গণমাধ্যমের ওপর অশুভ ছায়া by সৈয়দ আবদাল আহমদ
অশুভ
কালো ছায়ার কবলে আবারো বাংলাদেশের গণমাধ্যম। স্বাধীনভাবে গণমাধ্যম আর কাজ
করতে পারছে না। গণমাধ্যমের হাত-পা বেঁধে ফেলা হচ্ছে। কখনো ভীতি প্রদর্শন,
অলিখিত প্রেস অ্যাডভাইস, আবার কখনো সেন্সরশিপ। খবর নিয়ন্ত্রণের নিত্যনতুন
কৌশল প্রয়োগ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণ ও সাংবাদিকদের পেশাগত দায়িত্ব
পালন বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। এসব কৌশল করেও যখন কোনো কোনো গণমাধ্যমকে বাগে
আনা যাচ্ছে না, তখন একটা অজুহাত দাঁড় করিয়ে সেটা বন্ধ করেও দেয়া হচ্ছে।
এমন এক পরিস্থিতিতে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকেরাও শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকতে পারলেন না, সোচ্চার হলেন। সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস কাউন্সিল গণমাধ্যমের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরে বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে সম্পাদকেরা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি যে, সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র ও জাতীয় প্রচারমাধ্যমের পক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’ এর আগে সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা সভা-সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সামান্য কর্ণপাতও করা হয়নি।
এডিটরস কাউন্সিলের বৈঠকে গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের স্বাক্ষরে ওই বিবৃতি দেয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এক দিকে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। অন্য দিকে সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার মাধ্যমের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। সরকার ও প্রশাসন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনায় বাধা সৃষ্টি করছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সংসদে সম্পাদক ও প্রকাশকদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে, যা তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। ইতোমধ্যে একাধিক সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। কোনো কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশনকে অন্যায়ভাবে বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর মুখপাত্র হিসেবে তকমা দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি ডেইলি স্টার পত্রিকায় একটি ছবি ও ক্যাপশন ছাপানোকে কেন্দ্র করে সংসদে দেয়া প্রতিক্রিয়া প্রচারমাধ্যমের প্রতি বৈরী মনোভাবেরই প্রকাশ, যা কোনো সরকারের কাছে কাম্য নয়। একইভাবে ইংরেজি দৈনিক নিউএজ পত্রিকার অফিসে তল্লাশির নামে পুলিশি হয়রানির মতো ঘটনাও ঘটানো হয়েছে। একাধিক টিভি মালিককে গ্রেফতার করে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। টিভি টকশোতে নানাভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। কিছু টকশো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। টকশোর অতিথি তালিকা নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার নিয়ে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। কী প্রচার হবে আর হবে না, তা নিয়ে টেলিফোন নির্দেশনা মতপ্রকাশের ওপর হস্তক্ষেপ। সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও দলীয় কার্যক্রমের খবর সংগ্রহের সুযোগ কোনো কোনো সাংবাদিককে দেয়া হচ্ছে না।’
সম্পাদকদের এই বিবৃতি সময়োপযোগী এবং তাদের উদ্বেগ যথার্থ। বরং নিরপেক্ষভাবে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখলে যে কেউই বলবেন, সম্পাদকেরা তাদের বিবৃতিতে প্রকৃত অবস্থার চেয়ে কমই উল্লেখ করেছেন। গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপের এ অভিযোগ এখন শুধু দেশের সাংবাদিকেরাই করছেন না। নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এ অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও এ বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোতেও এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। স্বয়ং জাতিসঙ্ঘ, লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এবং যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক নিউ ইয়র্কে সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অধিকার সমর্থন করে জাতিসঙ্ঘ।’ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের বার্ষিক রিপোর্টে বলেছে, ‘বাংলাদেশে অব্যাহত মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।’ অনেক সাংবাদিক ও টকশোতে অংশগ্রহণকারী বলেছেন, হুমকির কারণে তারা কথা বলার সময় ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ করতে বাধ্য হচ্ছেন। