ভরদুপুরে মেডিকেলের বার্ন ইউনিটে by সৈয়দ আবুল মকসুদ
ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট |
ঢাকা
মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট। লোকজনের নড়াচড়া আছে, কিন্তু কেমন
সুনসান। আমি যখন যাই তখন ভরদুপুর। বিভিন্ন ওয়ার্ডে দুর্ঘটনাজনিত আগুনে
পুড়ে আহত মানুষগুলো যন্ত্রণায় কাতরাচ্ছেন। তাঁদের মধ্যে অবরোধ-হরতালে
পেট্রলবোমায় আহত ব্যক্তিরাও আছেন। পাঁচতলায় একটি পুরো ওয়ার্ডই শুধু
অবরোধ-হরতালের রোগীদের জন্য। দোতলায় নিবিড় পরিচর্যা কেন্দ্র (আইসিইউ)।
অন্য ওয়ার্ড ঘুরে আমি আইসিইউতে যাই।
তখন ছিলেন আইসিইউ ইনচার্জ রওশন আখতার। তিনি আমাকে চিনলেন, বসালেন এবং বললেন, স্যার (বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক ডা. সামন্তলাল সেন) বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি-বিষয়ক কনফারেন্সে গেছেন সোনারগাঁও হোটেলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। জানতে চাইলাম পেট্রলবোমায় আহত ব্যক্তিদের অবস্থা। তিনি বললেন, কয়েকজনের অবস্থা খুব খারাপ। বগুড়া থেকে আসা জাহাঙ্গীর হোসেন যেকোনো সময়—।
কাচের পার্টিশনের এ–পাশ থেকে দেখছিলাম অগ্নিদগ্ধ হতভাগ্য ব্যক্তিদের। আইসিইউতে ডাক্তার-নার্স ও রোগীর নির্বাচিত নিকটজন কেউ ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন বার্ন ইউনিট পরিদর্শন করেন, তিনিও এখানে কাচের এ-পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। তিনি চলে যাওয়ার পরে আমিও সেদিন গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বীভৎস রকম অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর হোসেনের পরিবারও পেয়েছে।
কাচের ও-পাশের বেডেই সাত বছরের মরিয়ম। এসেছে গাজীপুর থেকে। পেট্রলবোমায় শরীরের ৪৫ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে। নাকে অক্সিজেন ইত্যাদির নল। অচেতন হয়ে পড়ে আছে মরিয়ম। পাশে দাঁড়িয়ে তার নির্বাক মা। সেরে উঠবে এবং একসময় সঙ্গীসাথিদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে খেলবে, সে আশ্বাস দেননি ডাক্তাররা। আরেক পাশের বেডে সুভাষ নামে ৫৬ বছর বয়স্ক একজন। এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। সাম্যবাদী দলের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আমাদের বন্ধু দিলীপ বড়ুয়ার ঘনিষ্ঠ কেউ। তাঁর অবস্থাও খারাপ। মুখমণ্ডল ঝলসে গেছে। নাকে-মুখে যন্ত্রপাতি লাগানো। বাঁচার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারেন না।
সুভাষবাবুর ও-পাশের বেডে জাহাঙ্গীর। এক দিন এই পৃথিবীতে তিনি এসেছিলেন। নিজের ইচ্ছায় আসেননি। যদি জানতেন এই জগৎ এতটা নিষ্ঠুর এবং বিধাতা তাঁর মতামত নিতেন, তাহলে তিনি এখানে আসতেন না। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত—সৃষ্টির সেরা জীব, সুন্দর অবয়ববিশিষ্ট প্রাণী, পেট্রলবোমায় পুড়ে গেলে কেমন হয় তার অবয়ব, তা চোখে না দেখলে মৌখিকভাবে হোক বা লিখে হোক অন্য কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও সামান্য লেখক হিসেবে লেখার যেটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে বীভৎস অগ্নিদগ্ধের বর্ণনা না দেওয়াই ভালো।
