রাজনীতিকরা আর কত ঘুমাবেন? by আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী
দেশের
রাজনীতিকদের এ বড় অদ্ভুত ঘুম। চলছে তো চলছেই। চারদিকে গোঙানি, কান্না,
ধিক্কার, গগনবিদারী আর্তনাদ। অথচ তারা কুম্ভকর্ণ। চারপাশে লাশের মিছিল,
ঝলসানো মুখ-দেহ। অথচ তাদের মনোভাবটা যেন কুছ পরটা নেহি। রাজনীতির নামে কী
আশ্চর্য প্রতিহিংসায় তারা মেতে আছেন মাসের পর মাস, বছরের পর বছর! সহিংস
রাজনীতির জন্য কোনো নোবেল থাকলে বাংলাদেশ নির্ঘাৎ প্রতি বছর পুরস্কার পেত! সহিংস রাজনীতির গন্গনে আগুনে দুনেত্রী জাগেন না বটে, তবে গোটা বিশ্ব জাগ্রত। তটস্থ। দেখুন তার চালচিত্র। ১৮
ফেব্রুয়ারি সংলাপে বসার আহ্বান জানিয়ে লেখা বান কি মুনের চিঠি প্রসঙ্গে
পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর ভাষ্য : খুনিদের সঙ্গে কোনো সংলাপ নয়।
তথ্যমন্ত্রীর ভাষ্য : সন্ত্রাসী ও জঙ্গিদের সঙ্গে কোনো আলোচনা নয়। একই
বিষয়ে পরদিন সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রীর বক্তব্য : সন্ত্রাস-নৈরাজ্য
সৃষ্টিকারীদের সঙ্গে আলোচনা নয়।
১৭ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত চলমান সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে সংকট সমাধানে সবার দায়িত্ব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। ওই দিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল। একই দিন এসএসসি পরীক্ষা সত্ত্বেও বিএনপি অতিরিক্ত ৬০ ঘণ্টা হরতালের ঘোষণা দেয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্র অব্যাহত দেখতে চায় এবং কানাডার রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে চলমান সহিংসতা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন। একই দিন সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে কী লাভ?
১২ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস সরকারকে অবশ্যই বিরোধীদের আলোচনায় ডাকতে হবে শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সেদিনই প্রধানমন্ত্রী দানবের কাছে মানুষ হারতে পারে না বলে মন্তব্য করেন।
১১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কানাডার রাষ্ট্রদূত দেখা করে চলমান সন্ত্রাসের নিন্দা ও সংলাপের আহবান জানান। অন্যদিকে সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন ১ ঘণ্টা বৈঠক করে সব পক্ষকে কর্মের পরিণতি সম্পর্কে ভাবা ও চলমান অচলাবস্থা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন। ওই দিন বিকালে জাতিসংঘ চলমান সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তিন রাষ্ট্রদূতের প্রায় অভিন্ন অনুরোধ ও জাতিসংঘের গভীর উদ্বেগের বিপরীতে সরকারের অবস্থান : কার সঙ্গে আলোচনা করব? খুনির সঙ্গে? আর বিএনপির বিবৃতি : দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত দুর্বার আন্দোলন।
একই বিষয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ১ ঘণ্টা বৈঠক করেন। চলমান সহিংসতাকে নিঃসন্দেহে বিয়োগান্তক ঘটনা আখ্যায়িত করে তিনি তা বন্ধে প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। একই দিন তথ্যমন্ত্রী খুনিদের সঙ্গে সংলাপ নয় এবং বাণিজ্যমন্ত্রী সংলাপের প্রস্তাব অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য বলে বক্তব্য দেন। বিপরীতে বিএনপির বিবৃতি : সরকার অচিরেই দিনেও সরকারি অফিস বন্ধ করতে বাধ্য হবে।
৯ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) সরকারকে সংলাপ শুরু এবং বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার আহ্বান জানায়। ভারতীয় হাইকমিশনার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি বলে মত দেন। আর সেদিনই জাতীয় শ্রমিক লীগ খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ৩৫ গজ দূরে জমায়েত হয়ে তাকে অবরুদ্ধ রাখার হুমকি দেয়।
৮ ফেব্রুয়ারি তথ্যমন্ত্রী দানবের সঙ্গে মানবের সংলাপ হয় না এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে, সংলাপও হবে ২০১৯ সালে, তবে তা হবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে, অন্য কারও সঙ্গে নয় বলে বক্তব্য দেন। একই দিন মৈত্রী ট্রেনে বোমা হামলা হয়।
৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সহিংসতা বন্ধে সব পক্ষের সহযোগিতা করা উচিত মর্মে বিবৃতি দেয়। সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য : জঙ্গিদের কাছে নতি স্বীকার করব না। আর ওই দিনই নাশকতায় নিহত হয় ১০ জন।
