মহাদেব সাহার প্রেম ও প্রকৃতির কবিতা by সাইফুজ্জামান

বাংলা কবিতায় মহাদেব সাহা গুরুত্বপূর্ণ কবি হিসেবে আবির্ভূত হয়েছেন। মধ্যবিত্ত মানুষের জীবনের বহুমাত্রিকতা তার কবিতায় উদ্ভাসিত হয়। মানবপ্রেম, প্রকৃতি ও মানুষের যূথবদ্ধ অবস্থান, জীবনের দ্বান্দ্বিকতা মহাদেব সাহার কবিতার মুখ্য উপাদান।


আবেগ কবিতার প্রাণ। এই আবেগকে শক্তিময় করে তুলতে গিয়ে মনের রহস্য, মানবিক সম্পর্কের টানাপোড়েন তাঁকে গভীরভাবে স্পর্শ করে। নিজেকে মহাদেব স্বতন্ত্র পদ্যরীতি, বক্তব্য ও মর্মস্পর্শী লাবণ্যময় গীতি ধারার কবিতা নির্মাণে ব্যাপৃত রেখেছেন। তাঁর কবিতা যাপিত জীবনের অভিজ্ঞতা ও সৌন্দর্য স্নাত। প্রকৃতি, ঋতুচক্র, মানবিকতায় আর্দ্র কবিতা জীবনের জয়গানে মুখর। শস্য খামার, জলের তরঙ্গ, জনপদ, মানুষের মনস্তত্ত্বনির্ভর মহাদেব সাহার কবিতা অশ্রুসজল বিধুর।
‘এই গৃহ এই সন্ন্যাস মানব এসেছি কাছে’ ‘চাই বিষ অমরতা’ ‘কী সুন্দর অন্ধ’ ‘তোমার পায়ের শব্দ’ কাব্যগ্রন্থের কবিতায় অন্তর্গত বোধ, বোধি ও মননের উদ্ভাসন লক্ষ্য করা যায়।
ষাট দশকে মহাদেব সাহার অভিষেক গীতল প্রেমের কবিতা রচনার মধ্য দিয়ে। তিনি রচনা করেছেন সমাজ ও মানুষের রূপান্তর বিষয়ে তার নিজস্ব উপলব্ধি। সমকালীন ঘটনাবলী, স্মৃতি, আনন্দ-বিষাদ ও কাতরতার প্রতিধ্বনি তাঁর কবিতায় অনুরণিত হয় নিজস্ব কণ্ঠ স্বরে :
মা আমাকে বলেছিলোÑ যেখানেই থাকিস তুই
বাড়ি আসবি পয়লা বোশেখে। পয়লা বোশেখ ভালো দিন
এদিন ঘরের ছেলে বাইরে থাকতে নেই কভু, বছরের এই একটি দিনে
আমি সিদ্ধিদাতা গণেশের পায়ে দিই
ফুলজল, কে বলবে কী করে কার বছর কাটবে
বন্যা, ঝড় কিংবা অগ্নিকা- কতো কি ঘটতে পারে, তোর তো কথাই নেই
মাসে মাসে সর্দিজ্বর, বুক ব্যথা লেগে আছেই, বত্রিশ বছর বয়স
নাগাদ এই সব চলবে তোর রাশিচক্র ভীষণ খারাপ
যেখানেই থাকিস তুই বাড়ি আসবি পয়লা বোশেখে। সেদিন সকালে
উঠবি ঘুম থেকে, সময়মতো খাবিদাবি, ভালো ভালোয় কাটাবি দিনটা
যেন এমনি মঙ্গল মতো সারাটা বছর কাটে, তোকে না ছোঁয় কোনো
ঝড়-ঝাপটা-বিপদ আপদ
আমি নিজহাতে একশো একটি বাতি জ্বালিয়ে পোড়াবো তোর সমস্ত বালাই।
...কিন্তু মা সারাটা বছর কাটে ক্যালেন্ডার
পাল্টে যায়
দেখতে কেমন
জীবনে আর আসে না পয়লা বোশেখ
(বৈশাখে নিজস্ব সংবাদ : এই গৃহ এই সন্ন্যাস)
