আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতিই দুষ্কৃতকারীদের বেপরোয়া করছে by বদরুদ্দীন উমর

বাংলাদেশের শাসন ব্যবস্থা এখন ভাঙনের মুখে। যে কোনো ব্যবস্থাকে দাঁড় করিয়ে রাখার জন্য সব থেকে বড় প্রয়োজন হলো, সেই ব্যবস্থায় আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি সুষ্ঠু নিয়ন্ত্রণের অধীনে থাকা। বাংলাদেশে এই নিয়ন্ত্রণ যেভাবে শিথিল হয়েছে এবং ক্রমশ ও দ্রুত আরও শিথিল হচ্ছে, তাতে এই পরিস্থিতি অদূর ভবিষ্যতে যে আরও ঘোলাটে হবে, এতে সন্দেহ নেই। এ নিয়ে বিতর্কের বিশেষ অবকাশ নেই যে, আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার দায়িত্ব যেসব সশস্ত্র বাহিনী ও সরকারি সংস্থার দায়িত্ব তাদের দায়িত্বহীন কর্মকাণ্ডই এই সংকট সৃষ্টির জন্য মূলত দায়ী। দুর্নীতি ও ঘুষখোরি তো পুলিশের মজ্জাগত। ব্রিটিশ আমলে উনিশ শতকে পুলিশ বাহিনী গঠনের সময় থেকে পাকিস্তান আমল এবং ১৯৭১ সালের পর বাংলাদেশে পুলিশের এই চরিত্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। উপরন্তু এদিক দিয়ে অবস্থার ক্রমাগত অবনতি ঘটে পরিস্থিতি এমন হয়েছে, যাতে পুলিশ এবং অন্য আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী থেকে জনগণের আশা করার কিছুই নেই। এ বিষয়ে অন্য আলোচনার আগে উল্লেখ করা দরকার সদ্য সংঘটিত অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড। ২৬ ফেব্রুয়ারি রাত ৯টার দিকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় টিএসসির পাশে ফুটপাতের ওপর দুই সন্ত্রাসী অভিজিৎকে ধারালো চাপাতি দিয়ে আক্রমণ করে। সঙ্গে থাকা তার স্ত্রী রাফিদা আহমদ তাকে রক্ষার জন্য চিৎকার করে সাহায্য চাইলেও কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা পুলিশ এবং ওই এলাকার আড্ডা দিতে থাকা ছাত্ররা কেউই তাদেরকে সাহায্য করতে এগিয়ে না এসে দৃশ্য দেখেছে। সন্ত্রাসীরা অভিজিৎকে হত্যা করে তার স্ত্রীকে গুরুতরভাবে আহত করে নিরাপদে পালিয়ে যায়। টিএসসির এই এলাকায় ছাত্রদের মধ্যে ছাত্রলীগ এবং সেই সঙ্গে যুবলীগের সদস্যরা নিয়মিত আড্ডা দিয়ে থাকে। ওইদিন সেখানে তারাও ছিল। কিন্তু তার থেকে উল্লেখযোগ্য হলো পুলিশের ভূমিকা। তারা ঘটনাস্থলের খুব কাছাকাছি থাকা সত্ত্বেও এবং চোখের সামনে এই হত্যাকাণ্ড ঘটতে দেখলেও তা রোধ করতে না আসা কোনো তাৎপর্যহীন ব্যাপার নয়। এর থেকে বোঝা যায়, দেশে আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতির অবনতি কী পরিমাণ হয়েছে এবং এই পরিস্থিতিতে পুলিশ ও অন্যান্য বাহিনী নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করে কীভাবে দেশে অরাজকতা বৃদ্ধির ক্ষেত্রে ভূমিকা রাখছে। নিজেদের এই ভূমিকা সম্পর্কে তারা যে ব্যাখ্যা দিয়েছে সেটা একেবারে ভুয়া এবং কর্তব্য কাজে চরম অবহেলার দৃষ্টান্ত ছাড়া আর কিছুই নয়।
অভিজিৎ রায়ের পিতা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পদার্থ বিজ্ঞানের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক অজয় রায় বলেন, তিনি আগেই অভিজিৎকে হত্যার হুমকি নিয়ে পুলিশের আইজি, ডিআইজিকে বলেন। অভিজিতের হত্যা তাদের ব্যর্থতাই প্রমাণ করে (ডেইলি স্টার, ২.৩.