আত্মসঙ্কটে বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা by মিনা ফারাহ
অমীমাংসিত
৪৭, বুদ্ধিজীবীদের আত্মসঙ্কট, সাউথ ব্লকের ষড়যন্ত্র- তিন রাহুর কবলে
বাংলাদেশ। লাহোর প্রস্তাবের ৭৫ বছর পর শেষবারের মতো এবার বাঙালি মুসলমান
বুদ্ধিজীবীদেরকেই মীমাংসা করতে হবে শান্তি না যুদ্ধ- কোনটা পছন্দ। তাদের
ভুলের বিরুদ্ধে নারাজির অধিকার পাবলিকের জন্মগত সত্ত্বেও ওরা সেটা মানছে
না। এভাবে মারদাঙ্গা জীবন আর চলছে না।
৭৫ বছরের ইতিহাস বলছে, ৪৭-কে কেন্দ্র করে যতগুলো যুদ্ধ এবং দাঙ্গা, একসাথে যোগ করলে মাঝারি আকারের বিশ্বযুদ্ধের সমান। দেশ বিভাগের আগে ও পরের গণহত্যাগুলোর পরিসংখ্যান নেই। কোটি কোটি মানুষের দেশ হারানোর কষ্ট পরোয়া করেন না বুদ্ধিজীবীরা। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, অমীমাংসিত দেশ বিভাগের দৃশ্যপট পাল্টে দেয়ার সুযোগ বৃহত্তর বাংলার বুদ্ধিজীবীদের হাতেই ছিল। দিল্লি সব সময় দুই বাংলার রাওয়ালপিন্ডি এবং দুই বাংলা জমজ বোনের মতো। ভারতীয় আগ্রাসনের গভীরতা কখনোই বুঝতে চান না বুদ্ধিজীবীরা। দিল্লির গরু, সুপারি আর মতার ষড়যন্ত্রমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত জ্বলবে বাংলাদেশ।
ভুলের কিছুটা নমুনা। লাহোর প্রস্তাব ভালো কিন্তু মুসলিম লীগ খারাপ। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ভালো, কিন্তু পাকিস্তান খারাপ। মুসলিম লীগ খারাপ, কিন্তু পাকিস্তান ভালো। জিন্না খারাপ, কিন্তু কেবিনেট মিটিং ভালো। ভাষা আন্দোলন ভালো, কিন্তু লাহোর প্রস্তাব ভালো না। যুক্তফ্রন্ট, মুসলিম লীগ কোনোটাই ভালো না বরং ছয় দফাই সব। সমাধান দেয়নি কাগমারি সম্মেলন, এনডিএফ চাই। গোলটেবিল ভালো, কিন্তু বেসিক ডেমোক্র্যাসি খারাপ? এরই ধারাবাহিকতায় একদলীয় ও বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাংলাদেশের শরীরে জমজ সন্তানের মতো মাথা থেকে পা পর্যন্ত জোড়া। দিল্লি না রাওয়ালপিন্ডি, একবারো সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি বুদ্ধিজীবীরা।
লাহোর প্রস্তাবের ৭৫ বছর পর, যে পর্যন্ত না ৪৭, ৭১ ও ৫ জানুয়ারির মীমাংসা হবে, তত দিন পর্যন্ত জেরুসালেম আর কাশ্মিরের মতো অমীমাংসিতই থাকবে বাংলাদেশ। এক একর জমি লালনপালনে পরিকল্পনা লাগে, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের জন্য লাগে না? ’৭৪-এর মতো আবারো কতকাল র্যাব-পুলিশ দিয়ে জনজীবন চালাতে চায় আওয়ামী লীগ? বন্দুকের নল উত্তর হলে, আইয়ুব-এরশাদের দোষটা কোথায়? দেশ বিভাগের পর থেকে এদের নেতৃত্বে যুদ্ধ-দাঙ্গা অনেকটাই রুয়ান্ডা-বসনিয়ার মতো। একমাত্র পাগল আর শিশুই বলবে না, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই বাংলাদেশ।
যারা নিজেকে অস্বীকার করে, তারা কাউকেই স্বীকার করে না। তখন তাদের কাজ অন্যের দোষ খোঁজা। ধরে নিতে পারি, ইংরেজ উপনিবেশের নর্দমাগুলো ৫৬ হাজার বর্গমাইলেই শেষ করেছিল কংগ্রেস। সেই নর্দমার বিষেই বুদ্ধিজগতে ধস। এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছিল দেশ বিভাগে।
বারবার ভুল করা বুদ্ধিজীবীদের কাছে প্রশ্ন- এখন সমস্যা কোনটা? ৫ জানুয়ারিতে অবৈধ নির্বাচন করে ক্ষমতায় যায়নি ২০ দলীয় জোট। ৫ জানুয়ারির আগে বহু মানুষ পুড়ে মরার পর বার্ন ইউনিটের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেই জাদুরকাঠি যার হাতে, তিনি কি তার দায়িত্ব পালন করেছেন? নিরপেক্ষ নির্বাচন না দিয়ে বরং বারবার বার্ন ইউনিটে যাওয়া জর্জ বুশের মিশন কমপ্লিটের মতো দুরভিসন্ধিমূলক। পশু না, আমরা মানুষ। ৪৭ ও ৭১ পারেনি, এবার ৫ জানুয়ারির জবাব প্রতিটি বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীকে অবশ্যই দিতে হবে। প্রমাণসাপেক্ষে নির্বাচনজনিত গণহত্যারও বিচার হবে। ১৬ ডিসেম্বরের পর পাকিস্তান বিদায়, ৪৭ সাল থেকে ৭৪ পর্যন্ত একবারো সৈন্য নামাতে হয়নি ভারতে। আমাদের ইতিহাস কী বলে? প্রধান সমস্যা হলো, বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিতে ধস। ভোটের অধিকার ছিনতাইকারীদের কার্যালয় ঘেরাও না করে, করছে উল্টোটা।
যুদ্ধ-দাঙ্গায় যাদেরকে মরতে হয় তারা ভাগ্যবান। কিন্তু যারা বেঁচে যায় আমৃত্যু ওই স্মৃতি বহন করে। তাদের জীবন কখনোই স্বাভাবিক হয় না। দেশ বিভাগের পর জন্ম নেয়া আমিও তাদেরই একজন। জীবনের প্রথম অর্ধেক কাটল হিন্দু-মুসলমানের যুদ্ধ-দাঙ্গা আর দেশ ত্যাগের ধারাবাহিকতা দেখে। প্রথম নষ্ট অভিজ্ঞতা, ১৯৬৪-এর দাঙ্গা। বাবার মুখে শুনেছি, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে কেন্দ্র করে কলকাতা-নোয়াখালীতে ভয়ানক দাঙ্গা। ৫০-এ ক্ষতিগ্রস্ত আমার পরিবারও। পরপর ১৯৪৭, ৪৮, ৫০... লাগাতার মারদাঙ্গায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবসৃষ্ট দুর্ভোগের কারণ আলোচনায় না থাকলে আজকের সমস্যার সমাধান হবে না। একসাথে স্বাধীন হয়েও কোথায় চলে গেল ভারত! ভোটের ১৫ দিন পর্যন্ত বাক্সগুলো নির্বাচন কমিশনের জিম্মায় থাকে। ৬৭ বছরে এই কথা কি একবারো বলতে পেরেছি? বুদ্ধির গভীরতা এতটাই নিম্নমানের, প্রতিবারই যা চায়, কড়ায়-গণ্ডায় পায়; কিন্তু প্রতিবারই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে।
৯৬ শতাংশ ভোট দিয়ে এরাই আনল পাকিস্তান, ওই রাতেই সিদ্ধান্ত পাকিস্তান ভালো না। ধর্মভিত্তিক দেশ বিভাগ ছাড়া মানবেই না, ৭২-এ পৌঁছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আর বিষ্ঠা এক সমান। এই রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে জিয়াউর রহমান হলেন মুক্তিযুদ্ধের কলঙ্ক; কিন্তু ধর্মকে সংবিধানের অংশ করা এরশাদ হলেন সবচেয়ে ভালো। ৮৬-তে এরশাদ খারাপ, কিন্তু জামায়াত ভালো। ৯৬-তে এরশাদ ও জামায়াত দুইই ভালো। বুদ্ধিজীবীরা কী চান, জানেন তো? ৪৭ সালে সৃষ্ট বাংলা-পাঞ্জাবের শরীরে ছুরি চালিয়ে দুই ব্যাগ ভর্তি অদ্ভুত পাকিস্তান, ইতিহাসের নিকৃষ্ট কলঙ্ক। দুই হাজার মাইল দূরত্বে মাথা আর পা, মধ্যখানে কাশ্মিরের ক্যানসার নিয়ে রামরাজত্ব ভারতের। এই দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোথাও নেই।
