দ্বিধাদ্বন্দ্বে সরকার by মঈন উদ্দিন খান ও জাকির হোসেন লিটন
দৃষ্টি এখন গুলশানে বিএনপি চেয়ারপারসনের কার্যালয়ের দিকে। গ্রেফতারি পরোয়ানা সত্ত্বেও ‘নিরাপত্তাজনিত’ কারণে আজো আদালতে যাচ্ছেন না বেগম খালেদা জিয়া। ২০ দলের ডাকে চলমান হরতাল-অবরোধ কর্মসূচি ভেঙে কার্যালয় থেকে বের না হওয়ার অবস্থানে অনড় রয়েছেন তিনি। আদালতে হাজির না হলে কী ধরনের পরিস্থিতির উদ্ভব হতে পারে, তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে আলোচনার যেন শেষ নেই। এটাই এখন টক অব দ্য কান্ট্রি।
সরকারের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বেগম খালেদা জিয়া আদালতে হাজির না হলে তাকে গ্রেফতার করা নিয়ে সরকারের ভেতরে এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারেÑ এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ চাচ্ছেন, এই মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার না করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশি চালানো হোক, যাতে করে কার্যালয়ে অবস্থানকারী নেতা ও কর্মকর্তাদের সেখান থেকে বের করে আনা যায়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আজ বুধবার বেগম খালেদা জিয়ার আদালতে হাজির হওয়ার তারিখ রয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ দু’টি মামলায় বকশিবাজারের বিশেষ আদালতে হাজির না হওয়ায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর পর থেকে খালেদা জিয়াকে কখন গ্রেফতার করা হবে বা আদৌ গ্রেফতার করা হবে কি না তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক সপ্তাহ ধরে নানা হিসাব-নিকাশ চলছে।
কার্যালয় থেকে বের হবেন না বেগম খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া নয়া দিগন্তকে বলেছেন, ‘নিরাপত্তাজনিত কারণেই খালেদা জিয়ার আজ আদালতে যাওয়া অনিশ্চিত’। তিনি বলেন, ‘গত ২৫ ফেব্রুয়ারি যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত, আমরা তা প্রত্যাহারের আবেদন করেছি। আজ এ বিষয়ে শুনানি হবে। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার মামলার বিচারপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা দেয়াসংক্রান্ত হাইকোর্টে আবেদনের শুনানি হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। এসব আইনি দিক উল্লেখ করে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি সময়-সুযোগমতো অবশ্যই আদালতে হাজিরা দেবেন। ’
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গত ৩ জানুয়ারি থেকে গুলশান-২-এর ৮৬ নম্বর রোডে নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। ৬ জানুয়ারি থেকে তার ডাকেই নতুন নির্বাচনের দাবিতে দেশজুড়ে চলছে লাগাতার হরতাল-অবরোধ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের এই কর্মসূচি নিয়ে সরকারের ভেতরে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে কর্মসূচির ৫৪ দিন পেরিয়ে গেছে। বেশ কিছু দিন ধরেই সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। গুলশান কার্যালয়ের সব ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল আন্দোলন শুরুর দুই সপ্তাহ পরেই। কিন্তু আন্দোলনে অনড় খালেদা জিয়াকে কিছুতেই টলানো যায়নি। এরই মধ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকারী এক নেতা গত রাতে জানিয়েছেন, গ্রেফতার নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি স্বাভাবিক রয়েছেন। আন্দোলন সফলতার দিকে নিয়ে যাওয়াই তার একমাত্র লক্ষ্য। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকায় নিযুক্ত প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক করেছেন বেগম খালেদা জিয়া।
ওই নেতা জানান, দল কিংবা জোটের ডাকে হরতাল-অবরোধ থাকলে কখনোই বাইরে বের হন না খালেদা জিয়া। স্বাভাবিকভাবেই আজো তিনি বের হবেন না।
