তালগোল by মাহবুব তালুকদার

আগুণে পুড়ে নিহত পোষাককর্মীদের স্মৃতির উদ্দেশ্যে..., ঢাকার অদূরে আশুলিয়ায়
পোশাক কারখানা তাজরীন ফ্যাশনে ভয়াবহ অগ্নিকাণ্ডের ঘটনায় নিহত প্রত্যেক ব্যক্তির
পরিবারকে এক লাখ টাকা করে আর্থিক সহায়তা দেওয়ার ঘোষণা দিয়েছে বিজিএমইএ
কয়েকদিন চাচার সঙ্গে যোগাযোগ নেই। আমি নিজেই নানা কাজে ব্যস্ত থাকায় তার বাসায় যেতে পারিনি। তাই আমাদের আলাপচারিতা বন্ধ ছিল। আজ সকাল থেকে চাচার কথা ভাবছিলাম। দুপুরে তিনি নিজেই ফোন করলেন। বললেন, বিকালে কি আসতে পারবে? তোমার সঙ্গে একটা বিশেষ আলাপ আছে।
চাচার কণ্ঠে উদ্বিগ্নতার স্বর আমার কান এড়িয়ে গেল না। বললাম, কি ব্যাপার?
পুলিশ তালগোল পাকিয়ে ফেলেছে। চাচার কথায় এবার সত্যি সত্যি উৎকণ্ঠা প্রকাশ পেল।
পুলিশ তালগোল পাকালে আপনার কী?
আইন শৃঙ্খলা বাহিনীকে একটা ভালো পরামর্শ দেয়া প্রত্যেক সুনাগরিকের কর্তব্য। একটু থেমে চাচা আবার বললেন, এসব কথা টেলিফোনে আলাপ করা মোটেই ঠিক হচ্ছে না। সব কথাই তো রেকর্ড করা হয়। কোন কথার কি অর্থ হবে কে জানে?
বিকালে চাচার বাসায় চলে গেলাম। কথা বলতে গিয়ে মনে হলো, চাচা রীতিমত পেরেশানীতে আছে। তিনি জানালেন, পুলিশ মিরপুরের কাজীপাড়া থেকে তিন যুবকের লাশ উদ্ধার করে নিয়ে আসে। ওখানকার ওসির দাবি ওই তিনজন মনিপুর স্কুলে একটি শাখা পুড়িয়ে দেয়ার পরিকল্পনা করেছিল। ওসি বলেছেন, বিক্ষুব্ধ জনতা তাদের ধরে পিটিয়ে ও গুলি করে হত্যা করেছে। পত্রিকার ভাষ্যমতে- ‘কারা গুলি করল জানতে চাইলে তিনি (ওসি) বলেন, অনেকেরই কাছেই লাইসেন্স করা অস্ত্র রয়েছে। মানুষকে অস্ত্র দেয়া হয়েছে নিজের ও অন্যের জানমাল রক্ষার জন্য। এখন সেই অস্ত্র নাশকতার বিরুদ্ধে ব্যবহার হয়েছে। এটা আসলে নাশকতা সৃষ্টিকারীদের বিরুদ্ধে জনরোষের প্রচণ্ড বহিঃপ্রকাশ।’
বললাম, খবরটি আমিও পড়েছি। এতে অসুবিধা কি?
পুলিশের ভাবমূর্তির অসুবিধা। সাংবাদিকরা অকুস্থলে গিয়ে ও মেডিকেল কলেজের মর্গে গিয়ে জেনেছে, নিহত তিনজনের গায়ে মোট ৫৪টি (২২+১৭+১৫) গুলির ক্ষত ছিল। তারা গণপিটুনিতে মারা গেছে এলাকাবাসীদের সঙ্গে কথা বলে পুলিশের এই দাবির সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়নি। চাচা আরও বললেন, পত্রিকাওয়ালাদের কাছ থেকে আজকাল কিছুই লুকানো যায় না রে ভাই। তারা রাস্তার ওপরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা গুলির খোসাগুলোর ছবি ছেপে দিয়েছে। রক্তমাখা দড়িও ছিল পাশে। সাংবাদিকরা লিখেছে, গণপিটুনির কোনো ঘটনা সেখানে ঘটেনি।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এ ব্যাপারে আপনি আমাকে ডেকেছেন কেন? আমি কি করবো?