পৃথিবীর আর কোথাও এত অল্প সময়ে এতগুলো যুদ্ধ, দাঙ্গা আর দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেনি। দুইবার দেশ কর্তনও হয়নি। তখন দাবি ৯ + ৫ = ১০। আমার কথা, ডাইরেক্ট অ্যাকশন সবচেয়ে বড় ভুল। ওদের চোখে ডাইরেক্ট অ্যাকশনই একমাত্র পথ। লাহোর প্রস্তাবের বিকল্প অবশ্যই ছিল। বিধানসভা পরপর দুই দফা তাদের দখলেই। দিল্লির কেবিনেট মিটিংয়েই কংগ্রেসের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ইতিহাস বলে, অস্পৃশ্যদের মতো বাঙালি মুসলমানদেরকেও দীর্ঘ সময় বঞ্চিত রেখেছিল কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। ফলে বুদ্ধি প্রয়োগে নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়েছিল ভারত ভাগের সময়। ইতিহাসের এই অধ্যায়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাঁটি হাঁটি পা পা করে দুই দফা বিধানসভার মতা পাওয়ার মতো অসম্ভব সম্ভব করলেও, আসল অঙ্কে ভুল করলেন বুদ্ধিজীবীরা। অর্থাৎ ৬৭ বছর যা ঘটছে, অতীতের বুদ্ধিহীনতার প্রতিচ্ছবি।
যে মুহূর্তে কনফেডারেশন সরকারের দাবি বাতিল হলো, বৃহত্তর বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর তখনই সুযোগ ছিল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম না করে পুরনো দাবিতে ফেরা। প্রয়োজনে দুই-চার বছর অপেক্ষা করলে ক্ষতি ছিল না। সে রকম হলে ইংরেজরা যেনতেন ও অসম দেশ বিভাগ চাপিয়ে দিতে পারত না। কাশ্মির কিংবা ছিটমহলেরও প্রশ্ন উঠত না। একই অস্থিরতার পুনরাবৃত্তি ৭১-এ। এখনই এই মুহূর্তে সব সমস্যার সমাধান চাই। মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা পৃথিবীতে একটাই। এরপর রাওয়ালপিন্ডিকে সরিয়ে সাউথ ব্লকের কবলে। সারা পৃথিবীতেই মুসলমান, তার মানে এই নয়, সব দেশেই মুসলমানদের জন্য আলাদা-আলাদা দেশ বানাতে হবে। ভুলগুলো যত দিন না আলোচনায় আসবে, তত দিন পর্যন্ত আজকের সমস্যার গোড়া খুঁজে পাবে না।
পাকিস্তানি আর বাঙালিদের ভাষা-সংস্কৃতি যে ভিন্ন, তারা জানতেন। তখনই সাবধান হলে ৬৭ বছর ধরে যা হচ্ছে, হতো না। বাংলা ভাগ হলেও অল্পসংখ্যক মুসলমান ভারত ছেড়েছে, এপার বাংলার হিন্দুদের সংখ্যা ৩৮ থেকে কমে ৮ ভাগের প্রধান কারণ, বারবার যুদ্ধ-দাঙ্গায় অনিরাপত্তাবোধ। সত্য যে, ভারত ভাগের পক্ষে ৯৬ ভাগ ভোট বাঙালিদের আর ৪৯ ভাগ অবাঙালিদের। আমার অভিজ্ঞতায়, এদের রাজনীতির প্রধান পুঁজি লাঠি বনাম ভারতীয়দের বুদ্ধির সুব্যবহার। আজকের সঙ্কটের সূত্র ধামাচাপা দিলে আরো যুদ্ধ, আরো দাঙ্গা হবে। অন্যথায় ৪৭-এর মাত্র ২৪ বছর পর আরেকটা যুদ্ধ করতে হতো না।
ডাইরেক্ট অ্যাকশনের কারণেই রেডক্লিফেকে জরুরিভিত্তিতে তলব করে সৃষ্টি করা হলো অদ্ভুত দু’টি দেশ, যার শরীরটা মধ্যখানে আর মাথা ও পা দুই হাজার মাইল দূরত্বে। বাংলা-পাঞ্জাবকে শ্মশান করা দেশ বিভাগের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বহু বছর গবেষণা ও বিতর্ক চলতে পারে। কয়েক দিনে খুন হলো প্রায় ১৫ লাখ, রিফিউজি আরো লাখ লাখ, জন্ম থেকেই জ্বলছে সবগুলো দেশ। কাশ্মিরসহ ভারতের অনেক অঙ্গরাজ্যের অবস্থা ৭১-এর মতো। আমাদের রসদ জোগানো ভারতের ৭১ ঠেকানোর দায়িত্ব, সর্বদাই আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। এই উপলে উভয় পরে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র এবং এটাই বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা।
মধ্যরাতেই কলকাতায় বুদ্ধিজীবীদের বৈঠক, হায় হায়! পকিস্তান ভালো না, আলাদা হতে হবে। আমার প্রশ্ন- ডাইরেক্ট অ্যাকশনের আগে ছিলেন কোথায়? যুদ্ধ, খুনাখুনি ও দাঙ্গায় কেটে গেলো ৪৭, ৪৮, ৫০, ৬২, ৬৪, ৬৫, ৭১...। ৯৬ শতাংশ ভোট দিয়ে পাকিস্তান আনল, কিন্তু পাকিস্তান ভালো না। ভাঙো ১৪৪ ধারা, পেটাও জিন্নাকে। রাতারাতি ইতিহাস গড়ল ভাষা আন্দোলন। তারপর? এবার যুক্তফ্রন্ট করে দেখিয়ে দিতে হবে। যুক্তফ্রন্ট হলো, তারপর? দেশ বিভাগ করা বুদ্ধিজীবীদের মারামারি-কাটাকাটি বাড়ল দেড়শ’ দ্বিগুণ। একজন আরেকজনের মুখ দেখে না। একজন আরেকজনের ভোটকেন্দ্রে ডাকাতি করতে এক ডজন জাহাজ নিয়ে হাজির হয়। আনল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ... কাগমারি সম্মেলনেই স্বায়ত্তশাসন কায়েমের অবস্থা সৃষ্টি করলে আইয়ুব খানের আগমন। যুক্তফ্রন্ট ফেল, তারপর? হুজুর ভাসানী নাম দিলেন নাথিং ডুইং ফ্রন্ট, অর্থাৎ এনডিএফ। সেটাও যথাসময়ে ফেল। আইয়ুব খানের স্বৈরগণতন্ত্রের বেসিক ডেমোক্র্যসির সাথে যোগ দিলেন মোনায়েম খান ও সবুর খানের মতো বড় বড় শিংওয়ালা বুদ্ধিজীবীরা। ওটাই স্বৈরগণতন্ত্রের প্রসব। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে মুজিবের প্রত্যাশিত চন্দ্রগ্রহণ কাটল। মরেনি মুসলিম লীগ, তাই ছয় দফাকে কেন্দ্র করে আবারো দ্বিখণ্ডিত। এক ভাগ চায় পাকিস্তান, অন্য ভাগ বাংলাদেশ। ধর্মভিত্তিক নয়, বরং এবার নিজেদের মধ্যেই দুই নম্বর ডাইরেক্ট অ্যাকশন।
সীমান্তের কাছে হওয়ায়, ৬৪-এর ভয়াবহ দাঙ্গা দিয়ে আমার ক্ষতবিক্ষত স্মৃতির ভাণ্ডারে প্রথম নষ্ট অভিজ্ঞতার শুরু। আসাম থেকে মুসলমানের ঢল আর গভীর রাতে এপার থেকে হাজার হাজার হিন্দু দেশ ছাড়ে। ৫০-এরপর ৬০-এর দশকে আবারো পাল্টে যেতে থাকল শহরের চেহারা, সাইনবোর্ড, শিক্ষাঙ্গন ইত্যাদি। কৈশোরের লণ্ডভণ্ড অভিজ্ঞতা। ৪৮-এর পর কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে আবারো ৬৫-এর যুদ্ধে ভয়ানক সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতিতে মুখোমুখি দুই প। যুদ্ধ হয় দুই পাকিস্তানে, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এপারের হিন্দুরা (ওপারের ক্ষতিগ্রস্তরা তুলনামূলক কম)। ৬৫-কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হলো ঐতিহাসিক শত্রুসম্পত্তি, যার পরিমাণ পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এক নম্বর। পাকিস্তান আনল, কিন্তু ছয় দফার দাবিতে ফের দেশ অচল। এবার কংগ্রেস নেই; বরং বাঙালি বনাম বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আরেকটা হলোকস্ট।
৬০-এর দশকে লাগাতার আন্দোলন, মিছিল-মিটিংই যেন জীবন। একবার ছয় দফা আবার ১১ দফা। স্বায়ত্তশাসন বনাম স্বাধীনতার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলা। দম নেয়ার ফুরসত নেই। দেশ বিভাগের ২৪ বছর পর, ৭১-এ আবারো বিশ্বকাপ জিতল; কিন্তু সেটাও অনেকেরই পছন্দ নয়। কাশ্মির নই, কিন্তু কম কিসে?
