ভয়ের সংস্কৃতি বনাম মানবাধিকার সংস্কৃতি by সুলতানা কামাল
সহজভাবে
মানবাধিকার ব্যাখ্যা করতে গিয়ে অনেকেই বলে থাকেন, ‘যেকোনো ধরনের ভয় থেকে
মুক্ত থাকাই হচ্ছে মানবাধিকার।’ তো, ভয় মানুষ পায় কোথা থেকে? ছোটবেলায়
আমরা অনেকেই ভূতের ভয়ে কুঁকড়ে থাকতাম। বড় হতে হতে যদি ভূতের
অস্তিত্বহীনতায় বিশ্বাস আনা যায়, তবে ভূতের ভয় একসময় জয় করা যায়। কিন্তু এর
বাইরে আমাদের অন্য রকম ভয়ের মধ্যেও থাকতে হয়। সেটা নির্যাতনের ভয়,
অত্যাচারের ভয়, ক্ষুধার ভয়—সর্বোপরি মৃত্যুভয়।
আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজে যেহেতু ভূতের স্থান নেই, তাই ভূতের ভয় নিয়ে আধুনিক সমাজের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু অন্য যে ভয়, তা থেকে মুক্তির উপায় খোঁজা আধুনিক সমাজের প্রধানতম কর্তব্য। আর তাই এই বিষয় মানবাধিকারের অন্যতম প্রধান উপজীব্য। ভূতের ভয় থেকে মুক্তির জন্য আশ্রয় খোঁজা যায় বিজ্ঞানে। কিন্তু এর বাইরে যে ভয়, তা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ ভরসা খুঁজবে কোথায়? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই ‘রাষ্ট্র’ ধারণার উদ্ভব। মানুষের ভয় যত বাড়তে থাকে, বরাভয় দিতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাও বেড়ে চলে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। রাষ্ট্রের অতিরিক্ত ক্ষমতা সমস্যার কারণও হয়ে দাঁড়ায় কখনো কখনো। ভয়ের পিঠে বরাভয় দেওয়ার বদলে রাষ্ট্র কখনো কখনো নিজেও ভয়সঞ্চারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
আমাদের বাংলাদেশে এখন তেমন অবস্থাই চলছে। এ যেন লাগামহীন ভয়ের রাজত্ব। একদিকে পেট্রলবোমা-ককটেলে পুড়ে অঙ্গার হওয়ার ভয়, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে মৃত্যুর ভয়। ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে টানা অবরোধ। সংবাদপত্রের হিসাব অনুযায়ী, অবরোধের ৫৫ দিনে (১ মার্চ ২০১৫ পর্যন্ত) পেট্রলবোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ৬০ জন (প্রথম আলো, ১ মার্চ ২০১৫)। বোমা-ককটেল হামলা থেকে রক্ষা পাননি নারী-শিশু-বৃদ্ধ; হামলা হয়েছে স্কুলে, পাঠ্যপুস্তকবাহী গাড়িতে। শিশুদের স্কুল বন্ধ, এসএসসি পরীক্ষা চলছে ধুঁকে ধুঁকে। অন্যদিকে, এসব নাশকতার বিপরীতে বেড়ে গেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’। ৫৫ দিনে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর ‘গণপিটুনিতে’ নিহত হয়েছে ৩৬ জন (প্রথম আলো, ১ মার্চ ২০১৫)। আমরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি, পুলিশি প্রহরায় গাড়ির বহরে হামলা হয়েছে, থানার কাছেই মানুষ পুড়েছে, পুলিশের চোখের সামনে পুড়েছে গাড়ি (প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি ২০১৫)। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই এসব নাশকতাকারীকে পুলিশ হাতেনাতে ধরতে পেরেছে। পরবর্তীকালে যত গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে, সে ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয়ই ছিল মুখ্য বিষয়। তাদের অনেককে মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে টাকাপয়সার লেনদেনের অভিযোগ তুলেছেন স্বজনেরা (প্রথম আলো, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ আলামত ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি, পুলিশের হাতে আটক ব্যক্তির সড়ক দুর্ঘটনায় ‘সন্দেহজনক’ মৃত্যু হয়েছে। কথিত ‘গণপিটুনি’তে নিহত ব্যক্তিদের শরীরে পাওয়া গেছে অসংখ্য গুলির ক্ষত (প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। প্রশ্ন হচ্ছে, মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে এই পরিস্থিতিতে আমাদের বক্তব্য কী?
