মায়ের দুধ ও শিশু by ডা. যাকিয়া মাহ্ফুজা হাসান

মায়ের দুধ অর্থাৎ মানবশিশুর মায়ের বুকের দুধ থেকে গরম্ন র দুধ ভাল এ ধারণাটা কবে কীভাবে মানুষের মাথায় ঢুকল তা বলা দুষ্কর হলেও মানুষ কেন এই কথাটি ভাবতে শুরম্ন করল তা বলা বেশ সহজ। কতিপয় মানুষের ব্যবসাবুদ্ধিই সাধারণ মানুষকে এ কথা ভাবতে শিখিয়েছে।


এমন একটা সময় ছিল যখন মানুষ 'সত্যকে সত্য বলে চিনত, স্বতঃসিদ্ধ ব্যাপারগুলোকে অবধারিত সত্য বলে মেনে নিতে পারত। কিন্তু কতিপয় অসাধু ব্যবসায়ী মানুষকে ভাবতে শিখিয়েছিল যে বিদেশী চারণভূমির বিশেষ তৃণ ও বিশেষভাবে প্রসত্মুতকৃত গোখাদ্যে পুষ্ট কুলীন গাভীর দুধের সাথে মনুষ্য প্রসত্মুতকৃত উপাদান যোগ করে যে শিশুখাদ্য তৈরি হয় তা মায়ের বুকের দুধের চেয়ে বহুগুণে উপকারী। শুধু তাই নয়_ শিশুকে সত্মন্যদান মায়ের জন্য সৌন্দর্যহানিকর, ঝামেলাময়, অনাধুনিক ও অনেকটা অশালীনও বটে। পানত্মরে শিশুকে কৌটার সব গুণসমৃদ্ধ গুঁড়ো দুধ দেয়া শুধু শিশুর জন্যই আদর্শ নয় মায়ের জন্যও একটি আধুনিক অভিজাত ও সৌন্দর্যবর্ধন ব্যাপার।
ধিক! ব্যবসায়ী সম্প্রদায়কে এবং ধিক আমাদের মতো চিকিৎসাবিজ্ঞানীদের যারা এক সময় অসাধু ব্যবসায়ীদের উদ্দেশ্যপ্রণোদিত বচনে প্রভাবিত হয়ে মায়েদের গুঁড়ো দুধ খাওয়ানোর জন্য নির্দেশ দিয়েছে।
আমি খুব সুস্পষ্টভাবে মনে করতে পারি (এবং মনে করে আহত অনুভব করি) যে সত্তর দশকের মধ্যভাগে যখন আমার প্রথম সনত্মান জন্মগ্রহণ করে তখন এক খ্যাতিসম্পন্ন ধাত্রীবিদ্যা বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক আমাকে একটি বিশেষ গুঁড়োদুধের নাম স্বহসত্মে লিখে দিয়েছিলেন ২/৩ ঘণ্টা পর পর খাওয়ানোর জন্য। একবারও মুখ ফুটে উচ্চারণ করেননি এ কথাটি যে, "মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য সর্বশ্রেষ্ঠ, চেষ্টা করো বাচ্চাকে বুকের দুধ দেয়ার জন্য_ যখন পারবে না তখন কৌটার দুধের দ্বারস্থ হয়ো"_ যেহেতু আমি তখন মেডিক্যাল ছাত্রী ছিলাম এবং তিনি ছিলেন আমার শিক অধ্যাপক এবং তাঁর তত্ত্বাবধানেই আমার সনত্মান জন্মগ্রহণ করে।
হায় বিভ্রানত্মি! মানুষ কতভাবেই না নিজে বিভ্রানত্ম হয় এবং অন্যকেও বিভ্রানত্ম করে।
যা হোক_ আবার কী করে বিশ্ববিবেক জাগ্রত হয়ে উঠল, কী মন্ত্রে পুনরম্ন জ্জীবত হলো মিথ্যাকে প্রত্যাখ্যান করে সত্য গ্রহণ করার মতো শুভবুদ্ধি- তা জানি না; হয়ত মানব সম্প্রদায়ের অসত্মিত্ব বিপন্ন হওয়ার মতো কোন পরিস্থিতি সামাল দিতেই এই সত্য গ্রহণ করার প্রবণতার পুনরম্ন জ্জীবন ঘটেছে। তবে কারণ যাই হোক_ মানুষ যে আবার ভুল পথ পরিহার করে সঠিক পথে চলে আসতে চাচ্ছে_ এইটিই সবচেয়ে বড় স্বসত্মি ও সুখের কথা।