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বাংলাদেশের গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপের বিষয়ে উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে। বিশেষ করে ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে সংসদে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগকে সংগঠনটি গণমাধ্যমে তথ্য জানানোর অধিকারের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে। পাশাপাশি ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিতেও আহ্বান জানিয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের মানবাধিকার সাব কমিটির শুনানিতে বলা হয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা প্রয়োজন, কেননা দেশটিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সন্তোষজনক নয়। একই দিন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাইর ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মৌলিক স্বাধীনতা থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য সরকারের কর্ণকুহরে এসব ঢুকছে না। উল্টো তথ্য মন্ত্রণালয় অনেকটা নির্লজ্জের মতো বিবৃতি দিয়ে বলছে, দেশে গণমাধ্যম নাকি স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে।
মিডিয়ায় হস্তক্ষেপের কিছু নমুনা
গণমাধ্যমের ওপর চড়াও হওয়ার একেবারে তরতাজা উদাহরণ হচ্ছে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীরের একটি পোস্টারের ছবি ছাপানোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, পজিটিভ অথবা নেগেটিভÑযেভাবেই ডেইলি স্টার লিখুক না কেন এটা বিশাল আকারে ছাপানো হিজবুত তাহরীরকে মদদ দেয়ার শামিল। এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়Ñ ‘প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় অফিসিয়াল ফেসবুকে স্টেটাস দিয়ে বলেছেন, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং আইনজীবী ড. কামাল হোসেনকে গ্রেফতার করা উচিত। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় একজন আইনজীবী ডেইলি স্টার সম্পাদক, প্রধান বার্তা সম্পাদক ও প্রধান আলোকচিত্রীকে আসামি করে একটি মামলাও করেছেন। ২২ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম বলেন, গণমাধ্যম সন্ত্রাসী বোমাবাজদের উসকানি দিচ্ছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়। যারা এসব করছে তাদের সহযোগী হিসেবে বিচার করা হবে। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট পরিদর্শনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী টিভি চ্যানেলগুলোকে একধরনের হুমকিই দেন। তিনি টিভি চ্যানেলগুলোতে খালেদা জিয়া এবং বিএনপি-জামায়াতের খবর প্রচারের সমালোচনা করে বলেন, জল্লাদের খবর প্রচার না করলে কি টেলিভিশন চলবে না? এসব চ্যানেলের অনুমোদন কিন্তু আমরাই দিয়েছি। এর আগে সংসদে টকশোর আলোচকদের বিরুদ্ধেও প্রধানমন্ত্রী বিষোদগার করেন। তিনি বলেন, টকশোর বক্তব্য পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। টকশোর আলোচকদের ‘নিশি কুটুম্ব’ বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাংবাদিক মরহুম এবিএম মূসাও সমালোচনা থেকে রেহাই পাননি।
সংসদের বাইরে সরকারের মন্ত্রী ও শাসকদলের নেতারা অহরহ টকশোর আলোচকদের গালমন্দ করছেন। অদৃশ্য ফোনের হুমকিতে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাভিশনের জনপ্রিয় টকশো ‘ফ্রন্টলাইন’। মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঞ্চালনায় পাঁচ বছর ধরে এ টকশো চলছিল। একুশে টিভিতে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বক্তব্য প্রচার করার অপরাধে টিভি চ্যানেলটির ওপর ভয়াবহ খড়গ নেমে আসে। একুশে টিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে গ্রেফতার করে দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে। টিভি চ্যানেলটিকে কাজই করতে দেয়া হচ্ছে না। তাদের লাইভ সম্প্রচারসহ স্বাভাবিক সম্প্রচার বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে তথ্যমন্ত্রীর চাপ ও ইঙ্গিতে ক্যাবল অপারেটররা একুশে টিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলে সম্প্রচার বাধাগ্রস্ত করতে বাধ্য হচ্ছেন। একুশে টিভির সাংবাদিকেরা এ নিয়ে রিট করলে হাইকোর্ট কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই ইটিভির অনুষ্ঠান সম্প্রচারে হঠাৎ বাধা দেয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে সরকারকে রুল জারি করেছে।
টিভি চ্যানেলগুলোতে অদৃশ্য ফোনের দৌরাত্ম্য এতই ব্যাপক যে, অনেক ক্ষেত্রে ঝামেলা ও ঝুঁকি এড়াতে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই সেলফ সেন্সরশিপের আশ্রয় নিচ্ছেন। টকশো শুরুর আগে উপস্থাপক শব্দ চয়ন এবং বিষয়ের ব্যাপারে আলোচকদের সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ করে থাকেন। কারণ পান থেকে চুন খসলেই বিটিআরসি ফ্রিকোয়েন্সি বন্ধ কিংবা নানা ধরনের কারিগরি জটিলতার মাধ্যমে সম্প্রচারে জ্যাম করে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব, ভাইবার বন্ধ করে দেয়ার বেশ কিছু আলামতের কথা নাগরিকদের অজানা নয়।
২০ দলীয় জোটের চলমান আন্দোলনকে সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসেবে একতরফা প্রচারের জন্য গণমাধ্যমের ওপর চাপ সৃষ্টির নজির কিছু দিন আগে লক্ষ করা গেছে। তথ্যমন্ত্রীসহ সিনিয়র মন্ত্রীরা দুই দফায় গণমাধ্যমের সম্পাদক ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠকে ডেকে সরকারের ওই মনোভাবের কথা জানিয়ে দেন। সিনিয়র সাংবাদিকেরা সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানালেও তাতে গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
