সুবচন যখন নির্বাসনে, রাজনীতি তখন... by ড. মাহবুব উল্লাহ্
বাংলাদেশের
রাজনীতি থেকে সুবচন নির্বাসনে গেছে। রাজনীতিকদের তেতো কথা সমগ্র
জনগোষ্ঠীকে ত্যক্ত-বিরক্ত করে তুলেছে। গণতান্ত্রিক রাজনীতিতে মিষ্ট ভাষণের
কোনো বিকল্প নেই। গণতান্ত্রিক দেশে মতপার্থক্য থাকে, মতদ্বৈধতাও থাকে।
রাজনৈতিক সংস্কৃতি যখন উন্নত পর্যায়ে পৌঁছে তখন মতপার্থক্যের প্রকাশ ঘটে
বুদ্ধিদীপ্ত সমালোচনা এবং কখনও কখনও বিদ্রুপের ভাষায়। কিন্তু ভাষার মাধ্যমে
প্রতিপক্ষের প্রতি আক্রমণ কখনোই বিষবাষ্প ছড়ায় না। উন্নতমানের রাজনৈতিক
সংস্কৃতিতে রাজনীতিকরা প্রতিনিয়ত চেষ্টা করেন প্রতিপক্ষের দুর্বলতা ও
ভুল-ভ্রান্তিগুলোকে এমন ভাষায় তুলে ধরতে যার ফলে প্রতিপক্ষ জনগণের কাছে
বিদ্রুপের খোরাকে পরিণত হয়। রাজনৈতিক কালচারের সৌন্দর্যকে ধারণ করার জন্যই
সংসদীয় বিতর্কে সংসদীয় ভাষা ব্যবহারের চল হয়েছে। একজন সংসদ সদস্য অপর একজন
সংসদ সদস্যের বক্তব্যকে মিথ্যা বলে উল্লেখ করবেন না। এ রকম ক্ষেত্রে
মিথ্যার পরিবর্তে অসত্য কিংবা সত্যের অপলাপ ঘটানোর কথা বলা হয়ে থাকে।
সংসদীয় ভব্যতা রক্ষার স্বার্থে সংসদে যিনি উপস্থিত নেই কিংবা যিনি পরলোকগমন
করেছেন এমন ব্যক্তি সম্পর্কে অশোভন মন্তব্য করা থেকে বিরত থাকতে হয়। বিগত
বছরগুলোতে আমাদের সংসদে পরলোকগত ব্যক্তিদের সম্পর্কেও নানারকম অবাঞ্ছিত,
কুৎসিত বক্তব্য প্রদান করা হয়েছে। অথচ সেসব ব্যক্তির এ ধরনের কটুকথার জবাব
দেয়ার কোনো সুযোগই ছিল না। জিয়াউর রহমানের মতো মুক্তিযোদ্ধার সমালোচনা করতে
গিয়ে বলা হয়েছে, তিনি ছিলেন পাকিস্তানিদের চর এবং আইএসআইয়ের এজেন্ট। এ রকম
অশালীন মন্তব্যে জিয়াভক্তরা ক্ষুব্ধ হয়েছেন, কষ্ট পেয়েছেন। কিন্তু এ ধরনের
মন্তব্য যারা করলেন তারা নিজ দলের জন্য কতটুকু ফায়দা হাসিল করতে পেরেছেন
সে ব্যাপারে গভীর সন্দেহ রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য সংসদের বাইরে থেকে
বাংলাদেশের স্থপতি শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে প্রদত্ত অবাঞ্ছিত এবং
অরাজনৈতক বক্তব্য। যারা এভাবে বক্তব্য দেন তারা হয়তো মনে-প্রাণে বিশ্বাস
করেন তাদের অবস্থানটি সঠিক এবং সব ধরনের বিতর্কের ঊর্ধ্বে। কিন্তু তারা
বুঝতে চান না কিংবা বুঝতে পারেন না যে, এ ধরনের দায়িত্বহীন ও বলগাহীন
বক্তব্যের ফলে রাজনৈতিক বিভাজন তীব্র হয়ে ওঠে। বিভাজন যদি শুধু বিভাজনের
মধ্যেই সীমিত থাকত, তাহলে দুর্ভাবনার কারণ থাকলেও প্রচণ্ডভাবে উদ্বিগ্ন হতে
হতো না। কিন্তু সমস্যাটা হল বিভাজন থেকে সৃষ্টি হয় বিভাগের এবং বিভাগ থেকে
জন্ম নেয় সংঘাত ও সংঘর্ষ। এ সংঘাত ও সংঘর্ষ এতটাই প্রকট হয়ে উঠতে পারে যে,
এর ফলে দেশ গৃহযুদ্ধের মতো দুর্ভাগ্যজনক অবস্থায় নিপতিত হতে পারে।
রক্তপাত, প্রাণহানি অনিবার্য হয়ে উঠতে পারে। সেই অবস্থায় এ রকম
দুর্ভাগ্যজনক পরিস্থিতির রাশ টেনে ধরা মুশকিল হয়ে দাঁড়ায়। জাতির মধ্যে
পুনর্বার সদ্ভাব-সমঝোতা প্রতিষ্ঠা করা অসাধ্য সাধনের পর্যায়ে চলে যেতে
পারে।
রাজনীতিকরা আমাদের শিরোধার্য ব্যক্তি। তারা নেতৃত্ব দেন এবং জাতিকে এগিয়ে চলার পথনির্দেশনা দেন। একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে কঠিন কাজটি হল জাতি গঠন কিংবা রাষ্ট্র গঠন।
