যে অপরাধের ক্ষমা নেই by ডা. সারওয়ার আলী
বাংলাদেশের
স্বাধীনতা এবং মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে গণহত্যা ও ধর্ষণের মতো মানবতাবিরোধী
অপরাধে যুক্ত থাকার অভিযোগে কয়েকজনের বিচার কাজ শুরু হয়েছে চার বছর আগে।
১৯৭১ সালে আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি স্বাধীনতা অর্জন করেছে। এ লক্ষ্যে
পেঁৗছানো মোটেই সহজ ছিল না। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী জনগণের আকাঙ্ক্ষাকে
চিরতরে দমনের জন্য ২৫ মার্চ রাতে বর্বর সামরিক অভিযান শুরু করেছিল। তারা
পরিকল্পনামাফিক অগ্রসর হয়। এজন্য নৃশংসতায় পারঙ্গম সৈন্যদের বাংলাদেশ
ভূখণ্ডে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে নিয়ে আসা হয়। ৩ মার্চ ঢাকায় জাতীয় পরিষদের
অধিবেশন শুরু করার কথা ছিল। একদিকে এ অধিবেশনের প্রস্তুতি চলছিল। পাশাপাশি
সামরিক জান্তা সৈন্য সমাবেশ ঘটাতে থাকে। নিষ্ঠুর দমন অভিযানের মাধ্যমে
বাঙালির স্বাধীনতা চিরতরে দমন করার মূল দায়িত্ব অর্পণ করা হয় বেলুচিস্তানের
কসাই নামে কুখ্যাতি লাভ করা লে. জেনারেল টিক্কা খানের ওপর। ২৫ মার্চ ঢাকায়
গণহত্যা অভিযান শুরুর কয়েকদিনের মধ্যেই জামায়াতে ইসলামী ও মুসলিম লীগের
মতো কয়েকটি উগ্র সাম্প্রদায়িক রাজনৈতিক দলের নেতারা গোলাম আযম ও নূরুল
আমীনের নেতৃত্বে টিক্কা খানের সঙ্গে বৈঠক করেন এবং বাঙালিদের বিরুদ্ধে
নিষ্ঠুর সামরিক অভিযানের প্রতি পূর্ণ সমর্থন ব্যক্ত করেন। শুধু তাই নয়,
দ্রুতই তারা পাকিস্তান সামরিক বাহিনীর সহযোগী ঘাতক শক্তিতে পরিণত হয়। তারা
প্রথমে শান্তি কমিটি গঠন করে এবং জনমত পাকিস্তানের পক্ষে ঘুরিয়ে দিতে
চেষ্টা করে। এতে তারা স্বাভাবিকভাবেই ব্যর্থ হয়। কারণ জনগণ ছিল বাংলাদেশের
ভূখণ্ড থেকে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীকে বিতাড়নের জন্য বঙ্গবন্ধুর
নেতৃত্বে একাত্ম। পাকিস্তানি সেনাবাহিনী প্রধানত জামায়াতে ইসলামী এবং
অন্যান্য ধর্মান্ধ দলের কর্মীদের নিয়ে রাজাকার ও আলবদর বাহিনী গঠন করে
তাদের অস্ত্রসজ্জিত করে। আলবদর বাহিনী ছিল সম্পূর্ণ জামায়াতে ইসলামীর
নিয়ন্ত্রণে। মানবতাবিরোধী অপরাধের যে বিচার কাজ এগিয়ে চলেছে তাতে দেখা যায়,
১৯৭১ সালে এ দলটির শীর্ষ নেতৃত্বের প্রায় সবাই ছিল আলবদর বাহিনীর
কমান্ডার। তারা শুধু ভয়ঙ্কর ঘাতক এই বাহিনীকে পরিচালিত করেনি, নিজেরাও
গণহত্যা অভিযানে অংশগ্রহণ করে। আমাদের মুক্তিযুদ্ধ যখন চূড়ান্ত বিজয়ের পথে
তখন তারা বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করার লক্ষ্যে বুদ্ধিজীবী ও মুক্তবুদ্ধির
অনুসারীদের টার্গেট করে হত্যা করে।
আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলেও মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি যুক্তদের বিচার কাজ তাৎক্ষণিক সম্পন্ন করা যায়নি। অনেককে আটক করা হয়েছিল। বিচারের জন্য আইনও জাতীয় সংসদে প্রণীত হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার যে পরিবর্তন ঘটে তারপর দীর্ঘদিন এ বিষয়টি এজেন্ডার বাইরে চলে যায়। শুধু তাই নয়, ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত দু'জনকে তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানো গাড়িতে তারা সদর্পে ঘুরে বেড়াতে থাকে। বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম এটা মেনে নেয়নি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে তারা দাবি তোলে_ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর প্রকৃতই এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আর কেবল প্রস্তাব-স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকে না, বাস্তব হয়ে ওঠে। কয়েকজন আত্মস্বীকৃত ও সুপরিচিত ব্যক্তিকে এ অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারক, তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীরা নিয়োগ লাভ করেন।
বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল যে ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা হত্যা করলেও বিশ্বে জেনোসাইডের মানচিত্রে এ বিষয়টি তেমন গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়নি। এটাকে আমরা জাতীয় ব্যর্থতা বলেই গণ্য করতে পারি। কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে এজন্য দায়ী করলে ভুল হবে। এটাও মনে রাখা চাই যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরবর্তী বছরগুলো ছিল চরম প্রতিকূল। আমাদের বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। সরকারি প্রচারযন্ত্র ও পাঠ্যবইয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নাম পর্যন্ত উল্লেখ থাকত না। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার কাজে সরকারের সামান্যতম ভূমিকা দেখা যায়নি। তাদের কাছে ১৯৭১ সাল ছিল 'অতীত'। বাংলাদেশের বাইরের অনেক পণ্ডিতের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং তা দমনে পাকিস্তানের নিষ্ঠুর গণহত্যার বিষয়টি যতটা না গুরুত্ব পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে 'পাক-ভারত সংঘাত'। জামায়াতে ইসলামীও তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক এবং অর্থ-বিত্ত কাজে লাগিয়ে তাদের অপরাধ যেন সামনে না আসে সেজন্য পরিকল্পিতভাবে চেষ্টা চালায়। চার বছর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার বিষয়টি যখন নিশ্চিত হয়ে যায় তখন তারা প্রচার চালাতে থাকে যে বিচার কাজে স্বচ্ছতা নেই। কেন চার দশক পর বিচার শুরু হচ্ছে, সে প্রশ্ন তারা তোলে। তাদের সপক্ষে বিপুল অর্থ ব্যয়ে গোলাম আযম-মতিউর রহমান নিজামীর দলটি আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করে। তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের আইন প্রণেতাদের কাছে পেঁৗছানোর মতো লবিস্টও পেয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামী বলতে থাকে যে বিচার কাজ আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না। তাদের হয়ে কোনো কোনো তথাকথিত 'মানবাধিকার' সংগঠনকেও এ বক্তব্য প্রচার করতে দেখা যায়। জামায়াতে ইসলামীর সুরে সুর মিলিয়ে তারা বলে, মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে নয়_ বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার বিচার করছে ইসলাম ধর্মীয় নেতা ও আলেমদের। এমনকি বিবিসি এবং সিএনএনের একাধিক প্রতিবেদনেও আমরা দেখেছি যে, একাত্তরের ঘাতকদের ধর্মীয় নেতা কিংবা আলেম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের পরিচয় দিতে গিয়ে এটাও বলা হয়েছে যে, কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণেই প্রবীণ এসব ব্যক্তি বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে জামায়াতে ইসলামী সুপরিকল্পিতভাবেই নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে চেয়েছে এবং বিপুল অর্থ ব্যয়ের কারণে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো কোনো কোনো সংগঠনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে খুবই প্রশ্নবিদ্ধ।