বিএনপির নেতারা বলেছেন, আন্দোলন থামাতে সরকার বেশ কিছু কৌশল নিয়েছে। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা তাদের কৌশলের চূড়ান্ত অংশ। তাকে গ্রেফতার করা হলে আন্দোলনের গতি আরো বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে সারা দেশে এমন নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলে অসহযোগ কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে।
খালেদা জিয়ার সাথে কার্যালয়ে গত ৩ জানুয়ারি থেকে অবস্থান করছেন দলের বেশ কয়েকজন নেতা, কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত স্টাফ। ওই কার্যালয়ে খাবার প্রবেশেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
দ্বিধাদ্বন্দ্বে সরকার : ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অনড় অবস্থানের কারণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে সরকার। তাকে গ্রেফতার করা হবে নাকি গুলশান কার্যালয় থেকে বের করে বাসায় পাঠানো হবে, নাকি কার্যালয়ে তল্লাশি করে অন্য সবাইকে বের করে দেয়া হবে, তা নিয়ে শেষ মুহূর্তে চরম সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার গ্রেফতারের খবরে রাজধানীসহ দেশজুড়ে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হওয়া, ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের মনোভাব এবং গত রাতে খালেদা জিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকদের বৈঠকের খবরে কিছুটা নড়ে চড়ে বসছেন ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।
এর আগে খালেদা জিয়ার কঠোর অবস্থানের কাছে সরকারের নানা কৌশল ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা কাজে লাগিয়ে খালেদা জিয়াকে গুলশান কার্যালয় থেকে বের করার কৌশল নেয় সরকার। সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা মনে করছিলেন, এই পরোয়ানার কারণে খালেদা জিয়া নিজেই ওই অফিস থেকে বের হয়ে আদালতে জামিন চাইতে বাধ্য হবেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত খালেদা জিয়া কার্যালয় থেকে বের না হওয়ায় সরকারের এ কৌশলও সাময়িকভাবে মার খায়। এমন প্রেক্ষাপটে আজ সরকার কঠোর অবস্থানে যাওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত থাকলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করতে পারেননি নীতিনির্ধারকেরা।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, এক দিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, অন্য দিকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছে সরকার। আওয়ামী লীগ ও সরকারের কট্টরপন্থী নেতা ও মন্ত্রীরা খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর মাধ্যমে চলমান সঙ্কটের সমাধান চান। কিন্তু অপেক্ষাকৃত মধ্যমপন্থী ও সিনিয়ররা মনে করছেন, এর মাধ্যমে আসলে সঙ্কটের চূড়ান্ত সমাধান না হয়ে আরো জটিল হতে পারে। বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুত্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সার্বক্ষণিক নজরদারি সদ্য সফর করে যাওয়া ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের মনোভাব এবং সারা দেশে সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের প্রস্তুতির খবর সরকারের জন্য খুব সুখের বিষয় নয়। তাকে গ্রেফতারের পর সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এবং আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। তাই তারা খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের পক্ষে নন। তবে আদালতের নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে খালেদা জিয়াকে গুলশান কার্যালয় থেকে বের করে আদালতে হাজির করে জামিনের পক্ষেও মত দিয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু খালেদা জিয়া জামিনের মাধ্যমে কার্যালয়ে ফেরার নিশ্চয়তা পেলেই