ভারত-চীন সম্পর্ক ও দক্ষিণ এশিয়ার রাজনীতি by তারেক শামসুর রেহমান
গেল
সেপ্টেম্বরে চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফর এবং আহমেদাবাদ বিমানবন্দরে স্বয়ং
প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি কর্তৃক তাকে অভ্যর্থনা প্রদানের ঘটনা
পঞ্চাশের দশকের দু’দেশের সম্পর্কের কথা মনে করিয়ে দিলেও অতি সম্প্রতি
অরুনাচল প্রদেশ নিয়ে দু’দেশের আস্থার সম্পর্কে কিছুটা ঘাটতি দেখা দিয়েছে।
গত ২০ ফেব্র“য়ারি প্রধানমন্ত্রী মোদি অরুনাচল সফর করেন। সেখানে তিনি রেলপথ ও
বিদ্যুৎ কেন্দ্র উদ্বোধন করেন। এর প্রতিবাদ জানিয়েছে চীন। টাইমস অব
ইন্ডিয়ার খবরে বলা হয়েছে প্রধানমন্ত্রী মোদির অরুনাচল সফরকে সমালোচনা করে
চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় একটি বিবৃতি প্রকাশ করে। পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে দেয়া ওই বিবৃতিতে বলা হয়, চীনা সরকার কখনোই অরুনাচল
প্রদেশকে স্বীকৃতি দেয়নি। বেইজিংয়ের মতে চীনের অন্তর্গত তিব্বতের মনিয়ুল,
লোয়ুল ও নিু সায়ুল এলাকা নিয়ে ‘তথাকথিত অরুনাচল’ প্রদেশ গড়েছে নয়াদিল্লি।
ওই এলাকাগুলো এখনও ভারতের ‘অবৈধ দখলদারির’ কবলে রয়েছে। চীনের পররাষ্ট্র
মন্ত্রণালয়ের এ অভিমত সঙ্গত কারণেই দু’দেশের সম্পর্কের ওপর প্রভাব ফেলবে।
অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, কিছুদিন আগে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুমিও কিসিদা ভারতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি অরুনাচল প্রদেশ যে ভারতের সে ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিসিদার ওই বক্তব্যে চীন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। চীন মনে করে, ভারত জাপানকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। আগামী মে মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদি চীন সফরে যাবেন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি প্রথম সফরে ভুটান গিয়েছিলেন। ওই সময় সেখানে চীনবিরোধী বক্তব্যও তিনি দিয়েছিলেন। চীন এখন পর্যন্ত ভুটানে তার দূতাবাস খোলার অনুমতি পায়নি শুধু ভারতের আপত্তির কারণে। নয়া পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকর তার দক্ষিণ এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ভুটান হয়ে ২ মার্চ ঢাকায় এসেছেন। এরপর যাবেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে।
ইতিমধ্যে ওবামার ভারত সফর (২৫ জানুয়ারি ২০১৫) এ অঞ্চলে নতুন এক মেরুকরণের জন্ম দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এ মেরুকরণ কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল তথা ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। এ দুটি অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ‘সামরিক তৎপরতা’ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক ঐক্য গঠিত হয়েছে। উদ্দেশ্য চীনের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। অন্যদিকে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীন তার নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে অ্যারাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। কারণ এটি তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। এদিকে ভারতও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতের নৌবাহিনীর ‘নিউ ইস্টার্ন ফ্লিটে’ যুক্ত হয়েছে বিমানবাহী জাহাজ। রয়েছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। আন্দামান