এভাবে ৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশে সহিংসতা বন্ধ হওয়া উচিত বলে বিবৃতি দেয়। ৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ বাংলাদেশের চলমান সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এর আগে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকরা প্রথমবারের মতো উদ্বেগ জানান। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও নিন্দা জানায়। ১৫ জানুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন সব দলকে সংঘাত থামানোর আহ্বান জানায়। ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসতে অনুরোধ করে। তাতে বোধোদয় দূরে থাক, ১৯ জানুয়ারি অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্ত হয়েই খালেদা জিয়া বলেন, অবরোধ চলবে। ২২ জানুয়ারি জাতিসংঘ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে গোলযোগপূর্ণ আখ্যায়িত করে বিরোধী নেতাদের নির্বিচারে গ্রেফতার না করার আহবান জানায়। বিপরীতে সরকারের হুংকার- দেখামাত্র গুলি।
সম্প্রতি দি ইকোনমিস্টের (৭-১৩ ফেব্রুয়ারি সংখ্যা) এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে খাদের কিনারে দাঁড়ানো এক রাষ্ট্র (A country on the brink) এবং বাংলাদেশের দুই নেত্রীকে যুদ্ধরত বেগম (battling begums) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশ দুই দলে বৃত্তবন্দি একটি অকার্যকর ব্যবস্থায় ধুঁকছে, যেখানে যুদ্ধরত বেগমগণ রাষ্ট্রীয় অর্থে পরস্পরের বিরুদ্ধে বংশানুক্রমিকভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থে লিপ্ত।
বিদেশীদের উদ্বেগ-নিন্দা-আহ্বান এদেশে নতুন কিছু নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থায়ও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ওই সময় জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো তিনবার বাংলাদেশ সফর করেন। প্রতিবার দফায় দফায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। শেষবার তো চারদিনে ২২টি বৈঠক করেন। তার মধ্যে খালেদা ও সিইসির সঙ্গে বসেছেন দুবার। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিনিধিদের সঙ্গে একত্রে বসেছেন দুবার। ইতিবাচক অগ্রগতির স্বস্তি নিয়ে দেশ ছাড়লেও দুই দলই পরে আগের অবস্থানে ফিরে যায়। একই উদ্দেশ্যে ২০১২ সালের ৬-৭ মে বাংলাদেশ সফরে আসেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন। এরপর আসে বান কি মুনের ফোন। ২৭ নভেম্বর ২০১৩ আসে তার চিঠি। মাঝখানে একই উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই আসেন। ২০ নভেম্বর ২০১৩ প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস নিষেধাজ্ঞাসহ নানা চাপে পড়তে পারে বাংলাদেশ মর্মে সম্পাদকীয় ছাপে। ৪ ডিসেম্বর ২০১৩ বিখ্যাত দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ প্রধান বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন বৈধতা হারাবে শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। পত্রিকাটি ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিণতিও সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বর ২০১৩ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি শেখ হাসিনাকে ফোন দেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ১৯৯৪ সালের শেষদিকে বাংলাদেশে আসেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন। ২০০১ সালের সংকটে আসেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। ২০০৬ সালের সংকটে ওই দায়িত্ব নেন দেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকরা। কিন্তু প্রতিবারই দুদলের একই মনোভাব- বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার।
বাংলাদেশের সর্বত্র এখন একটাই রব- শান্তি চাই, শান্তি। তারপরও দুনেত্রী অনড়। ২৪ জানুয়ারি আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে মানুষ ভেবেছিল, খালেদা জিয়া শোকে অন্তত হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করবেন। শেখ হাসিনা খালেদাকে সান্ত্বনা দিতে যাচ্ছেন শুনে মানুষ সমঝোতার আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু সব গুড়ে বালি। উল্টো খালেদার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা- অবরোধ চলবেই। শেখ হাসিনাকে বাড়িতে ঢুকতে পর্যন্ত দেয়া হলো না। কী নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের! বাস্তবতা হল- দেশী-বিদেশী কোনো উদ্যোগ, সংলাপ-আলোচনা এ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সংকটে দুনেত্রীকে এক করতে পারেনি। কবে পারবে? তাদের ঘুম ভাঙার যে কোনো লক্ষণই দেখি না! তাদের ব্যাটল থামার চিহ্নও তো চোখে পড়ে না!