এর বিপরীতে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের অবস্থান সাধারণভাবে ইতিবাচক। তারা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের কর্মকাণ্ড নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছে। ২০১৩ সালে শাহবাগকে কেন্দ্র করে যে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে ওঠে তার প্রচারেও এসব মাধ্যম ভালো ভূমিকা রেখেছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তিন দিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। এর বিষয়বস্তু ছিল 'বাংলাদেশে গণহত্যা ও অপরাধের বিচার'। পৃথিবীর সবক'টি মহাদেশ থেকে গণহত্যা বিষয়ক গবেষক, পণ্ডিত ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ১৭ জন বিশিষ্ট প্রতিনিধি এতে অংশ নেন। এ সম্মেলনে আমরা জোর দিয়ে বলি, বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার। অপরাধীদের বিচার ছাড়া তাদের ক্ষত নিরাময় হবে না। এ কারণেই এ বিচারের সামাজিক প্রভাব হবে শুভ। এ সম্মেলনের ফলে একাত্তরের জেনোসাইড নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের সৃষ্ট বিভ্রান্তিও দূর হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, বাংলাদেশে যেভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ এগিয়ে চলেছে তার সঙ্গে বিভিন্ন দেশে একই ধরনের অভিযোগে যে বিচার কাজ চলছে তার মধ্যে তেমন পার্থক্য করা যাবে না। কোনো কোনো দেশে দেখা গেছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের কারণে বিচার কাজ থমকে গেছে কিংবা পরিত্যক্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও এমন শঙ্কার কথা কিন্তু শোনা যায়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ সম্পন্ন করার জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের এ ইস্যুতে আন্তরিক উদ্যোগে তারা সন্তুষ্ট_ এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এ বিচার কাজ অন্যান্য দেশেও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজে সহায়ক হবে এবং দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে বলে তারা জানান।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের কিছু দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ এখন মাথাচাড়া দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ওয়ার অন টেরোরিজমের নামে যেভাবে তাদের মোকাবেলা করতে চাইছে সেটা সঠিক পথ নয় বলেই বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের মনে হয়েছে। তারা বলেন, ধর্মীয় চরমপন্থি শক্তি একটি দেশের জন্য শুধু নয়, গোটা মানবজাতির জন্য কী ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে সেটা তারা উপলব্ধিতে এনেছেন ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর। কিন্তু বাংলাদেশে এ অপশক্তির আঘাত এসেছিল ১৯৭১ সালে এবং তাদের মোকাবেলা করেই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়েছিল। বাংলাদেশে এখনও এ শক্তির দিক থেকে বিপদ রয়েছে এবং তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা চাই। এ শক্তি যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তার সর্বশেষ নজির ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড। তিনি মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন_ কেবল এ জন্যই একুশের বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে সুপরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে একই অপশক্তির আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল প্রথাবিরোধী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদের। শুধু তাদের ওপর আঘাত হানা নয়, এই চরমপন্থি শক্তি সক্রিয় রয়েছে আমাদের প্রিয় স্বদেশভূমিকে ধর্মান্ধতার যুগে ফিরিয়ে নিতে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে শুধু বাংলাদেশের নয়, অন্যান্য দেশে সক্রিয় ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর জন্যও একটি স্পষ্ট বার্তা যাবে_ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে রেহাই মেলে না। একদিন না একদিন এ জন্য বিচারের সম্মুখীন হতেই হবে। ১৯৭১ সালের তুলনায় জঙ্গি অপশক্তির নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত। এক দেশে তারা দুর্বল হলে বিশ্বের নানা স্থানে তার প্রভাব পড়বে। আমাদের এই সংগ্রামে তাই আন্তর্জাতিক সহায়তা-সহযোগিতা কাঙ্ক্ষিত।
ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
আমাদের দুর্ভাগ্য, ১৬ ডিসেম্বর পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় সহযোগীরা নিঃশর্ত আত্মসমর্পণ করলেও মানবতাবিরোধী অপরাধে সরাসরি যুক্তদের বিচার কাজ তাৎক্ষণিক সম্পন্ন করা যায়নি। অনেককে আটক করা হয়েছিল। বিচারের জন্য আইনও জাতীয় সংসদে প্রণীত হয়। কিন্তু ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মধ্য দিয়ে ক্ষমতার যে পরিবর্তন ঘটে তারপর দীর্ঘদিন এ বিষয়টি এজেন্ডার বাইরে চলে যায়। শুধু তাই নয়, ২০০১ সালে বেগম খালেদা জিয়া একাত্তরে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডে সরাসরি যুক্ত দু'জনকে তার মন্ত্রিসভায় অন্তর্ভুক্ত করেন। লাল-সবুজের পতাকা ওড়ানো গাড়িতে তারা সদর্পে ঘুরে বেড়াতে থাকে। বাংলাদেশের জনগণ, বিশেষ করে স্বাধীনতা-পরবর্তী প্রজন্ম এটা মেনে নেয়নি। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের সাধারণ নির্বাচন সামনে রেখে তারা দাবি তোলে_ একাত্তরের যুদ্ধাপরাধীদের বিচার হতেই হবে।
২০০৯ সালের জানুয়ারিতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে মহাজোট সরকার গঠনের পর প্রকৃতই এক নতুন পরিস্থিতি সৃষ্টি হয়। মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার আর কেবল প্রস্তাব-স্লোগানে সীমাবদ্ধ থাকে না, বাস্তব হয়ে ওঠে। কয়েকজন আত্মস্বীকৃত ও সুপরিচিত ব্যক্তিকে এ অভিযোগে গ্রেফতার করা হয়। গঠিত হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। বিচারক, তদন্ত কর্মকর্তা ও আইনজীবীরা নিয়োগ লাভ করেন।