আমাদের সামনে এখন দুটো বিষয়। এক. নাশকতার মাধ্যমে মানুষের চলাফেরার অধিকার, জীবনের অধিকারের লঙ্ঘন—মানুষের মনে ভীতি আর নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা। দুই. রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বলপ্রয়োগের ধরন ও মাত্রা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধান প্রধান বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে সেই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সমাবেশ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি দেয় বিরোধী দলগুলো। সরকারের পক্ষ থেকে সেই কর্মসূচি পালনের অনুমতি না দিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনকে তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সম্ভাব্য নাশকতা এড়ানোর জন্যই সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং বিএনপির নেত্রীকে সমাবেশে যেতে দেওয়া হয়নি। আর এর পরদিন থেকেই সারা দেশে শুরু হয় নাশকতা। এই নাশকতা যেমন কঠোর ভাষায় নিন্দনীয়, তেমনি নাশকতা ঠেকানোর যুক্তিতে বিরোধী দলকে গণতান্ত্রিক অধিকার না দেওয়াও নিন্দনীয়। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে আন্দোলন করার অধিকার ও সুযোগ অবশ্যই থাকতে হবে।
টানা প্রায় দুই মাস ধরে চলছে নাশকতা। চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর—রাজনীতির সঙ্গে যাদের নেই বিন্দুমাত্র সংস্রব। সাধারণের মধ্যে যারা আরও সাধারণ—চালক, চালকের সহকারী, সবজিবিক্রেতা, ঘর থেকে বাইরে না বেরিয়ে যাদের উপায় নেই, মূলত তারাই আক্রান্ত হচ্ছে। পেটের তাগিদে ঘরের বাইরে তাদের বেরোতেই হয়। অন্যদিকে, নাশকতাকারীদের তারা সহজ টার্গেট, কারণ এ ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ ঝুঁকি নিতে হয় না। সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে তারা ভয়ের রাজত্ব তৈরি করতে চায়, ভয় দেখিয়ে মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে চায়। এভাবে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতা হরণ করা, তার জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রূপ হতে পারে না। এর মাধ্যমে নিঃসন্দেহে মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড দেশের আইনেরও লঙ্ঘন বটে। আর আইন ভঙ্গকারীদের আটকানোর দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এবং তাদের তা করতে হবে আইনি কাঠামোর মধ্যে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে এসব অপরাধীকে শনাক্ত করা, গ্রেপ্তার করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি তা করছে? দুঃখজনকভাবে আমরা এখনো এ বিষয়ে আস্থা স্থাপনের মতো তথ্য পাইনি।
এটা স্পষ্ট যে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে সহজ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে চাইছে। এই বাহিনীর প্রধানেরা তো বটেই, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গত ২৮ জানুয়ারি পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘যারা মানুষকে পোড়াবে বা আঘাত করবে, তাদের বিরুদ্ধে যত কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেটা আপনারা নেবেন। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। যা কিছু হোক, সেই দায়িত্ব আমি নেব’ (প্রথম আলো, ২৯ জানুয়ারি ২০১৫)। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভুল বার্তা দিতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী বরং জোর দিয়ে বলতে পারতেন, পুলিশ যেন আইনি কাঠামোর মধ্য থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