২০১৫)। আসলে একে পুলিশের ব্যর্থতা বললেও ঠিক বলা হয় না। এটা হলো নিজেদের পেশাগত দায়িত্ব-কর্তব্য বিষয়ে পুলিশের ইচ্ছাকৃত ঔদাসীন্য। এই ঔদাসীন্যের কারণ হলো, এর জন্য কারও কাছে, কোনো ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের কাছে পুলিশের কোনো জবাবদিহিতার ব্যাপার না থাকা। দ্বিতীয়ত, পুলিশ কর্তৃক নিজেই নানাভাবে আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড বেপরোয়াভাবে করে চলা। যারা নিজেরা এ ধরনের কাজ করে তারা যে বেসরকারি ক্রিমিনালদের তৎপরতা বন্ধের ক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা রাখবে, তাদের কাছে জনগণের এমন প্রত্যাশাও আর নেই। শুধু পুলিশেরই যে এই অবস্থা তাই নয়। কয়েকদিন আগে ঢাকা সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী শাহদীন মালিক বলেছেন, বাংলাদেশে অধিকাংশ ক্ষেত্রে কাজকর্ম আইন মান্য করে হচ্ছে না। এটা শুধু তার কথা নয়। শাসন ব্যবস্থা বর্তমানে যেভাবে চলছে এটা দেখে জনগণের সর্বস্তরের লোকদের ধারণা একই প্রকার। এটাই স্বাভাবিক। কারণ কোনো দেশেই প্রশাসনের একটি অংশ আইনবহির্ভূত কাজ করবে বেপরোয়াভাবে এবং অন্যান্য অংশ আইন মান্য করে আইনের আওতায় কাজ করবে, এটা হয় না। কারণ সমগ্র প্রশাসন এক অখণ্ড ব্যবস্থা হিসেবেই কাজ করে এবং এই ব্যবস্থার প্রত্যেকটি অংশ পরস্পরের সঙ্গে সম্পর্কিত থাকে। বাংলাদেশে এখন অপরাধীদের পাকড়াও করা, তাদেরকে আইনের আওতায় রাখা ও শাস্তি দেওয়ার কোনো কার্যকর ব্যবস্থা নেই। যেটুকু আছে তা এতই শিথিল যে, নানা ফাঁকফোকর দিয়ে অপরাধী আইন-শৃঙ্খলার কোনো পরোয়া না করে নিজেদের নিরাপদ রাখতে সক্ষম। বিশেষত পুলিশের মতো সরকারি সংস্থা ও সরকারি দলের লোকজন সম্পর্কেই এসব কথা বিশেষভাবে প্রযোজ্য।
বাংলাদেশে বর্তমানে যে নৈরাজ্যিক পরিস্থিতি দেখা যাচ্ছে, সেটা নিয়ন্ত্রণ করা ও সামাল দেওয়া পুলিশ বাহিনীর কর্তব্য। কিন্তু কর্তব্য পালনেরও কিছু নিয়ম আছে। এই নিয়মের বাইরে দাঁড়িয়ে যখন পুলিশ নিজেই আইনের আওতার বাইরে গিয়ে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষার কথা বলে, তখন তার ফলাফল উল্টো হওয়াই স্বাভাবিক। মাত্র কয়েকদিন আগে গাজীপুরে পুলিশের এক সভায় ঢাকা রেঞ্জের পুলিশ অফিসার এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের উপস্থিতিতে এই রেঞ্জের ডিআইজি পুলিশ সদস্যকে উদ্দেশ করে বলেন সন্ত্রাসীদের দেখামাত্র গুলি করতে। শুধু তাই নয়, তাদের পরিবারবর্গ ও বংশকে পর্যন্ত নির্মূল করার জন্য তিনি তার পুলিশ সহকর্মীদের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, এর জন্য তাদের কোনো অসুবিধা হবে না। তিনিই এর দায়িত্ব নেবেন! কিন্তু এই বেপরোয়া কাজের দায়িত্ব পুলিশের একজন ডিআইজি কীভাবে নিতে পারেন? তিনি এভাবে আইনবহির্ভূত কাজের নির্দেশ দেওয়ার জন্য তো তার বিরুদ্ধে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের পদক্ষেপ নেওয়ার কথা। কিন্তু এখানে এই পদক্ষেপ নেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কারণ, পুলিশ এ কাজ করছে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের অনুসৃত কর্মধারা ও নির্দেশ অনুযায়ী। এই কার্যধারা এবং এ ধরনের নির্দেশই যে দেশে সরকারি বৃত্তের বাইরে থাকা ক্রিমিনালদের অপরাধ করতে এবং দেশে পরিস্থিতির অবনতি ঘটিয়ে ধর্মীয় জঙ্গিসহ অন্যান্য সন্ত্রাসী গ্রুপ, এমনকি ব্যক্তিকে তাদের অপরাধ করতে সাহস এবং উৎসাহের জোগান দেবে, এতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।