ও নিকোবরে রয়েছে তাদের ঘাঁটি। ফলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চীন ও ভারতের মধ্যে রয়েছে। এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে চীন ও ভারতের অবস্থান এখন অনেকটা পরস্পরবিরোধী। যেখানে চীনা নেতৃত্ব একটি নয়া ‘মেরিটাইম সিল্ক রুটের’ কথা বলছে, সেখানে মোদি সরকার বলছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোরের’ কথা। স্বার্থ মূলত এক ও অভিন্ন- এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর এ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এশিয়ার এ দুটি বড় দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এটাকেই কাজে লাগাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
একসময় মার্কিন গবেষকরা একটি সম্ভাব্য চীন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা বলেছিলেন। জনাথন হোলসলাগ ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ঈযরহফরধ-র (অর্থাৎ চীন-ভারত) ধারণা দিয়েছিলেন। নয়া চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের (২০১৪) পর ধারণা করা হচ্ছিল, দেশ দুটি আরও কাছাকাছি আসবে। কিন্তু শ্রীলংকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা, ওবামার ভারত সফর এবং চীনা প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে এ সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। নতুন আঙ্গিকে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ ধারণা আবার ফিরে এসেছে। এ ডকট্রিন মনরো ডকট্রিনের দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কারও কর্তৃত্ব ভারত স্বীকার করে নেবে না। একসময় এ এলাকা, অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা ঘিরে ‘প্রিমাকভ ডকট্রিনের’ (২০০৭ সালে রচিত। শ্রীলংকা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে ঐক্য) যে ধারণা ছিল, শ্রীলংকায় সিরিসেনার বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণা এখন আর কাজ করবে না। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী ধারণাকে আরও শক্তিশালী করতে বিসিআইএমে’র (বাংলাদেশ, চীনের ইউনান রাজ্য, ভারতের সাত বোন, মিয়ানমার) প্রতি যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে এখন শ্লথগতি আসতে পারে। সামরিক ও অর্থনেতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত এখন আর বিসিআইএম ধারণাকে প্রমোট করবে না। আর বাংলাদেশের একার পক্ষে চীন ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে বিসিএম ধারণাকে এগিয়ে নেয়াও সম্ভব হবে না।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, ওবামার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে ভারত নানাভাবে লাভবান হয়েছে। ‘পাক্বা গুজরাতি’ নরেন্দ্র মোদি জাতিগতভাবেই ব্যবসা বোঝেন। ১২১ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত। জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ ভাগ মানুষ অতিদরিদ্র, অর্ধেক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নেই, ৩১ ভাগ মানুষের দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে (যা জাতিসংঘ নির্ধারিত অতি দরিদ্রের মানদণ্ড)। ভারতে প্রতি তিনজনের একজন দরিদ্র। প্রতিদিন মারা যায় ৫ হাজার শিশু। আর কন্যা শিশুর ভ্রুণ হত্যা করার কাহিনী তো অনেক পুরনো। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছিল, ভারতে ১ লাখ ৮৩ হাজার কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে গত ১০ বছরে আÍহত্যা করেছে। এখানে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন মোদি। তার পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানো। আর বিনিয়োগ বাড়াতেই তিনি চীনা ও মার্কিন বিনিয়োগকারীদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। স্বভাবতই ভারতে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। দারিদ্র্য কমবে। যদি বৈষম্য কমিয়ে আনা যায়, তাহলে ভারত আরও এগিয়ে যাবে। মোদির স্বার্থ এখানেই।