তুমি তো এককালে গল্প লিখতে। তাই ভাবলাম, এসব বিষয়ে তুমি একটা বিশ্বাসযোগ্য গল্প বানিয়ে দিতে পার। বন্দুকযুদ্ধ বা ক্রসফায়ারের ব্যাপারে পুলিশ যা বলছে তা অনেকে বিশ্বাস করছে না। কদিন আগে পুলিশের সাফাই ছিল, সন্ত্রাসী পালাতে গিয়ে গাড়ির চাকার তলে পিষ্ট হয়ে মারা গেছে। এ কথাও কেউ বিশ্বাস করেনি। তবে ঘটনাগুলোর ক্ষেত্রে গল্পের ভেরিয়েশন দরকার। একজন গল্পলেখক হিসেবে ব্যাপারটা নিশ্চয়ই তুমি বুঝবে। পুলিশের মুখের দিকে তাকিয়ে একটা কিছু কর রে ভাই!
চাচা নার্ভাস হয়ে গেলে আমাকে ভাই বলে সম্বোধন করেন। তিনি ভুলে যান যে আমি তার ভাতিজা। তবে চাচার এহেন উদ্বিগ্নতা ও উৎকণ্ঠা আমাকে বিচলিত করলো। সত্যি বলতে কি বিএনপি সরকারের আমলে যখন র‌্যাবের সৃষ্টি হয়, তখন ক্রসফায়ার সম্পর্কে বলা হতো, নিহত ব্যক্তি হার্ট অ্যাটাকে মারা গেছে। এটি ছিল খুবই বিশ্বাসযোগ্য গল্প। কারণ গুলি করে বা পিটিয়ে বা অন্য কোনো উপায়ে কাউকে মারা হলে হৃদস্পন্দন থেমে না যাওয়া পর্যন্ত তাকে মৃত ঘোষণা করা যায় না- এটা হচ্ছে ডাক্তারি শাস্ত্রের কথা। ফলে বিচার বহির্ভূতভাবে যিনিই যেভাবেই নিহত হন, তার হার্ট ফেল না হলে মারা যাওয়া সম্ভব নয়। র‌্যাবের তৎকালীন বক্তব্যটি ছিল বিজ্ঞান ভিত্তিক ও সত্যকথন। পরবর্তীকালে আওয়ামী লীগ সরকার সম্ভবত রাজনৈতিক কারণে গল্পের ফরম্যাটটি পরিত্যাজ্য মনে করে।
আমি বললাম, চাচা! মিরপুরের ঘটনায় পুলিশের বক্তব্য সম্ভবত নিচের দিকে কারও তাৎক্ষণিকভাবে তৈরি। পুলিশের মধ্যে অনেক ভালো লেখক আছেন বা ছিলেন। এক সময়ের আইজি আবুল খায়ের মোসলেউদ্দিন ছিলেন ডাকসাইটে লেখক বা কথাশিল্পী। কিন্তু সমস্যাটা গল্প লেখা বা বানানোর নয়।
তাহলে? চাচা জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে তাকালেন আমার দিকে।
বললাম, পুলিশ যদি নি:সংকোচে নিরপেক্ষতা, নৈতিকতা ও নিষ্ঠা দ্বারা পরিচালিত হয়ে দায়িত্ব পালন করে তাহলে তাদের প্রতি জনগণের আস্থা আরও বাড়বে। পুলিশ আত্মসমালোচনা করে কাজ করলে অন্যদের সমালোচনা থেকে রক্ষা পাবে। পুলিশের উচ্চপদস্থ কর্মকর্তাদের খুবই সতর্কতার সঙ্গে কথাবার্তা বলতে হবে। কারণ, তারা সরকারের পুলিশ হলেও মূলত দেশের জনগণের পুলিশ। প্রশ্নবিদ্ধ বক্তব্য দিয়ে কোনো বিতর্কে জড়ানো তাদের উচিত হবে না।
কিন্তু ক্রসফায়ার বা বন্দুকযুদ্ধ সম্পর্কে তাদের বক্তব্য কি হবে? আসল কথাটা তুমি এড়িয়ে যাচ্ছ কেন?