অভিজিৎ রায়ের পিতা অধ্যাপক অজয় রায় পুলিশের আইজি ও ডিআইজিকে তার পুত্রের জীবনের ওপর ধর্মান্ধ সন্ত্রাসীদের হুমকি বিষয়ে জানানো সত্ত্বেও যে পুলিশ এ ক্ষেত্রে কিছুই করেনি, এটা যেভাবে এই হত্যাকাণ্ড হয়েছে এবং পুলিশ ঘটনাস্থলের কাছেই দাঁড়িয়ে থেকে সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে, এর থেকেই প্রমাণিত হয়। কিন্তু পুলিশ যে শুধু এ ধরনের অপরাধ রোধে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতেই অপরাগ, তাই নয়। তারা নিজেরাও যে নানাভাবে এ ধরনের অপরাধ করে চলেছে তার ভূরি ভূরি উদাহরণ দেশের লোকের অজানা নয়। সংবাদপত্রে পুলিশ, র‌্যাব, বিজিবি ইত্যাদি এনকাউন্টার, ক্রসফায়ার এবং জেলহাজতে মৃত্যুর ঘটনার রিপোর্ট যেভাবে দেখা যায়, তাতে এই তথাকথিত আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থাগুলো কী অবস্থায় এসে দাঁড়িয়েছে, এটা বোঝার কোনো অসুবিধা নেই।
অভিজিৎ হত্যার মাত্র কয়েকদিন আগে মিরপুরে তিনজন সাধারণ কর্মজীবী যুবকের মৃত্যু ঘটে। হত্যাকাণ্ডের এই ঘটনা সম্পর্কে পুলিশের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে যে, গণপিটুনিতে তাদের মৃত্যু হয়েছে। প্রথম কথা হলো, থানার একেবারে পার্শ্ববর্তী জায়গায় এ ধরনের গণপিটুনির ঘটনা ঘটে থাকলে পুলিশ তা রোধ করার জন্য কিছুই করেনি। কিছু করার বিষয়ে তাদের কোনো বক্তব্য বা দাবিও নেই। দ্বিতীয়ত, গণপিটুনিতে এই যুবকদের মৃত্যু হয়েছে এ কথা পুলিশ বললেও ময়নাতদন্তের রিপোর্টে বলা হয়েছে যে, গণপিটুনিতে মৃত্যুর কোনো চিহ্ন মৃতদেহগুলোতে নেই। উপরন্তু তাদের শরীরে ৫৬টি বুলেটের চিহ্ন আছে। এই মৃতদেহগুলোর যে ছবি সংবাদপত্রে বের হয়েছে, তাতেও গুলির চিহ্ন খুব স্পষ্টভাবেই দেখা যায়। এর থেকে বোঝার অসুবিধা নেই যে, এই আইনবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড কাদের কাজ।
এ ধরনের কর্মকাণ্ড যেখানে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী করে চলে এবং সরকার তা নিয়ন্ত্রণের পরিবর্তে রাজনৈতিকভাবে তাদেরকে এ ধরনের কাজে নিজেরাই ব্যবহার করে, সেখানে দেশের শাসন ব্যবস্থায় যে ভাঙন দেখা দেবে, এটা স্বাভাবিক। এই পরিস্থিতি আরও বিপজ্জনক এ কারণে যে, এর বিরুদ্ধে সমাজে ও রাজনৈতিক মহলে যে প্রতিবাদ ও বিক্ষোভ হওয়া দরকার তার কিছুই নেই। অভিজিতের হত্যাকাণ্ডের বিরুদ্ধে বড় ধরনের প্রতিবাদ হয়েছে ও হচ্ছে। এটা হওয়া দরকার। কিন্তু এই ঘটনার মাত্র কয়েকদিন আগে তিনজন গরিব কর্মজীবী যুবককে হত্যার বিরুদ্ধে কোনো মহলের কোনো প্রতিক্রিয়া, বিক্ষোভ ও ক্রোধের অভিব্যক্তি না থাকা হলো বর্তমান পরিস্থিতির এক অতি বিপজ্জনক দিক। পুলিশ এ কাজ করেছে এ ব্যাপারে নিশ্চিন্ত হয়ে, একে বর্তমান পরিস্থিতিতে স্বাভাবিক মনে করে যেখানে নীরবতা পালন করা হয়, সেখানে ধর্মান্ধ দুষ্কৃতকারীসহ অন্য অপরাধীরা যে বেপরোয়াভাবে সক্রিয় হবে এতে বিস্মিত হওয়ার কিছু নেই। সাধারণভাবে হত্যাকাণ্ডসহ নানা অপরাধের প্রতি ক্ষমতাসীন মহল ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বুদ্ধিজীবী মহলের একদিকে বিক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া এবং অন্যদিকে নীরবতা ও নিষ্ক্রিয়তার মধ্যে যে নীতিগত এবং আচরণগত অসঙ্গতি আছে সে কারণেই ধর্মান্ধ জঙ্গিদের বিরুদ্ধে যত বিক্ষোভই দেখানো হোক, তার বিশেষ কোনো ফল দেখা যায় না। এ ধরনের 'অসাম্প্রদায়িক' ধর্মান্ধতা প্রতিরোধ আন্দোলন ধর্মীয় সহিংসতা রোধ করা বা কমিয়ে আনার পরিবর্তে তার বৃদ্ধির শর্তই যে তৈরি করে ওপরে বর্ণিত বর্তমান পরিস্থিতির মধ্যে এটা অভ্রান্তভাবেই দেখা যায়।
২.৩.২০১৫
সভাপতি, জাতীয় মুক্তি কাউন্সিল

No comments

Powered by Blogger.