ঔপনিবেশিক শক্তিকে পরাস্ত করার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতি গঠিত হয়ে যায় না। এ পর্যায়ে রাজনীতিক বা নেতৃত্বের দায়িত্ব হল জাতির বিভিন্ন খণ্ডাংশকে ঐক্যবদ্ধ করা। তাদের সব অংশের মধ্যে এমন একটি মনোভাবের উজ্জীবন ঘটানো যাতে তারা ভাবতে শুরু করে একে অপরের জন্য তারা অপরিহার্য। এক অংশ থেকে অন্য অংশের দূরে চলে যাওয়ার মানে হল জাতির দুর্বল হওয়া, জাতির মধ্যে সুপ্ত সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা এবং কালক্রমে দুর্বল ও ম্রিয়মাণ হয়ে বহির্শক্তির করতলগত হওয়া। একটি জাতির জন্য এর চেয়ে অমঙ্গলজনক পরিস্থিতি আর কী হতে পারে? দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করছি, বাংলাদেশে এ রকম অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। শুনেছি জাপানিদের মধ্যে একটি চল আছে। এটি হারাকিরি নামে পরিচিত। নিজের ছুরি দিয়ে নিজেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়াকেই হারাকিরি বলা হয়। গত ক’মাসে দেশব্যাপী যেসব ঘটনা ঘটেছে তার জন্য যারাই দায়ী হোক না কেন, একে হারাকিরি না বলে আর কী বলা যায়? নীরদ চৌধুরী বাঙালিকে আত্মঘাতী বাঙালি বলে উল্লেখ করেছিলেন। অনেক বিদ্বতজনের দৃষ্টিতে নীরদ চৌধুরী ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি মানুষের চিন্তা ও ধারণার বিপরীত উচ্চারণ করে গর্ববোধ করতেন। এখন বাংলাদেশের অবস্থা দেখে মনে হয় বাঙালি নীরদ চৌধুরীর উক্তিকেই স্বপ্রমাণিত করছে।
আমাদের জাতীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাকিস্তান আমলেও রাজনীতিতে আপত্তিকর কথন হতো। পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি আমাদের তীব্র অপছন্দ সত্ত্বেও আপত্তিকর উক্তির তেমন প্রাবল্য দেখা যায় না। এর কারণ হয়তো এই যে, আমরা তখন যুক্তি ও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে চাইতাম আমাদের প্রতি কতভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। ১৯৬৬ সালের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুর রহমান তার ৬ দফার কর্মসূচি উত্থাপন করেছিলেন। এটাকে তিনি বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মহাশক্তিধর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। সামরিক শক্তির জোরেই তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে তিনি ৬ দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, 'He is using the weapon of language and we shall use the language of weapons?' অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান ভাষার অস্ত্র প্রয়োগ করছেন। কে না জানে তার বাগ্মিতা ছিল অসাধারণ। ৬ দফার পক্ষে তিনি যেভাবে তেজস্বিনী ভাষায় বক্তব্য রাখতেন, তাতে তার বাঙালি শ্রোতারা প্রচণ্ডভাবে উজ্জীবিত হতেন। কিন্তু আইয়ুব খান হুমকি দিলেন যে, তিনি অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করবেন। অর্থাৎ সশস্ত্র পন্থায় এ আন্দোলনকে তিনি দমন করবেন। লক্ষণীয় হল দমনের মতো কোনো শব্দ তিনি উলঙ্গভাবে ব্যবহার করেননি। অথচ ঠিকই দমনের ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ার জন্য তার এ রকম উচ্চারণই যথেষ্ট ছিল। আর এ উচ্চারণই পাকিস্তানকে অবধারিত ধ্বংসের মুখে নিয়ে গিয়েছিল। যে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির কথা তিনি বারবার উচ্চারণ করতেন, সেই পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি তার একটি দায়িত্বহীন উক্তির ফলে অবধারিতভাবে অনৈক্য ও সংহতিহীনতার বীজ বপন করেছিল। এটি মহীরুহে পরিণত হতে ৪ বছরের বেশি সময় লাগেনি। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ঘটল এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব হল। এক কথায় বলা যায় পাকিস্তানি জাতি গঠনের প্রকল্পটি ভেঙে তছনছ হয়ে গেল।
বাঙালিদের সম্পর্কে আইয়ুব খানের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল অশালীন ও আপত্তিকর। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ Friends not Masters-এ বাঙালিদের সম্পর্কে নানা বিরূপ মন্তব্য করেন। বাঙালিদের সম্পর্কে আইয়ুব খানের মূল্যায়ন তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব রাজনীতিকই তার এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই গেল। পাকস্তানের দুই অংশের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ আরও তীব্র আকার ধারণ করল। পাকিস্তানের একসময়কার প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাজনৈতিক বিরোধীদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘শির কুচাল দেঙ্গে’ অর্থাৎ বিরোধীদের শিরñেদ ঘটানো হবে। বাংলাদেশের এখনকার রাজনীতিতে প্রায় একই ধরনের ভয়াবহ উক্তি উচ্চারিত হতে দেখে প্রমাদ না গুনে পারি না। পত্রিকায় পড়লাম, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া, আপনার রাজনীতির মৃত্যু হয়েছে। এখন মানুষ হত্যার দায় নিয়ে বাকি দিনগুলো আপনাকে কারাগারে কাটাতে হবে। কারাগারে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ক্ষণ গুনতে থাকুন। অবরোধ ও হরতালের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারা শুরুর পর থেকেই আপনার রাজনীতির মৃত্যু হয়েছে।’ বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কটি মামলা হয়েছে, এগুলোর কয়েকটিতে তাকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। আইনি মারপ্যাঁচের আলোচনায় আমি যাব না। কারণ আইন ব্যবসা আমার পেশা নয়। আইনশাস্ত্র সম্পর্কে আমার তেমন কোনো জ্ঞানও নেই। তবে প্রাচীন রোমের আইন বিশেষজ্ঞ সিসারোর লেখা পড়েছি নিছক জ্ঞানচর্চার আনন্দ থেকে। বেগম জিয়াকে চিরকাল কারাগারে কাটাতে হবে কিনা সেটা নির্ধারণের দায়িত্ব আদালতের। আদালতের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে না দিয়ে আগাম এমন সব মন্তব্য করা কার্যত আদালতকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার শামিল। যিনি বা যে পক্ষই হোক না কেন, দলমত নির্বিশেষে সবাই যদি এ ধরনের দায়িত্বহীন মন্তব্য থেকে বিরত থাকেন এবং কিছুটা ধৈর্য ধারণ করেন তাহলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশেরই মঙ্গল হবে। ব্যক্তি হিসেবে খালেদা জিয়ার কী হবে তার চেয়েও অনেক বড় কথা হল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কী হবে? আমরা যেন বাংলাদেশের কল্যাণ ও মঙ্গলের কথা ভুলে না যাই।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