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর থেকে বার্ন ইউনিটে আমি বহুবার গিয়েছি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে অসুস্থ হওয়া কোনো রোগ নয়। দুর্ঘটনাজনিত শারীরিক সমস্যা। বজ্রপাতসহ নানা কারণে মানুষের শরীর আগুনে ঝলসে যেতে পারে। রক্ত-মাংসের মানবদেহ আগুনে পুড়ে গেলে—অল্প হোক বা বেশি হোক—কী যে যন্ত্রণা, তা যেকোনো মানুষের পক্ষে অনুমান করা সম্ভব। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে আগুনে পোড়া রোগীদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা অপ্রতুল। পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবিতে নাগরিক সংহতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সমাবেশ করেছি। শহীদ মিনার, মেডিকেলের সামনে মানববন্ধনও করেছি। আমাদের আন্দোলনের কথা অধ্যাপক সামন্তলাল সেন জানেন। তাঁর সঙ্গে আমার এ বিষয়ে অনেকবার কথা হয়েছে। তিনি সজ্জন ও সহানুভূতিশীল চিকিৎসক।
জাহাঙ্গীরের কোনো কষ্ট নেই, কারণ তাঁর লেশমাত্র চেতনা নেই। অবর্ণনীয় কষ্ট তাঁর প্রিয়জনদের। জাহাঙ্গীরের মুখের খসে যাওয়া চামড়া কেউ ছাড়ালেন। ওই দৃশ্য দেখা যায় না। তখন জাহাঙ্গীর সব সেবা-শুশ্রূষা ও চিকিৎসার ঊর্ধ্বে। তবু ডাক্তার-সেবিকারা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। দুজন কম বয়সী নারী জাহাঙ্গীরের বেডের দুই পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর দিকে তাকিয়ে অপলক। সবচেয়ে নিষ্ঠুর মুহূর্তটি কখন আসে কেউ জানে না। অ্যাটেনডেন্টদের একজন জাহাঙ্গীরের স্ত্রী বিউটি খাতুন আর একজন বিউটির বোন।
আমি ইশারায় বিউটি খাতুনকে ডাকি। তিনি আসেন। কিন্তু তাঁর দিকে আমি তাকাতে পারি না। পাঁচটি সপ্তাহ যাবৎ তিনি স্বামীর পাশে। তাঁর নাওয়া-খাওয়া-ঘুম হারাম। তাতেও তাঁর কষ্ট ছিল না, যদি কেউ তাঁকে আশ্বাস দিতেন যে তাঁর স্বামী সুস্থ হয়ে উঠবেন। তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখ দিয়ে পড়ার মতো পানি বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না, তবু টপ টপ করে পড়ছিল পানি। বললাম, সন্তানাদি কী? বললেন, এক মেয়ে এক ছেলে। মনে মনে বললাম, ছোট সংসার, সুখী সংসার। অল্প আয়ে বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিল। ছেলে জাহিদের বয়স ১৩, মেয়ে জুঁইয়ের বয়স ৯। অনর্থক সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, দেখবেন, আপনার ছেলেমেয়েরা ভালো হবে। ওদের পড়াশোনা করাবেন, সবাই আপনার পাশে থাকবে। জাহিদ পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে, জুঁই তৃতীয় শ্রেণিতে।
অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জাঁ-পল সাত্রে৴র ভাষায়, মানুষ এক অর্থহীন ভাবাবেগ—আ ইউসলেস প্যাশন। স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধনে এই জগৎ-সংসারে জড়িয়ে থাকে মানুষ। জাহাঙ্গীর তাঁর ছেলে ও মেয়ের নাম তাঁর নিজের নামের আদ্যক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছিলেন: জাহিদ ও জুঁই। জাহাঙ্গীরের মা-বাবাও জীবিত।
বিউটি জানালেন, তাঁদের বাড়ি বগুড়ার কাহালু উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে। তাঁর স্বামী ছিলেন ট্রাকের হেলপার। ওই ট্রাকের চালক ছিলেন তাঁর বোনজামাই। ২৩ জানুয়ারি রাতে দুপচাঁচিয়া থেকে সারিয়াকান্দী যাচ্ছিল ট্রাক। বগুড়া শহরের চৌমাথায় তাঁদের ওপর নেমে আসে গজব। চালক মাসুদ কম আহত হন। তিনিও বার্ন ইউনিটের অন্য ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। ট্রাকে কাজ নেওয়ার আগে জাহাঙ্গীর ভ্যান চালাতেন।