৪৭-এর মতোই ৭১ এসেছিল বহু অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে। রাওয়ালপিন্ডিকে সরিয়ে এবার দিল্লি। স্বাধীন হওয়ামাত্র রক্ষীবাহিনী, বাকশাল, র, কম্বলচোরদের জয়জয়কার। সকালে রাষ্ট্রপতি, দুপুরে প্রধানমন্ত্রী, বিকেলে আবার রাষ্ট্রপতি- কোনটা চান মুজিব নিজেও জানেন না; কিন্তু মানুষের কী হবে, সেটা ভাবনা নয়। নব্য দখলদার, কালোবাজারারি আর রক্ষীবাহিনীর মিশনে অতিষ্ঠ জীবন। সিরাজ শিকদার হত্যা মুজিবতন্ত্রের অন্যতম চমক। ৭৩ সালে তিন টাকা সের চিনি, ৭৪ সালে ৩৩ টাকা। এক দিকে দুর্ভি, অন্য দিকে ফুলের মালা আর মানপত্র নিয়ে ব্যস্ত মুজিব। টাইম ম্যাগাজিনে জালপরা বাসন্তীর ছবি নিয়ে হইচই। যুদ্ধ ফেরত উচ্ছৃঙ্খল বাহিনীগুলোর খুনাখুনিতে ভয়ঙ্কর অবস্থা আমার স্মৃতির ভাণ্ডারে অন্যতম নষ্ট অভিজ্ঞতা। কে অস্বীকার করবে সাড়ে তিন বছরের দুঃশাসন? আমার অভিজ্ঞতায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সর্বদা ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের মতো। রুয়ান্ডা ও বসনিয়ার কথা বলি, কিন্তু আমাদের বেলায় কোনটা কম!
৭২ থেকে ৭৫-এর জবাব দিতে চলে গেল ৯০। বর্তমান দুর্ভোগের জন্য দায়ী ছয় দফা বনাম স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে আজ পর্যন্ত মীমাংসা না করা। রাজাকার বনাম মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা স্পষ্ট না করা। তর্কবিদেরা বলবেন, বঙ্গবীর রাজাকার হলে গোলাম আযম মুক্তিযোদ্ধা! ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের রমরমা সার্টিফিকেটবাণিজ্য তাই আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের মতে এ কে খন্দকার একটা রাজাকার। পাঠ্যপুস্তক থেকে ভাসানী, জেনারেল ওসমানী ও বঙ্গতাজের মতো গর্বিত সন্তানেরা উধাও? ইনডেমনিটি দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষক সাব্যস্ত করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কারো পৈত্রিক সম্পত্তি। ‘জয়বাংলা’ বনাম ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদের’ যুদ্ধ হেঁটে হেঁটে আসেনি। হুটু-টুটসিদের মতো নিজেরাই খুনাখুনি, আর সব দোষ ৭৫-এর? ভেবেছিল ৯০ পার হলেই বাংলাদেশ এমন গণতন্ত্র পাবে, ব্রিটেনের সংসদীয় গণতন্ত্র পর্যন্ত লজ্জা পাবে। দুই মহিলার নেতৃত্বে এরশাদের অবস্থা খান সাহেবদের মতো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। বিদেশী দূতদের জানা উচিত, সংলাপ কত সহজলভ্য, ৯০-এ প্রমাণ করেছেন দুই নেত্রী। এরশাদকে টেনে নামানোর জন্য দুই নেত্রীর ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ঘটনা কে না জানে! ৯১ সাল থেকে স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে দুই-সতীনের চুলাচুলির শুরু। বুদ্ধিজীবীরা বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র হলো, কিন্তু ৯২ সালে এসব কী? বাবরি মসজিদ ভাঙ্গল ওই পারে আর গণহত্যা এই পারে? পাকিস্তানের চেয়ে দীর্ঘ সামরিক শাসন আর স্বৈরগণতন্ত্রের চেহারা দেখে বুদ্ধিজীবীরা গান গায়- ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সবই ভুল...।
৮৬ থেকে যা পেলাম। জামায়াত বহুদলীয় গণতন্ত্র, কিন্তু এরশাদ মহাস্বৈরাচার। একবার জামায়াত সন্ত্রাস, পরেরবার এরশাদ। বহুদলীয় গণতন্ত্র ভালো, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান একটা খাঁটি রাজাকার। ক্ষমতার প্রশ্নে জামায়াত আর জাতীয় পার্টি- দুই নেত্রীর চোখে দুই কোহিনূর। এক দল ধরে, অন্য দল ছাড়ে। ক্ষমতার প্রয়োজন হলেই একজনকে পাঠায় ফাঁসির মঞ্চে, আরেকজনকে নামায়। ফাঁসির সুইচ অন-অফ খেলা, দুই নেত্রীর ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল। তার পরেও ৫ জানুয়ারি নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য কী প্রমাণ করে?
ছয় দফা যে স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা কোনোটাই নয়, উত্তর- ৯১ থেকে ২০১৫-এর অদ্ভুত গণতন্ত্র যেখানে সংসদ মানেই বিরোধী দল রাস্তায়। দুই দফায় ৩০৩ দিন আওয়ামী হরতালের বিশ্বরেকর্ড এখন পর্যন্ত ভাঙতে পারেনি বিএনপি। জনতার মঞ্চ বানিয়ে প্রত্য সংগ্রাম দিবসের রক্তারক্তির রেকর্ডও ভাঙতে পারেনি ২০ দলীয় জোট। বাংলাভাই অবশ্যই খারাপ, কিন্তু আওয়ামী লীগের অস্ত্র আর ক্যাডার সরবরাহকারী এরশাদ শিকদার নিশ্চয়ই ধোয়া তুলসিপাতা নন। নিজেদের গায়ে গ্রেনেড হামলার মল; কিন্তু ২৮ অক্টোবরে আওয়ামী সন্ত্রাসের মুখোশ খুলতে ব্যর্থ বিএনপি। গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন, পেট্রলবোমার রেকর্ড এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগেরই সম্পদ। একটা পড়লে ১০টা লাশ চাই, শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন মানুষ মারার রাজনীতির (ইউটিউব)। ওই তো শুরু। তুলনামূলকভাবে বিএনপির জাতীয়তাবাদ অনেকটাই জিন্নার পোকায় খাওয়া পাকিস্তানের মতো, ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এত বছর মতায় থেকেও না জাতীয়তাবাদ, না জাতীয় কবির অস্বস্তি, কোনোটাই প্রতিষ্ঠা করতে পারলো না জাতীয়তাবাদী দল।
এরশাদ গেল কিন্তু মারামারি-কাটাকাটি আগের মতোই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেই ওঁম শান্তি! সংসদীয় গণতন্ত্র না এসে যাবেটা কোথায়! জনতার মঞ্চ থেকে লাগাতার হরতাল আর মানুষ খুনের ঘোষণা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় যেন আরেকটা ৪৬। সংসদ খালি, কয়েক দিন পরপরই হরতাল। রাস্তায় মুখোমুখি গানপাউডার বনাম জলকামান গণতন্ত্র? বুদ্ধিজীবীরা বলেন, ১-১১ এলেই সব ঠিক। তারপর? ৪৭-এর মতো আবারো বিদেশীরাই ঠিক করল, ২০০৮ সালে জিতবে শেখ হাসিনা, হারবে খালেদা জিয়া। মাইনু-ফকরু বললেন- আসেন বসি, ঘোড়া দিয়েছে প্রণববাবু, ঘোড়ায় বসে আলাপ করি। সাউথ ব্লকের প্রেসক্রিপশন পূরণ হলেই ওঁম শান্তি। প্রথম শর্ত, বিডিআর নির্মূল করে সীমান্তের দখল পরিবর্তন। দ্বিতীয় শর্ত, ভারতের স্বাধীনতাকামীদের ঠেকাতে ভবিষ্যতের যেকোনো উৎপাত দমনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও ইনডেমনিটি। সাউথ ব্লকের বিরুদ্ধে যেকোনো সংগ্রাম শক্তহাতে দমনের আইন সংশোধনীতে থাকতে হবে। ১৭৫৭ সালের মতো আরেক খায়রুল হককে খুঁজে পেতে এক মুহূর্তও দেরি করল না নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বুদ্ধিজীবীরা। ৩২ নম্বর ট্রাস্টের অর্থগ্রহণ বনাম ১৫তম সংশোধনী পাস, আদালতে অবশ্যই কনফিক্ট অব ইন্টারেস্ট। পলাশির সেনাপতিরা অস্ত্র সমর্পণ করলে সর্বসম্মতিক্রমে আবারো জ্বলে উঠল বাংলাদেশ।