তবে একটা ভয়ের কারণ আছে- চিরবৈরী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা। ওবামার ভারত সফরের পরপরই ভারত পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য মিসাইল অগ্নি-৫ উৎক্ষেপণ করে। এ অগ্নি-৫-এর ব্যাপ্তি সুদূর চীন পর্যন্ত। ভারত এখন আর পাকিস্তানকে বিবেচনায় নিচ্ছে না। ভারতের টার্গেট চীন। অর্থাৎ চীনের কর্তৃত্ব কমানো। অগ্নি-৫ নিক্ষেপের পরদিনই পাকিস্তান তার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘রাদ’ বা ‘ব্রজে’র পরীক্ষা চালায়। এর আগে পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। ফলে দেশ দুটি আবারও এক ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষায় নিয়োজিত হয়। মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানের গুরুত্ব কম। যদিও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল দু’দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। ইতিমধ্যে তিনি ভুটান ও নেপাল সফর করেছেন। এ মার্চেই তিনি যাবেন শ্রীলংকায়। সেখানে তিনি জাফনাতেও যাবেন। মার্চে বাংলাদেশে আসতে পারেন। চীনকে গুরুত্ব দেয়ার পেছনে কাজ করছে তার বাণিজ্যিক নীতি। তিনি চান বিনিয়োগ। তবে চূড়ান্ত বিচারে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। তবে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোই হবে মোদি সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার।
মোদির পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, মোদি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছেন। একদিকে চীন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গেও সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক রক্ষা করে মোদি তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন। রাশিয়া থেকে তিনি অস্ত্র কিনছেন। ইউক্রেন ইস্যুতে তিনি রাশিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করেছেন (এ প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থানও অনেকটা ভারতের মতো)। রাশিয়া ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে ভারত ব্রিকস ব্যাংক গড়ে তুলছে, যা হবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প আরেকটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক। বাংলাদেশও এ ব্যাংকের ব্যাপারে আগ্রহী। সুষমা স্বরাজের বেইজিং সফরের সময় সেখানে ত্রিদেশীয় একটি ‘মিনি সামিট’ হয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সেখানে মিলিত হয়েছেন। ফলে বোঝাই যায়, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের সামরিক ও পারমাণবিক সম্পর্ক গড়ে তুললেও চীন ও রাশিয়াকেও কাছে রাখতে চায়। আগামী দিনগুলোয় স্পষ্ট হবে এ সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়।
একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি- চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করবে। সঙ্গত কারণেই বিশ্বের বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ থাকবে এ অঞ্চলের ব্যাপারে। যদিও জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টারও যুক্তরাষ্ট্র। জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে), তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। এদিকে চীনের নয়া প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং যে নতুন সিল্ক রুটের কথা বলছেন, তা অন্য চোখে দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এতে করে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃত্ব, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এই ‘সিল্ক রোড’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ রোডের মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের নয়া প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি ‘মেরিটাইম সিল্ক রুটের’ কথাও আমরা জানি, যা কি-না চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ মেরিটাইম সিল্ক রুটের ধারণাও কয়েকশ’ বছর আগের। এ মেরিটাইম সিল্ক রুট ধরে চীনা অ্যাডমিরাল ঝেং হে (মা হে) ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল- এই ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহসাগরে চীনা পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৪২১-১৪৩১ সালে তিনি দু’বার বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে এসেছিলেন। চীন এ নৌরুটটি নতুন করে আবার ব্যবহার করতে চায়।
তবে কয়েকশ’ বছরের ব্যবধানে এ অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। চীন আর একক শক্তি নয়। ভারত তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়েই তার নিজের স্বার্থ আদায় করতে চায়। ফলে এটা স্পষ্ট নয় ভারত-চীন সম্পর্ক আগামীতে কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হবে। কারণ ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এ স্বার্থ যদি পরস্পরবিরোধী হয়, তাহলে সংঘর্ষ অনিবার্য। মে মাসে মোদির চীন সফরের আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান কৈলাসের যাত্রা সহজ করতে চায় ভারত। চীন এ ব্যাপারে নমনীয় হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এখন কৈলাসে যেতে হয় উত্তরাঞ্চলের কাঠগোদাম থেকে হেঁটে। এটা কষ্টদায়ক ও পথটি দুর্গম। পথটিও দীর্ঘ। অথচ কৈলাসে গাড়িতে করে যাওয়া সম্ভব। গ্যাংটকের পাশেই নাথুলা। রাস্তাও ভালো চীনের দিকে। চীন অনুমতি দিলে গাড়িতে করেই তীর্থযাত্রীরা কৈলাসে যেতে পারবেন। মোদি নিজেও এ পথে কৈলাস যেতে চান। সুতরাং দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা প্রভাব কমাতে মোদির উদ্যোগ এবং চীনের ব্যাপারে মোদির ব্যক্তিগত আগ্রহ- এ দু’য়ের মধ্য দিয়ে আস্থার সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
অনেকেই স্মরণ করতে পারেন, কিছুদিন আগে জাপানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ফুমিও কিসিদা ভারতে এসেছিলেন। সেখানে তিনি অরুনাচল প্রদেশ যে ভারতের সে ব্যাপারে বক্তব্য দিয়েছিলেন। কিসিদার ওই বক্তব্যে চীন ব্যাপক প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছিল। চীন মনে করে, ভারত জাপানকে চীনের বিরুদ্ধে ব্যবহার করছে। আগামী মে মাসে প্রধানমন্ত্রী মোদি চীন সফরে যাবেন। সাম্প্রতিক সময়গুলোতে দক্ষিণ এশিয়ায় ভারতের প্রভাব ও কর্তৃত্ব বাড়ছে। মোদি তার পররাষ্ট্রনীতিতে দক্ষিণ এশিয়াকে অগ্রাধিকার তালিকায় রেখেছেন। দায়িত্ব নেয়ার পর তিনি প্রথম সফরে ভুটান গিয়েছিলেন। ওই সময় সেখানে চীনবিরোধী বক্তব্যও তিনি দিয়েছিলেন। চীন এখন পর্যন্ত ভুটানে তার দূতাবাস খোলার অনুমতি পায়নি শুধু ভারতের আপত্তির কারণে। নয়া পররাষ্ট্র সচিব জয়শংকর তার দক্ষিণ এশিয়া সফরের অংশ হিসেবে ভুটান হয়ে ২ মার্চ ঢাকায় এসেছেন। এরপর যাবেন পাকিস্তান ও আফগানিস্তানে।