যে পেট্রলবোমাটি জাহাঙ্গীরদের ট্রাকে ছোড়া হয়েছে, ওটি অলৌকিক ছিল না। কেউ না কেউ—কোনো মানুষই ছুড়ে মেরেছে। ওই বোমা নিক্ষেপকারীর সঙ্গে জাহাঙ্গীরদের জমিজমা নিয়ে কোনো বিবাদ ছিল না। রাস্তার পাশের চা-দোকানে কারও সঙ্গে জাহাঙ্গীর ঝগড়াও করেননি। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যে লোক বোমা ছুড়েছে সে মাসুদ বা জাহাঙ্গীরকে চিনতও না।
আণবিক বোমাও বোমা, নাপাম বোমাও বোমা, পেট্রলবোমাও বোমা। কোনোটি বড়, কোনোটি মাঝারি, কোনোটি ছোট। সবার একই কাজ। মানুষকে পুড়িয়ে মারা। প্রথম ধাক্কায় যারা মরে না, তারা কিছুকাল নরকযন্ত্রণা ভোগ করে মারা যায়।
কোনো বোমা কারও প্রতি নিক্ষেপ করার আগে যত্ন করে বানাতে হয়। পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করতে সম্ভবত একটি হাতই যথেষ্ট। বানাতে লাগে দুটি হাত ও একটি মাথা। হিরোশিমা-নাগাসাকির বোমা দুটির কারণে যা ঘটেছে তার দায় আইনস্টাইন এড়াতে পারেন না। যেসব বিজ্ঞানী বোমা দুটি বানিয়েছিলেন তাঁরাও দায় এড়াতে পারেন না। যেসব বৈমানিক ওই বোমা ওখানে বহন করেছেন, তাঁরাও নন। যাঁদের হাত দিয়ে বোমা দুটি ফেলা হয়েছে, তাঁদের অপরাধ কতটা, তা আদালত বলতে পারবেন। কিন্তু আমেরিকার গবেষণাগার থেকে হিরোশিমার আকাশ পর্যন্ত বোমা দুটি যে গেল, তার দায় কার, তা বিধাতা ছাড়া কেউ জানেন না। তবে বাংলায় আজ পেট্রলবোমায় যাঁরা জাহাঙ্গীরের মতো পুড়ছেন, তার দায় আমাদের সবার: ষোলো কোটি জীবিত মানুষের। অবরোধের ৫৫ দিনে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ১১৩; তার মধ্যে পেট্রলবোমার আগুনে নিহত হয়েছেন ৬০ জন, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ‘গণপিটুনি’তে ৩৬ জন এবং কথিত ‘গুলিবিদ্ধ লাশ’ ও ‘সড়ক দুর্ঘটনা’য় ১৭ জন।
পেট্রলবোমায় যাঁরা পুড়ে মরেছেন, তাঁদের সামাজিক অবস্থান কী? তাঁরা সবাই শ্রমজীবী বা সাধারণ পরিবারের মানুষ। জাহাঙ্গীর একটি দৃষ্টান্ত মাত্র, আমি বলতে চাইছি ‘জাহাঙ্গীরদের’ কথা। সুভাষ, মরিয়ম ও জাহাঙ্গীরদের সবার কথা লিখতে গেলে লাখ লাখ পৃষ্ঠার প্রয়োজন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্যই হোক, ইসলামের খেদমত করার জন্যই হোক, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যই হোক, দারিদ্র্য দূর ও সুশাসনের জন্যই হোক বা জনগণকে দেশপ্রেমে দীক্ষিত করতেই হোক, আমাদের ভাগ্যবানদের কাছে অর্থ আসে বিদেশ থেকে। ওই অর্থ থেকেই দামি গাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বনভূমিতে বাগানবাড়ি, বিদেশভ্রমণ, ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়ানো—সবই চলে। জাহাঙ্গীরদের একমাত্র পুঁজি তাঁদের শরীর। সারা দিন, সারা রাত খাটুনি। মজুরির টাকায় বউ-ছেলে-মেয়ের জন্য বাজার করা। হপ্তায় দুই দিনও মাছ-মাংস জোটে না। কোনো কোনো দিন বাজারের চুনোপুঁটি বা টাকি বা খালের পানিতে চাষের তেলাপিয়া হলেই খুশি। জাহাঙ্গীররা কখনোই পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, শিককাবাব, হামবার্গার, পিৎজার প্রত্যাশা করেন না। সামনে ঈদ আসছে। জাহাঙ্গীররা তাঁদের বউদের জামদানি, কাতান বা লেহেঙ্গা নয়, বাবুরহাটি শাড়ি দিলেই সন্তুষ্ট। তাঁদের ওপর এমন গজব কেন?