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
aftabragib@yahoo.com
১৭ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত চলমান সহিংসতার নিন্দা জানিয়ে সংকট সমাধানে সবার দায়িত্ব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। ওই দিন খালেদা জিয়ার সঙ্গে বৈঠক করে ইউরোপীয় পার্লামেন্টের প্রতিনিধি দল। একই দিন এসএসসি পরীক্ষা সত্ত্বেও বিএনপি অতিরিক্ত ৬০ ঘণ্টা হরতালের ঘোষণা দেয়।
১৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সাক্ষাতে যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশে গণতন্ত্র অব্যাহত দেখতে চায় এবং কানাডার রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে চলমান সহিংসতা বাংলাদেশের ভাবমূর্তিতে প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেন। একই দিন সংসদে প্রধানমন্ত্রী বলেন, খালেদা জিয়ার সঙ্গে আলোচনা করে কী লাভ?
১২ ফেব্রুয়ারি নিউইয়র্ক টাইমস সরকারকে অবশ্যই বিরোধীদের আলোচনায় ডাকতে হবে শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। সেদিনই প্রধানমন্ত্রী দানবের কাছে মানুষ হারতে পারে না বলে মন্তব্য করেন।
১১ ফেব্রুয়ারি প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত এবং পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রীর সঙ্গে কানাডার রাষ্ট্রদূত দেখা করে চলমান সন্ত্রাসের নিন্দা ও সংলাপের আহবান জানান। অন্যদিকে সন্ধ্যায় খালেদা জিয়ার সঙ্গে ব্রিটিশ হাইকমিশনার রবার্ট গিবসন ১ ঘণ্টা বৈঠক করে সব পক্ষকে কর্মের পরিণতি সম্পর্কে ভাবা ও চলমান অচলাবস্থা নিরসনে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলেন। ওই দিন বিকালে জাতিসংঘ চলমান সহিংসতা ও প্রাণহানির ঘটনায় গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে। তিন রাষ্ট্রদূতের প্রায় অভিন্ন অনুরোধ ও জাতিসংঘের গভীর উদ্বেগের বিপরীতে সরকারের অবস্থান : কার সঙ্গে আলোচনা করব? খুনির সঙ্গে? আর বিএনপির বিবৃতি : দাবি আদায় না হওয়া পর্যন্ত দুর্বার আন্দোলন।
একই বিষয়ে ১০ ফেব্রুয়ারি মার্কিন রাষ্ট্রদূত পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে ১ ঘণ্টা বৈঠক করেন। চলমান সহিংসতাকে নিঃসন্দেহে বিয়োগান্তক ঘটনা আখ্যায়িত করে তিনি তা বন্ধে প্রত্যেকের দায়িত্ব রয়েছে বলে মন্তব্য করেন। একই দিন তথ্যমন্ত্রী খুনিদের সঙ্গে সংলাপ নয় এবং বাণিজ্যমন্ত্রী সংলাপের প্রস্তাব অবাস্তব, অগ্রহণযোগ্য বলে বক্তব্য দেন। বিপরীতে বিএনপির বিবৃতি : সরকার অচিরেই দিনেও সরকারি অফিস বন্ধ করতে বাধ্য হবে।