মানবাধিকার রক্ষার নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনীও এখন মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আমরা সেটা সমর্থন করতে পারি না। অধিকার হরণের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। দীর্ঘমেয়াদি ও কষ্টসাধ্য হলেও আমরা চাই স্থায়ী সমাধান এবং মানবাধিকারের নীতিমালা সমুন্নত রাখার মাধ্যমেই কেবল তা করা সম্ভব।
এই পরিস্থিতিতে আমরা অন্য আরেক দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছি। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থেকে মুক্ত থাকার চিন্তায় অনেকেই উভয় তরফের সমানুপাতিক নিন্দা করছেন অথবা নিশ্চুপ থাকছেন। এ যেন বিশিষ্ট লেখক জোসেফ মোর্সের রাজনৈতিক থ্রিলার ধ্বংসের ঈশ্বর-এ বর্ণিত পরিস্থিতি, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘মানুষ যখন ডান-বামের তর্কে লিপ্ত হয়, তখন তারা ঠিক-বেঠিকের হিসাব করতে ভুলে যায়।’ কিন্তু ঠিক-বেঠিকের হিসাব না করতে পারলে আমাদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। এই হিসাব স্পষ্ট করে আমাদের সবাইকে সরব হতে হবে। মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে আমাদের বক্তব্য, চলমান নাশকতা অবশ্যই মানুষের মানবাধিকার হরণ করছে। এসব কার্যক্রম দেশের প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন এবং তা প্রতিহত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে কারণেই রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী। কিন্তু এটা করতে গিয়ে আইনানুগ পথ থেকে এক চুলও বিচ্যুত হওয়া উচিত নয়। সেটা যদি হয়, তবে তা-ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমরা জানি, আইনানুগ পথে নাশকতাকারীদের ধরা ও বিচার করার ক্ষেত্রে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, আছে সময়ের প্রশ্ন। তথাপি এর অন্যথা করার কোনো সুযোগ নেই।
মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী, নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি তাঁর ‘ভয় থেকে মুক্তি’ শীর্ষক এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘যখন মানুষের মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকার করা হয়, তখন ভয়ই নিয়মে পরিণত হয়। কিন্তু মানুষের পক্ষে কখনোই পুরোপুরি ভয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে কারণেই, এমনকি কঠিনতম সময়েও সাহসে ভর করে জেগে ওঠে মানুষ, কারণ ভয় তার সহজাত প্রবৃত্তি নয়, বরং সাহসই তার সহজাত।’
শেষ কথা হচ্ছে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? অবধারিতভাবেই এ প্রশ্নও রয়েছে আমাদের সামনে। স্বীকার করি, এর উত্তর পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। সহিংসতা ও ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া নিন্দনীয় এবং তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা চাই সব পক্ষ অবিলম্বে সহিংসতা পরিহার করবে এবং সরকার আইনানুগ পন্থায় বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে।