বাংলাদেশের জন্য দুর্ভাগ্যের বিষয় ছিল যে ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ নারী-পুরুষ-শিশুকে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী এবং তাদের এ দেশীয় দোসররা হত্যা করলেও বিশ্বে জেনোসাইডের মানচিত্রে এ বিষয়টি তেমন গুরুত্বের সঙ্গে তুলে ধরা হয়নি। এটাকে আমরা জাতীয় ব্যর্থতা বলেই গণ্য করতে পারি। কেবল স্বাধীনতা সংগ্রামে নেতৃত্বদানকারী দল আওয়ামী লীগ কিংবা মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তিকে এজন্য দায়ী করলে ভুল হবে। এটাও মনে রাখা চাই যে, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্টের পরবর্তী বছরগুলো ছিল চরম প্রতিকূল। আমাদের বিদ্যালয়ের পাঠ্যবইতে মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরা হয়নি। সরকারি প্রচারযন্ত্র ও পাঠ্যবইয়ে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর নাম পর্যন্ত উল্লেখ থাকত না। ওই সময়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছেও মুক্তিযুদ্ধের প্রকৃত ইতিহাস তুলে ধরার কাজে সরকারের সামান্যতম ভূমিকা দেখা যায়নি। তাদের কাছে ১৯৭১ সাল ছিল 'অতীত'। বাংলাদেশের বাইরের অনেক পণ্ডিতের কাছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধ এবং তা দমনে পাকিস্তানের নিষ্ঠুর গণহত্যার বিষয়টি যতটা না গুরুত্ব পেয়েছে, তার চেয়ে বেশি প্রাধান্য পেয়েছে 'পাক-ভারত সংঘাত'। জামায়াতে ইসলামীও তাদের আন্তর্জাতিক নেটওয়ার্ক এবং অর্থ-বিত্ত কাজে লাগিয়ে তাদের অপরাধ যেন সামনে না আসে সেজন্য পরিকল্পিতভাবে চেষ্টা চালায়। চার বছর আগে যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু হওয়ার বিষয়টি যখন নিশ্চিত হয়ে যায় তখন তারা প্রচার চালাতে থাকে যে বিচার কাজে স্বচ্ছতা নেই। কেন চার দশক পর বিচার শুরু হচ্ছে, সে প্রশ্ন তারা তোলে। তাদের সপক্ষে বিপুল অর্থ ব্যয়ে গোলাম আযম-মতিউর রহমান নিজামীর দলটি আন্তর্জাতিক লবিস্ট নিয়োগ করে। তারা যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনসহ ইউরোপের কয়েকটি দেশের আইন প্রণেতাদের কাছে পেঁৗছানোর মতো লবিস্টও পেয়ে যায়। জামায়াতে ইসলামী বলতে থাকে যে বিচার কাজ আন্তর্জাতিক মানের হচ্ছে না। তাদের হয়ে কোনো কোনো তথাকথিত 'মানবাধিকার' সংগঠনকেও এ বক্তব্য প্রচার করতে দেখা যায়। জামায়াতে ইসলামীর সুরে সুর মিলিয়ে তারা বলে, মানবতাবিরোধী অপরাধের কারণে নয়_ বাংলাদেশে শেখ হাসিনার সরকার বিচার করছে ইসলাম ধর্মীয় নেতা ও আলেমদের। এমনকি বিবিসি এবং সিএনএনের একাধিক প্রতিবেদনেও আমরা দেখেছি যে, একাত্তরের ঘাতকদের ধর্মীয় নেতা কিংবা আলেম হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। তাদের পরিচয় দিতে গিয়ে এটাও বলা হয়েছে যে, কেবল রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ হওয়ার কারণেই প্রবীণ এসব ব্যক্তি বিচারের সম্মুখীন হয়েছেন বলে অনেকে মনে করেন। প্রকৃতপক্ষে জামায়াতে ইসলামী সুপরিকল্পিতভাবেই নিজেদের অপকর্ম আড়াল করতে চেয়েছে এবং বিপুল অর্থ ব্যয়ের কারণে কিছুটা হলেও সফল হয়েছে। হিউম্যান রাইটস ওয়াচের মতো কোনো কোনো সংগঠনের ভূমিকা এ ক্ষেত্রে খুবই প্রশ্নবিদ্ধ।
এর বিপরীতে বাংলাদেশের সংবাদপত্র ও টেলিভিশনের অবস্থান সাধারণভাবে ইতিবাচক। তারা মানবতাবিরোধী অপরাধে অভিযুক্তদের কর্মকাণ্ড নতুন প্রজন্মের কাছে তুলে ধরেছে। ২০১৩ সালে শাহবাগকে কেন্দ্র করে যে গণজাগরণ মঞ্চ গড়ে ওঠে তার প্রচারেও এসব মাধ্যম ভালো ভূমিকা রেখেছে।