আমার মনে হয়, পুলিশের নির্ধারিত আইনকানুন ও বিধি অনুযায়ী যে কোন অপরিহার্য ব্যবস্থা নিলে কেউ তাদের বিরুদ্ধে কিছু বলবে না। যে কোন ঘটনার সত্য প্রকাশ করলে, তাদের গল্প বানাতে হবে না। দেশের মানুষ তাদেরকেই সবচেয়ে বেশি বিশ্বাস করবে।
কথাগুলো শুনে চাচা শান্ত হলেন। বললেন, তোমার কথাই আমি তাদের বুঝিয়ে বলব। যে কোনো ভালো পরামর্শ দেওয়া সুনাগরিক হিসাবে আমাদের কর্তব্য। কি বলো?
সেদিন চাচার বাড়ি থেকে ফিরতে আমার মনটা বেশ ভলো হয়ে গেল। সাধারণত কোনো বিষয়ের আলোচনায় আমাদের মতের মিল হয় না। অনেক সময় সাময়িকভাবে মনেরও গরমিল দেখা দেয়। আমাদের পারস্পরিক মনের দূরত্ব অবশ্য বেশিক্ষণ স্থায়ী থাকে না। অধিকাংশ ক্ষেত্রে চাচার অযাচিত আচরণে আমাকে চুপ থাকতে হয়। কারণ, আমার ধারণা, চাচা জনগণের এক বৃহৎ অংশের প্রতিনিধিত্ব করেন। তাঁর আলাপচারিতার ভিতর দিয়ে আমার নিজের চিন্তার বিপরীত চিন্তাধারার উপাদান খুঁজে পাওয়া যায়। নিজের মননকে পরিপুষ্ট করতে এটা আমার কাছে মূল্যবান মনে হয়।
দুদিন পরে ঢাকা উত্তর ও দক্ষিণ সিটি কর্পোরেশনের মেয়র নির্বাচনের ঘোষণা শোনার পর থেকে চাচাকে খুবই উৎফুল্ল দেখা গেল। চাচার মতে অব্যাহত হরতাল ও অবরোধের মধ্যে এ ধরনের সিদ্ধান্ত গণতন্ত্রপ্রাণ সরকারের সঠিক পদক্ষেপ। এতে বিদেশে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি জ্বল জ্বল করে উঠবে। গণতন্ত্র আর নির্বাচন নিয়ে যারা সরকারের সমালোচনা করে, তাদের মুখে ঝামা ঘষে দেয়া হবে।
দেশের সংকটাপন্ন অবস্থায় ঢাকার মেয়র নির্বাচন করার সিদ্ধান্তটি আমার কাছে বোধগম্য নয়। এর আগে দীর্ঘকাল নানা অজুহাতে মেয়র নির্বাচন বন্ধ রাখা হয়। সেসব অজুহাত এখনও হয়ত আছে। কিন্তু সরকার ভাবছে বর্তমান পরিস্থিতিতে নির্বাচন হলে এক ঢিলে দুই পাখি নয়, অনেক পাখি মারা যাবে।
আমি জিজ্ঞাসা করলাম, এমন ডামাডোলের মধ্যে এ- সময় মেয়র নির্বাচন কি ঠিক হচ্ছে?
এই তো সময়! চাচা হাসিমুখে বললেন, ঢাকা শহরে হরতাল অবরোধের কোনো চিহ্ন নেই। লোকেরা নিশ্চিন্তে এখন ভোট দিতে পারবে। তাছাড়া এ সময়ে কাউন্সিলার পদে নির্বাচনের জন্য বিএনপির কোনো প্রার্থী খুঁজে পাওয়া যাবে না। মামলা-হামলার ভয়ে তারা সবাই আত্মগোপনে আছে।
এখন নির্বাচন হলে কি সরকারি দল জয়ী হতে পারবে? বিএনপি যদি সংসদ নির্বাচনের মতো এই নির্বাচন বর্জন না করে?