লেখাটি মানবাধিকার ও আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে লেখা হয়েছে।
সুলতানা কামাল: নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
আধুনিক বৈজ্ঞানিক সমাজে যেহেতু ভূতের স্থান নেই, তাই ভূতের ভয় নিয়ে আধুনিক সমাজের মাথাব্যথা নেই। কিন্তু অন্য যে ভয়, তা থেকে মুক্তির উপায় খোঁজা আধুনিক সমাজের প্রধানতম কর্তব্য। আর তাই এই বিষয় মানবাধিকারের অন্যতম প্রধান উপজীব্য। ভূতের ভয় থেকে মুক্তির জন্য আশ্রয় খোঁজা যায় বিজ্ঞানে। কিন্তু এর বাইরে যে ভয়, তা থেকে মুক্তির জন্য মানুষ ভরসা খুঁজবে কোথায়? এই প্রশ্নের জবাব খুঁজতে গিয়েই ‘রাষ্ট্র’ ধারণার উদ্ভব। মানুষের ভয় যত বাড়তে থাকে, বরাভয় দিতে রাষ্ট্রের ক্ষমতাও বেড়ে চলে তার সঙ্গে পাল্লা দিয়ে। রাষ্ট্রের অতিরিক্ত ক্ষমতা সমস্যার কারণও হয়ে দাঁড়ায় কখনো কখনো। ভয়ের পিঠে বরাভয় দেওয়ার বদলে রাষ্ট্র কখনো কখনো নিজেও ভয়সঞ্চারী ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়।
আমাদের বাংলাদেশে এখন তেমন অবস্থাই চলছে। এ যেন লাগামহীন ভয়ের রাজত্ব। একদিকে পেট্রলবোমা-ককটেলে পুড়ে অঙ্গার হওয়ার ভয়, অন্যদিকে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর গুলিতে মৃত্যুর ভয়। ২০১৫ সালের ৬ জানুয়ারি থেকে শুরু হয়েছে টানা অবরোধ। সংবাদপত্রের হিসাব অনুযায়ী, অবরোধের ৫৫ দিনে (১ মার্চ ২০১৫ পর্যন্ত) পেট্রলবোমা ও আগুনে দগ্ধ হয়ে নিহত হয়েছেন ৬০ জন (প্রথম আলো, ১ মার্চ ২০১৫)। বোমা-ককটেল হামলা থেকে রক্ষা পাননি নারী-শিশু-বৃদ্ধ; হামলা হয়েছে স্কুলে, পাঠ্যপুস্তকবাহী গাড়িতে। শিশুদের স্কুল বন্ধ, এসএসসি পরীক্ষা চলছে ধুঁকে ধুঁকে। অন্যদিকে, এসব নাশকতার বিপরীতে বেড়ে গেছে রাষ্ট্রীয় বাহিনীর সঙ্গে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’। ৫৫ দিনে কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধ’ আর ‘গণপিটুনিতে’ নিহত হয়েছে ৩৬ জন (প্রথম আলো, ১ মার্চ ২০১৫)। আমরা বেশ কিছু ক্ষেত্রে দেখেছি, পুলিশি প্রহরায় গাড়ির বহরে হামলা হয়েছে, থানার কাছেই মানুষ পুড়েছে, পুলিশের চোখের সামনে পুড়েছে গাড়ি (প্রথম আলো, ১৫ জানুয়ারি ২০১৫)। কিন্তু খুব কম ক্ষেত্রেই এসব নাশকতাকারীকে পুলিশ হাতেনাতে ধরতে পেরেছে। পরবর্তীকালে যত গ্রেপ্তারের ঘটনা ঘটেছে, সে ক্ষেত্রে গ্রেপ্তারকৃত ব্যক্তিদের রাজনৈতিক পরিচয়ই ছিল মুখ্য বিষয়। তাদের অনেককে মুক্তি দেওয়ার ক্ষেত্রে টাকাপয়সার লেনদেনের অভিযোগ তুলেছেন স্বজনেরা (প্রথম আলো, ৯ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। পত্রিকায় প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়েছে, কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধের’ আলামত ঘটনাস্থলে পাওয়া যায়নি, পুলিশের হাতে আটক ব্যক্তির সড়ক দুর্ঘটনায় ‘সন্দেহজনক’ মৃত্যু হয়েছে। কথিত ‘গণপিটুনি’তে নিহত ব্যক্তিদের শরীরে পাওয়া গেছে অসংখ্য গুলির ক্ষত (প্রথম আলো, ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০১৫)। প্রশ্ন হচ্ছে, মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে এই পরিস্থিতিতে আমাদের বক্তব্য কী?