সাতটি মহাদেশে সাত রকমের সমস্যা, বাংলাদেশে একসাথে সব মহাদেশের সব সমস্যা। সিমলা চুক্তি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, এখানে নেই এমন কোনো সমস্যা পৃথিবীতে নেই। ৪৭-এর আগে এবং ১-১১-এর পর, বুদ্ধিজীবীদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি জীবন। বাকশালকে পরাজিত করার মতো অভূতপূর্ব শাসনতন্ত্র প্রসব করল ৫ জানুয়ারি। ১-১১ আনা বুদ্ধিজীবীরা মাথা চুলকায়। সব করলাম ভাই, উকুন গেল না। মনে হয় উকুন না, মাথার মধ্যে শুঁয়োপোকা। চাইলাম গণতন্ত্র, এসে গেল মনমোহন-পুতিনের উন্নতিতন্ত্র। উন্নতি ধুয়ে কি পানি খাবো? ব্রিটিশ-পাকিস্তান সব দেখলাম; কিন্তু এই রকম উন্নতি জীবনেও দেখেছি? দেখেন খবরের কাগজগুলো কী লেখে! শোনেন টকশোতে কী বলে! ১০ বছরে কত মানুষ খুন হলো, ভাবতে পারেন? ভাই! রুয়ান্ডা-বসনিয়া ফেল! ভুল সবই ভুল...। ১৫তম সংশোধনী নাটকের সর্বশেষ পর্ব। যাদের সাথে একাধিকবার সংসদে এবং বিরোধী দলে, সেই জামায়াতের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের মেনুফেস্টোতে তিন নম্বর ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ঘোষণা। যারা মেন্ডেলার ইতিহাস পড়েছেন, নিশ্চয়ই জানেন, বর্ণবাদ সমস্যা সমাধানে তার ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা। ঠিক তার উল্টো, দেশটাকে রুয়ান্ডা-বসনিয়া বানানোর জন্য আওয়ামী লীগের এই একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগ নির্মূলের ধারবাহিকতায় জামায়াত-বিএনপি নির্মূলই লক্ষ্য। কৃতকার্য হলে ২০৪১ পর্যন্ত মতার গ্যারান্টি। সুতরাং নামানো হলো ইমরান সরকারের নামে র-বাহিনী। সুজাতা সিংয়ের আগমনে, গণতন্ত্রের চেহারা হলো ৫ জানুয়ারির মতো। সুজাতার প্রেসক্রিপশন, এরশাদকে সিএমএইচে ঢুকিয়ে নির্বাচনের শক দাও। শক খেয়েই এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা। এরই নাম সাউথ ব্লক- এই আচার যে খায়নি, বুঝবে না কত ঝাঁঝ। বুদ্ধিজীবীদের একাংশের স্বপ্নভঙ্গ ছয় দফা, ১১ দফা, ৭১... ভুল? মধ্যরাতের টকশোতে দুই দল বসে ‘অদৃশ্যের’ সাথে যুদ্ধ করে। এই জন্য লাইভ মারামারিও করেন। করের টাকায় তিন মাস পরপর মিলিয়ন ডলারের বকপক্ষিটি উড়ে এসেই ডিজিটাল উন্নতি আর নতুন নতুন সন্ত্রাসের ফর্মূলা ঢুকিয়ে দিয়ে হাওয়া। প্রমাণ হয়েছে, গণ্ডগোল বাধানোই বকপক্ষিটির কাজ। আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের দাবি- গণতন্ত্র হচ্ছে ফিউডালিজমের মতো, ‘রাজা লুই’ যা বলবে, সেটাই আহেলি কিতাব। কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নতি; অবশ্যই ভিশন-২০২১ ও ২০৪১ হবে রাশিয়া ও চীনের মতো। যাদের পছন্দ না, নির্মূল করা হবে। এই উপলে যা করার, দেখিয়ে দেবো। দুঃখে অনেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে গান করেন, ভুল সবই ভুল...।
ছয় দফা স্বাধীনতা নাকি স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে যত দিন সমঝোতা না হবে তত দিন ৭১ প্রশ্নবিদ্ধ যুদ্ধ রূপে বহাল থাকবে। ইতিহাসে এর স্থায়ী ঠিকানা কখনোই হবে না। কারণ ভারতীয়রা এর নাম দিয়েছে চতুর্থ ইন্দো-পাক যুদ্ধ এবং সব প্রশ্নের উত্তর এখানেই। ৪৭ থেকে ৭১, দুই বাংলা যত দিন দিল্লিমুক্ত না হবে, তত দিন মানবসৃষ্ট দুর্যোগ কাটবে না। দিল্লির সাথে দুই বাংলার দূরত্ব বনাম দুই বাংলার নৈকট্য, দুই হাজার মাইল দূরত্বে দুই পাকিস্তানের মতোই অদৃশ্য অভিশাপ। আওয়ামী লীগ যত দিন থাকবে, ভারতের সাথে ভেজাল পররাষ্ট্রনীতির নাড়িকর্তন অসম্ভব। ভারতের পাকস্থলির মধ্যে আমরা, হজম করে ফেলেছে। ভারতের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, আওয়ামী লীগ মতায় না থাকলে পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য টুকরা-টুকরা হবে। আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি, অখণ্ডতা বজায় রাখতে সব করবে। এই অদৃশ্য শৃঙ্খল যত দিন না আলোচনায় আসবে, জ্বলবে বাংলাদেশ। সুতরাং ২০৪১ সাল পর্যন্ত যতবার নির্বাচন হবে, ভারতের প্রয়োজনে প্রতিবারই জিতবে এরা। ৫ জানুয়ারি সর্বশেষ প্রমাণ। ৪৭, ৭১, ৫ জানুয়ারি ধারবাহিকভাবে কংগ্রেসের কর্ম। এই সত্য যত দ্রুত উপলব্ধি করবে, তত দ্রুত নিভবে আগুন। তাদের দুই প্রেসক্রিপসন- হয় সিকিম, নয় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ জরুরি। বারবার প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সাউথ ব্লকের ষড়যন্ত্রে গরু, সুপারি আর মতার মোহমুক্তি সম্ভব না। তর্কবিদেরা বলবেন, দিল্লির উপনিবেশবাদের কারণেই রাওয়ালপিন্ডি বিদায়।
বারবার বার্ন ইউনিটের উত্তাপ অনুভবে ব্যর্থ ভিশনারিরা, হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। এরাই পৃথিবীর বহু দেশে বিএনপি-আওয়ামী লীগ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এমনকি পাকিস্তানি বা ভারতীয়রা বিদেশের মাটিতে দেশীয় রাজনীতি করে না। ভারতীয়রা সব সময় দেশকে তুলে ধরার কাজে নিয়োজিত, পাকিস্তানিরা সাতে-পাঁচে নেই। একমাত্র বাঙালি কমিউনিটিতেই ঘরে ঘরে বিএনপি-আওয়ামী লীগ, বাংলা পত্রিকার ঢল। সেপ্টেম্বর মাস এলে স্বরূপে বিকশিত হয় কেনেডি এয়ারপোর্টে। খালেদা-হাসিনার ছবি নিয়ে মারামারি শুরু করলে এয়ারপোর্টের পুলিশ মধ্যখানে দাঁড়ায়। বুদ্ধিবৃত্তিতে খরার প্রভাব, দূরদেশেও।
এই দফায় ৫ জানুয়ারির ফ্যাসিজমকে জোর করে গণতন্ত্র বলে চালিয়ে দেয়ার দানবীয় চেষ্টা। এদেরকে সাহায্য করছে প্যারোলে থাকা লাখ লাখ আওয়ামী শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্ররূপী সন্ত্রাসীরা। এরাই পরপর নেহেরু, ইন্দিরা এবং প্রণবের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিল। আবারো কংগ্রেসের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ৫ জানুয়ারি কায়েম করেও বুঝতে অক্ষম। অবাঙালি নয়, বারবার বাঙালি মুসলমানেরাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে আর সব দোষ খান সাহেবদের? জঙ্গিবাদের সমালোচনা করি; কিন্তু সংসদীয় জঙ্গিবাদ যে কত ভয়ঙ্কর- প্রমাণ বাংলাদেশ।
মহাত্মা, লিয়াকত আলী খান, মুজিব, ইন্দিরার করুণ পরিণতি কাম্য নয়। বেঁচে থাকবে এবং বাঁচতে দেবে। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি এবং পরিবার নিয়ে শান্তিতে থাকার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের জন্মগত। এখানে হাত দিলেই পুড়বে। যারাই অতীত থেকে শিক্ষা না নিয়ে বারবার ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ভুল করে, বলছি সাধু সাবধান!
