‘আমি কোথায় পাব তারে’ থেকে ‘আমার সোনার বাংলা’ by কুলদা রায়

নাম তার গগন দাস। বাড়ি কুষ্টিয়ার শিলাইদহে। আড়পাড়া গ্রামের এক কায়স্থ পরিবারে জন্ম উনিশ শতকের মাঝামাঝি। তার বাবা-মা সম্পর্কে বিশেষ কিছু জানা যায় না। তবে কিরণচন্দ্র দাস নামে গগনের এক ছেলের নাম জানা যায় । এইটুকু গগন-কথা।


গবেষক প্রফেসর ড. আবুল আহসান চৌধুরী রবীন্দ্র উত্তরসূরি গ্রন্থে জানাচ্ছেন- দুই যুগ আগেও গগনের ভিটার অস্তিত্ব ও ফলের বাগানের সাদৃশ্য ছিল। লোকমুখে জানতে পারা যায়, গগন হরকরার একটি বড় ফলের বাগান ছিল। উল্লেখ্য, গগনের বাস্তুভিটায় আসামদ্দি নামক একজন কৃষক বাড়ি করে থাকতেন এবং সেই বাড়িটি আজও ‘দাসের ভিটা’ নামে পরিচিত। সে সময় দাসেরা ম-ল নামেও পরিচিত ছিল।
শিলাইদহের শচীন্দ্রনাথ অধিকারী লিখেছেন- গগন সামান্য শিক্ষাদীক্ষায় পারদর্শী ছিলেন এবং তার ফলেই তৎকালীন শিলাইদহের ডাকঘরের ডাক হরকরার চাকরি পেয়েছিলেন। গাঁয়ে গাঁয়ে চিঠি বিলি করতেন। আর করতে গান। তিনি শিলাইদহে ‘সখীসংবাদের’ গানে এমন করুণ আখর লাগিয়ে গাইতেন যে, শ্রোতারা মুগ্ধ হয়ে সে গান শুনতেন। গগন সম্পর্কে প-িত ক্ষিতি মোহন সেন শাস্ত্রি বলেছেন : লালনের শীর্ষধারার একজন ছিলেন রবীন্দ্রনাথের শিলাইদহের ডাক হরকরা- যার নাম গগন। রবীন্দ্রনাথ গগনকে সবার মাঝে বিভিন্নভাবে পরিচিত ও বিখ্যাত করে যথাসাধ্য মূল্যায়ন করেছেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৮৮৯ থেকে ১৯০১ সাল বাংলাদেশের শিলাইদহ ও শাহজাদপুরে জমিদারি দেখাশোনা করতে নিয়মিত যেতেন। তখন শিলাইদহে তাঁর সঙ্গে গগনের পরিচয় হয়েছিল। গগন তাঁকে গান গেয়ে শোনাতেন।
শিলাইদহে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সঙ্গে গগন হরকরা, গোঁসাই গোপাল সরক্ষেপী বোষ্টমী, গোঁসাই রামলাল এবং লালনের অজস্র শিষ্য, প্রো-শিষ্যদের সঙ্গে সাক্ষাত হয়েছিল। তিনি বাউল-ফকিরদের গান শুনে আপ্লুত-নিজে শিলাইদহ ও ছেঁউড়িয়া অঞ্চল হতে অনেক বাউল গান সংগ্রহ ও প্রচার করেছেন। তারপরে বিভিন্ন পত্রপত্রিকায় সেগুলো প্রচার করার ব্যবস্থা করেন। উদ্দেশ্য একটাই- যাতে সুধী সমাজের মধ্যে বাংলাদেশের বাউল গান সম্পর্কে একটা ধারণা জন্মে।
অধ্যাপক মনসুর উদ্দীনের হারামণির গ্রন্থের ভূমিকায় লিখছেন, শিলাইদহে যখন ছিলাম, বাউল দলের সঙ্গে আমার সর্বদাই দেখাসাক্ষাত ও আলাপ-আলোচনা হতো। আমার অনেক গানেই আমি বাউলের সুর গ্রহণ করেছি এবং অনেক গানে অন্য রাগরাগিণীর সঙ্গে আমার জ্ঞাত বা অজ্ঞাতসারে বাউল সুরের মিলন ঘটেছে। এর থেকে বোঝা যাবে বাউলের সুর ও বাণী কোন এক সময়ে আমার মনের মধ্যে সহজ হয়ে মিশে গেছে। আমার মনে আছে, তখন আমার নবীন বয়স, শিলাইদহ অঞ্চলেরই এক বাউল কলকাতায় একতারা বাজিয়ে গেয়েছিলÑ
কোথায় পাব তারে
আমার মনের মানুষ যে রে।