গত ২৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকায় মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর তিন দিনব্যাপী একটি আন্তর্জাতিক সম্মেলনের আয়োজন করে। এর বিষয়বস্তু ছিল 'বাংলাদেশে গণহত্যা ও অপরাধের বিচার'। পৃথিবীর সবক'টি মহাদেশ থেকে গণহত্যা বিষয়ক গবেষক, পণ্ডিত ও আন্তর্জাতিক সংস্থার ১৭ জন বিশিষ্ট প্রতিনিধি এতে অংশ নেন। এ সম্মেলনে আমরা জোর দিয়ে বলি, বাংলাদেশের লাখ লাখ মানুষ মানবতাবিরোধী অপরাধের শিকার। অপরাধীদের বিচার ছাড়া তাদের ক্ষত নিরাময় হবে না। এ কারণেই এ বিচারের সামাজিক প্রভাব হবে শুভ। এ সম্মেলনের ফলে একাত্তরের জেনোসাইড নিয়ে পাকিস্তানের সামরিক জান্তা এবং তাদের এ দেশীয় দোসরদের সৃষ্ট বিভ্রান্তিও দূর হয়ে যাবে বলে আমার ধারণা।
সম্মেলনে অংশগ্রহণকারীরা বলেন, বাংলাদেশে যেভাবে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ এগিয়ে চলেছে তার সঙ্গে বিভিন্ন দেশে একই ধরনের অভিযোগে যে বিচার কাজ চলছে তার মধ্যে তেমন পার্থক্য করা যাবে না। কোনো কোনো দেশে দেখা গেছে, রাজনৈতিক ক্ষমতার পরিবর্তনের কারণে বিচার কাজ থমকে গেছে কিংবা পরিত্যক্ত হয়েছে। বাংলাদেশেও এমন শঙ্কার কথা কিন্তু শোনা যায়। সম্মেলনে অংশগ্রহণকারী বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিরা বলেন, মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ সম্পন্ন করার জন্য ক্ষমতাসীন সরকারের ভূমিকা বিশেষভাবে গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমানে শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের এ ইস্যুতে আন্তরিক উদ্যোগে তারা সন্তুষ্ট_ এমন অভিমত ব্যক্ত করেছেন। এ বিচার কাজ অন্যান্য দেশেও মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজে সহায়ক হবে এবং দৃষ্টান্ত হিসেবে কাজ করবে বলে তারা জানান।
বাংলাদেশসহ বিশ্বের কিছু দেশে ধর্মীয় উগ্রবাদ এখন মাথাচাড়া দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্র ওয়ার অন টেরোরিজমের নামে যেভাবে তাদের মোকাবেলা করতে চাইছে সেটা সঠিক পথ নয় বলেই বিভিন্ন দেশের প্রতিনিধিদের মনে হয়েছে। তারা বলেন, ধর্মীয় চরমপন্থি শক্তি একটি দেশের জন্য শুধু নয়, গোটা মানবজাতির জন্য কী ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে সেটা তারা উপলব্ধিতে এনেছেন ২০০১ সালের সেপ্টেম্বরে টুইন টাওয়ারে সন্ত্রাসী হামলার পর। কিন্তু বাংলাদেশে এ অপশক্তির আঘাত এসেছিল ১৯৭১ সালে এবং তাদের মোকাবেলা করেই ১৬ ডিসেম্বর বিজয় অর্জিত হয়েছিল। বাংলাদেশে এখনও এ শক্তির দিক থেকে বিপদ রয়েছে এবং তাদের ব্যাপারে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকা চাই। এ শক্তি যে কতটা ভয়ঙ্কর হতে পারে তার সর্বশেষ নজির ড. অভিজিৎ রায় হত্যাকাণ্ড। তিনি মুক্তবুদ্ধির চর্চা করেন_ কেবল এ জন্যই একুশের বইমেলা থেকে বাসায় ফেরার পথে সুপরিকল্পিতভাবে তাকে হত্যা করা হয়েছে। একইভাবে একই অপশক্তির আঘাতে মৃত্যু হয়েছিল প্রথাবিরোধী লেখক ড. হুমায়ুন আজাদের। শুধু তাদের ওপর আঘাত হানা নয়, এই চরমপন্থি শক্তি সক্রিয় রয়েছে আমাদের প্রিয় স্বদেশভূমিকে ধর্মান্ধতার যুগে ফিরিয়ে নিতে।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার কাজ যথাযথভাবে সম্পন্ন হলে শুধু বাংলাদেশের নয়, অন্যান্য দেশে সক্রিয় ধর্মান্ধ গোষ্ঠীর জন্যও একটি স্পষ্ট বার্তা যাবে_ মানবতার বিরুদ্ধে অপরাধ করে রেহাই মেলে না। একদিন না একদিন এ জন্য বিচারের সম্মুখীন হতেই হবে। ১৯৭১ সালের তুলনায় জঙ্গি অপশক্তির নেটওয়ার্ক অনেক বিস্তৃত। এক দেশে তারা দুর্বল হলে বিশ্বের নানা স্থানে তার প্রভাব পড়বে। আমাদের এই সংগ্রামে তাই আন্তর্জাতিক সহায়তা-সহযোগিতা কাঙ্ক্ষিত।
ট্রাস্টি, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর
No comments