৭৫ বছরের ইতিহাস বলছে, ৪৭-কে কেন্দ্র করে যতগুলো যুদ্ধ এবং দাঙ্গা, একসাথে যোগ করলে মাঝারি আকারের বিশ্বযুদ্ধের সমান। দেশ বিভাগের আগে ও পরের গণহত্যাগুলোর পরিসংখ্যান নেই। কোটি কোটি মানুষের দেশ হারানোর কষ্ট পরোয়া করেন না বুদ্ধিজীবীরা। ইতিহাস সাক্ষী দেয়, অমীমাংসিত দেশ বিভাগের দৃশ্যপট পাল্টে দেয়ার সুযোগ বৃহত্তর বাংলার বুদ্ধিজীবীদের হাতেই ছিল। দিল্লি সব সময় দুই বাংলার রাওয়ালপিন্ডি এবং দুই বাংলা জমজ বোনের মতো। ভারতীয় আগ্রাসনের গভীরতা কখনোই বুঝতে চান না বুদ্ধিজীবীরা। দিল্লির গরু, সুপারি আর মতার ষড়যন্ত্রমুক্ত না হওয়া পর্যন্ত জ্বলবে বাংলাদেশ।
ভুলের কিছুটা নমুনা। লাহোর প্রস্তাব ভালো কিন্তু মুসলিম লীগ খারাপ। ডাইরেক্ট অ্যাকশন ভালো, কিন্তু পাকিস্তান খারাপ। মুসলিম লীগ খারাপ, কিন্তু পাকিস্তান ভালো। জিন্না খারাপ, কিন্তু কেবিনেট মিটিং ভালো। ভাষা আন্দোলন ভালো, কিন্তু লাহোর প্রস্তাব ভালো না। যুক্তফ্রন্ট, মুসলিম লীগ কোনোটাই ভালো না বরং ছয় দফাই সব। সমাধান দেয়নি কাগমারি সম্মেলন, এনডিএফ চাই। গোলটেবিল ভালো, কিন্তু বেসিক ডেমোক্র্যাসি খারাপ? এরই ধারাবাহিকতায় একদলীয় ও বহুদলীয় গণতন্ত্র, বাংলাদেশের শরীরে জমজ সন্তানের মতো মাথা থেকে পা পর্যন্ত জোড়া। দিল্লি না রাওয়ালপিন্ডি, একবারো সঠিক সিদ্ধান্ত নেননি বুদ্ধিজীবীরা।
লাহোর প্রস্তাবের ৭৫ বছর পর, যে পর্যন্ত না ৪৭, ৭১ ও ৫ জানুয়ারির মীমাংসা হবে, তত দিন পর্যন্ত জেরুসালেম আর কাশ্মিরের মতো অমীমাংসিতই থাকবে বাংলাদেশ। এক একর জমি লালনপালনে পরিকল্পনা লাগে, ৫৬ হাজার বর্গমাইলের জন্য লাগে না? ’৭৪-এর মতো আবারো কতকাল র্যাব-পুলিশ দিয়ে জনজীবন চালাতে চায় আওয়ামী লীগ? বন্দুকের নল উত্তর হলে, আইয়ুব-এরশাদের দোষটা কোথায়? দেশ বিভাগের পর থেকে এদের নেতৃত্বে যুদ্ধ-দাঙ্গা অনেকটাই রুয়ান্ডা-বসনিয়ার মতো। একমাত্র পাগল আর শিশুই বলবে না, লাহোর প্রস্তাবের ভিত্তির ওপর দাঁড়িয়ে নেই বাংলাদেশ।
যারা নিজেকে অস্বীকার করে, তারা কাউকেই স্বীকার করে না। তখন তাদের কাজ অন্যের দোষ খোঁজা। ধরে নিতে পারি, ইংরেজ উপনিবেশের নর্দমাগুলো ৫৬ হাজার বর্গমাইলেই শেষ করেছিল কংগ্রেস। সেই নর্দমার বিষেই বুদ্ধিজগতে ধস। এর ভয়ঙ্কর প্রভাব পড়েছিল দেশ বিভাগে।
বারবার ভুল করা বুদ্ধিজীবীদের কাছে প্রশ্ন- এখন সমস্যা কোনটা? ৫ জানুয়ারিতে অবৈধ নির্বাচন করে ক্ষমতায় যায়নি ২০ দলীয় জোট। ৫ জানুয়ারির আগে বহু মানুষ পুড়ে মরার পর বার্ন ইউনিটের যেন পুনরাবৃত্তি না হয়, সেই জাদুরকাঠি যার হাতে, তিনি কি তার দায়িত্ব পালন করেছেন? নিরপেক্ষ নির্বাচন না দিয়ে বরং বারবার বার্ন ইউনিটে যাওয়া জর্জ বুশের মিশন কমপ্লিটের মতো দুরভিসন্ধিমূলক। পশু না, আমরা মানুষ। ৪৭ ও ৭১ পারেনি, এবার ৫ জানুয়ারির জবাব প্রতিটি বাঙালি মুসলমান বুদ্ধিজীবীকে অবশ্যই দিতে হবে। প্রমাণসাপেক্ষে নির্বাচনজনিত গণহত্যারও বিচার হবে। ১৬ ডিসেম্বরের পর পাকিস্তান বিদায়, ৪৭ সাল থেকে ৭৪ পর্যন্ত একবারো সৈন্য নামাতে হয়নি ভারতে। আমাদের ইতিহাস কী বলে? প্রধান সমস্যা হলো, বুদ্ধিজীবীদের বুদ্ধিবৃত্তিতে ধস। ভোটের অধিকার ছিনতাইকারীদের কার্যালয় ঘেরাও না করে, করছে উল্টোটা।
যুদ্ধ-দাঙ্গায় যাদেরকে মরতে হয় তারা ভাগ্যবান। কিন্তু যারা বেঁচে যায় আমৃত্যু ওই স্মৃতি বহন করে। তাদের জীবন কখনোই স্বাভাবিক হয় না। দেশ বিভাগের পর জন্ম নেয়া আমিও তাদেরই একজন। জীবনের প্রথম অর্ধেক কাটল হিন্দু-মুসলমানের যুদ্ধ-দাঙ্গা আর দেশ ত্যাগের ধারাবাহিকতা দেখে। প্রথম নষ্ট অভিজ্ঞতা, ১৯৬৪-এর দাঙ্গা। বাবার মুখে শুনেছি, প্রত্যক্ষ সংগ্রাম দিবসকে কেন্দ্র করে কলকাতা-নোয়াখালীতে ভয়ানক দাঙ্গা। ৫০-এ ক্ষতিগ্রস্ত আমার পরিবারও। পরপর ১৯৪৭, ৪৮, ৫০... লাগাতার মারদাঙ্গায় ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে মানবসৃষ্ট দুর্ভোগের কারণ আলোচনায় না থাকলে আজকের সমস্যার সমাধান হবে না। একসাথে স্বাধীন হয়েও কোথায় চলে গেল ভারত! ভোটের ১৫ দিন পর্যন্ত বাক্সগুলো নির্বাচন কমিশনের জিম্মায় থাকে। ৬৭ বছরে এই কথা কি একবারো বলতে পেরেছি? বুদ্ধির গভীরতা এতটাই নিম্নমানের, প্রতিবারই যা চায়, কড়ায়-গণ্ডায় পায়; কিন্তু প্রতিবারই সঠিক সিদ্ধান্ত নিতে ভুল করে।
৯৬ শতাংশ ভোট দিয়ে এরাই আনল পাকিস্তান, ওই রাতেই সিদ্ধান্ত পাকিস্তান ভালো না। ধর্মভিত্তিক দেশ বিভাগ ছাড়া মানবেই না, ৭২-এ পৌঁছে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি আর বিষ্ঠা এক সমান। এই রাজনীতির পুনঃপ্রতিষ্ঠা করে জিয়াউর রহমান হলেন মুক্তিযুদ্ধের কলঙ্ক; কিন্তু ধর্মকে সংবিধানের অংশ করা এরশাদ হলেন সবচেয়ে ভালো। ৮৬-তে এরশাদ খারাপ, কিন্তু জামায়াত ভালো। ৯৬-তে এরশাদ ও জামায়াত দুইই ভালো। বুদ্ধিজীবীরা কী চান, জানেন তো? ৪৭ সালে সৃষ্ট বাংলা-পাঞ্জাবের শরীরে ছুরি চালিয়ে দুই ব্যাগ ভর্তি অদ্ভুত পাকিস্তান, ইতিহাসের নিকৃষ্ট কলঙ্ক। দুই হাজার মাইল দূরত্বে মাথা আর পা, মধ্যখানে কাশ্মিরের ক্যানসার নিয়ে রামরাজত্ব ভারতের। এই দৃষ্টান্ত পৃথিবীর কোথাও নেই।
পৃথিবীর আর কোথাও এত অল্প সময়ে এতগুলো যুদ্ধ, দাঙ্গা আর দেশত্যাগের ঘটনা ঘটেনি। দুইবার দেশ কর্তনও হয়নি। তখন দাবি ৯ + ৫ = ১০। আমার কথা, ডাইরেক্ট অ্যাকশন সবচেয়ে বড় ভুল। ওদের চোখে ডাইরেক্ট অ্যাকশনই একমাত্র পথ। লাহোর প্রস্তাবের বিকল্প অবশ্যই ছিল। বিধানসভা পরপর দুই দফা তাদের দখলেই। দিল্লির কেবিনেট মিটিংয়েই কংগ্রেসের উদ্দেশ্য পরিষ্কার। ইতিহাস বলে, অস্পৃশ্যদের মতো বাঙালি মুসলমানদেরকেও দীর্ঘ সময় বঞ্চিত রেখেছিল কট্টর হিন্দুত্ববাদীরা। ফলে বুদ্ধি প্রয়োগে নেতিবাচক প্রভাব অবশ্যই পড়েছিল ভারত ভাগের সময়। ইতিহাসের এই অধ্যায়টি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। হাঁটি হাঁটি পা পা করে দুই দফা বিধানসভার মতা পাওয়ার মতো অসম্ভব সম্ভব করলেও, আসল অঙ্কে ভুল করলেন বুদ্ধিজীবীরা। অর্থাৎ ৬৭ বছর যা ঘটছে, অতীতের বুদ্ধিহীনতার প্রতিচ্ছবি।