গ্রাম থেকে আসা একজন মানুষের আর্তি কবিতায় উঠে এসেছে। মাতৃভক্ত একজন মানুষের বদলে যাওয়া জীবনের বাস্তবতায় কতটা হাহাকার তৈরি করে এই কবিতায় তা মহাদেব সাহা ব্যক্ত করেছেন। পয়লা বোশেখ ঘুরে ঘুরে আসে নাগরিক জীবনে তার প্রভাব সামান্যই। একজন মহাদেব, একজন সন্তান বহু মানুষের প্রতিনিধি হয়ে স্মৃতিসত্তার কাছে সমর্পিত হয়। মহাদেব সাহা সময়ের বাঁকে বাঁকে জীবনের অভিজ্ঞতা কবিতাবদ্ধ করেন। মহাদেব দুঃখ-কষ্ট আর আনন্দকে সমান্তরাল ভঙ্গিতে দাঁড় করিয়ে তার অনুভূতি প্রকাশ করেন। “হায় আমার দুঃখ আছে কত রকম/বুকের ক্ষত/বুকে গাঢ় জখম/মা যেমন দুঃখ করেন/হলো না তার ঘটি বাটি সোনার বাসন/ নগস্য আসন/সবাই আমরা দুঃখ করি/একটা কিছুর দুঃখ করি/ঘটি বাটি, বসতবাড়ি ফুলদানি বা সোনার বাসন/নিজের জন্যে হলো না ঠিক যোগ্য আসন/হাত বাড়ার শক্ত লাঠি/পরিপাটি সোনার জীবন হলো না ঠিক/যেমনটি চাই দুঃখ করি দুঃখ আছে কত রকম :
এই গৃহ এই সন্ন্যাস
মহাদেব সাহা আমাদের সমাজ জীবনের হাহাকার, বেদনাবোধ প্রত্যক্ষ করেন। প্রতিটি মানুষ এক ধরনেরঅতৃপ্তিতে ভোগে। এই অতৃপ্তি মানবিক সহমর্মিতার যোগসূত্র তৈরি করে। পৃথিবী ক্রমান্বয়ে মানুষের বসবাসের অনুপযোগী হয়ে উঠছে। হিংস্রতা, ক্রূরতা, কপটতার বিস্তার কবিচিত্তে আলোড়ন তোলে। ‘বন্ধুর জন্য বিজ্ঞাপন’ কবিতায় মহাদেব সাহা একজন বিশ্বস্ত বন্ধুর জন্য প্রতীক্ষা করেন। যে বন্ধু পিতৃশোক ভাগ করে নেবেÑ তার জন্য অপেক্ষা কত না মধুর তা আমরা অনুভব করি। ফুসফুসের দূষিত বাতাস বের করে নিয়ে বন্ধু তার উদারতা, মহত্তে বন্দী করবে, এমন মানুষকে আমরা খুঁজি। পৃথিবী থেকে বিশ্বাস আর মানবতার অবসান কবিকে ব্যথিত করে। কবি আশা ও স্বপ্নে জেগে ওঠেন। কবির অপেক্ষা সুন্দরের জন্য। একজন ত্রাণকর্তা ও যোগ্য মানুষ কবির আরাধ্য :
আমি একটি বন্ধু খুঁজছিলাম যে আমার পিতৃশোক ভাগ করে নেবে। নেবে আমার ফুসফুস থেকে দূষিত বাতাস;
বেড়ে গেলে শহরময় শীতের প্রকোপ
তার মুখ মনে হবে সবুজ চায়ের প্যাকেট, এখানে ওখানে দেখা দিলে সংক্রামক রোগ
ক্ষয়কাশ, উইয়ে খাওয়া কারেন্সি নোটের মতো আমার ফুসফুসটিকে
তীক্ষè দাঁতে ছিদ্র করে দিলে, সন্দেহজনকভাবে পুলিশ ঘুরলে
পিছে, ডবল ডেকার থেকে সে আমাকে ফেলে দেবে কোমল ব্যান্ডেজ, সে আমাকে ফেলে দেবে
ট্রন্সিপারেন্ট জাদুর রুমাল, আমি যাবো পাখি হয়ে পুলিশ স্কোয়াডে থেকে
জেনেভায় নিরস্ত্রীকরণ সম্মেলনে, বলবো-
আমি প্রেমিকার পলাতক গুপ্তচর;