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে
দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে
গগন হরকরার গানটির পূর্ণপাঠ :
আমি কোথায় পাব তারে
আমি কোথায় পাব তারে আমার মনের মানুষ যে রেÑ
হারায়ে সেই মানুষে তার উদ্দেশে দেশ-বিদেশে বেড়াই ঘুরে।
লাগি সেই হৃদয়শশী সদা প্রাণ হয় উদাসী
পেলে মন হতো খুশি দেখতাম নয়ন ভরে।
আমি প্রেমানলে মরছি জ্বলে নিভাই অনল কেমন করে
মরি হায় হায় রে
ও তার বিচ্ছেদে প্রাণ কেমন করে
ওরে দেখ না তোরা হৃদয় চিরে।
দিব তার তুলনা কি যার প্রেমে জগত সুখী
হেরিলে জুড়ায় আঁখি সামান্যে কি দেখিতে পারে
তারে যে দেখেছে সেই মজেছে ছাই দিয়ে সংসারে।
মরি হায় হায় রে-
ও সে না জানি কি কুহক জানে
অলক্ষ্যে মন চুরি করে।
কুল মান সব গেল রে তবু না পেলাম তারে
প্রেমের লেশ নাই অন্তরে-
তাইতে মোরে দেয় না দেখা সে রে।
ও তার বসত কোথায় না জেনে তায় গগন ভেবে মরে
মরি হায় হায় রে-
ও সে মানুষের উদ্দিশ যদি জানুস কৃপা করে
আমার সুহৃদ হয়ে ব্যথায় ব্যথিত।
রবীন্দ্রনাথ গগন হরকরার এই ‘কোথায় পাব তারে আমার মনে মানুষ যে রে’ গানটি বিষয়ে আরও লিখেছেন, কথা নিতান্ত সহজ, কিন্তু সুরের যোগে এর অর্থ অপূর্ব জ্যোতিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছিল। এই কথাটিই উপনিষদের ভাষায় শোনা গিয়েছে : তং বেদ্যং পুরুষং বেদ মা বো মৃত্যুঃ পরিব্যথাঃ। যাঁকে জানবার সেই পুরুষকেই জানো নইলে যে মরণবেদনা। অপ-িতের মুখে এই কথাটিই শুনলুম তার গেঁয়ো সুরে সহজ ভাষায় যাঁকে সকলের চেয়ে জানবার তাঁকেই সকলের চেয়ে না-জানবার বেদনা-অন্ধকারে মাকে দেখতে পাচ্ছে না যে শিশু তারই কান্নার সুর- তার কণ্ঠে বেজে উঠেছে। ‘অন্তরতর যদয়মাত্মা’ উপনিষদের এই বাণী এদের মুখে যখন ‘মনের মানুষ’ বলে শুনলুম, আমার মনে বড় বিস্ময় লেগেছিল। এর অনেক কাল পরে ক্ষিতি মোহন সেন মহাশয়ের অমূল্য সঞ্চয়ের থেকে এমন বাউলের গান শুনেছি ভাষার সরলতায়, ভাবের গভীরতায়, সুরের দরদে যার তুলনা মেলে না- তাতে যেমন জ্ঞানের তত্ত্ব তেমনি কাব্যরচনা, তেমনি ভক্তির রস মিশেছে। লোকসাহিত্যে এমন অপূর্ণতা আর কোথাও পাওয়া যায় বলে বিশ্বাস করি নে।
রবীন্দ্র উত্তরসূরিতে প্রফেসর ড. আবুল আহসান চৌধুরী লিখেছেন, রবীন্দ্রনাথের ভাগ্নি সরলা দেবী (১৮৭২-১৯৪৫) ‘ভারতী’ পত্রিকায় (ভাদ্র-১৩০২) গগনের কয়েকটি গান সংগ্রহ ও প্রকাশ করেছিলেন। সরলা দেবী উক্ত প্রবন্ধের শেষ অংশে আবেদন করেছিলেন যে, “পেমিক গগনের ভক্ত জীবনীর বিবরণ সংগ্রহ করিয়া কেহ ‘ভারতী’ পত্রিকায় প্রকাশার্তে পাঠাইয়া দিলে আমাদের কাছে বিশেষ কৃতজ্ঞতা ভাজন হইবেন।” রবীন্দ্রনাথ তাঁর বিভিন্ন বক্তৃতা-প্রবন্ধে গগনের গানের কথা ও গগনের নাম উল্লেখ করেছেন একাধিকবার।

No comments

Powered by Blogger.