মেধাবী সাংবাদিক শওকত মাহমুদ সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ ফোরাম বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বিএফইউজের সভাপতি। তিনি জাতীয় প্রেস কাবের চারবারের সাধারণ সম্পাদক ও দুইবারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার প্রতিবাদসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের রুটি-রুজির আন্দোলন এবং মিডিয়া আক্রান্ত হওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। টিভি টকশোগুলোতে যুক্তির মাধ্যমে তিনি জোরালো বিশ্লেষণ রেখে এসেছেন। তাকে নিবৃত্ত করার কৌশল হিসেবে তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে ছয়টি উদ্দেশ্যমূলক মামলা। একইভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলীকে। এনটিভির মতো একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলকে নিয়ন্ত্রণই এর লক্ষ্য। নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবির বরাবরই টকশোতে সাহসী বক্তব্য রেখে এসেছেন। তাকে টেলিফোনে হুমকি দেয়াই শুধু নয়, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসির নেতৃত্বে পুলিশের ২০-২৫ জনের একটি দল গত ডিসেম্বরে নিউএজ কার্যালয়ে তল্লাশি চালায়। ভীতসন্ত্রস্ত করার হীন লক্ষ্যই এখানে কাজ করেছে। ইনকিলাব পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করে পত্রিকার বার্তা সম্পাদককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি জাস্টনিউজ বিডি ডটকম সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। অনলাইন পত্রিকাটির অপরাধ ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দফতর ও নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্রের ব্রিফিংয়ে কেন ওই অনলাইনের সম্পাদক মুশফিকুল ফজল আনসারী প্রশ্ন করেছেন। ঢাকার বাইরে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকেরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের প্রচণ্ড হুমকি ও চাপের মধ্যে কাজ করছেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি একাত্তর টিভির টকশোতে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তার পত্রিকার সাংবাদিকদের এমন চাপের মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
গত আগস্ট মাসে সরকার বেসরকারি বেতার-টিভির জন্য সম্প্রচার নীতিমালা ঘোষণা করে। এ নীতিমালাটি বেসরকারি বেতার-টিভির হাত-পা বেঁধে দেয়ারই অপপ্রয়াস। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এবং এডিটরস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এ নীতিমালা অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানালেও এটি বহাল আছে। নীতিমালায় এমন কিছু ধারার উল্লেখ রয়েছে, যা গণমাধ্যমের জন্য ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করবে। যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না, বিচারিক ক্ষমতা আছে এমন সরকারি কর্মকর্তা ডিসির বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। টকশোতে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করা যাবে না, বিজ্ঞাপন প্রচারে শর্তারোপ ইত্যাদি।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর গণমাধ্যম নতুন করে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। অতীতের আওয়ামী লীগ আমলের মতোই হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়ে ভিন্নমতের গণমাধ্যম। এ যেন এক জন্ম-আক্রোশ! ১৯৭৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে শত শত সাংবাদিক-কর্মচারীকে বেকারত্বের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছিল। ১৯৯৬ সালে তার কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে দৈনিক বাংলা, টাইমস, বিচিত্রা, আনন্দ বিচিত্রা বন্ধ করে দিয়ে এক হাজার সাংবাদিক-কর্মচারীকে কর্মচ্যুত করেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের সরকার এবং ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তার মিডিয়া দলন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী শেখ হাসিনা সরকারের পাঁচ বছর ও বর্তমান বিতর্কিত শাসনকালে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিসহ ২৪ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন পাঁচ হাজারের বেশি সাংবাদিক। সাগর-রুনি হত্যার তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখনো জানা যায়নি হত্যাকারী কারা এবং হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কী ছিল? তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীকে গ্রেফতারের কথা বলেছিলেন। তৎকালীন আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য’ অগ্রগতি হয়েছে। এরপর ডিবি পুলিশ হাইকোর্টে গিয়ে জানায় হত্যা রহস্য উন্মোচনে তারা ব্যর্থ। র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেন হাইকোর্ট। তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ৩২ বার সময় নিয়েছে। সাগর-রুনি হত্যা তদন্তের অগ্রগতি এতটুকুই। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল কারো বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়।