রাজনীতিকরা আমাদের শিরোধার্য ব্যক্তি। তারা নেতৃত্ব দেন এবং জাতিকে এগিয়ে চলার পথনির্দেশনা দেন। একটি দেশ স্বাধীন হওয়ার পর সবচেয়ে কঠিন কাজটি হল জাতি গঠন কিংবা রাষ্ট্র গঠন।
ঔপনিবেশিক শক্তিকে পরাস্ত করার মাধ্যমে স্বয়ংক্রিয়ভাবে জাতি গঠিত হয়ে যায় না। এ পর্যায়ে রাজনীতিক বা নেতৃত্বের দায়িত্ব হল জাতির বিভিন্ন খণ্ডাংশকে ঐক্যবদ্ধ করা। তাদের সব অংশের মধ্যে এমন একটি মনোভাবের উজ্জীবন ঘটানো যাতে তারা ভাবতে শুরু করে একে অপরের জন্য তারা অপরিহার্য। এক অংশ থেকে অন্য অংশের দূরে চলে যাওয়ার মানে হল জাতির দুর্বল হওয়া, জাতির মধ্যে সুপ্ত সম্ভাবনাকে নস্যাৎ করা এবং কালক্রমে দুর্বল ও ম্রিয়মাণ হয়ে বহির্শক্তির করতলগত হওয়া। একটি জাতির জন্য এর চেয়ে অমঙ্গলজনক পরিস্থিতি আর কী হতে পারে? দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ করছি, বাংলাদেশে এ রকম অনাকাক্সিক্ষত পরিস্থিতি ক্রমেই অবনতির দিকে ধাবিত হচ্ছে। শুনেছি জাপানিদের মধ্যে একটি চল আছে। এটি হারাকিরি নামে পরিচিত। নিজের ছুরি দিয়ে নিজেই আত্মহননের পথ বেছে নেয়াকেই হারাকিরি বলা হয়। গত ক’মাসে দেশব্যাপী যেসব ঘটনা ঘটেছে তার জন্য যারাই দায়ী হোক না কেন, একে হারাকিরি না বলে আর কী বলা যায়? নীরদ চৌধুরী বাঙালিকে আত্মঘাতী বাঙালি বলে উল্লেখ করেছিলেন। অনেক বিদ্বতজনের দৃষ্টিতে নীরদ চৌধুরী ছিলেন এমন একজন মানুষ যিনি মানুষের চিন্তা ও ধারণার বিপরীত উচ্চারণ করে গর্ববোধ করতেন। এখন বাংলাদেশের অবস্থা দেখে মনে হয় বাঙালি নীরদ চৌধুরীর উক্তিকেই স্বপ্রমাণিত করছে।
আমাদের জাতীয় ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, পাকিস্তান আমলেও রাজনীতিতে আপত্তিকর কথন হতো। পশ্চিম পাকিস্তানিদের প্রতি আমাদের তীব্র অপছন্দ সত্ত্বেও আপত্তিকর উক্তির তেমন প্রাবল্য দেখা যায় না। এর কারণ হয়তো এই যে, আমরা তখন যুক্তি ও তথ্য দিয়ে প্রমাণ করতে চাইতাম আমাদের প্রতি কতভাবে বৈষম্যমূলক আচরণ করা হয়েছে। ১৯৬৬ সালের প্রথমদিকে শেখ মুজিবুর রহমান তার ৬ দফার কর্মসূচি উত্থাপন করেছিলেন। এটাকে তিনি বাঙালির বাঁচার দাবি হিসেবে উল্লেখ করেছিলেন। তখন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ছিলেন মহাশক্তিধর ফিল্ড মার্শাল আইয়ুব খান। সামরিক শক্তির জোরেই তিনি পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তান সফরে এসে তিনি ৬ দফার প্রবক্তা শেখ মুজিবুর রহমান সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, 'He is using the weapon of language and we shall use the language of weapons?' অর্থাৎ শেখ মুজিবুর রহমান ভাষার অস্ত্র প্রয়োগ করছেন। কে না জানে তার বাগ্মিতা ছিল অসাধারণ। ৬ দফার পক্ষে তিনি যেভাবে তেজস্বিনী ভাষায় বক্তব্য রাখতেন, তাতে তার বাঙালি শ্রোতারা প্রচণ্ডভাবে উজ্জীবিত হতেন। কিন্তু আইয়ুব খান হুমকি দিলেন যে, তিনি অস্ত্রের ভাষা প্রয়োগ করবেন। অর্থাৎ সশস্ত্র পন্থায় এ আন্দোলনকে তিনি দমন করবেন। লক্ষণীয় হল দমনের মতো কোনো শব্দ তিনি উলঙ্গভাবে ব্যবহার করেননি। অথচ ঠিকই দমনের ব্যাপারটি বুঝিয়ে দিয়েছিলেন। গণমাধ্যমের শিরোনাম হওয়ার জন্য তার এ রকম উচ্চারণই