৯ ফেব্রুয়ারি ব্রাসেলসভিত্তিক গবেষণা সংস্থা ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি) সরকারকে সংলাপ শুরু এবং বিএনপিকে জামায়াতের সঙ্গ ছাড়ার আহ্বান জানায়। ভারতীয় হাইকমিশনার পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে যায়নি বলে মত দেন। আর সেদিনই জাতীয় শ্রমিক লীগ খালেদা জিয়ার কার্যালয়ের ৩৫ গজ দূরে জমায়েত হয়ে তাকে অবরুদ্ধ রাখার হুমকি দেয়।
৮ ফেব্রুয়ারি তথ্যমন্ত্রী দানবের সঙ্গে মানবের সংলাপ হয় না এবং স্বাস্থ্যমন্ত্রী নির্বাচন হবে ২০১৯ সালে, সংলাপও হবে ২০১৯ সালে, তবে তা হবে নির্বাচন কমিশনের সঙ্গে, অন্য কারও সঙ্গে নয় বলে বক্তব্য দেন। একই দিন মৈত্রী ট্রেনে বোমা হামলা হয়।
৭ ফেব্রুয়ারি আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচ সহিংসতা বন্ধে সব পক্ষের সহযোগিতা করা উচিত মর্মে বিবৃতি দেয়। সেদিনই প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য : জঙ্গিদের কাছে নতি স্বীকার করব না। আর ওই দিনই নাশকতায় নিহত হয় ১০ জন।
এভাবে ৬ ফেব্রুয়ারি মার্কিন পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশে সহিংসতা বন্ধ হওয়া উচিত বলে বিবৃতি দেয়। ৫ ফেব্রুয়ারি জাতিসংঘ বাংলাদেশের চলমান সহিংসতায় উদ্বেগ প্রকাশ করে। এর আগে চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিতে ১৩ জানুয়ারি ঢাকায় নিযুক্ত বিদেশী কূটনীতিকরা প্রথমবারের মতো উদ্বেগ জানান। ওই দিন যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নও নিন্দা জানায়। ১৫ জানুয়ারি জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশন সব দলকে সংঘাত থামানোর আহ্বান জানায়। ১৯ জানুয়ারি যুক্তরাজ্যের হাউস অব কমন্স বাংলাদেশের রাজনৈতিক দলগুলোকে আলোচনায় বসতে অনুরোধ করে। তাতে বোধোদয় দূরে থাক, ১৯ জানুয়ারি অবরুদ্ধ দশা থেকে মুক্ত হয়েই খালেদা জিয়া বলেন, অবরোধ চলবে। ২২ জানুয়ারি জাতিসংঘ চলমান রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে গোলযোগপূর্ণ আখ্যায়িত করে বিরোধী নেতাদের নির্বিচারে গ্রেফতার না করার আহবান জানায়। বিপরীতে সরকারের হুংকার- দেখামাত্র গুলি।
সম্প্রতি দি ইকোনমিস্টের (৭-১৩ ফেব্রুয়ারি সংখ্যা) এক প্রতিবেদনে বাংলাদেশকে খাদের কিনারে দাঁড়ানো এক রাষ্ট্র (A country on the brink) এবং বাংলাদেশের দুই নেত্রীকে যুদ্ধরত বেগম (battling begums) হিসেবে আখ্যায়িত করা হয়। বলা হয়, বাংলাদেশ দুই দলে বৃত্তবন্দি একটি অকার্যকর ব্যবস্থায় ধুঁকছে, যেখানে যুদ্ধরত বেগমগণ রাষ্ট্রীয় অর্থে পরস্পরের বিরুদ্ধে বংশানুক্রমিকভাবে প্রতিহিংসা চরিতার্থে লিপ্ত।