কি আশ্চর্য! তুমি সবসময় নেতিবাচক চিন্তা কর। ঢাকা শহরের সব মানুষ এখন আওয়ামী লীগের পক্ষে। হরতাল অবরোধ আর পেট্রলবোমার কারণে মানুষজন তো দূরের কথা, বিএনপির পক্ষে কোনো কাক-পক্ষীও নেই। সরকারের উচিত গোপনে সাধাসাধি করে বিএনপিকে এই নির্বাচনে টেনে আনা।
কেন? আমি বুঝতে না পেরে প্রশ্ন করলাম।
সহজ উত্তর। ভোটে এলেই বিএনপি তথা ২০ দলীয় জোটের অন্ত:সারশূন্যতা প্রকাশ পাবে।
কিন্তু চাচা! বিগত ৫টি মহানগরীতে মেয়র নির্বাচনের মতো বিএনপি প্রার্থী যদি জিতে যায়?
তুমি অকারণে এসব কথা ভাবছ। আমি তো মনে করি ঢাকার উত্তর-দক্ষিণের মেয়র নির্বাচনে বিএনপিকে বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় জিতিয়ে দেয়া উচিত। তাহলে গত সংসদ নির্বাচনে ১৫৩ আসনে আওয়ামী লীগের বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হওয়ার সঙ্গে একটা ব্যালেন্স হয়ে যাবে।
কি বলছেন আপনি? বিএনপির মেয়র ঢাকা সিটি কর্পোরেশনের নির্বাচিত নগরপিতা হবেন?
সাময়িকভাবে হতে অসুবিধা কী? দেশে গণতন্ত্র আছে না?
সাময়িকভাবে বলছেন কেন?
রাজনীতি না বুঝলে আমার কথার মর্মার্থ বুঝতে পারবে না।
আপনি বুঝিয়ে দিলে পারব।
শোনো। যে ৫টি মহানগরীতে বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন তাঁরা এখন কোথায়? এদের দুজন জেলে, দুজন পলাতক, একজন অসুস্থ। ঢাকা শহরে বিএনপির কেউ মেয়র হলে তাদের পরিণতিও একই হবে। হয় জেল, নয় পলায়ন। কারণ তারা নিশ্চিতই হরতাল অবরোধ ও মানুষ পুড়িয়ে মারার সঙ্গে জড়িত। তখন আনিসুল হক আর সাঈদ খোকনকে প্রশাসক হিসাবে বসিয়ে দিলেই হলো। তাদেরকে আর কারও কাছে জবাবদিহি করতে হবে না। জবাবদিহিতার অনেক জ্বালা রে ভাই! সফল মেয়র হানিফকেই কি কম জ্বালাতন ভোগ করতে হয়েছে? তবে এভাবে প্রশাসক নিয়োগ না করে আওয়ামী লীগের নেতাদের প্যানেল মেয়র হিসাবেও দায়িত্ব দেয়া যায়। এটা অবশ্য রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়।
আপনার এই অভিনব চিন্তাটি কি আপনি কারো সঙ্গে শেয়ার করেছেন?
সময় পেলাম কোথায়? আমি আমার আইডিয়াটা উচ্চপর্যায়ে জানাব ভাবছিলাম। কিন্তু তার আগেই আনিসুল হক আর সাঈদ খোকনের নাম ঘোষণা করা হলো।
চাচা! আনিসুল হক খুব ভালো প্রার্থী। হাসি হাসি মুখে টেলিভিশনে খুব ভালো অনুষ্ঠান করতেন। কিন্তু সাঈদ খোকনের ব্যাপারে আমার রিজার্ভেশন আছে।
মানে?
সাঈদ খোকন এক-এগারোর সময় আওয়ামী লীগ ত্যাগ করে কিংস পার্টির নেতা হয়েছিলেন। হানিফ সাহেবের ছেলের সেই পদঙ্খলন-
চোপ্‌! একেবারে চোপ্‌!! এ বিষয়ে আর একটি কথাও বলবে না। চাচা ধমকের সুরে বললেন, নেত্রী যদি এক এগারোতে সাঈদ খোকনের ভূমিকার কথা জেনে তাকেই মেয়র হিসাবে চান, তাহলে এ বিষয়ে কথা বলার তুমি কে?

No comments

Powered by Blogger.