যথেষ্ট ছিল। আর এ উচ্চারণই পাকিস্তানকে অবধারিত ধ্বংসের মুখে নিয়ে গিয়েছিল। যে পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতির কথা তিনি বারবার উচ্চারণ করতেন, সেই পাকিস্তানের ঐক্য ও সংহতি তার একটি দায়িত্বহীন উক্তির ফলে অবধারিতভাবে অনৈক্য ও সংহতিহীনতার বীজ বপন করেছিল। এটি মহীরুহে পরিণত হতে ৪ বছরের বেশি সময় লাগেনি। ১৯৭১-এর মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানের পরাজয় ঘটল এবং স্বাধীন বাংলাদেশ রাষ্ট্রের উদ্ভব হল। এক কথায় বলা যায় পাকিস্তানি জাতি গঠনের প্রকল্পটি ভেঙে তছনছ হয়ে গেল।
বাঙালিদের সম্পর্কে আইয়ুব খানের দৃষ্টিভঙ্গিও ছিল অশালীন ও আপত্তিকর। তিনি তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ Friends not Masters-এ বাঙালিদের সম্পর্কে নানা বিরূপ মন্তব্য করেন। বাঙালিদের সম্পর্কে আইয়ুব খানের মূল্যায়ন তাদের মধ্যে প্রচণ্ড ক্ষোভের সৃষ্টি করে। তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানের প্রায় সব রাজনীতিকই তার এ বক্তব্য প্রত্যাখ্যান করেছিলেন। কিন্তু ক্ষতি যা হওয়ার তা হয়েই গেল। পাকস্তানের দুই অংশের মধ্যে ঘৃণা ও বিদ্বেষ আরও তীব্র আকার ধারণ করল। পাকিস্তানের একসময়কার প্রধানমন্ত্রী লিয়াকত আলী খান রাজনৈতিক বিরোধীদের সম্পর্কে মন্তব্য করেছিলেন, ‘শির কুচাল দেঙ্গে’ অর্থাৎ বিরোধীদের শিরñেদ ঘটানো হবে। বাংলাদেশের এখনকার রাজনীতিতে প্রায় একই ধরনের ভয়াবহ উক্তি উচ্চারিত হতে দেখে প্রমাদ না গুনে পারি না। পত্রিকায় পড়লাম, বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়াকে উদ্দেশ করে আওয়ামী লীগের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মাহবুবউল আলম হানিফ বলেছেন, ‘বেগম খালেদা জিয়া, আপনার রাজনীতির মৃত্যু হয়েছে। এখন মানুষ হত্যার দায় নিয়ে বাকি দিনগুলো আপনাকে কারাগারে কাটাতে হবে। কারাগারে যাওয়ার জন্য মানসিক প্রস্তুতি নিয়ে ক্ষণ গুনতে থাকুন। অবরোধ ও হরতালের নামে মানুষ পুড়িয়ে মারা শুরুর পর থেকেই আপনার রাজনীতির মৃত্যু হয়েছে।’ বেগম খালেদা জিয়ার বিরুদ্ধে বেশ কটি মামলা হয়েছে, এগুলোর কয়েকটিতে তাকে হুকুমের আসামি করা হয়েছে। আইনি মারপ্যাঁচের আলোচনায় আমি যাব না। কারণ আইন ব্যবসা আমার পেশা নয়। আইনশাস্ত্র সম্পর্কে আমার তেমন কোনো জ্ঞানও নেই। তবে প্রাচীন রোমের আইন বিশেষজ্ঞ সিসারোর লেখা পড়েছি নিছক জ্ঞানচর্চার আনন্দ থেকে। বেগম জিয়াকে চিরকাল কারাগারে কাটাতে হবে কিনা সেটা নির্ধারণের দায়িত্ব আদালতের। আদালতের মাধ্যমে আইনি প্রক্রিয়াকে স্বাভাবিক গতিতে চলতে না দিয়ে আগাম এমন সব মন্তব্য করা কার্যত আদালতকে রাজনৈতিকভাবে প্রভাবিত করার শামিল। যিনি বা যে পক্ষই হোক না কেন, দলমত নির্বিশেষে সবাই যদি এ ধরনের দায়িত্বহীন মন্তব্য থেকে বিরত থাকেন এবং কিছুটা ধৈর্য ধারণ করেন তাহলে শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশেরই মঙ্গল হবে। ব্যক্তি হিসেবে খালেদা জিয়ার কী হবে তার চেয়েও অনেক বড় কথা হল দেশ হিসেবে বাংলাদেশের কী হবে? আমরা যেন বাংলাদেশের কল্যাণ ও মঙ্গলের কথা ভুলে না যাই।
ড. মাহবুব উল্লাহ : অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়
No comments