মিডিয়া দলনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ সরকার দুইবার বন্ধ করেছে, রহস্যজনক আগুনে পুড়েছে পত্রিকা কার্যালয়। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার নামে আকস্মিকভাবে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের সম্প্রচার। প্রায় দু’বছর পেরিয়ে গেলেও আজো সেই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়নি। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে মফস্বলের দুই শতাধিক আঞ্চলিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয় সরকার। এর ফলে বেকার সাংবাদিক-কর্মচারীর মিছিল বাড়ছেই। এ সরকার আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দু’বার জেলে ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে। তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে ৬৮টি মামলা। বিনাবিচারে তিনি জেল খেটেই যাচ্ছেন। সরকার তো নয়ই, সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টেও আমার দেশ খুলে দেয়াসংক্রান্ত রিটটির শুনানি হচ্ছে না। সরকার জেলে নিয়েছে প্রবীণ সাংবাদিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকেও।
দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান ও আমার দেশ-এর বেকার সাংবাদিকেরা তাদের মিডিয়া খুলে দেয়ার জন্য সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এসব দাবি আমলেই নেয়নি সরকার। অতীতের স্বৈরশাসক, একনায়ক এবং সামরিক শাসকদের মতোই মিডিয়া দলন চলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের রেকর্ডও ম্লান হয়ে গেছে। বর্তমানে আবার একাত্তর টিভির মতো সরকারের স্বার্থ রক্ষাকারী কিছু মিডিয়া দাঁড়িয়ে গেছে, যেগুলো মিডিয়া দলনে সরকারকে উৎসাহিত করছে। এরা নিজেরা খবর গায়েব করে দিচ্ছে এবং অন্যদেরও তা করতে বাধ্য করছে।
কণ্ঠরোধের অতীত ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতা
স্বাধীন গণমাধ্যম সব দেশে সব কালেই স্বৈরশাসক, সামরিক শাসক, অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসক এবং একনায়কের জন্য ত্রাস। তাই তারা ক্ষমতা দখল কিংবা ক্ষমতা আঁখড়ে রাখার জন্য গণমাধ্যমের ওপর খড়গহস্ত হয়। গণমাধ্যমকে বেড়ি পরিয়ে তারা জনগণের আশা আকাক্সাকে শৃঙ্খলিত করে। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে মানুষ বারবার স্বৈরশাসনের কবলে পড়েছে। ওই সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সাংবিধানিক গ্যারান্টির অনুপস্থিতিতে বাক-ব্যক্তি, সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার বিভিন্ন আলামত জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ আশান্বিত হয়। কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ সেই আশা-আকাক্সক্ষাকে ধূলিসাৎ করে দেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন গণতন্ত্রীর হাতে এই আইনটি রচিত হয়েছে, যা ভবিষ্যৎ স্বৈরশাসকদের জন্য একটি স্বৈরাচারের সনদ রচনার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে জারি করা হয় বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৩ সালে জারি হয় প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট। ১৯৭৫ সালে দেশে প্রবর্তন করা হয় একদলীয় শাসন। একই বছর ১৬ জুন মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে সব সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। রাতারাতি শত শত সাংবাদিক-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হন। সাংবাদিকেরা এখনো ১৬ জুন কালো দিবস পালন করেন। সে দিন বেকার হয়ে অনেক সাংবাদিক ফলের দোকান, মুদির দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ অবস্থা থেকে জাতি কিছু দিনের জন্য মুক্তি পেলেও ১৯৮২ সালে আবারো জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন চেপে বসে এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। গণমাধ্যমের জন্য ওই সময়টি ছিল একটি অন্ধকার যুগ। কঠোর প্রেস সেন্সরশিপ আরোপ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ হরণ করা হয়। তবে এরশাদ সাহেব খবর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে প্রেস সেন্সরশিপ নয়, প্রেস অ্যাডভাইস নাম দিয়েছিলেন। এটি ছিল আগেকার প্রেস সেন্সরশিপের চেয়ে অনেক ভয়াবহ। সংবাদপত্র অফিসে সন্ধ্যার পর পিআইডি থেকে ফোন আসত। প্রতিটি সংবাদপত্র অফিসে এই প্রেস অ্যাডভাইসের একটি করে খাতা ‘মেইনটেন’ করা হতো। পিআইডির ফোন এলেই ওই খাতায় লেখা হতো এবং সে অনুযায়ী সংবাদপত্রে খবর ছাপা হতো। জেনারেল এরশাদের শাসনামলে যেসব দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে, তাকে জড়িয়ে যেসব নারীঘটিত স্ক্যান্ডাল হয়েছে এবং যে অনিয়ম, হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক নোংরামি এবং আন্দোলনের খবর কিছুই পত্রিকায় ছাপা যেত না। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রে কোনো বাধা ছাড়াই স্বাধীনভাবে খবর প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে গণমাধ্যম একপ্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে। এরশাদ আমলের মতো পিআইডি থেকে এখন সংবাদপত্র অফিস কিংবা টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়ায় ফোন আসে না, আসে না প্রেস অ্যাডভাইস। কিন্তু অদৃশ্য জায়গা থেকে ঠিকই আসছে ফোন এবং অলিখিত প্রেস অ্যাডভাইস। এগুলো খাতায়ও লেখা যাচ্ছে না। যারা ফোন বা প্রেস অ্যাডভাইস দিচ্ছেন তাদের পরিচিতি জানা থাকলেও প্রকাশ করা যাচ্ছে না। একইভাবে প্রযুক্তির কল্যাণে খবর নিয়ন্ত্রণের এমন সব কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে, যার কারণে সরকারের বিপক্ষে যায় এমন অনেক খবর আলোর মুখ দেখছে না। এককথায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের বর্তমান কৌশল অতীতের সব কৌশলকে হার মানিয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মাধ্যমেই শুধু এ অবস্থার অবসান ঘটানো সম্ভব।