কেবল আদালতে যেতে পারেন বলে তার আইনজীবীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় সরকার আসলে কোন দিকে যাবে তা ভেবে পাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। এখন শুধু সময় ও সুযোগের অপেক্ষায়। এর আগে একাধিকবার গ্রেফতারের পরিকল্পনা করেও পরিস্থিতির কারণে তা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় সরকার। তবে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পরোয়ানা এবং আদালতে হাজিরার দিন থাকায় আজ তার ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কী করা হবে তা কোনোভাবেই বলা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ গতকাল বলেছেন, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হবে কি না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই সিদ্ধান্ত নেবে। এটি তাদের বিষয়।
তবে আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আজ হয়তো খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা না-ও হতে পারে। তবে সারা দিন তিনি আদালতে না গেলে আজ রাতে অথবা আগামীকাল হয়তো তার কার্যালয়ে তল্লাশি করা হবে। এর মাধ্যমে সেখান থেকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের কাউকে কাউকে গ্রেফতারও করা হবে। অন্য দিকে খালেদা জিয়াকে সেখানে নিঃসঙ্গ করে রেখে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হতে পারে।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ ও হরতাল সরকারের জন্য খুব উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলমান আন্দোলনে দেশের এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নিজেই জাতীয় সংসদে তথ্য দিয়েছেন। আর চলমান অবস্থাকে জাতীয় সমস্যা ও দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করেছেন অর্থমন্ত্রী। নানা চেষ্টার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় এ সঙ্কট কিভাবে নিরসন হবে তা বলতে পারছেন না কেউ। হঠাৎ করে পরিস্থিতি আবারো অবনতি হওয়ায় সরকারের মন্ত্রিসভায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। ওই বৈঠক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের সাবধানে চলাফেরার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
সরকারের বিভিন্ন সূত্রে জানা গেছে, বেগম খালেদা জিয়া আদালতে হাজির না হলে তাকে গ্রেফতার করা নিয়ে সরকারের ভেতরে এখনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব রয়েছে। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলে রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারেÑ এমন আশঙ্কাও করা হচ্ছে। সরকারের কর্তাব্যক্তিদের কেউ কেউ চাচ্ছেন, এই মুহূর্তে খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার না করে আদালতের নির্দেশ অনুযায়ী গুলশান কার্যালয়ে তল্লাশি চালানো হোক, যাতে করে কার্যালয়ে অবস্থানকারী নেতা ও কর্মকর্তাদের সেখান থেকে বের করে আনা যায়।
জিয়া অরফানেজ ট্রাস্ট ও জিয়া চ্যারিটেবল ট্রাস্ট মামলায় আজ বুধবার বেগম খালেদা জিয়ার আদালতে হাজির হওয়ার তারিখ রয়েছে। গত ২৫ ফেব্রুয়ারি এ দু’টি মামলায় বকশিবাজারের বিশেষ আদালতে হাজির না হওয়ায় খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করা হয়। এর পর থেকে খালেদা জিয়াকে কখন গ্রেফতার করা হবে বা আদৌ গ্রেফতার করা হবে কি না তা নিয়ে রাজনৈতিক অঙ্গনে এক সপ্তাহ ধরে নানা হিসাব-নিকাশ চলছে।
কার্যালয় থেকে বের হবেন না বেগম খালেদা জিয়া
খালেদা জিয়ার আইনজীবী অ্যাডভোকেট সানাউল্লাহ মিয়া নয়া দিগন্তকে বলেছেন, ‘নিরাপত্তাজনিত কারণেই খালেদা জিয়ার আজ আদালতে যাওয়া অনিশ্চিত’। তিনি বলেন, ‘গত ২৫ ফেব্রুয়ারি যে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেছেন আদালত, আমরা তা প্রত্যাহারের আবেদন করেছি। আজ এ বিষয়ে শুনানি হবে। এ ছাড়া খালেদা জিয়ার মামলার বিচারপতির বিরুদ্ধে অনাস্থা দেয়াসংক্রান্ত হাইকোর্টে আবেদনের শুনানি হবে আগামীকাল বৃহস্পতিবার। এসব আইনি দিক উল্লেখ করে সানাউল্লাহ মিয়া বলেন, খালেদা জিয়া আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। তিনি সময়-সুযোগমতো অবশ্যই আদালতে হাজিরা দেবেন। ’
বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া গত ৩ জানুয়ারি থেকে গুলশান-২-এর ৮৬ নম্বর রোডে নিজ কার্যালয়ে অবস্থান করছেন। ৬ জানুয়ারি থেকে তার ডাকেই নতুন নির্বাচনের দাবিতে দেশজুড়ে চলছে লাগাতার হরতাল-অবরোধ। বিএনপি নেতৃত্বাধীন ২০ দলের এই কর্মসূচি নিয়ে সরকারের ভেতরে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে। ইতোমধ্যে কর্মসূচির ৫৪ দিন পেরিয়ে গেছে। বেশ কিছু দিন ধরেই সরকারের মন্ত্রী-এমপিরা খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করার দাবি জানিয়ে আসছিলেন। গুলশান কার্যালয়ের সব ধরনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করা হয়েছিল আন্দোলন শুরুর দুই সপ্তাহ পরেই। কিন্তু আন্দোলনে অনড় খালেদা জিয়াকে কিছুতেই টলানো যায়নি। এরই মধ্যে গত ২৫ ফেব্রুয়ারি আদালত খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা জারি করেন।
গুলশান কার্যালয়ে অবস্থানকারী এক নেতা গত রাতে জানিয়েছেন, গ্রেফতার নিয়ে মোটেও উদ্বিগ্ন নন বেগম খালেদা জিয়া। তিনি স্বাভাবিক রয়েছেন। আন্দোলন সফলতার দিকে নিয়ে যাওয়াই তার একমাত্র লক্ষ্য। গতকাল মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ঢাকায় নিযুক্ত প্রভাবশালী দেশের কূটনীতিকদের সাথে বৈঠক করেছেন বেগম খালেদা জিয়া।
ওই নেতা জানান, দল কিংবা জোটের ডাকে হরতাল-অবরোধ থাকলে কখনোই বাইরে বের হন না খালেদা জিয়া। স্বাভাবিকভাবেই আজো তিনি বের হবেন না।
বিএনপির নেতারা বলেছেন, আন্দোলন থামাতে সরকার বেশ কিছু কৌশল নিয়েছে। খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা তাদের কৌশলের চূড়ান্ত অংশ। তাকে গ্রেফতার করা হলে আন্দোলনের গতি আরো বেড়ে যাবে। ইতোমধ্যে সারা দেশে এমন নির্দেশনাও দেয়া হয়েছে। জানা গেছে, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হলে অসহযোগ কর্মসূচির ঘোষণা আসতে পারে।
খালেদা জিয়ার সাথে কার্যালয়ে গত ৩ জানুয়ারি থেকে অবস্থান করছেন দলের বেশ কয়েকজন নেতা, কর্মকর্তা ও ব্যক্তিগত স্টাফ। ওই কার্যালয়ে খাবার প্রবেশেও বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।
দ্বিধাদ্বন্দ্বে সরকার : ২০ দলীয় জোট নেত্রী বেগম খালেদা জিয়ার অনড় অবস্থানের কারণে দ্বিধাদ্বন্দ্বে পড়েছে সরকার। তাকে গ্রেফতার করা হবে নাকি গুলশান কার্যালয় থেকে বের করে বাসায় পাঠানো হবে, নাকি কার্যালয়ে তল্লাশি করে অন্য সবাইকে বের করে দেয়া হবে, তা নিয়ে শেষ মুহূর্তে চরম সিদ্ধান্তহীনতায় পড়েছেন সরকারের নীতিনির্ধারকেরা। বিশেষ করে খালেদা জিয়ার গ্রেফতারের খবরে রাজধানীসহ দেশজুড়ে নতুন করে অস্থিরতা শুরু হওয়া, ভারতের পররাষ্ট্রসচিবের মনোভাব এবং গত রাতে খালেদা জিয়ার সাথে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য ও ইউরোপীয় ইউনিয়নসহ প্রভাবশালী দেশগুলোর কূটনীতিকদের বৈঠকের খবরে কিছুটা নড়ে চড়ে বসছেন ক্ষমতাসীন দল ও সরকারের নীতিনির্ধারকেরা।
এর আগে খালেদা জিয়ার কঠোর অবস্থানের কাছে সরকারের নানা কৌশল ব্যর্থ হয়। সর্বশেষ আদালতের গ্রেফতারি পরোয়ানা কাজে লাগিয়ে খালেদা জিয়াকে গুলশান কার্যালয় থেকে বের করার কৌশল নেয় সরকার। সরকারের শীর্ষ কর্তাব্যক্তিরা মনে করছিলেন, এই পরোয়ানার কারণে খালেদা জিয়া নিজেই ওই অফিস থেকে বের হয়ে আদালতে জামিন চাইতে বাধ্য হবেন। কিন্তু গতকাল পর্যন্ত খালেদা জিয়া কার্যালয় থেকে বের না হওয়ায় সরকারের এ কৌশলও সাময়িকভাবে মার খায়। এমন প্রেক্ষাপটে আজ সরকার কঠোর অবস্থানে যাওয়ার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত থাকলেও শেষ মুহূর্ত পর্যন্ত তা চূড়ান্ত করতে পারেননি নীতিনির্ধারকেরা।