যে মুহূর্তে কনফেডারেশন সরকারের দাবি বাতিল হলো, বৃহত্তর বাংলার মুখ্যমন্ত্রীর তখনই সুযোগ ছিল প্রত্যক্ষ সংগ্রাম না করে পুরনো দাবিতে ফেরা। প্রয়োজনে দুই-চার বছর অপেক্ষা করলে ক্ষতি ছিল না। সে রকম হলে ইংরেজরা যেনতেন ও অসম দেশ বিভাগ চাপিয়ে দিতে পারত না। কাশ্মির কিংবা ছিটমহলেরও প্রশ্ন উঠত না। একই অস্থিরতার পুনরাবৃত্তি ৭১-এ। এখনই এই মুহূর্তে সব সমস্যার সমাধান চাই। মাত্র ৯ মাসে স্বাধীনতা পৃথিবীতে একটাই। এরপর রাওয়ালপিন্ডিকে সরিয়ে সাউথ ব্লকের কবলে। সারা পৃথিবীতেই মুসলমান, তার মানে এই নয়, সব দেশেই মুসলমানদের জন্য আলাদা-আলাদা দেশ বানাতে হবে। ভুলগুলো যত দিন না আলোচনায় আসবে, তত দিন পর্যন্ত আজকের সমস্যার গোড়া খুঁজে পাবে না।
পাকিস্তানি আর বাঙালিদের ভাষা-সংস্কৃতি যে ভিন্ন, তারা জানতেন। তখনই সাবধান হলে ৬৭ বছর ধরে যা হচ্ছে, হতো না। বাংলা ভাগ হলেও অল্পসংখ্যক মুসলমান ভারত ছেড়েছে, এপার বাংলার হিন্দুদের সংখ্যা ৩৮ থেকে কমে ৮ ভাগের প্রধান কারণ, বারবার যুদ্ধ-দাঙ্গায় অনিরাপত্তাবোধ। সত্য যে, ভারত ভাগের পক্ষে ৯৬ ভাগ ভোট বাঙালিদের আর ৪৯ ভাগ অবাঙালিদের। আমার অভিজ্ঞতায়, এদের রাজনীতির প্রধান পুঁজি লাঠি বনাম ভারতীয়দের বুদ্ধির সুব্যবহার। আজকের সঙ্কটের সূত্র ধামাচাপা দিলে আরো যুদ্ধ, আরো দাঙ্গা হবে। অন্যথায় ৪৭-এর মাত্র ২৪ বছর পর আরেকটা যুদ্ধ করতে হতো না।
ডাইরেক্ট অ্যাকশনের কারণেই রেডক্লিফেকে জরুরিভিত্তিতে তলব করে সৃষ্টি করা হলো অদ্ভুত দু’টি দেশ, যার শরীরটা মধ্যখানে আর মাথা ও পা দুই হাজার মাইল দূরত্বে। বাংলা-পাঞ্জাবকে শ্মশান করা দেশ বিভাগের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বহু বছর গবেষণা ও বিতর্ক চলতে পারে। কয়েক দিনে খুন হলো প্রায় ১৫ লাখ, রিফিউজি আরো লাখ লাখ, জন্ম থেকেই জ্বলছে সবগুলো দেশ। কাশ্মিরসহ ভারতের অনেক অঙ্গরাজ্যের অবস্থা ৭১-এর মতো। আমাদের রসদ জোগানো ভারতের ৭১ ঠেকানোর দায়িত্ব, সর্বদাই আওয়ামী লীগের ঘাড়ে। এই উপলে উভয় পরে সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র এবং এটাই বাংলাদেশের এক নম্বর সমস্যা।
মধ্যরাতেই কলকাতায় বুদ্ধিজীবীদের বৈঠক, হায় হায়! পকিস্তান ভালো না, আলাদা হতে হবে। আমার প্রশ্ন- ডাইরেক্ট অ্যাকশনের আগে ছিলেন কোথায়? যুদ্ধ, খুনাখুনি ও দাঙ্গায় কেটে গেলো ৪৭, ৪৮, ৫০, ৬২, ৬৪, ৬৫, ৭১...। ৯৬ শতাংশ ভোট দিয়ে পাকিস্তান আনল, কিন্তু পাকিস্তান ভালো না। ভাঙো ১৪৪ ধারা, পেটাও জিন্নাকে। রাতারাতি ইতিহাস গড়ল ভাষা আন্দোলন। তারপর? এবার যুক্তফ্রন্ট করে দেখিয়ে দিতে হবে। যুক্তফ্রন্ট হলো, তারপর? দেশ বিভাগ করা বুদ্ধিজীবীদের মারামারি-কাটাকাটি বাড়ল দেড়শ’ দ্বিগুণ। একজন আরেকজনের মুখ দেখে না। একজন আরেকজনের ভোটকেন্দ্রে ডাকাতি করতে এক ডজন জাহাজ নিয়ে হাজির হয়। আনল পাকিস্তান আওয়ামী লীগ, আওয়ামী লীগ, ন্যাপ... কাগমারি সম্মেলনেই স্বায়ত্তশাসন কায়েমের অবস্থা সৃষ্টি করলে আইয়ুব খানের আগমন। যুক্তফ্রন্ট ফেল, তারপর? হুজুর ভাসানী নাম দিলেন নাথিং ডুইং ফ্রন্ট, অর্থাৎ এনডিএফ। সেটাও যথাসময়ে ফেল। আইয়ুব খানের স্বৈরগণতন্ত্রের বেসিক ডেমোক্র্যসির সাথে যোগ দিলেন মোনায়েম খান ও সবুর খানের মতো বড় বড় শিংওয়ালা বুদ্ধিজীবীরা। ওটাই স্বৈরগণতন্ত্রের প্রসব। সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুতে মুজিবের প্রত্যাশিত চন্দ্রগ্রহণ কাটল। মরেনি মুসলিম লীগ, তাই ছয় দফাকে কেন্দ্র করে আবারো দ্বিখণ্ডিত। এক ভাগ চায় পাকিস্তান, অন্য ভাগ বাংলাদেশ। ধর্মভিত্তিক নয়, বরং এবার নিজেদের মধ্যেই দুই নম্বর ডাইরেক্ট অ্যাকশন।
সীমান্তের কাছে হওয়ায়, ৬৪-এর ভয়াবহ দাঙ্গা দিয়ে আমার ক্ষতবিক্ষত স্মৃতির ভাণ্ডারে প্রথম নষ্ট অভিজ্ঞতার শুরু। আসাম থেকে মুসলমানের ঢল আর গভীর রাতে এপার থেকে হাজার হাজার হিন্দু দেশ ছাড়ে। ৫০-এরপর ৬০-এর দশকে আবারো পাল্টে যেতে থাকল শহরের চেহারা, সাইনবোর্ড, শিক্ষাঙ্গন ইত্যাদি। কৈশোরের লণ্ডভণ্ড অভিজ্ঞতা। ৪৮-এর পর কাশ্মিরকে কেন্দ্র করে আবারো ৬৫-এর যুদ্ধে ভয়ানক সাম্প্রদায়িক অসম্প্রীতিতে মুখোমুখি দুই প। যুদ্ধ হয় দুই পাকিস্তানে, বেশি ক্ষতিগ্রস্ত এপারের হিন্দুরা (ওপারের ক্ষতিগ্রস্তরা তুলনামূলক কম)। ৬৫-কে কেন্দ্র করে সৃষ্টি হলো ঐতিহাসিক শত্রুসম্পত্তি, যার পরিমাণ পৃথিবীতে আজ পর্যন্ত এক নম্বর। পাকিস্তান আনল, কিন্তু ছয় দফার দাবিতে ফের দেশ অচল। এবার কংগ্রেস নেই; বরং বাঙালি বনাম বাংলাদেশী জাতিয়তাবাদের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে আরেকটা হলোকস্ট।
৬০-এর দশকে লাগাতার আন্দোলন, মিছিল-মিটিংই যেন জীবন। একবার ছয় দফা আবার ১১ দফা। স্বায়ত্তশাসন বনাম স্বাধীনতার মধ্যে তালগোল পাকিয়ে ফেলা। দম নেয়ার ফুরসত নেই। দেশ বিভাগের ২৪ বছর পর, ৭১-এ আবারো বিশ্বকাপ জিতল; কিন্তু সেটাও অনেকেরই পছন্দ নয়। কাশ্মির নই, কিন্তু কম কিসে?
৪৭-এর মতোই ৭১ এসেছিল বহু অমীমাংসিত প্রশ্ন নিয়ে। রাওয়ালপিন্ডিকে সরিয়ে এবার দিল্লি। স্বাধীন হওয়ামাত্র রক্ষীবাহিনী, বাকশাল, র, কম্বলচোরদের জয়জয়কার। সকালে রাষ্ট্রপতি, দুপুরে প্রধানমন্ত্রী, বিকেলে আবার রাষ্ট্রপতি- কোনটা চান মুজিব নিজেও জানেন না; কিন্তু মানুষের কী হবে, সেটা ভাবনা নয়। নব্য দখলদার, কালোবাজারারি আর রক্ষীবাহিনীর মিশনে অতিষ্ঠ জীবন। সিরাজ শিকদার হত্যা মুজিবতন্ত্রের অন্যতম চমক। ৭৩ সালে তিন টাকা সের চিনি, ৭৪ সালে ৩৩ টাকা। এক দিকে দুর্ভি, অন্য দিকে ফুলের মালা আর মানপত্র নিয়ে ব্যস্ত মুজিব। টাইম ম্যাগাজিনে জালপরা বাসন্তীর ছবি নিয়ে হইচই। যুদ্ধ ফেরত উচ্ছৃঙ্খল বাহিনীগুলোর খুনাখুনিতে ভয়ঙ্কর অবস্থা আমার স্মৃতির ভাণ্ডারে অন্যতম নষ্ট অভিজ্ঞতা। কে অস্বীকার করবে সাড়ে তিন বছরের দুঃশাসন? আমার অভিজ্ঞতায় বাঙালি বুদ্ধিজীবীরা সর্বদা ১০ নম্বর মহাবিপদ সঙ্কেতের মতো। রুয়ান্ডা ও বসনিয়ার কথা বলি, কিন্তু আমাদের বেলায় কোনটা কম!