মাতৃদুগ্ধ যে শিশুর জন্য সর্বোৎকৃষ্ট, সর্বশ্রেষ্ঠ খাদ্য এবং নবজাত শিশুর জন্য 'একমাত্র' খাদ্য_ আধুনিক বিজ্ঞানীদের কল্যাণে তা আজ প্রায় সবাই জেনে গেছেন। অনেক দিন ধরেই এই প্রচারটি শুরম্ন হয়েছে এবং এ ব্যাপারে গণসচেতনতা সৃষ্টি করার ব্যাপক প্রয়াস চলছে নিয়মিতভাবে। এমনকি শিশুখাদ্য ব্যবসায়ীদের বাধ্য করা হয়েছে জনগণকে এ কথা স্বয়ং তাদের প থেকে জানাতে যে মায়ের বুকের দুধই শিশুর জন্য সর্বোৎকৃষ্ট তাদের প্রসত্মুতকৃত খাদ্যটির স্থান মাতৃদুগ্ধের অনেক নিচে এবং কিছু বিশেষ েেত্রই কেবল এর প্রয়োগ চলতে পারে_ সর্বত্র নয়।
আসলে যে কোন সহজ বোধবুদ্ধিসম্পন্ন মানুষেরই এটা বঝতে পারা উচিত, যে কোন প্রাণীরই তাদের শিশুদের জন্য তার মায়ের বুকের দুধই উপযুক্ত খাবার এবং একটি নির্দিষ্ট সময়সীমা পর্যনত্ম একমাত্র খাবার। গরম্নর দুধ তার শিশু অর্থাৎ বাছুরের জন্য নির্ধারিত, ছাগলের দুধ ছাগশিশুর জন্য এবং এভাবে পৃথিবীর প্রতিটি সত্মন্যপায়ী প্রাণীর জন্য একথা প্রযোজ্য। তবে মানুষের বেলায় কেন সে নিয়মের ব্যত্যয় ঘটবে? মানুষের বুদ্ধি বেশি বলে? মানুষ প্রচলিত নিয়মকে অস্বীকার করে অপ্রচলিত, নতুন উদ্ভাবিত, গবেষণালব্ধ জ্ঞানকে কাজে লাগাবার প্রবণতাসম্পন্ন বলে? কিন্তু সেই প্রবণতা যে সবসময় মঙ্গলকর নয় এবং অনেক সময়ই অশুভকর, অমঙ্গলকর এবং মানবজাতির অসত্মিত্ব বিপন্নকর, সে সত্যের বোধোদয় ঘটতে বিলম্ব হলে যে আরও কত বিপর্যয় ঘটবে সে কথাও তো আর অস্বীকার করার উপায় নেই।
যাক, আবার মাতৃদুগ্ধের কথায় ফিরে আসি। আসলে মায়ের বুকের দুধ মানবশিশুর জন্য যে কতখানি উপকারী তা বলে শেষ করার নয়। আজ বলা হচ্ছে যে, সনত্মান জন্মের প্রথম ঘণ্টার মধ্যে মায়ের বুকের প্রথম দুধ (যাকে শালদুধ বলা হয়) খাওয়ালে তা শিশুর মৃতু্যর হার অনেকাংশে কমিয়ে দেয় অর্থাৎ কিনা সেই 'শালদুধ' শিশুর শরীরে এমন কিছু উপকারী উপাদান সরবরাহ করে যা শিশুকে দান করে অনেক রোগকে প্রতিরোধ করার স্বাভাবিক মতা এবং মায়ের বুকের দুধের মাধ্যমে শিশুর শরীরে সেই রকম রোগপ্রতিরোধ মতা জন্ম নেয়_ যা কিনা একমাত্র টিকার মাধ্যমে পরবতর্ীতে মানুষের অর্জন করা সম্ভব। অথচ একসময় আমি নিজেই শুনেছি যে সনত্মান জন্ম নেয়ার পর পর মায়ের বুকের এই শালদুধ সনত্মানের জন্য অত্যনত্ম তিকর এবং শিশুকে না খাইয়ে এটা গেলে ফেলে দেয়া উচিত। ঈশ্বর প্রদত্ত কল্যাণকর অমৃতের কী অবিমৃষ্যকারী অপচয়!