ইতিমধ্যে ওবামার ভারত সফর (২৫ জানুয়ারি ২০১৫) এ অঞ্চলে নতুন এক মেরুকরণের জন্ম দিয়েছে। ভারতের পররাষ্ট্রনীতিতে এ মেরুকরণ কিছুটা হলেও প্রভাব ফেলবে। এশিয়া-প্যাসিফিক অঞ্চল তথা ভারত মহাসাগর আগামী দিনে প্রত্যক্ষ করবে এক ধরনের প্রভাব বিস্তারের প্রতিযোগিতা। এ দুটি অঞ্চলে সাম্প্রতিক সময়ে বেশ কিছু ‘সামরিক তৎপরতা’ লক্ষ্য করা যাচ্ছে। দক্ষিণ চীন সাগরে যুক্তরাষ্ট্র, জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সমন্বয়ে একটি সামরিক ঐক্য গঠিত হয়েছে। উদ্দেশ্য চীনের ওপর ‘চাপ’ প্রয়োগ করা। অন্যদিকে ভারত মহাসাগর অঞ্চলে চীন তার নৌবাহিনীর তৎপরতা বাড়িয়েছে। দক্ষিণ চীন সাগর থেকে মালাক্কা প্রণালী হয়ে ভারত মহাসাগর অতিক্রম করে অ্যারাবিয়ান গালফ পর্যন্ত যে সমুদ্রপথ, তার নিয়ন্ত্রণ নিতে চায় চীন। কারণ এটি তার জ্বালানি সরবরাহের পথ। চীনের জ্বালানি চাহিদা প্রচুর। এদিকে ভারতও ভারত মহাসাগরে তার কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে চায়। ভারতের নৌবাহিনীর ‘নিউ ইস্টার্ন ফ্লিটে’ যুক্ত হয়েছে বিমানবাহী জাহাজ। রয়েছে পারমাণবিক শক্তিচালিত সাবমেরিন। আন্দামান ও নিকোবরে রয়েছে তাদের ঘাঁটি। ফলে এক ধরনের প্রতিযোগিতা চীন ও ভারতের মধ্যে রয়েছে। এশিয়া-প্যাসিফিক ও দক্ষিণ এশিয়ার কর্তৃত্ব নিয়ে চীন ও ভারতের অবস্থান এখন অনেকটা পরস্পরবিরোধী। যেখানে চীনা নেতৃত্ব একটি নয়া ‘মেরিটাইম সিল্ক রুটের’ কথা বলছে, সেখানে মোদি সরকার বলছে ‘ইন্দো-প্যাসিফিক ইকোনমিক করিডোরের’ কথা। স্বার্থ মূলত এক ও অভিন্ন- এ অঞ্চলে কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করা। আর এ কর্তৃত্ব প্রতিষ্ঠা করতে গিয়ে এশিয়ার এ দুটি বড় দেশের মধ্যে দ্বন্দ্ব অনিবার্য হয়ে উঠেছে। এটাকেই কাজে লাগাতে চায় যুক্তরাষ্ট্র।
একসময় মার্কিন গবেষকরা একটি সম্ভাব্য চীন-ভারত অ্যালায়েন্সের কথা বলেছিলেন। জনাথন হোলসলাগ ‘ফরেন পলিসি’ ম্যাগাজিনে প্রকাশিত এক প্রবন্ধে ঈযরহফরধ-র (অর্থাৎ চীন-ভারত) ধারণা দিয়েছিলেন। নয়া চীনা প্রেসিডেন্টের ভারত সফরের (২০১৪) পর ধারণা করা হচ্ছিল, দেশ দুটি আরও কাছাকাছি আসবে। কিন্তু শ্রীলংকার অভ্যন্তরীণ রাজনীতিতে ভারতের ভূমিকা, ওবামার ভারত সফর এবং চীনা প্রেসিডেন্টের প্রতিক্রিয়া দেখে মনে হচ্ছে এ সম্ভাবনা এখন ক্ষীণ। নতুন আঙ্গিকে ‘ইন্ডিয়া ডকট্রিনের’ ধারণা আবার ফিরে এসেছে। এ ডকট্রিন মনরো ডকট্রিনের দক্ষিণ এশীয় সংস্করণ। অর্থাৎ দক্ষিণ এশিয়ায় অন্য কারও কর্তৃত্ব ভারত স্বীকার করে নেবে না। একসময় এ এলাকা, অর্থাৎ ভারত মহাসাগরীয় এলাকা ঘিরে ‘প্রিমাকভ ডকট্রিনের’ (২০০৭ সালে রচিত। শ্রীলংকা, চীন, ইরান ও রাশিয়ার মধ্যে ঐক্য) যে ধারণা ছিল, শ্রীলংকায় সিরিসেনার বিজয়ের সঙ্গে সঙ্গে এ ধারণা এখন আর কাজ করবে না। ফলে বাংলাদেশ তার পূর্বমুখী ধারণাকে আরও শক্তিশালী করতে বিসিআইএমে’র (বাংলাদেশ, চীনের ইউনান রাজ্য, ভারতের সাত বোন, মিয়ানমার) প্রতি যে আগ্রহ দেখিয়েছিল, তাতে এখন শ্লথগতি আসতে পারে। সামরিক ও অর্থনেতিক নিরাপত্তার প্রশ্নে ভারত এখন আর বিসিআইএম ধারণাকে প্রমোট করবে না। আর বাংলাদেশের একার পক্ষে চীন ও মিয়ানমারকে সঙ্গে নিয়ে বিসিএম ধারণাকে এগিয়ে নেয়াও সম্ভব হবে না।