৭২ থেকে ৭৫-এর জবাব দিতে চলে গেল ৯০। বর্তমান দুর্ভোগের জন্য দায়ী ছয় দফা বনাম স্বায়ত্তশাসনের মধ্যে আজ পর্যন্ত মীমাংসা না করা। রাজাকার বনাম মুক্তিযোদ্ধার সংজ্ঞা স্পষ্ট না করা। তর্কবিদেরা বলবেন, বঙ্গবীর রাজাকার হলে গোলাম আযম মুক্তিযোদ্ধা! ভুয়া মুক্তিযোদ্ধাদের রমরমা সার্টিফিকেটবাণিজ্য তাই আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের মতে এ কে খন্দকার একটা রাজাকার। পাঠ্যপুস্তক থেকে ভাসানী, জেনারেল ওসমানী ও বঙ্গতাজের মতো গর্বিত সন্তানেরা উধাও? ইনডেমনিটি দিয়ে স্বাধীনতার ঘোষক সাব্যস্ত করতে হলে মুক্তিযুদ্ধের চেতনা কারো পৈত্রিক সম্পত্তি। ‘জয়বাংলা’ বনাম ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদের’ যুদ্ধ হেঁটে হেঁটে আসেনি। হুটু-টুটসিদের মতো নিজেরাই খুনাখুনি, আর সব দোষ ৭৫-এর? ভেবেছিল ৯০ পার হলেই বাংলাদেশ এমন গণতন্ত্র পাবে, ব্রিটেনের সংসদীয় গণতন্ত্র পর্যন্ত লজ্জা পাবে। দুই মহিলার নেতৃত্বে এরশাদের অবস্থা খান সাহেবদের মতো ছেড়ে দে মা কেঁদে বাঁচি। বিদেশী দূতদের জানা উচিত, সংলাপ কত সহজলভ্য, ৯০-এ প্রমাণ করেছেন দুই নেত্রী। এরশাদকে টেনে নামানোর জন্য দুই নেত্রীর ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ঘটনা কে না জানে! ৯১ সাল থেকে স্বাধীনতার ঘোষক প্রশ্নে দুই-সতীনের চুলাচুলির শুরু। বুদ্ধিজীবীরা বলেন, সংসদীয় গণতন্ত্র হলো, কিন্তু ৯২ সালে এসব কী? বাবরি মসজিদ ভাঙ্গল ওই পারে আর গণহত্যা এই পারে? পাকিস্তানের চেয়ে দীর্ঘ সামরিক শাসন আর স্বৈরগণতন্ত্রের চেহারা দেখে বুদ্ধিজীবীরা গান গায়- ভুল সবই ভুল, এই জীবনের পাতায় পাতায় যা লেখা সবই ভুল...।
৮৬ থেকে যা পেলাম। জামায়াত বহুদলীয় গণতন্ত্র, কিন্তু এরশাদ মহাস্বৈরাচার। একবার জামায়াত সন্ত্রাস, পরেরবার এরশাদ। বহুদলীয় গণতন্ত্র ভালো, কিন্তু মুক্তিযোদ্ধা জিয়াউর রহমান একটা খাঁটি রাজাকার। ক্ষমতার প্রশ্নে জামায়াত আর জাতীয় পার্টি- দুই নেত্রীর চোখে দুই কোহিনূর। এক দল ধরে, অন্য দল ছাড়ে। ক্ষমতার প্রয়োজন হলেই একজনকে পাঠায় ফাঁসির মঞ্চে, আরেকজনকে নামায়। ফাঁসির সুইচ অন-অফ খেলা, দুই নেত্রীর ক্ষমতায় যাওয়ার কৌশল। তার পরেও ৫ জানুয়ারি নিয়ে বুদ্ধিজীবীদের বক্তব্য কী প্রমাণ করে?
ছয় দফা যে স্বায়ত্তশাসন বা স্বাধীনতা কোনোটাই নয়, উত্তর- ৯১ থেকে ২০১৫-এর অদ্ভুত গণতন্ত্র যেখানে সংসদ মানেই বিরোধী দল রাস্তায়। দুই দফায় ৩০৩ দিন আওয়ামী হরতালের বিশ্বরেকর্ড এখন পর্যন্ত ভাঙতে পারেনি বিএনপি। জনতার মঞ্চ বানিয়ে প্রত্য সংগ্রাম দিবসের রক্তারক্তির রেকর্ডও ভাঙতে পারেনি ২০ দলীয় জোট। বাংলাভাই অবশ্যই খারাপ, কিন্তু আওয়ামী লীগের অস্ত্র আর ক্যাডার সরবরাহকারী এরশাদ শিকদার নিশ্চয়ই ধোয়া তুলসিপাতা নন। নিজেদের গায়ে গ্রেনেড হামলার মল; কিন্তু ২৮ অক্টোবরে আওয়ামী সন্ত্রাসের মুখোশ খুলতে ব্যর্থ বিএনপি। গানপাউডার ছিটিয়ে আগুন, পেট্রলবোমার রেকর্ড এখন পর্যন্ত আওয়ামী লীগেরই সম্পদ। একটা পড়লে ১০টা লাশ চাই, শেখ হাসিনা ঘোষণা দিলেন মানুষ মারার রাজনীতির (ইউটিউব)। ওই তো শুরু। তুলনামূলকভাবে বিএনপির জাতীয়তাবাদ অনেকটাই জিন্নার পোকায় খাওয়া পাকিস্তানের মতো, ধুঁকে ধুঁকে মরছে। এত বছর মতায় থেকেও না জাতীয়তাবাদ, না জাতীয় কবির অস্বস্তি, কোনোটাই প্রতিষ্ঠা করতে পারলো না জাতীয়তাবাদী দল।
এরশাদ গেল কিন্তু মারামারি-কাটাকাটি আগের মতোই। তত্ত্বাবধায়ক সরকার হলেই ওঁম শান্তি! সংসদীয় গণতন্ত্র না এসে যাবেটা কোথায়! জনতার মঞ্চ থেকে লাগাতার হরতাল আর মানুষ খুনের ঘোষণা দিয়ে তত্ত্বাবধায়ক সরকার আদায় যেন আরেকটা ৪৬। সংসদ খালি, কয়েক দিন পরপরই হরতাল। রাস্তায় মুখোমুখি গানপাউডার বনাম জলকামান গণতন্ত্র? বুদ্ধিজীবীরা বলেন, ১-১১ এলেই সব ঠিক। তারপর? ৪৭-এর মতো আবারো বিদেশীরাই ঠিক করল, ২০০৮ সালে জিতবে শেখ হাসিনা, হারবে খালেদা জিয়া। মাইনু-ফকরু বললেন- আসেন বসি, ঘোড়া দিয়েছে প্রণববাবু, ঘোড়ায় বসে আলাপ করি। সাউথ ব্লকের প্রেসক্রিপশন পূরণ হলেই ওঁম শান্তি। প্রথম শর্ত, বিডিআর নির্মূল করে সীমান্তের দখল পরিবর্তন। দ্বিতীয় শর্ত, ভারতের স্বাধীনতাকামীদের ঠেকাতে ভবিষ্যতের যেকোনো উৎপাত দমনে প্রয়োজনীয় সংশোধনী ও ইনডেমনিটি। সাউথ ব্লকের বিরুদ্ধে যেকোনো সংগ্রাম শক্তহাতে দমনের আইন সংশোধনীতে থাকতে হবে। ১৭৫৭ সালের মতো আরেক খায়রুল হককে খুঁজে পেতে এক মুহূর্তও দেরি করল না নব্য ইস্ট ইন্ডিয়া কোম্পানির বুদ্ধিজীবীরা। ৩২ নম্বর ট্রাস্টের অর্থগ্রহণ বনাম ১৫তম সংশোধনী পাস, আদালতে অবশ্যই কনফিক্ট অব ইন্টারেস্ট। পলাশির সেনাপতিরা অস্ত্র সমর্পণ করলে সর্বসম্মতিক্রমে আবারো জ্বলে উঠল বাংলাদেশ।