কবি যে বলেছেন, ‘এই দেশেতে জন্ম আমার যেন এই দেশেতেই মরি’—কথাটা জাহাঙ্গীরদের জীবনেই সত্য। তাঁদের জন্ম এই দেশেতে, তাঁরা মরেনও এই দেশেতেই। তাঁরা কল্পনাও করেন না যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদে বা সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে গিয়ে মরবেন। অথবা সগৌরবে মৃত্যু হবে দিল্লির অ্যাপোলোতে, লন্ডনে বা নিউইয়র্কের কোনো বিলাসবহুল হাসপাতালে। জাহাঙ্গীরদের প্রথম পছন্দ নিজের ঘরের মলিন বিছানায় প্রিয়জনদের মধ্যে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ। খুব বেশি হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা জেলা সদর হাসপাতাল।
আমি দেখে আসার ১৪ ঘণ্টা পরে রাতের গভীর যামে জাহাঙ্গীর তাঁর শেষনিঃশ্বাসটি ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে কোনো রাজনৈতিক দলের কিছুই আসে-যায় না। জগৎ-সংসার তার নিজস্ব নিয়মে চলবে।
সেদিন বার্ন ইউনিট থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের চত্বরে দাঁড়াই। বাংলার আকাশে নীলের পরিমাণ কম, ধূসরতাই বেশি। নগরের যানবাহন ও মানুষের কোলাহলের মধ্যেও কার্জন হলের দিক থেকে কুহু-কুহু-কুহু ডেকে ওঠে একটি কোকিল। কোকিলটির কণ্ঠে কোনো মাধুর্য নেই, কেমন একধরনের উগ্রতা। প্রত্যুত্তরে ফজলুল হক হলের দিক থেকে আর একটি কোকিল ডেকে ওঠে। সে কণ্ঠেও তীব্রতা। সোলায়মান পয়গম্বরের মতো আমরা যদি পাখিদের ভাষা বুঝতে পারতাম, তাহলে জানা যেত, বাংলার কোকিলেরা ফাল্গুনে শুধু আনন্দেই ডাকে না, তারা মানুষের নির্মমতা, হিংসা ও বর্বরতার প্রতিবাদেও চিৎকার করে ওঠে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
তখন ছিলেন আইসিইউ ইনচার্জ রওশন আখতার। তিনি আমাকে চিনলেন, বসালেন এবং বললেন, স্যার (বার্ন ইউনিটের প্রতিষ্ঠাতা-পরিচালক ডা. সামন্তলাল সেন) বার্ন ও প্লাস্টিক সার্জারি-বিষয়ক কনফারেন্সে গেছেন সোনারগাঁও হোটেলে। মাননীয় প্রধানমন্ত্রী উদ্বোধন করবেন। জানতে চাইলাম পেট্রলবোমায় আহত ব্যক্তিদের অবস্থা। তিনি বললেন, কয়েকজনের অবস্থা খুব খারাপ। বগুড়া থেকে আসা জাহাঙ্গীর হোসেন যেকোনো সময়—।
