
স্পষ্টতই লিখেছেন, যুদ্ধের পূর্বেই আন্তর্জাতিক কূটনৈতিক যোগাযোগ কাঠামোয়
বেশ কিছু চিড় দেখা গিয়েছিল। যে চিড় বা ফাটলকে ইংরেজিতে তিনি বলেছেন, ‘ফল্ট
লাইনস’। কোন দেশেও যদি রাজনীতিতে চিড় ধরে বা ফল্ট লাইন দেখা দেয়, তাহলে
সেটা বিরাট বিপদের কারণ হয়। তখন রাজনৈতিক শক্তিসমূহের মধ্যে দূরত্ব বাড়ে।
পারস্পরিক শ্রদ্ধা কমে। সংঘাত-সংঘর্ষ প্রাধান্য পায়। অচলাবস্থার সৃষ্টি হয়।
রাজনৈতিক জট লাগে। রাজনীতির সমস্যা নানাবিধ অন্যান্য সমস্যার কার্যকারণে
পরিণত হয়। রাজা বিন্দুসার বিশ্বাস ভঙ্গ করে নাগরিক নিরাপত্তা বিধানে ব্যর্থ
হওয়ায় তার শাসনে চিড় ধরিয়েছিল। ইউরোপের নেতৃবৃন্দ পারস্পরিক যোগাযোগ ও
সম্পর্কের মধ্যে অবিশ্বাস আর ফাটল তৈরি করার মাধ্যমে প্রথম ও দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধের মতো ভয়ঙ্কর বিপদ ডেকে এনেছিলেন পৃথিবীর সামনে। একালের বহু
দেশে বহু রাজনীতিবিদ রাজনৈতিক ফাটল সৃষ্টি করে নিজের পতন আর জনতার সঙ্কট
করেছেন এবং করছেন। মধ্যপ্রাচ্য, আরব বিশ্ব, আফ্রিকা, পশ্চিম এশিয়ায় ঘন ঘন
শাসন বদল, গৃহযুদ্ধ, জনতার মধ্যে রক্তপাত এবং বিদেশী অনুপ্রবেশের প্রধানত
কারণই হলো সেসব দেশে সৃষ্ট রাজনৈতিক ফাটল। রাজনৈতিক সঙ্কট আর লড়াই যখন
বিরাট ফাটল তৈরি করে তখন ভেতর কিংবা বাইরে থেকে বিপদ এলে ঠেকাবে কে? যে
রাজনৈতিক শক্তি জনতাকে নিয়ে রক্ষার কাজ করবে, তারাই যদি একে অপরের ক্ষতির
কারণ হয়, তখন পরবর্তী আরও অনেক ক্ষতির প্রেক্ষাপটই তৈরি হয়। একালের
রাজনীতিবিদগণ এসব কথা জানেন বটে। ইতিহাসের পাঠ তাদের নেই, এটা বলা যাবে না।
তারপরও তারা এমন ভুল কাজই করেন কেন? সমঝোতা, সংলাপের বদলে ফাটলটিকেই বড়
করে তোলেন কেন? অন্যের বিপদ থেকে নিজের এবং সকলের বিপদের মতো পরিস্থিতি
ঘটান কেন? কে এসব প্রশ্নের জবাব দিতে পারবে? হয়ত ভবিষ্যতের ইতিহাস।
ড. মাহফুজ পারভেজ |
No comments