আমাদের সামনে এখন দুটো বিষয়। এক. নাশকতার মাধ্যমে মানুষের চলাফেরার অধিকার, জীবনের অধিকারের লঙ্ঘন—মানুষের মনে ভীতি আর নিরাপত্তাহীনতার শঙ্কা। দুই. রাষ্ট্রীয় বাহিনীর বলপ্রয়োগের ধরন ও মাত্রা।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি প্রধান প্রধান বিরোধী দলের বর্জনের মধ্য দিয়ে অনুষ্ঠিত নির্বাচনের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে সেই নির্বাচন বাতিল করে নতুন নির্বাচনের দাবিতে ২০১৫ সালের ৫ জানুয়ারি সমাবেশ অনুষ্ঠানের কর্মসূচি দেয় বিরোধী দলগুলো। সরকারের পক্ষ থেকে সেই কর্মসূচি পালনের অনুমতি না দিয়ে বিএনপির চেয়ারপারসনকে তাঁর কার্যালয়ে অবরুদ্ধ করে রাখা হয়। সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়, সম্ভাব্য নাশকতা এড়ানোর জন্যই সমাবেশের অনুমতি দেওয়া হয়নি এবং বিএনপির নেত্রীকে সমাবেশে যেতে দেওয়া হয়নি। আর এর পরদিন থেকেই সারা দেশে শুরু হয় নাশকতা। এই নাশকতা যেমন কঠোর ভাষায় নিন্দনীয়, তেমনি নাশকতা ঠেকানোর যুক্তিতে বিরোধী দলকে গণতান্ত্রিক অধিকার না দেওয়াও নিন্দনীয়। একটি গণতান্ত্রিক সমাজে আন্দোলন করার অধিকার ও সুযোগ অবশ্যই থাকতে হবে।
টানা প্রায় দুই মাস ধরে চলছে নাশকতা। চোরাগোপ্তা হামলা হচ্ছে সাধারণ মানুষের ওপর—রাজনীতির সঙ্গে যাদের নেই বিন্দুমাত্র সংস্রব। সাধারণের মধ্যে যারা আরও সাধারণ—চালক, চালকের সহকারী, সবজিবিক্রেতা, ঘর থেকে বাইরে না বেরিয়ে যাদের উপায় নেই, মূলত তারাই আক্রান্ত হচ্ছে। পেটের তাগিদে ঘরের বাইরে তাদের বেরোতেই হয়। অন্যদিকে, নাশকতাকারীদের তারা সহজ টার্গেট, কারণ এ ক্ষেত্রে তাদের বিশেষ ঝুঁকি নিতে হয় না। সাধারণ মানুষকে টার্গেট করে তারা ভয়ের রাজত্ব তৈরি করতে চায়, ভয় দেখিয়ে মানুষকে ঘরে আটকে রাখতে চায়। এভাবে ভয়ের পরিবেশ তৈরি করে মানুষের চলাফেরার স্বাধীনতা হরণ করা, তার জীবনের অধিকার কেড়ে নেওয়া গণতান্ত্রিক আন্দোলনের রূপ হতে পারে না। এর মাধ্যমে নিঃসন্দেহে মানুষের মানবাধিকার লঙ্ঘন করা হচ্ছে। কিন্তু এসব কর্মকাণ্ড দেশের আইনেরও লঙ্ঘন বটে। আর আইন ভঙ্গকারীদের আটকানোর দায়িত্ব আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর এবং তাদের তা করতে হবে আইনি কাঠামোর মধ্যে। তাদের দায়িত্ব হচ্ছে এসব অপরাধীকে শনাক্ত করা, গ্রেপ্তার করা এবং তাদের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নেওয়া। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী কি তা করছে? দুঃখজনকভাবে আমরা এখনো এ বিষয়ে আস্থা স্থাপনের মতো তথ্য পাইনি।
এটা স্পষ্ট যে সরকার ও আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী বিদ্যমান পরিস্থিতিতে সমস্যা সমাধানে সহজ প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে চাইছে। এই বাহিনীর প্রধানেরা তো বটেই, স্বয়ং প্রধানমন্ত্রী গত ২৮ জানুয়ারি পুলিশ কর্মকর্তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘যারা মানুষকে পোড়াবে বা আঘাত করবে, তাদের বিরুদ্ধে যত কঠিন ব্যবস্থা নেওয়া দরকার, সেটা আপনারা নেবেন। কোনো দ্বিধাদ্বন্দ্ব নেই। যা কিছু হোক, সেই দায়িত্ব আমি নেব’ (প্রথম আলো, ২৯ জানুয়ারি ২০১৫)। স্বয়ং প্রধানমন্ত্রীর এ ধরনের বক্তব্য আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের ভুল বার্তা দিতে বাধ্য। প্রধানমন্ত্রী বরং জোর দিয়ে বলতে পারতেন, পুলিশ যেন আইনি কাঠামোর মধ্য থেকে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করে।