কাচের পার্টিশনের এ–পাশ থেকে দেখছিলাম অগ্নিদগ্ধ হতভাগ্য ব্যক্তিদের। আইসিইউতে ডাক্তার-নার্স ও রোগীর নির্বাচিত নিকটজন কেউ ছাড়া অন্য কারও প্রবেশ নিষেধ। শুনলাম, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যেদিন বার্ন ইউনিট পরিদর্শন করেন, তিনিও এখানে কাচের এ-পাশে দাঁড়িয়ে দেখেছেন। তিনি চলে যাওয়ার পরে আমিও সেদিন গিয়েছিলাম। প্রধানমন্ত্রী বীভৎস রকম অগ্নিদগ্ধ ব্যক্তিদের পরিবারকে ১০ লাখ টাকা করে অনুদান দিয়েছেন। জাহাঙ্গীর হোসেনের পরিবারও পেয়েছে।
কাচের ও-পাশের বেডেই সাত বছরের মরিয়ম। এসেছে গাজীপুর থেকে। পেট্রলবোমায় শরীরের ৪৫ শতাংশের বেশি পুড়ে গেছে। নাকে অক্সিজেন ইত্যাদির নল। অচেতন হয়ে পড়ে আছে মরিয়ম। পাশে দাঁড়িয়ে তার নির্বাক মা। সেরে উঠবে এবং একসময় সঙ্গীসাথিদের সঙ্গে দৌড়াদৌড়ি করে খেলবে, সে আশ্বাস দেননি ডাক্তাররা। আরেক পাশের বেডে সুভাষ নামে ৫৬ বছর বয়স্ক একজন। এসেছেন চট্টগ্রাম থেকে। সাম্যবাদী দলের নেতা ও সাবেক মন্ত্রী আমাদের বন্ধু দিলীপ বড়ুয়ার ঘনিষ্ঠ কেউ। তাঁর অবস্থাও খারাপ। মুখমণ্ডল ঝলসে গেছে। নাকে-মুখে যন্ত্রপাতি লাগানো। বাঁচার গ্যারান্টি কেউ দিতে পারেন না।
সুভাষবাবুর ও-পাশের বেডে জাহাঙ্গীর। এক দিন এই পৃথিবীতে তিনি এসেছিলেন। নিজের ইচ্ছায় আসেননি। যদি জানতেন এই জগৎ এতটা নিষ্ঠুর এবং বিধাতা তাঁর মতামত নিতেন, তাহলে তিনি এখানে আসতেন না। মানুষ আশরাফুল মাখলুকাত—সৃষ্টির সেরা জীব, সুন্দর অবয়ববিশিষ্ট প্রাণী, পেট্রলবোমায় পুড়ে গেলে কেমন হয় তার অবয়ব, তা চোখে না দেখলে মৌখিকভাবে হোক বা লিখে হোক অন্য কাউকে বোঝানো সম্ভব নয়। তা সত্ত্বেও সামান্য লেখক হিসেবে লেখার যেটুকু শক্তি আছে তা দিয়ে বীভৎস অগ্নিদগ্ধের বর্ণনা না দেওয়াই ভালো।
নিমতলী ট্র্যাজেডির পর থেকে বার্ন ইউনিটে আমি বহুবার গিয়েছি। অগ্নিদগ্ধ হয়ে অসুস্থ হওয়া কোনো রোগ নয়। দুর্ঘটনাজনিত শারীরিক সমস্যা। বজ্রপাতসহ নানা কারণে মানুষের শরীর আগুনে ঝলসে যেতে পারে। রক্ত-মাংসের মানবদেহ আগুনে পুড়ে গেলে—অল্প হোক বা বেশি হোক—কী যে যন্ত্রণা, তা যেকোনো মানুষের পক্ষে অনুমান করা সম্ভব। বাংলাদেশের হাসপাতালগুলোতে আগুনে পোড়া রোগীদের সুচিকিৎসার ব্যবস্থা অপ্রতুল। পূর্ণাঙ্গ বার্ন ইনস্টিটিউট প্রতিষ্ঠার দাবিতে নাগরিক সংহতিসহ বিভিন্ন সংগঠনের পক্ষ থেকে আমরা সমাবেশ করেছি। শহীদ মিনার, মেডিকেলের সামনে মানববন্ধনও করেছি। আমাদের আন্দোলনের কথা অধ্যাপক সামন্তলাল সেন জানেন। তাঁর সঙ্গে আমার এ বিষয়ে অনেকবার কথা হয়েছে। তিনি সজ্জন ও সহানুভূতিশীল চিকিৎসক।