তবে এটা স্বীকার করতেই হবে, ওবামার ভারত সফরের মধ্য দিয়ে ভারত নানাভাবে লাভবান হয়েছে। ‘পাক্বা গুজরাতি’ নরেন্দ্র মোদি জাতিগতভাবেই ব্যবসা বোঝেন। ১২১ কোটি জনসংখ্যার দেশ ভারত। জনগোষ্ঠীর প্রায় ৩০ ভাগ মানুষ অতিদরিদ্র, অর্ধেক জনগোষ্ঠীর স্বাস্থ্যসম্মত শৌচাগার নেই, ৩১ ভাগ মানুষের দৈনিক আয় ১ দশমিক ২৫ সেন্টের নিচে (যা জাতিসংঘ নির্ধারিত অতি দরিদ্রের মানদণ্ড)। ভারতে প্রতি তিনজনের একজন দরিদ্র। প্রতিদিন মারা যায় ৫ হাজার শিশু। আর কন্যা শিশুর ভ্রুণ হত্যা করার কাহিনী তো অনেক পুরনো। সংবাদপত্রে প্রকাশিত এক সংবাদে বলা হয়েছিল, ভারতে ১ লাখ ৮৩ হাজার কৃষক ঋণ পরিশোধ করতে না পেরে গত ১০ বছরে আÍহত্যা করেছে। এখানে পরিবর্তন আনতে চাচ্ছেন মোদি। তার পররাষ্ট্রনীতির মূল কথা হচ্ছে বিনিয়োগ বাড়ানো। আর বিনিয়োগ বাড়াতেই তিনি চীনা ও মার্কিন বিনিয়োগকারীদের দিকে হাত বাড়িয়েছেন। স্বভাবতই ভারতে বিদেশী বিনিয়োগ বাড়লে কর্মসংস্থান বাড়বে। দারিদ্র্য কমবে। যদি বৈষম্য কমিয়ে আনা যায়, তাহলে ভারত আরও এগিয়ে যাবে। মোদির স্বার্থ এখানেই।
তবে একটা ভয়ের কারণ আছে- চিরবৈরী দুই দেশ ভারত ও পাকিস্তানের মধ্যে পারমাণবিক অস্ত্র প্রতিযোগিতা। ওবামার ভারত সফরের পরপরই ভারত পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য মিসাইল অগ্নি-৫ উৎক্ষেপণ করে। এ অগ্নি-৫-এর ব্যাপ্তি সুদূর চীন পর্যন্ত। ভারত এখন আর পাকিস্তানকে বিবেচনায় নিচ্ছে না। ভারতের টার্গেট চীন। অর্থাৎ চীনের কর্তৃত্ব কমানো। অগ্নি-৫ নিক্ষেপের পরদিনই পাকিস্তান তার পারমাণবিক ক্ষেপণাস্ত্র ‘রাদ’ বা ‘ব্রজে’র পরীক্ষা চালায়। এর আগে পাকিস্তান পারমাণবিক বোমা বহনযোগ্য ক্ষেপণাস্ত্রের পরীক্ষা চালিয়েছিল। ফলে দেশ দুটি আবারও এক ধরনের পারমাণবিক অস্ত্র পরীক্ষায় নিয়োজিত হয়। মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানের গুরুত্ব কম। যদিও শপথগ্রহণ অনুষ্ঠানে পাক প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফের উপস্থিতি দেখে মনে হয়েছিল দু’দেশের সম্পর্ক ঘনিষ্ঠতর হবে। কিন্তু দেখা যাচ্ছে, মোদির পররাষ্ট্রনীতিতে পাকিস্তানকে বাদ দিয়ে দক্ষিণ এশিয়ার অন্যান্য দেশ গুরুত্ব পাচ্ছে বেশি। ইতিমধ্যে তিনি ভুটান ও নেপাল সফর করেছেন। এ মার্চেই তিনি যাবেন শ্রীলংকায়। সেখানে তিনি জাফনাতেও যাবেন। মার্চে বাংলাদেশে আসতে পারেন। চীনকে গুরুত্ব দেয়ার পেছনে কাজ করছে তার বাণিজ্যিক নীতি। তিনি চান বিনিয়োগ। তবে চূড়ান্ত বিচারে চীনের সঙ্গে তার সম্পর্ক কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়, তা এ মুহূর্তে বোঝা যাচ্ছে না। তবে এ অঞ্চলে চীনের প্রভাব কমানোই হবে মোদি সরকারের এক নম্বর অগ্রাধিকার।
মোদির পররাষ্ট্রনীতি পর্যালোচনা করে বলা যায়, মোদি একটি ভারসাম্যমূলক পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করছেন। একদিকে চীন, অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র। এমনকি রাশিয়ার সঙ্গেও সমমর্যাদাভিত্তিক সম্পর্ক রক্ষা করে মোদি তার পররাষ্ট্রনীতি পরিচালনা করছেন। রাশিয়া থেকে তিনি অস্ত্র কিনছেন। ইউক্রেন ইস্যুতে তিনি রাশিয়ার অবস্থানকে সমর্থন করেছেন (এ প্রশ্নে বাংলাদেশের অবস্থানও অনেকটা ভারতের মতো)। রাশিয়া ও চীনকে সঙ্গে নিয়ে ভারত ব্রিকস ব্যাংক গড়ে তুলছে, যা হবে বিশ্বব্যাংকের বিকল্প আরেকটি আন্তর্জাতিক ব্যাংক। বাংলাদেশও এ ব্যাংকের ব্যাপারে আগ্রহী। সুষমা স্বরাজের বেইজিং সফরের সময় সেখানে ত্রিদেশীয় একটি ‘মিনি সামিট’ হয়েছে। চীন, রাশিয়া ও ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা সেখানে মিলিত হয়েছেন। ফলে বোঝাই যায়, ভারত যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বড় ধরনের সামরিক ও পারমাণবিক সম্পর্ক গড়ে তুললেও চীন ও রাশিয়াকেও কাছে রাখতে চায়। আগামী দিনগুলোয় স্পষ্ট হবে এ সম্পর্ক কোন পর্যায়ে উন্নীত হয়।