লেখক : জাতীয় প্রেস কাবের সাধারণ সম্পাদক
এমন এক পরিস্থিতিতে জাতীয় দৈনিকের সম্পাদকেরাও শেষ পর্যন্ত চুপ করে থাকতে পারলেন না, সোচ্চার হলেন। সম্পাদকদের সংগঠন এডিটরস কাউন্সিল গণমাধ্যমের সর্বশেষ অবস্থা তুলে ধরে বিবৃতি দিয়েছে। বিবৃতিতে সম্পাদকেরা স্পষ্ট করে বলেছেন, ‘আমরা গভীর উদ্বেগের সাথে লক্ষ করছি যে, সাম্প্রতিক সময়ে সংবাদপত্র ও জাতীয় প্রচারমাধ্যমের পক্ষে স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে কাজ করা কঠিন হয়ে পড়েছে।’ এর আগে সাংবাদিক ইউনিয়নের নেতারা সভা-সমাবেশ ও সংবাদ সম্মেলন করে গণমাধ্যমের কণ্ঠরোধের কথা বারবার উচ্চারণ করেছেন। কিন্তু এ বিষয়ে সামান্য কর্ণপাতও করা হয়নি।
এডিটরস কাউন্সিলের বৈঠকে গণমাধ্যমের বর্তমান পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক দ্য ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনামের স্বাক্ষরে ওই বিবৃতি দেয়া হয়। বিবৃতিতে বলা হয়, ‘এক দিকে রাজনৈতিক কর্মসূচির নামে দায়িত্বরত সাংবাদিকদের ওপর হামলা ও সহিংসতার ঘটনা ঘটছে। অন্য দিকে সংবাদপত্র ও প্রচারমাধ্যমের স্বাধীনতা খর্ব করার চেষ্টা চলছে। সরকারের পক্ষ থেকে প্রচার মাধ্যমের অধিকারে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। সরকার ও প্রশাসন স্বাধীন ও নিরপেক্ষ সংবাদ সংগ্রহ ও পরিবেশনায় বাধা সৃষ্টি করছে।’
সাম্প্রতিক সময়ে গণমাধ্যমের ওপর হস্তক্ষেপের বিভিন্ন ঘটনার উল্লেখ করে বিবৃতিতে বলা হয়, ‘সংসদে সম্পাদক ও প্রকাশকদের বিরুদ্ধে উসকানিমূলক বক্তব্য দেয়া হয়েছে, যা তাদের নিরাপত্তার ক্ষেত্রে হুমকিস্বরূপ। ইতোমধ্যে একাধিক সম্পাদক ও প্রকাশকের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দিয়ে তাদের হয়রানি করা হচ্ছে। কোনো কোনো পত্রিকা বা টেলিভিশনকে অন্যায়ভাবে বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর মুখপাত্র হিসেবে তকমা দেয়া হচ্ছে। সম্প্রতি ডেইলি স্টার পত্রিকায় একটি ছবি ও ক্যাপশন ছাপানোকে কেন্দ্র করে সংসদে দেয়া প্রতিক্রিয়া প্রচারমাধ্যমের প্রতি বৈরী মনোভাবেরই প্রকাশ, যা কোনো সরকারের কাছে কাম্য নয়। একইভাবে ইংরেজি দৈনিক নিউএজ পত্রিকার অফিসে তল্লাশির নামে পুলিশি হয়রানির মতো ঘটনাও ঘটানো হয়েছে। একাধিক টিভি মালিককে গ্রেফতার করে ভীতিকর পরিবেশ সৃষ্টি করা হয়েছে। টিভি টকশোতে নানাভাবে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। কিছু টকশো বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। টকশোর অতিথি তালিকা নির্দিষ্ট করে দেয়া হচ্ছে। লাইভ অনুষ্ঠান প্রচার নিয়ে হস্তক্ষেপ করা হচ্ছে। কী প্রচার হবে আর হবে না, তা নিয়ে টেলিফোন নির্দেশনা মতপ্রকাশের ওপর হস্তক্ষেপ। সরকারি বিভিন্ন অনুষ্ঠান ও দলীয় কার্যক্রমের খবর সংগ্রহের সুযোগ কোনো কোনো সাংবাদিককে দেয়া হচ্ছে না।’
সম্পাদকদের এই বিবৃতি সময়োপযোগী এবং তাদের উদ্বেগ যথার্থ। বরং নিরপেক্ষভাবে পরিস্থিতি খতিয়ে দেখলে যে কেউই বলবেন, সম্পাদকেরা তাদের বিবৃতিতে প্রকৃত অবস্থার চেয়ে কমই উল্লেখ করেছেন। গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপের এ অভিযোগ এখন শুধু দেশের সাংবাদিকেরাই করছেন না। নাগরিক সমাজ, পেশাজীবী, রাজনৈতিক দলের পক্ষ থেকেও এ অভিযোগ উঠেছে। শুধু তাই নয়, আন্তর্জাতিক মহলেও এ বিষয়টি আলোচিত হচ্ছে। বিশ্বের প্রভাবশালী গণমাধ্যমগুলোতেও এ নিয়ে প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছে। স্বয়ং জাতিসঙ্ঘ, লন্ডনভিত্তিক আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল, সাংবাদিকদের আন্তর্জাতিক সংগঠন রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস, ইউরোপিয়ান পার্লামেন্ট এবং যুক্তরাষ্ট্র পররাষ্ট্র দফতর বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ জানিয়েছে। জাতিসঙ্ঘ মহাসচিব বান কি মুনের মুখপাত্র স্টিফেন ডুজাররিক নিউ ইয়র্কে সংবাদ ব্রিফিংয়ে স্পষ্টভাবে বলেছেন, ‘বাংলাদেশে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও সংবাদপত্রের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখার অধিকার সমর্থন করে জাতিসঙ্ঘ।’ অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল তাদের বার্ষিক রিপোর্টে বলেছে, ‘বাংলাদেশে অব্যাহত মামলা ও হয়রানির শিকার হচ্ছেন সাংবাদিক ও মানবাধিকার কর্মীরা।’ অনেক সাংবাদিক ও টকশোতে অংশগ্রহণকারী বলেছেন, হুমকির কারণে তারা কথা বলার সময় ‘সেলফ সেন্সরশিপ’ করতে বাধ্য হচ্ছেন। রিপোর্টার্স উইদাউট বর্ডারস বাংলাদেশের গণমাধ্যমে হস্তক্ষেপের বিষয়ে উদ্বেগ ও নিন্দা জানিয়েছে। বিশেষ করে ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে সংসদে দেয়া প্রধানমন্ত্রীর অভিযোগকে সংগঠনটি গণমাধ্যমে তথ্য জানানোর অধিকারের লঙ্ঘন বলে মন্তব্য করেছে। পাশাপাশি ডেইলি স্টারের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিতেও আহ্বান জানিয়েছে। ২৬ ফেব্রুয়ারি ইউরোপিয়ান পার্লামেন্টের মানবাধিকার সাব কমিটির শুনানিতে বলা হয়, বাংলাদেশের গণমাধ্যম পরিস্থিতির ওপর নজর রাখা প্রয়োজন, কেননা দেশটিতে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সন্তোষজনক নয়। একই দিন দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী নিশা দেসাইর ব্রিফিংয়ে বাংলাদেশের গণমাধ্যমের মৌলিক স্বাধীনতা থাকার প্রয়োজনীয়তা রয়েছে উল্লেখ করে বলা হয়, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা নিশ্চিত করতে হবে। অবশ্য সরকারের কর্ণকুহরে এসব ঢুকছে না। উল্টো তথ্য মন্ত্রণালয় অনেকটা নির্লজ্জের মতো বিবৃতি দিয়ে বলছে, দেশে গণমাধ্যম নাকি স্মরণকালের সবচেয়ে বেশি স্বাধীনতা ভোগ করছে।
মিডিয়ায় হস্তক্ষেপের কিছু নমুনা
গণমাধ্যমের ওপর চড়াও হওয়ার একেবারে তরতাজা উদাহরণ হচ্ছে গত ১৮ ফেব্রুয়ারি সংসদে প্রশ্নোত্তরে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার একটি বক্তব্য। সংসদে দাঁড়িয়ে তিনি ডেইলি স্টারে প্রকাশিত নিষিদ্ধ সংগঠন হিজবুত তাহরীরের একটি পোস্টারের ছবি ছাপানোর প্রসঙ্গ উল্লেখ করে বলেন, পজিটিভ অথবা নেগেটিভÑযেভাবেই ডেইলি স্টার লিখুক না কেন এটা বিশাল আকারে ছাপানো হিজবুত তাহরীরকে মদদ দেয়ার শামিল। এর বিরুদ্ধে যথাযথ ব্যবস্থা নেয়া হবে। ২৭ ফেব্রুয়ারি প্রথম আলো পত্রিকার প্রথম পাতায় প্রকাশিত একটি খবরে বলা হয়Ñ ‘প্রধানমন্ত্রী পুত্র সজীব ওয়াজেদ জয় অফিসিয়াল ফেসবুকে স্টেটাস দিয়ে বলেছেন, ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম এবং আইনজীবী ড. কামাল হোসেনকে গ্রেফতার করা উচিত। ইতোমধ্যে আওয়ামী লীগ দলীয় একজন আইনজীবী ডেইলি স্টার সম্পাদক, প্রধান বার্তা সম্পাদক ও প্রধান আলোকচিত্রীকে আসামি করে একটি মামলাও করেছেন। ২২ ফেব্রুয়ারি কৃষিবিদ ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রীর উপস্থিতিতে আওয়ামী লীগ প্রেসিডিয়াম সদস্য শেখ সেলিম বলেন, গণমাধ্যম সন্ত্রাসী বোমাবাজদের উসকানি দিচ্ছে। সংবাদপত্রের স্বাধীনতা মানে যা খুশি তা করা নয়। যারা এসব করছে তাদের সহযোগী হিসেবে বিচার করা হবে। ঢাকা মেডিক্যালের বার্ন ইউনিট পরিদর্শনে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী টিভি চ্যানেলগুলোকে একধরনের হুমকিই দেন। তিনি টিভি চ্যানেলগুলোতে খালেদা জিয়া এবং বিএনপি-জামায়াতের খবর প্রচারের সমালোচনা করে বলেন, জল্লাদের খবর প্রচার না করলে কি টেলিভিশন চলবে না? এসব চ্যানেলের অনুমোদন কিন্তু আমরাই দিয়েছি। এর আগে সংসদে টকশোর আলোচকদের বিরুদ্ধেও প্রধানমন্ত্রী বিষোদগার করেন। তিনি বলেন, টকশোর বক্তব্য পরীক্ষা করে ব্যবস্থা নেয়া হবে। টকশোর আলোচকদের ‘নিশি কুটুম্ব’ বলেও প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন। সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাংবাদিক মরহুম এবিএম মূসাও সমালোচনা থেকে রেহাই পাননি।
সংসদের বাইরে সরকারের মন্ত্রী ও শাসকদলের নেতারা অহরহ টকশোর আলোচকদের গালমন্দ করছেন। অদৃশ্য ফোনের হুমকিতে বন্ধ হয়ে গেছে বাংলাভিশনের জনপ্রিয় টকশো ‘ফ্রন্টলাইন’। মানবজমিন সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঞ্চালনায় পাঁচ বছর ধরে এ টকশো চলছিল। একুশে টিভিতে বিএনপির সিনিয়র ভাইস চেয়ারম্যান তারেক রহমানের একটি বক্তব্য প্রচার করার অপরাধে টিভি চ্যানেলটির ওপর ভয়াবহ খড়গ নেমে আসে। একুশে টিভির চেয়ারম্যান আবদুস সালামকে গ্রেফতার করে দফায় দফায় রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। তার বিরুদ্ধে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনে মামলা হয়েছে। টিভি চ্যানেলটিকে কাজই করতে দেয়া হচ্ছে না। তাদের লাইভ সম্প্রচারসহ স্বাভাবিক সম্প্রচার বাধাগ্রস্ত করা হচ্ছে। অভিযোগ রয়েছে তথ্যমন্ত্রীর চাপ ও ইঙ্গিতে ক্যাবল অপারেটররা একুশে টিভিসহ বিভিন্ন চ্যানেলে সম্প্রচার বাধাগ্রস্ত করতে বাধ্য হচ্ছেন। একুশে টিভির সাংবাদিকেরা এ নিয়ে রিট করলে হাইকোর্ট কোনো ধরনের নোটিশ ছাড়াই ইটিভির অনুষ্ঠান সম্প্রচারে হঠাৎ বাধা দেয়া কেন আইনগত কর্তৃত্ব বহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না জানতে চেয়ে সরকারকে রুল জারি করেছে।
টিভি চ্যানেলগুলোতে অদৃশ্য ফোনের দৌরাত্ম্য এতই ব্যাপক যে, অনেক ক্ষেত্রে ঝামেলা ও ঝুঁকি এড়াতে চ্যানেল কর্তৃপক্ষ নিজেরাই সেলফ সেন্সরশিপের আশ্রয় নিচ্ছেন। টকশো শুরুর আগে উপস্থাপক শব্দ চয়ন এবং বিষয়ের ব্যাপারে আলোচকদের সতর্কতা অবলম্বনের অনুরোধ করে থাকেন। কারণ পান থেকে চুন খসলেই বিটিআরসি ফ্রিকোয়েন্সি বন্ধ কিংবা নানা ধরনের কারিগরি জটিলতার মাধ্যমে সম্প্রচারে জ্যাম করে দিচ্ছে। সাম্প্রতিক সময়ে সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ইন্টারনেট, ফেসবুক, ইউটিউব, ভাইবার বন্ধ করে দেয়ার বেশ কিছু আলামতের কথা নাগরিকদের অজানা নয়।