সাতটি মহাদেশে সাত রকমের সমস্যা, বাংলাদেশে একসাথে সব মহাদেশের সব সমস্যা। সিমলা চুক্তি থেকে পার্বত্য চট্টগ্রাম শান্তিচুক্তি, এখানে নেই এমন কোনো সমস্যা পৃথিবীতে নেই। ৪৭-এর আগে এবং ১-১১-এর পর, বুদ্ধিজীবীদের যন্ত্রণায় অতিষ্ঠ ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে প্রতিটি জীবন। বাকশালকে পরাজিত করার মতো অভূতপূর্ব শাসনতন্ত্র প্রসব করল ৫ জানুয়ারি। ১-১১ আনা বুদ্ধিজীবীরা মাথা চুলকায়। সব করলাম ভাই, উকুন গেল না। মনে হয় উকুন না, মাথার মধ্যে শুঁয়োপোকা। চাইলাম গণতন্ত্র, এসে গেল মনমোহন-পুতিনের উন্নতিতন্ত্র। উন্নতি ধুয়ে কি পানি খাবো? ব্রিটিশ-পাকিস্তান সব দেখলাম; কিন্তু এই রকম উন্নতি জীবনেও দেখেছি? দেখেন খবরের কাগজগুলো কী লেখে! শোনেন টকশোতে কী বলে! ১০ বছরে কত মানুষ খুন হলো, ভাবতে পারেন? ভাই! রুয়ান্ডা-বসনিয়া ফেল! ভুল সবই ভুল...। ১৫তম সংশোধনী নাটকের সর্বশেষ পর্ব। যাদের সাথে একাধিকবার সংসদে এবং বিরোধী দলে, সেই জামায়াতের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের মেনুফেস্টোতে তিন নম্বর ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ঘোষণা। যারা মেন্ডেলার ইতিহাস পড়েছেন, নিশ্চয়ই জানেন, বর্ণবাদ সমস্যা সমাধানে তার ঐতিহাসিক ভূমিকার কথা। ঠিক তার উল্টো, দেশটাকে রুয়ান্ডা-বসনিয়া বানানোর জন্য আওয়ামী লীগের এই একটি সিদ্ধান্তই যথেষ্ট। যুদ্ধাপরাধের বিচারকে কেন্দ্র করে মুসলিম লীগ নির্মূলের ধারবাহিকতায় জামায়াত-বিএনপি নির্মূলই লক্ষ্য। কৃতকার্য হলে ২০৪১ পর্যন্ত মতার গ্যারান্টি। সুতরাং নামানো হলো ইমরান সরকারের নামে র-বাহিনী। সুজাতা সিংয়ের আগমনে, গণতন্ত্রের চেহারা হলো ৫ জানুয়ারির মতো। সুজাতার প্রেসক্রিপশন, এরশাদকে সিএমএইচে ঢুকিয়ে নির্বাচনের শক দাও। শক খেয়েই এরশাদ প্রধানমন্ত্রীর বিশেষ উপদেষ্টা। এরই নাম সাউথ ব্লক- এই আচার যে খায়নি, বুঝবে না কত ঝাঁঝ। বুদ্ধিজীবীদের একাংশের স্বপ্নভঙ্গ ছয় দফা, ১১ দফা, ৭১... ভুল? মধ্যরাতের টকশোতে দুই দল বসে ‘অদৃশ্যের’ সাথে যুদ্ধ করে। এই জন্য লাইভ মারামারিও করেন। করের টাকায় তিন মাস পরপর মিলিয়ন ডলারের বকপক্ষিটি উড়ে এসেই ডিজিটাল উন্নতি আর নতুন নতুন সন্ত্রাসের ফর্মূলা ঢুকিয়ে দিয়ে হাওয়া। প্রমাণ হয়েছে, গণ্ডগোল বাধানোই বকপক্ষিটির কাজ। আওয়ামী বুদ্ধিজীবীদের দাবি- গণতন্ত্র হচ্ছে ফিউডালিজমের মতো, ‘রাজা লুই’ যা বলবে, সেটাই আহেলি কিতাব। কম গণতন্ত্র, বেশি উন্নতি; অবশ্যই ভিশন-২০২১ ও ২০৪১ হবে রাশিয়া ও চীনের মতো। যাদের পছন্দ না, নির্মূল করা হবে। এই উপলে যা করার, দেখিয়ে দেবো। দুঃখে অনেকেই লুকিয়ে লুকিয়ে গান করেন, ভুল সবই ভুল...।
ছয় দফা স্বাধীনতা নাকি স্বায়ত্তশাসন প্রশ্নে যত দিন সমঝোতা না হবে তত দিন ৭১ প্রশ্নবিদ্ধ যুদ্ধ রূপে বহাল থাকবে। ইতিহাসে এর স্থায়ী ঠিকানা কখনোই হবে না। কারণ ভারতীয়রা এর নাম দিয়েছে চতুর্থ ইন্দো-পাক যুদ্ধ এবং সব প্রশ্নের উত্তর এখানেই। ৪৭ থেকে ৭১, দুই বাংলা যত দিন দিল্লিমুক্ত না হবে, তত দিন মানবসৃষ্ট দুর্যোগ কাটবে না। দিল্লির সাথে দুই বাংলার দূরত্ব বনাম দুই বাংলার নৈকট্য, দুই হাজার মাইল দূরত্বে দুই পাকিস্তানের মতোই অদৃশ্য অভিশাপ। আওয়ামী লীগ যত দিন থাকবে, ভারতের সাথে ভেজাল পররাষ্ট্রনীতির নাড়িকর্তন অসম্ভব। ভারতের পাকস্থলির মধ্যে আমরা, হজম করে ফেলেছে। ভারতের বডি ল্যাঙ্গুয়েজ, আওয়ামী লীগ মতায় না থাকলে পশ্চিমবঙ্গসহ কয়েকটি অঙ্গরাজ্য টুকরা-টুকরা হবে। আওয়ামী লীগের প্রতিশ্রুতি, অখণ্ডতা বজায় রাখতে সব করবে। এই অদৃশ্য শৃঙ্খল যত দিন না আলোচনায় আসবে, জ্বলবে বাংলাদেশ। সুতরাং ২০৪১ সাল পর্যন্ত যতবার নির্বাচন হবে, ভারতের প্রয়োজনে প্রতিবারই জিতবে এরা। ৫ জানুয়ারি সর্বশেষ প্রমাণ। ৪৭, ৭১, ৫ জানুয়ারি ধারবাহিকভাবে কংগ্রেসের কর্ম। এই সত্য যত দ্রুত উপলব্ধি করবে, তত দ্রুত নিভবে আগুন। তাদের দুই প্রেসক্রিপসন- হয় সিকিম, নয় ব্রিটিশ উপনিবেশবাদের বিরুদ্ধে গণজাগরণ জরুরি। বারবার প্রমাণ হয়েছে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে সাউথ ব্লকের ষড়যন্ত্রে গরু, সুপারি আর মতার মোহমুক্তি সম্ভব না। তর্কবিদেরা বলবেন, দিল্লির উপনিবেশবাদের কারণেই রাওয়ালপিন্ডি বিদায়।
বারবার বার্ন ইউনিটের উত্তাপ অনুভবে ব্যর্থ ভিশনারিরা, হ্যামিলনের বংশীবাদকের মতো। এরাই পৃথিবীর বহু দেশে বিএনপি-আওয়ামী লীগ করে তাক লাগিয়ে দিয়েছে। এমনকি পাকিস্তানি বা ভারতীয়রা বিদেশের মাটিতে দেশীয় রাজনীতি করে না। ভারতীয়রা সব সময় দেশকে তুলে ধরার কাজে নিয়োজিত, পাকিস্তানিরা সাতে-পাঁচে নেই। একমাত্র বাঙালি কমিউনিটিতেই ঘরে ঘরে বিএনপি-আওয়ামী লীগ, বাংলা পত্রিকার ঢল। সেপ্টেম্বর মাস এলে স্বরূপে বিকশিত হয় কেনেডি এয়ারপোর্টে। খালেদা-হাসিনার ছবি নিয়ে মারামারি শুরু করলে এয়ারপোর্টের পুলিশ মধ্যখানে দাঁড়ায়। বুদ্ধিবৃত্তিতে খরার প্রভাব, দূরদেশেও।
এই দফায় ৫ জানুয়ারির ফ্যাসিজমকে জোর করে গণতন্ত্র বলে চালিয়ে দেয়ার দানবীয় চেষ্টা। এদেরকে সাহায্য করছে প্যারোলে থাকা লাখ লাখ আওয়ামী শিক্ষক, বুদ্ধিজীবী ও ছাত্ররূপী সন্ত্রাসীরা। এরাই পরপর নেহেরু, ইন্দিরা এবং প্রণবের পাতা ফাঁদে পা দিয়েছিল। আবারো কংগ্রেসের পাতা ফাঁদে পা দিয়ে ৫ জানুয়ারি কায়েম করেও বুঝতে অক্ষম। অবাঙালি নয়, বারবার বাঙালি মুসলমানেরাই আন্দোলনের নেতৃত্ব দিয়েছে আর সব দোষ খান সাহেবদের? জঙ্গিবাদের সমালোচনা করি; কিন্তু সংসদীয় জঙ্গিবাদ যে কত ভয়ঙ্কর- প্রমাণ বাংলাদেশ।
মহাত্মা, লিয়াকত আলী খান, মুজিব, ইন্দিরার করুণ পরিণতি কাম্য নয়। বেঁচে থাকবে এবং বাঁচতে দেবে। স্বাভাবিক মৃত্যুর গ্যারান্টি এবং পরিবার নিয়ে শান্তিতে থাকার অধিকার প্রতিটি নাগরিকের জন্মগত। এখানে হাত দিলেই পুড়বে। যারাই অতীত থেকে শিক্ষা না নিয়ে বারবার ডাইরেক্ট অ্যাকশনের ভুল করে, বলছি সাধু সাবধান!
মিনা ফারাহ : নিউইয়ক প্রবাসী লেখক
ইমেইল : farahmina@gmail.com
ওয়েবসাইট : www.minafarah.co
ইমেইল : farahmina@gmail.com
ওয়েবসাইট : www.minafarah.co
No comments