জাহাঙ্গীরের কোনো কষ্ট নেই, কারণ তাঁর লেশমাত্র চেতনা নেই। অবর্ণনীয় কষ্ট তাঁর প্রিয়জনদের। জাহাঙ্গীরের মুখের খসে যাওয়া চামড়া কেউ ছাড়ালেন। ওই দৃশ্য দেখা যায় না। তখন জাহাঙ্গীর সব সেবা-শুশ্রূষা ও চিকিৎসার ঊর্ধ্বে। তবু ডাক্তার-সেবিকারা তাঁদের দায়িত্ব পালন করে যাচ্ছেন। দুজন কম বয়সী নারী জাহাঙ্গীরের বেডের দুই পাশে দাঁড়িয়ে। তাঁর দিকে তাকিয়ে অপলক। সবচেয়ে নিষ্ঠুর মুহূর্তটি কখন আসে কেউ জানে না। অ্যাটেনডেন্টদের একজন জাহাঙ্গীরের স্ত্রী বিউটি খাতুন আর একজন বিউটির বোন।
আমি ইশারায় বিউটি খাতুনকে ডাকি। তিনি আসেন। কিন্তু তাঁর দিকে আমি তাকাতে পারি না। পাঁচটি সপ্তাহ যাবৎ তিনি স্বামীর পাশে। তাঁর নাওয়া-খাওয়া-ঘুম হারাম। তাতেও তাঁর কষ্ট ছিল না, যদি কেউ তাঁকে আশ্বাস দিতেন যে তাঁর স্বামী সুস্থ হয়ে উঠবেন। তিনি আমার সামনে এসে দাঁড়ালেন। চোখ দিয়ে পড়ার মতো পানি বিশেষ অবশিষ্ট ছিল না, তবু টপ টপ করে পড়ছিল পানি। বললাম, সন্তানাদি কী? বললেন, এক মেয়ে এক ছেলে। মনে মনে বললাম, ছোট সংসার, সুখী সংসার। অল্প আয়ে বেশ ভালোই চলে যাচ্ছিল। ছেলে জাহিদের বয়স ১৩, মেয়ে জুঁইয়ের বয়স ৯। অনর্থক সান্ত্বনা দিয়ে বললাম, দেখবেন, আপনার ছেলেমেয়েরা ভালো হবে। ওদের পড়াশোনা করাবেন, সবাই আপনার পাশে থাকবে। জাহিদ পড়ে চতুর্থ শ্রেণিতে, জুঁই তৃতীয় শ্রেণিতে।
অস্তিত্ববাদী দার্শনিক জাঁ-পল সাত্রে৴র ভাষায়, মানুষ এক অর্থহীন ভাবাবেগ—আ ইউসলেস প্যাশন। স্নেহ-মায়া-মমতার বন্ধনে এই জগৎ-সংসারে জড়িয়ে থাকে মানুষ। জাহাঙ্গীর তাঁর ছেলে ও মেয়ের নাম তাঁর নিজের নামের আদ্যক্ষরের সঙ্গে মিলিয়ে রেখেছিলেন: জাহিদ ও জুঁই। জাহাঙ্গীরের মা-বাবাও জীবিত।
বিউটি জানালেন, তাঁদের বাড়ি বগুড়ার কাহালু উপজেলার নিশ্চিন্তপুর গ্রামে। তাঁর স্বামী ছিলেন ট্রাকের হেলপার। ওই ট্রাকের চালক ছিলেন তাঁর বোনজামাই। ২৩ জানুয়ারি রাতে দুপচাঁচিয়া থেকে সারিয়াকান্দী যাচ্ছিল ট্রাক। বগুড়া শহরের চৌমাথায় তাঁদের ওপর নেমে আসে গজব। চালক মাসুদ কম আহত হন। তিনিও বার্ন ইউনিটের অন্য ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন। ট্রাকে কাজ নেওয়ার আগে জাহাঙ্গীর ভ্যান চালাতেন।