মানবাধিকার রক্ষার নামে রাষ্ট্রীয় বাহিনীও এখন মানবাধিকার লঙ্ঘন করছে। আমরা সেটা সমর্থন করতে পারি না। অধিকার হরণের মাধ্যমে অধিকার প্রতিষ্ঠা হতে পারে না। দীর্ঘমেয়াদি ও কষ্টসাধ্য হলেও আমরা চাই স্থায়ী সমাধান এবং মানবাধিকারের নীতিমালা সমুন্নত রাখার মাধ্যমেই কেবল তা করা সম্ভব।
এই পরিস্থিতিতে আমরা অন্য আরেক দ্বন্দ্বের মধ্যে পড়েছি। পক্ষপাতিত্বের অভিযোগ থেকে মুক্ত থাকার চিন্তায় অনেকেই উভয় তরফের সমানুপাতিক নিন্দা করছেন অথবা নিশ্চুপ থাকছেন। এ যেন বিশিষ্ট লেখক জোসেফ মোর্সের রাজনৈতিক থ্রিলার ধ্বংসের ঈশ্বর-এ বর্ণিত পরিস্থিতি, যেখানে তিনি বলেছেন, ‘মানুষ যখন ডান-বামের তর্কে লিপ্ত হয়, তখন তারা ঠিক-বেঠিকের হিসাব করতে ভুলে যায়।’ কিন্তু ঠিক-বেঠিকের হিসাব না করতে পারলে আমাদের দুর্ভোগ আরও বাড়বে। এই হিসাব স্পষ্ট করে আমাদের সবাইকে সরব হতে হবে। মানবাধিকার সংগঠন হিসেবে আমাদের বক্তব্য, চলমান নাশকতা অবশ্যই মানুষের মানবাধিকার হরণ করছে। এসব কার্যক্রম দেশের প্রচলিত আইনের লঙ্ঘন এবং তা প্রতিহত করার দায়িত্ব রাষ্ট্রের। সে কারণেই রাষ্ট্রকে দেওয়া হয়েছে আইন প্রয়োগের ক্ষমতা এবং রাষ্ট্রীয় বাহিনী। কিন্তু এটা করতে গিয়ে আইনানুগ পথ থেকে এক চুলও বিচ্যুত হওয়া উচিত নয়। সেটা যদি হয়, তবে তা-ও মানবাধিকার লঙ্ঘন। আমরা জানি, আইনানুগ পথে নাশকতাকারীদের ধরা ও বিচার করার ক্ষেত্রে সীমাহীন প্রতিবন্ধকতা রয়েছে, আছে সময়ের প্রশ্ন। তথাপি এর অন্যথা করার কোনো সুযোগ নেই।
মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থী নেত্রী, নোবেল বিজয়ী অং সান সু চি তাঁর ‘ভয় থেকে মুক্তি’ শীর্ষক এক বক্তব্যে বলেছিলেন, ‘যখন মানুষের মৌলিক মানবাধিকার অস্বীকার করা হয়, তখন ভয়ই নিয়মে পরিণত হয়। কিন্তু মানুষের পক্ষে কখনোই পুরোপুরি ভয়ের সঙ্গে খাপ খাওয়ানো সম্ভব হয়ে ওঠে না। সে কারণেই, এমনকি কঠিনতম সময়েও সাহসে ভর করে জেগে ওঠে মানুষ, কারণ ভয় তার সহজাত প্রবৃত্তি নয়, বরং সাহসই তার সহজাত।’
শেষ কথা হচ্ছে, এই পরিস্থিতি থেকে উত্তরণের উপায় কী? অবধারিতভাবেই এ প্রশ্নও রয়েছে আমাদের সামনে। স্বীকার করি, এর উত্তর পাওয়া অত্যন্ত দুরূহ। সহিংসতা ও ভীতি সৃষ্টির মাধ্যমে আন্দোলন চালিয়ে যাওয়া নিন্দনীয় এবং তা কোনোভাবেই সমর্থনযোগ্য নয়। আমরা চাই সব পক্ষ অবিলম্বে সহিংসতা পরিহার করবে এবং সরকার আইনানুগ পন্থায় বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলা করবে।
লেখাটি মানবাধিকার ও আইন সহায়তা প্রতিষ্ঠান আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) পক্ষে লেখা হয়েছে।
সুলতানা কামাল: নির্বাহী পরিচালক, আইন ও সালিশ কেন্দ্র
No comments