মহাদেব সাহার কবিতায় যুক্তি থাকে, থাকে মানবিক আবেদন নিবেদন। মানুষের মনোজগত, সমাজ ও পরিপার্শ্বের রহস্য ভেদ করে পরস্পর পরস্পরকে স্পর্শ করার আকুলতা থেকে উৎসারিত হয় তার কবিতার মূল স্রোতধারা। সজীব উপস্থাপনা, শুভ্রতা ও আর্তি মহাদেব সাহার কবিতায় স্বতন্ত্র ধারা নির্মাণ করে। মানুষের তৈরি পৃথিবী মানুষকে শ্রেণীবিভক্ত, সম্প্রদায় বিভক্ত ও আশরাফ-আতরাফ-উঁচু-নিচু স্তর বিন্যাস করেছে। শত্রুতা, খুনোখুনির ভয়াবহচিত্র চারপাশে তবু মানবিকতা, কল্যাণ মানুষকে শুদ্ধ করে এগিয়ে দেয় সম্মুখে। মহাদেব সাহার উচ্চারণ :
হে মানুষ, তোমাদের ঘৃণার বদলে আমি ভালোবাসার গোলাপ ছড়াবো,
তোমাদের উপেক্ষার মাটি ভেদ করে তুলবো সবুজ চারা গাছ
তোমাদের আলপিন আঁটা বুটের তলায় এই নগ্নবুক পেতে দেবো
হে মানুষ তোমাদের ঘৃণায় ফিরিয়ে নেয়া কঠিন মুখের দিকে চেয়ে
আমি একাকী স্মৃতির রুমাল;
(ঘৃণার উত্তরে চাই ক্ষমা)
স্বীকার করতে হবে মহাদেবের আত্ম জৈবনিক রচনা তাকে বিশেষভাবে খ্যাতিমান করেছে। প্রণয়নী, সংসার, নিঃসঙ্গতা ও কাতরতা তার নিত্যসঙ্গী। জীবনের চক্রে আমরা এই যে ডুবে আছি তা প্রতিদিন একটু একটু করে অভিজ্ঞতা সিঞ্চন করছে তা হয়ে যায় মহৎ কবির কবিতা রচনার উপাদান।
বাঙালীর জীবন সত্তার সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মিশে আছেন। আমাদের সমাজে সাধারণ মানুষ খুব সাধারণ চাহিদা নিয়ে বিচরণ করে। দুঃখ-কষ্টের পৃথিবী সহজ চাহিদায় পূরণ করে মানুষ। রাজনীতির ঘূর্ণি, স্বপ্নভঙ্গের বেদনা মানুষকে আশাহত করে।
নেতা সাধারণ মানুষের প্রেরণা
কবির স্বগতোক্তি :
আমার টেবিলের সামনে দেয়ালে শেখ মুজিবের
একটি ছবি টাঙানো আছে
কোন তেলরঙ কিংবা বিখ্যাত স্কেচ জাতীয় কিছু নয়
এই সাধারণ ছবিখানা ১৭ মার্চ- এ বছর শেখ মুজিবের
জন্ম দিনে একজন মুজিব প্রেমিক আমাকে উপহার দিয়েছিলো
কিন্তু কে জানতো এই ছবিখানা হঠাৎ দেয়াল ব্যপে
একগুচ্ছ পত্র পুষ্পের মতো আমাদের ঘরময়
প্রস্ফুটিত হয়ে উঠবে রাত্রিবেলা
মহাদেব সাহা বাংলাদেশের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আর মানুষকে অবলম্বন করে কবিতা রচনা করেন। বাঙালির গৌরবগাথা, সংগ্রামÑ প্রতিদিন যুদ্ধ করে বেঁচে থাকার গল্প তার কবিতার বক্তব্য ও চিত্রকল্পে উপস্থাপিত হয়। তার কবিতা অনান্তর বাণীতে অবগাহিত। সত্য, সুন্দরকে আবিষ্কার করার কাজ মহাদেব সার্থকভাবে সম্পন্ন করেছেন। মহাদেবের কবিতা শেড়ড়ের দিকে আমাদের ফেরার তাগিদ দেয়। তার কবিতায় সরল মানুষ ও নিরাভরণ চিত্রকল্পের উপস্থিতি ঘটে। মহাদেব সাহা কবিতা ঐতিহ্য অন্বেষা ও স্বাদু।

No comments

Powered by Blogger.