একুশ শতক হবে এশিয়ার। তিনটি বড় অর্থনৈতিক শক্তি- চীন, জাপান ও ভারতের মধ্যকার সম্পর্ক একুশ শতকের রাজনীতির গতি-প্রকৃতি নির্ধারণ করবে। সঙ্গত কারণেই বিশ্বের বৃহৎ শক্তি হিসেবে যুক্তরাষ্ট্রের আগ্রহ থাকবে এ অঞ্চলের ব্যাপারে। যদিও জাপানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের সম্পর্ক ঐতিহাসিক। জাপানের নিরাপত্তার গ্যারান্টারও যুক্তরাষ্ট্র। জাপানে যুক্তরাষ্ট্রের ঘাঁটি রয়েছে। একই কথা প্রযোজ্য ফিলিপাইনের ক্ষেত্রেও। ফলে এ অঞ্চলে চীনের সঙ্গে যে বিবাদ (জাপান ও ফিলিপাইনের সঙ্গে), তাতে যুক্তরাষ্ট্র একটি পক্ষ নিয়েছে। এদিকে চীনের নয়া প্রেসিডেন্ট শি জেন পিং যে নতুন সিল্ক রুটের কথা বলছেন, তা অন্য চোখে দেখছে ভারত ও যুক্তরাষ্ট্র। যুক্তরাষ্ট্রের নীতিনির্ধারকদের ধারণা, এতে করে বিশাল এক এলাকাজুড়ে চীনা কর্তৃত্ব, প্রভাব ও প্রতিপত্তি প্রতিষ্ঠিত হবে। ইতিহাসের ছাত্ররা অনেকেই জানেন, ২১০০ বছর আগে চীনের হ্যান রাজবংশ এই ‘সিল্ক রোড’ প্রতিষ্ঠা করেছিল। এ রোডের মাধ্যমে চীনের পণ্য (সিল্ক) সুদূর পারস্য অঞ্চল পর্যন্ত পৌঁছে যেত। এর মধ্য দিয়ে আজকের যে মধ্যপ্রাচ্য সেখানেও চীনের প্রভাব বেড়েছিল। চীনের নয়া প্রেসিডেন্ট এর নামকরণ করেছেন ‘নিউ সিল্ক রোড ইকোনমিক বেল্ট’। এটা চীনের পশ্চিমাঞ্চল থেকে শুরু করে মধ্য এশিয়া পর্যন্ত সম্প্রসারিত। একই সঙ্গে একটি ‘মেরিটাইম সিল্ক রুটের’ কথাও আমরা জানি, যা কি-না চীনের সঙ্গে দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার দেশগুলোর একটা যোগসূত্র ঘটিয়েছিল। ইতিহাস থেকে জানা যায়, এ মেরিটাইম সিল্ক রুটের ধারণাও কয়েকশ’ বছর আগের। এ মেরিটাইম সিল্ক রুট ধরে চীনা অ্যাডমিরাল ঝেং হে (মা হে) ১৪০৫ থেকে ১৪৩৩ সাল- এই ২৮ বছর প্রশান্ত মহাসাগর থেকে ভারত মহসাগরে চীনা পণ্য নিয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন। ১৪২১-১৪৩১ সালে তিনি দু’বার বাংলার রাজধানী সোনারগাঁওয়ে এসেছিলেন। চীন এ নৌরুটটি নতুন করে আবার ব্যবহার করতে চায়।
তবে কয়েকশ’ বছরের ব্যবধানে এ অঞ্চল অনেক বদলে গেছে। চীন আর একক শক্তি নয়। ভারত তার অন্যতম প্রতিদ্বন্দ্বী। আর যুক্তরাষ্ট্র ভারতকে সঙ্গে নিয়েই তার নিজের স্বার্থ আদায় করতে চায়। ফলে এটা স্পষ্ট নয় ভারত-চীন সম্পর্ক আগামীতে কোন পর্যায়ে গিয়ে উন্নীত হবে। কারণ ভারত মহাসাগরে চীন ও ভারতের যথেষ্ট স্বার্থ রয়েছে। এ স্বার্থ যদি পরস্পরবিরোধী হয়, তাহলে সংঘর্ষ অনিবার্য। মে মাসে মোদির চীন সফরের আগে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের তীর্থস্থান কৈলাসের যাত্রা সহজ করতে চায় ভারত। চীন এ ব্যাপারে নমনীয় হয়েছে বলে পত্রপত্রিকায় খবর প্রকাশিত হয়েছে। এখন কৈলাসে যেতে হয় উত্তরাঞ্চলের কাঠগোদাম থেকে হেঁটে। এটা কষ্টদায়ক ও পথটি দুর্গম। পথটিও দীর্ঘ। অথচ কৈলাসে গাড়িতে করে যাওয়া সম্ভব। গ্যাংটকের পাশেই নাথুলা। রাস্তাও ভালো চীনের দিকে। চীন অনুমতি দিলে গাড়িতে করেই তীর্থযাত্রীরা কৈলাসে যেতে পারবেন। মোদি নিজেও এ পথে কৈলাস যেতে চান। সুতরাং দক্ষিণ এশিয়ায় চীনা প্রভাব কমাতে মোদির উদ্যোগ এবং চীনের ব্যাপারে মোদির ব্যক্তিগত আগ্রহ- এ দু’য়ের মধ্য দিয়ে আস্থার সম্পর্ক কীভাবে তৈরি হয়, সেটাই দেখার বিষয়।
ড. তারেক শামসুর রেহমান : অধ্যাপক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক
tsrahmanbd@yahoo.com
No comments