২০ দলীয় জোটের চলমান আন্দোলনকে সন্ত্রাসী আন্দোলন হিসেবে একতরফা প্রচারের জন্য গণমাধ্যমের ওপর চাপ সৃষ্টির নজির কিছু দিন আগে লক্ষ করা গেছে। তথ্যমন্ত্রীসহ সিনিয়র মন্ত্রীরা দুই দফায় গণমাধ্যমের সম্পাদক ও শীর্ষ কর্মকর্তাদের বৈঠকে ডেকে সরকারের ওই মনোভাবের কথা জানিয়ে দেন। সিনিয়র সাংবাদিকেরা সংলাপের মাধ্যমে সমস্যা সমাধানের অনুরোধ জানালেও তাতে গুরুত্ব দেয়া হয়নি।
মেধাবী সাংবাদিক শওকত মাহমুদ সাংবাদিকদের সর্বোচ্চ ফোরাম বাংলাদেশ ফেডারেল সাংবাদিক ইউনিয়ন বিএফইউজের সভাপতি। তিনি জাতীয় প্রেস কাবের চারবারের সাধারণ সম্পাদক ও দুইবারের নির্বাচিত সভাপতি ছিলেন। সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার প্রতিবাদসহ গণমাধ্যমের স্বাধীনতা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, সাংবাদিকদের রুটি-রুজির আন্দোলন এবং মিডিয়া আক্রান্ত হওয়ার বিরুদ্ধে সোচ্চার ছিলেন। টিভি টকশোগুলোতে যুক্তির মাধ্যমে তিনি জোরালো বিশ্লেষণ রেখে এসেছেন। তাকে নিবৃত্ত করার কৌশল হিসেবে তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে ছয়টি উদ্দেশ্যমূলক মামলা। একইভাবে গ্রেফতার করা হয়েছে এনটিভির চেয়ারম্যান মোসাদ্দেক আলীকে। এনটিভির মতো একটি জনপ্রিয় টিভি চ্যানেলকে নিয়ন্ত্রণই এর লক্ষ্য। নিউএজ সম্পাদক নুরুল কবির বরাবরই টকশোতে সাহসী বক্তব্য রেখে এসেছেন। তাকে টেলিফোনে হুমকি দেয়াই শুধু নয়, তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানার ওসির নেতৃত্বে পুলিশের ২০-২৫ জনের একটি দল গত ডিসেম্বরে নিউএজ কার্যালয়ে তল্লাশি চালায়। ভীতসন্ত্রস্ত করার হীন লক্ষ্যই এখানে কাজ করেছে। ইনকিলাব পত্রিকায় প্রকাশিত একটি রিপোর্টকে কেন্দ্র করে পত্রিকার বার্তা সম্পাদককে গ্রেফতার ও রিমান্ডে নেয়া হয়েছে। ২৭ ফেব্রুয়ারি জাস্টনিউজ বিডি ডটকম সরকার বন্ধ করে দিয়েছে। অনলাইন পত্রিকাটির অপরাধ ওয়াশিংটনে পররাষ্ট্র দফতর ও নিউ ইয়র্কে জাতিসঙ্ঘ মহাসচিবের মুখপাত্রের ব্রিফিংয়ে কেন ওই অনলাইনের সম্পাদক মুশফিকুল ফজল আনসারী প্রশ্ন করেছেন। ঢাকার বাইরে প্রিন্ট ও ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাংবাদিকেরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ও প্রশাসনের প্রচণ্ড হুমকি ও চাপের মধ্যে কাজ করছেন। ২৬ ফেব্রুয়ারি একাত্তর টিভির টকশোতে ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম তার পত্রিকার সাংবাদিকদের এমন চাপের মুখোমুখি হওয়ার কথা উল্লেখ করেন।
গত আগস্ট মাসে সরকার বেসরকারি বেতার-টিভির জন্য সম্প্রচার নীতিমালা ঘোষণা করে। এ নীতিমালাটি বেসরকারি বেতার-টিভির হাত-পা বেঁধে দেয়ারই অপপ্রয়াস। সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন এবং এডিটরস কাউন্সিলের পক্ষ থেকে এ নীতিমালা অবিলম্বে বাতিলের দাবি জানালেও এটি বহাল আছে। নীতিমালায় এমন কিছু ধারার উল্লেখ রয়েছে, যা গণমাধ্যমের জন্য ভয়ঙ্কর অবস্থার সৃষ্টি করবে। যেমন আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না, বিচারিক ক্ষমতা আছে এমন সরকারি কর্মকর্তা ডিসির বিরুদ্ধে কথা বলা যাবে না। টকশোতে স্বাধীনভাবে মতপ্রকাশ করা যাবে না, বিজ্ঞাপন প্রচারে শর্তারোপ ইত্যাদি।
২০০৯ সালে শেখ হাসিনার সরকার ক্ষমতায় আসার পর গণমাধ্যম নতুন করে চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। অতীতের আওয়ামী লীগ আমলের মতোই হাসিনা সরকারের রোষানলে পড়ে ভিন্নমতের গণমাধ্যম। এ যেন এক জন্ম-আক্রোশ! ১৯৭৫ সালে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের সরকার চারটি পত্রিকা রেখে সব পত্রিকা বন্ধ করে দিয়ে শত শত সাংবাদিক-কর্মচারীকে বেকারত্বের অন্ধকারে নিক্ষেপ করেছিল। ১৯৯৬ সালে তার কন্যা শেখ হাসিনা ক্ষমতায় এসে দৈনিক বাংলা, টাইমস, বিচিত্রা, আনন্দ বিচিত্রা বন্ধ করে দিয়ে এক হাজার সাংবাদিক-কর্মচারীকে কর্মচ্যুত করেন। ২০০৯ সালে শেখ হাসিনার দ্বিতীয় মেয়াদের সরকার এবং ৫ জানুয়ারির একতরফা নির্বাচনে ক্ষমতাসীন হওয়ার পর তার মিডিয়া দলন অতীতের সব রেকর্ড ছাড়িয়ে গেছে। সংবাদপত্রের রিপোর্ট অনুযায়ী শেখ হাসিনা সরকারের পাঁচ বছর ও বর্তমান বিতর্কিত শাসনকালে সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনিসহ ২৪ জন সাংবাদিক হত্যার শিকার হয়েছেন। নির্যাতনের শিকার হয়েছেন পাঁচ হাজারের বেশি সাংবাদিক। সাগর-রুনি হত্যার তিন বছর পূর্ণ হয়েছে। কিন্তু এখনো জানা যায়নি হত্যাকারী কারা এবং হত্যাকাণ্ডের মোটিভ কী ছিল? তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে হত্যাকারীকে গ্রেফতারের কথা বলেছিলেন। তৎকালীন আইজিপি হাসান মাহমুদ খন্দকার বলেছিলেন তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য’ অগ্রগতি হয়েছে। এরপর ডিবি পুলিশ হাইকোর্টে গিয়ে জানায় হত্যা রহস্য উন্মোচনে তারা ব্যর্থ। র্যাবকে তদন্তের দায়িত্ব দেন হাইকোর্ট। তারা তদন্ত প্রতিবেদন জমা দেয়ার জন্য ৩২ বার সময় নিয়েছে। সাগর-রুনি হত্যা তদন্তের অগ্রগতি এতটুকুই। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে প্রধানমন্ত্রীর মন্তব্য ছিল কারো বেডরুম পাহারা দেয়া সম্ভব নয়।