যে পেট্রলবোমাটি জাহাঙ্গীরদের ট্রাকে ছোড়া হয়েছে, ওটি অলৌকিক ছিল না। কেউ না কেউ—কোনো মানুষই ছুড়ে মেরেছে। ওই বোমা নিক্ষেপকারীর সঙ্গে জাহাঙ্গীরদের জমিজমা নিয়ে কোনো বিবাদ ছিল না। রাস্তার পাশের চা-দোকানে কারও সঙ্গে জাহাঙ্গীর ঝগড়াও করেননি। নিশ্চিতভাবেই বলা যায়, যে লোক বোমা ছুড়েছে সে মাসুদ বা জাহাঙ্গীরকে চিনতও না।
আণবিক বোমাও বোমা, নাপাম বোমাও বোমা, পেট্রলবোমাও বোমা। কোনোটি বড়, কোনোটি মাঝারি, কোনোটি ছোট। সবার একই কাজ। মানুষকে পুড়িয়ে মারা। প্রথম ধাক্কায় যারা মরে না, তারা কিছুকাল নরকযন্ত্রণা ভোগ করে মারা যায়।
কোনো বোমা কারও প্রতি নিক্ষেপ করার আগে যত্ন করে বানাতে হয়। পেট্রলবোমা নিক্ষেপ করতে সম্ভবত একটি হাতই যথেষ্ট। বানাতে লাগে দুটি হাত ও একটি মাথা। হিরোশিমা-নাগাসাকির বোমা দুটির কারণে যা ঘটেছে তার দায় আইনস্টাইন এড়াতে পারেন না। যেসব বিজ্ঞানী বোমা দুটি বানিয়েছিলেন তাঁরাও দায় এড়াতে পারেন না। যেসব বৈমানিক ওই বোমা ওখানে বহন করেছেন, তাঁরাও নন। যাঁদের হাত দিয়ে বোমা দুটি ফেলা হয়েছে, তাঁদের অপরাধ কতটা, তা আদালত বলতে পারবেন। কিন্তু আমেরিকার গবেষণাগার থেকে হিরোশিমার আকাশ পর্যন্ত বোমা দুটি যে গেল, তার দায় কার, তা বিধাতা ছাড়া কেউ জানেন না। তবে বাংলায় আজ পেট্রলবোমায় যাঁরা জাহাঙ্গীরের মতো পুড়ছেন, তার দায় আমাদের সবার: ষোলো কোটি জীবিত মানুষের। অবরোধের ৫৫ দিনে নিহত ব্যক্তির সংখ্যা ১১৩; তার মধ্যে পেট্রলবোমার আগুনে নিহত হয়েছেন ৬০ জন, ‘বন্দুকযুদ্ধ’ ও ‘গণপিটুনি’তে ৩৬ জন এবং কথিত ‘গুলিবিদ্ধ লাশ’ ও ‘সড়ক দুর্ঘটনা’য় ১৭ জন।
পেট্রলবোমায় যাঁরা পুড়ে মরেছেন, তাঁদের সামাজিক অবস্থান কী? তাঁরা সবাই শ্রমজীবী বা সাধারণ পরিবারের মানুষ। জাহাঙ্গীর একটি দৃষ্টান্ত মাত্র, আমি বলতে চাইছি ‘জাহাঙ্গীরদের’ কথা। সুভাষ, মরিয়ম ও জাহাঙ্গীরদের সবার কথা লিখতে গেলে লাখ লাখ পৃষ্ঠার প্রয়োজন।