বিদেশীদের উদ্বেগ-নিন্দা-আহ্বান এদেশে নতুন কিছু নয়। ৫ জানুয়ারির নির্বাচনের আগে সৃষ্ট রাজনৈতিক অচলাবস্থায়ও ইউরোপীয় পার্লামেন্ট, চীন, ভারতসহ বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হিউম্যান রাইটস ওয়াচসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা উদ্বেগ প্রকাশ করেছিল। ওই সময় জাতিসংঘ মহাসচিবের বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্দেজ তারানকো তিনবার বাংলাদেশ সফর করেন। প্রতিবার দফায় দফায় বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও পেশাজীবীদের সঙ্গে আলোচনায় বসেন। শেষবার তো চারদিনে ২২টি বৈঠক করেন। তার মধ্যে খালেদা ও সিইসির সঙ্গে বসেছেন দুবার। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্রতিনিধিদের সঙ্গে একত্রে বসেছেন দুবার। ইতিবাচক অগ্রগতির স্বস্তি নিয়ে দেশ ছাড়লেও দুই দলই পরে আগের অবস্থানে ফিরে যায়। একই উদ্দেশ্যে ২০১২ সালের ৬-৭ মে বাংলাদেশ সফরে আসেন সাবেক মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও ফার্স্ট লেডি হিলারি ক্লিনটন। এরপর আসে বান কি মুনের ফোন। ২৭ নভেম্বর ২০১৩ আসে তার চিঠি। মাঝখানে একই উদ্দেশ্যে যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেশাই আসেন। ২০ নভেম্বর ২০১৩ প্রভাবশালী মার্কিন দৈনিক নিউইয়র্ক টাইমস নিষেধাজ্ঞাসহ নানা চাপে পড়তে পারে বাংলাদেশ মর্মে সম্পাদকীয় ছাপে। ৪ ডিসেম্বর ২০১৩ বিখ্যাত দৈনিক দ্য টেলিগ্রাফ প্রধান বিরোধী দল ছাড়া নির্বাচন বৈধতা হারাবে শিরোনামে সম্পাদকীয় প্রকাশ করে। পত্রিকাটি ১৯৮৮ ও ১৯৯৬ সালে বিরোধী দলবিহীন নির্বাচন অনুষ্ঠানের পরিণতিও সরকারকে স্মরণ করিয়ে দেয়। সর্বশেষ ১১ ডিসেম্বর ২০১৩ মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জন কেরি শেখ হাসিনাকে ফোন দেন। কিন্তু ফলাফল শূন্য। এর আগে তত্ত্বাবধায়ক সরকার ইস্যুতে ১৯৯৪ সালের শেষদিকে বাংলাদেশে আসেন কমনওয়েলথ মহাসচিবের বিশেষ দূত স্যার নিনিয়ান স্টিফেন। ২০০১ সালের সংকটে আসেন সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট জিমি কার্টার। ২০০৬ সালের সংকটে ওই দায়িত্ব নেন দেশে অবস্থানরত বিদেশী কূটনীতিকরা। কিন্তু প্রতিবারই দুদলের একই মনোভাব- বিচার মানি, কিন্তু তালগাছটা আমার।
বাংলাদেশের সর্বত্র এখন একটাই রব- শান্তি চাই, শান্তি। তারপরও দুনেত্রী অনড়। ২৪ জানুয়ারি আরাফাত রহমান কোকোর মৃত্যুতে মানুষ ভেবেছিল, খালেদা জিয়া শোকে অন্তত হরতাল-অবরোধ প্রত্যাহার করবেন। শেখ হাসিনা খালেদাকে সান্ত্বনা দিতে যাচ্ছেন শুনে মানুষ সমঝোতার আশায় বুক বেঁধেছিল। কিন্তু সব গুড়ে বালি। উল্টো খালেদার দ্ব্যর্থহীন ঘোষণা- অবরোধ চলবেই। শেখ হাসিনাকে বাড়িতে ঢুকতে পর্যন্ত দেয়া হলো না। কী নষ্ট রাজনৈতিক সংস্কৃতি আমাদের! বাস্তবতা হল- দেশী-বিদেশী কোনো উদ্যোগ, সংলাপ-আলোচনা এ পর্যন্ত রাষ্ট্রীয় সংকটে দুনেত্রীকে এক করতে পারেনি। কবে পারবে? তাদের ঘুম ভাঙার যে কোনো লক্ষণই দেখি না! তাদের ব্যাটল থামার চিহ্নও তো চোখে পড়ে না!
আফতাব উদ্দিন ছিদ্দিকী : আইনজীবী, বাংলাদেশ সুপ্রিমকোর্ট
aftabragib@yahoo.com
No comments