আওয়ামী লীগের একাধিক সূত্র জানায়, এক দিকে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে গ্রেফতারি পরোয়ানা, অন্য দিকে পরিবর্তিত রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে কিছুটা বিপাকে পড়েছে সরকার। আওয়ামী লীগ ও সরকারের কট্টরপন্থী নেতা ও মন্ত্রীরা খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করে কারাগারে পাঠানোর মাধ্যমে চলমান সঙ্কটের সমাধান চান। কিন্তু অপেক্ষাকৃত মধ্যমপন্থী ও সিনিয়ররা মনে করছেন, এর মাধ্যমে আসলে সঙ্কটের চূড়ান্ত সমাধান না হয়ে আরো জটিল হতে পারে। বিশেষ করে জাতিসঙ্ঘ ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন, যুত্তরাষ্ট্র ও যুক্তরাজ্যের সার্বক্ষণিক নজরদারি সদ্য সফর করে যাওয়া ভারতের পররাষ্ট্র সচিবের মনোভাব এবং সারা দেশে সরকারবিরোধী নেতাকর্মীদের প্রস্তুতির খবর সরকারের জন্য খুব সুখের বিষয় নয়। তাকে গ্রেফতারের পর সরকারের ওপর আন্তর্জাতিক চাপ এবং আন্দোলনে নতুন মাত্রা যোগ হতে পারে। তাই তারা খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের পক্ষে নন। তবে আদালতের নির্দেশনা পালন করতে গিয়ে খালেদা জিয়াকে গুলশান কার্যালয় থেকে বের করে আদালতে হাজির করে জামিনের পক্ষেও মত দিয়েছেন কেউ কেউ। কিন্তু খালেদা জিয়া জামিনের মাধ্যমে কার্যালয়ে ফেরার নিশ্চয়তা পেলেই কেবল আদালতে যেতে পারেন বলে তার আইনজীবীরা সাফ জানিয়ে দিয়েছেন। এ অবস্থায় সরকার আসলে কোন দিকে যাবে তা ভেবে পাচ্ছে না।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র জানায়, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতারের বিষয়ে সরকার সিদ্ধান্ত নিয়ে রেখেছে। এখন শুধু সময় ও সুযোগের অপেক্ষায়। এর আগে একাধিকবার গ্রেফতারের পরিকল্পনা করেও পরিস্থিতির কারণে তা থেকে সরে আসতে বাধ্য হয় সরকার। তবে খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে পরোয়ানা এবং আদালতে হাজিরার দিন থাকায় আজ তার ব্যাপারে কঠোর সিদ্ধান্ত নেয়ার কথা থাকলেও শেষ পর্যন্ত কী করা হবে তা কোনোভাবেই বলা যাচ্ছে না।
এ ব্যাপারে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুব-উল-আলম হানিফ গতকাল বলেছেন, খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা হবে কি না আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীই সিদ্ধান্ত নেবে। এটি তাদের বিষয়।
তবে আওয়ামী লীগের নির্ভরযোগ্য একটি সূত্র জানায়, পরিবর্তিত পরিস্থিতির কারণে আজ হয়তো খালেদা জিয়াকে গ্রেফতার করা না-ও হতে পারে। তবে সারা দিন তিনি আদালতে না গেলে আজ রাতে অথবা আগামীকাল হয়তো তার কার্যালয়ে তল্লাশি করা হবে। এর মাধ্যমে সেখান থেকে ব্যক্তিগত কর্মকর্তাদের কাউকে কাউকে গ্রেফতারও করা হবে। অন্য দিকে খালেদা জিয়াকে সেখানে নিঃসঙ্গ করে রেখে নানাভাবে চাপ প্রয়োগ করা হতে পারে।
এদিকে ২০ দলীয় জোটের লাগাতার অবরোধ ও হরতাল সরকারের জন্য খুব উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। চলমান আন্দোলনে দেশের এক লাখ ২০ হাজার কোটি টাকা ক্ষতি হয়েছে বলে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রী নিজেই জাতীয় সংসদে তথ্য দিয়েছেন। আর চলমান অবস্থাকে জাতীয় সমস্যা ও দুর্যোগ বলে আখ্যায়িত করেছেন অর্থমন্ত্রী। নানা চেষ্টার পরও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে না আসায় এ সঙ্কট কিভাবে নিরসন হবে তা বলতে পারছেন না কেউ। হঠাৎ করে পরিস্থিতি আবারো অবনতি হওয়ায় সরকারের মন্ত্রিসভায় বিষয়টি নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়েছে বলে খবর বেরিয়েছে। ওই বৈঠক থেকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা মন্ত্রীদের সাবধানে চলাফেরার পরামর্শ দিয়েছেন বলে জানা গেছে।
No comments