নির্বাচন পর্যবেক্ষণের জন্যই হোক, ইসলামের খেদমত করার জন্যই হোক, ধর্মনিরপেক্ষতার জন্যই হোক, দারিদ্র্য দূর ও সুশাসনের জন্যই হোক বা জনগণকে দেশপ্রেমে দীক্ষিত করতেই হোক, আমাদের ভাগ্যবানদের কাছে অর্থ আসে বিদেশ থেকে। ওই অর্থ থেকেই দামি গাড়ি, বিলাসবহুল ফ্ল্যাট, বনভূমিতে বাগানবাড়ি, বিদেশভ্রমণ, ছেলেমেয়েদের বিদেশে পড়ানো—সবই চলে। জাহাঙ্গীরদের একমাত্র পুঁজি তাঁদের শরীর। সারা দিন, সারা রাত খাটুনি। মজুরির টাকায় বউ-ছেলে-মেয়ের জন্য বাজার করা। হপ্তায় দুই দিনও মাছ-মাংস জোটে না। কোনো কোনো দিন বাজারের চুনোপুঁটি বা টাকি বা খালের পানিতে চাষের তেলাপিয়া হলেই খুশি। জাহাঙ্গীররা কখনোই পোলাও, কাচ্চি বিরিয়ানি, শিককাবাব, হামবার্গার, পিৎজার প্রত্যাশা করেন না। সামনে ঈদ আসছে। জাহাঙ্গীররা তাঁদের বউদের জামদানি, কাতান বা লেহেঙ্গা নয়, বাবুরহাটি শাড়ি দিলেই সন্তুষ্ট। তাঁদের ওপর এমন গজব কেন?
কবি যে বলেছেন, ‘এই দেশেতে জন্ম আমার যেন এই দেশেতেই মরি’—কথাটা জাহাঙ্গীরদের জীবনেই সত্য। তাঁদের জন্ম এই দেশেতে, তাঁরা মরেনও এই দেশেতেই। তাঁরা কল্পনাও করেন না যে এয়ার অ্যাম্বুলেন্সে ব্যাংককের বামরুনগ্রাদে বা সিঙ্গাপুরের মাউন্ট এলিজাবেথ হাসপাতালে গিয়ে মরবেন। অথবা সগৌরবে মৃত্যু হবে দিল্লির অ্যাপোলোতে, লন্ডনে বা নিউইয়র্কের কোনো বিলাসবহুল হাসপাতালে। জাহাঙ্গীরদের প্রথম পছন্দ নিজের ঘরের মলিন বিছানায় প্রিয়জনদের মধ্যে শেষনিঃশ্বাস ত্যাগ। খুব বেশি হলে উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স কিংবা জেলা সদর হাসপাতাল।
আমি দেখে আসার ১৪ ঘণ্টা পরে রাতের গভীর যামে জাহাঙ্গীর তাঁর শেষনিঃশ্বাসটি ত্যাগ করেন। তাঁর মৃত্যুতে কোনো রাজনৈতিক দলের কিছুই আসে-যায় না। জগৎ-সংসার তার নিজস্ব নিয়মে চলবে।
সেদিন বার্ন ইউনিট থেকে বেরিয়ে হাসপাতালের চত্বরে দাঁড়াই। বাংলার আকাশে নীলের পরিমাণ কম, ধূসরতাই বেশি। নগরের যানবাহন ও মানুষের কোলাহলের মধ্যেও কার্জন হলের দিক থেকে কুহু-কুহু-কুহু ডেকে ওঠে একটি কোকিল। কোকিলটির কণ্ঠে কোনো মাধুর্য নেই, কেমন একধরনের উগ্রতা। প্রত্যুত্তরে ফজলুল হক হলের দিক থেকে আর একটি কোকিল ডেকে ওঠে। সে কণ্ঠেও তীব্রতা। সোলায়মান পয়গম্বরের মতো আমরা যদি পাখিদের ভাষা বুঝতে পারতাম, তাহলে জানা যেত, বাংলার কোকিলেরা ফাল্গুনে শুধু আনন্দেই ডাকে না, তারা মানুষের নির্মমতা, হিংসা ও বর্বরতার প্রতিবাদেও চিৎকার করে ওঠে।
সৈয়দ আবুল মকসুদ: গবেষক, প্রাবন্ধিক ও কলাম লেখক৷
No comments