মিডিয়া দলনের নতুন রেকর্ড সৃষ্টি হয়েছে। এ সময়ে চ্যানেল ওয়ান বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। জনপ্রিয় পত্রিকা দৈনিক আমার দেশ সরকার দুইবার বন্ধ করেছে, রহস্যজনক আগুনে পুড়েছে পত্রিকা কার্যালয়। অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞার নামে আকস্মিকভাবে রুদ্ধ করে দেয়া হয়েছে দিগন্ত ও ইসলামিক টেলিভিশনের সম্প্রচার। প্রায় দু’বছর পেরিয়ে গেলেও আজো সেই অস্থায়ী নিষেধাজ্ঞা তুলে নেয়া হয়নি। এ ছাড়া ঢাকার বাইরে মফস্বলের দুই শতাধিক আঞ্চলিক পত্রিকা বন্ধ করে দেয় সরকার। এর ফলে বেকার সাংবাদিক-কর্মচারীর মিছিল বাড়ছেই। এ সরকার আমার দেশ সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে দু’বার জেলে ও রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করেছে। তার বিরুদ্ধে দেয়া হয়েছে ৬৮টি মামলা। বিনাবিচারে তিনি জেল খেটেই যাচ্ছেন। সরকার তো নয়ই, সর্বোচ্চ আদালত হাইকোর্টেও আমার দেশ খুলে দেয়াসংক্রান্ত রিটটির শুনানি হচ্ছে না। সরকার জেলে নিয়েছে প্রবীণ সাংবাদিক সংগ্রাম সম্পাদক আবুল আসাদকেও।
দিগন্ত টেলিভিশন, ইসলামিক টেলিভিশন, চ্যানেল ওয়ান ও আমার দেশ-এর বেকার সাংবাদিকেরা তাদের মিডিয়া খুলে দেয়ার জন্য সভা-সমাবেশ, সংবাদ সম্মেলন করে সরকারের দৃষ্টি আকর্ষণের চেষ্টা করেছে। কিন্তু এসব দাবি আমলেই নেয়নি সরকার। অতীতের স্বৈরশাসক, একনায়ক এবং সামরিক শাসকদের মতোই মিডিয়া দলন চলছে। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তাদের রেকর্ডও ম্লান হয়ে গেছে। বর্তমানে আবার একাত্তর টিভির মতো সরকারের স্বার্থ রক্ষাকারী কিছু মিডিয়া দাঁড়িয়ে গেছে, যেগুলো মিডিয়া দলনে সরকারকে উৎসাহিত করছে। এরা নিজেরা খবর গায়েব করে দিচ্ছে এবং অন্যদেরও তা করতে বাধ্য করছে।
কণ্ঠরোধের অতীত ইতিহাস ও বর্তমান বাস্তবতা
স্বাধীন গণমাধ্যম সব দেশে সব কালেই স্বৈরশাসক, সামরিক শাসক, অগণতান্ত্রিক ফ্যাসিবাদী শাসক এবং একনায়কের জন্য ত্রাস। তাই তারা ক্ষমতা দখল কিংবা ক্ষমতা আঁখড়ে রাখার জন্য গণমাধ্যমের ওপর খড়গহস্ত হয়। গণমাধ্যমকে বেড়ি পরিয়ে তারা জনগণের আশা আকাক্সাকে শৃঙ্খলিত করে। ১৯৪৭-এ দেশ বিভাগের পর পাকিস্তানের ২৪ বছরের শাসনামলে মানুষ বারবার স্বৈরশাসনের কবলে পড়েছে। ওই সময় গণমাধ্যমের স্বাধীনতার সাংবিধানিক গ্যারান্টির অনুপস্থিতিতে বাক-ব্যক্তি, সংবাদপত্র ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা খর্ব করার বিভিন্ন আলামত জনগণ প্রত্যক্ষ করেছে। ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর সংবিধানে গণমাধ্যমের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা বিধান করা হয়। গণতন্ত্রপ্রিয় মানুষ আশান্বিত হয়। কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা আইন ১৯৭৪ সেই আশা-আকাক্সক্ষাকে ধূলিসাৎ করে দেয়। দুর্ভাগ্যজনকভাবে দেশের স্থপতি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের মতো একজন গণতন্ত্রীর হাতে এই আইনটি রচিত হয়েছে, যা ভবিষ্যৎ স্বৈরশাসকদের জন্য একটি স্বৈরাচারের সনদ রচনার কাজে ব্যবহৃত হয়েছে। ১৯৭৪ সালে জারি করা হয় বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৩ সালে জারি হয় প্রিন্টিং প্রেসেস অ্যান্ড পাবলিকেশন্স অ্যাক্ট। ১৯৭৫ সালে দেশে প্রবর্তন করা হয় একদলীয় শাসন। একই বছর ১৬ জুন মাত্র চারটি সংবাদপত্র রেখে সব সংবাদপত্রের প্রকাশনা বন্ধ করে দেয়া হয়। রাতারাতি শত শত সাংবাদিক-কর্মচারী চাকরিচ্যুত হন। সাংবাদিকেরা এখনো ১৬ জুন কালো দিবস পালন করেন। সে দিন বেকার হয়ে অনেক সাংবাদিক ফলের দোকান, মুদির দোকান দিয়ে জীবিকা নির্বাহ করেন। এ অবস্থা থেকে জাতি কিছু দিনের জন্য মুক্তি পেলেও ১৯৮২ সালে আবারো জেনারেল এরশাদের স্বৈরশাসন চেপে বসে এবং ১৯৯০ সাল পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। গণমাধ্যমের জন্য ওই সময়টি ছিল একটি অন্ধকার যুগ। কঠোর প্রেস সেন্সরশিপ আরোপ করে গণমাধ্যমের স্বাধীনতা সম্পূর্ণ হরণ করা হয়। তবে এরশাদ সাহেব খবর নিয়ন্ত্রণ পদ্ধতিকে প্রেস সেন্সরশিপ নয়, প্রেস অ্যাডভাইস নাম দিয়েছিলেন। এটি ছিল আগেকার প্রেস সেন্সরশিপের চেয়ে অনেক ভয়াবহ। সংবাদপত্র অফিসে সন্ধ্যার পর পিআইডি থেকে ফোন আসত। প্রতিটি সংবাদপত্র অফিসে এই প্রেস অ্যাডভাইসের একটি করে খাতা ‘মেইনটেন’ করা হতো। পিআইডির ফোন এলেই ওই খাতায় লেখা হতো এবং সে অনুযায়ী সংবাদপত্রে খবর ছাপা হতো। জেনারেল এরশাদের শাসনামলে যেসব দুর্নীতির ঘটনা ঘটেছে, তাকে জড়িয়ে যেসব নারীঘটিত স্ক্যান্ডাল হয়েছে এবং যে অনিয়ম, হত্যাকাণ্ড, রাজনৈতিক নোংরামি এবং আন্দোলনের খবর কিছুই পত্রিকায় ছাপা যেত না। নব্বইয়ের গণ-অভ্যুত্থানের পর গণমাধ্যম তথা সংবাদপত্রে কোনো বাধা ছাড়াই স্বাধীনভাবে খবর প্রকাশিত হয়।
বর্তমানে গণমাধ্যম একপ্রকার অবরুদ্ধ অবস্থায় আছে। এরশাদ আমলের মতো পিআইডি থেকে এখন সংবাদপত্র অফিস কিংবা টেলিভিশন ও অনলাইন মিডিয়ায় ফোন আসে না, আসে না প্রেস অ্যাডভাইস। কিন্তু অদৃশ্য জায়গা থেকে ঠিকই আসছে ফোন এবং অলিখিত প্রেস অ্যাডভাইস। এগুলো খাতায়ও লেখা যাচ্ছে না। যারা ফোন বা প্রেস অ্যাডভাইস দিচ্ছেন তাদের পরিচিতি জানা থাকলেও প্রকাশ করা যাচ্ছে না। একইভাবে প্রযুক্তির কল্যাণে খবর নিয়ন্ত্রণের এমন সব কৌশল আবিষ্কৃত হয়েছে, যার কারণে সরকারের বিপক্ষে যায় এমন অনেক খবর আলোর মুখ দেখছে না। এককথায় গণমাধ্যমের স্বাধীনতা হরণের ক্ষেত্রে ক্ষমতাসীনদের বর্তমান কৌশল অতীতের সব কৌশলকে হার মানিয়েছে। গণতন্ত্র পুনরুদ্ধারের মাধ্যমেই শুধু এ অবস্থার অবসান ঘটানো সম্ভব।
লেখক : জাতীয় প্রেস কাবের সাধারণ সম্পাদক
No comments