শালদুধ দেয়ার পর থেকে শিশুকে শুধুমাত্র বুকের দুধই দেয়া উচিত অনত্মত ছয়মাস পর্যনত্ম। আর কিছুই এ সময় তার জন্য প্রয়োজন নেই। তবে মায়ের বুকের দুধে অপ্রতুলতা ঘটলে কয়েক মাস অতিবাহিত হবার পর অতিরিক্ত খাদ্য হিসেবে অন্য কোন খাবার যেমন_ গরম্ন র দুধ, কৌটার দুধ বা অন্য কোন সলিড খাবার, ফলমূল, চালের গুঁড়া, সুজি, রম্ন টি, নরম গলাভাত ইত্যাদি দেয়া যেতে পারে। তবে সনত্মান যদি প্রতিদিন নিয়মিত সত্মন চোষে এবং মা যদি প্রয়োজনানুসারে খাবার গ্রহণ করে তাহলে বুকের দুধের অপ্রতুলতা ঘটার কোন কারণ নেই।
মাতৃদুধ শিশুকে শারীরিক, মানসিক উভয়দিকে সুস্থভাবে গড়ে তোলে এবং কৃত্রিম খাদ্য গ্রহণকারী একটি শিশুর চেয়ে মাতৃদুধ পানকারী একটি শিশুর মেধার বিকাশ ঘটে অনেক বেশি। অর্থাৎ একটি মাতৃদুধ পানকারী শিশু কৃত্রিম দুধ পানকারী শিশুর চেয়ে অনেক বেশি সুস্থ, স্বাভাবিক, মেধাবী ও সুস্থ মানসিকতাসম্পন্ন মানুষে পরিণত হওয়ার মতা ধারণ করে এবং সুনিশ্চিতভাবে এই রকম শিশুর পরিণত বয়সে পৃথিবীকে সব রকমভাবে মোকাবেলা করার মতা থাকে অনেক অনেক গুণ বেশি। মোটামুটিভাবে এই গেল শিশুর কথা। হয়ত অনেকে ভাবতে পারেন যে সনত্মান না হয় উপকৃত হলো, কিন্তু সেটা হলো মায়ের ত্যাগের কারণে_ অর্থাৎ সনত্মানকে সুস্থ ও সুন্দর করতে যেয়ে মাকে করতে হলো দেহ সৌষ্ঠব হারানোর মতো ত্যাগ স্বীকার। কিন্তু সবারই জানা থাকা অত্যনত্ম দরকার যে এ কথাটি আদৌ সত্য তো নয়ই বরং পুরোপুরিভাবে মিথ্যা।
সনত্মানকে মায়ের বুকের দুধ খাওয়ালে তার দেহসৌষ্ঠব নষ্ট হওয়ার তো কোন প্রশ্নই নেই বরং বাসত্মবে ঘটে তার উল্টোটা অর্থাৎ সত্মন্যদান মায়ের সত্মনের আকৃতি, গঠন ও স্বাস্থ্য সুন্দর রাখতে সাহায্য করে। যারা বুকের দুধ খাওয়ান না তাদের সত্মনের গঠনে পরিবর্তন ঘটার সম্ভাবনা থাকে অনেক বেশি। কেননা সত্মন শরীরের এমন একটি অঙ্গ যা বিশেষভাবে সনত্মানকে খাদ্যদান করার জন্যই গঠিত এবং সেজন্য এর ভেতরে অসংখ্য দুগ্ধ প্রসত্মুতকারী গস্ন্যান্ড থাকে যেগুলো কিছু মেদকোষের মধ্যে সংরতি থাকে। সনত্মান পেটে আসার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে স্বাভাবিক নিয়মেই তাই সূচিত হয় বেশি কিছু পরিবর্তন। অনাগত সনত্মানের খাদ্য সংস্থানের প্রসত্মুতি তখন থেকেই শুরম্ন হয়ে যায় এবং তারই ফলাফল হিসেবে সনত্মান ভূমিষ্ট হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই সেখানে ব্যাপক কর্মকা- শুরম্ন হয় এবং সত্মনের দুধের গ্রন্থিগুলোতে প্রচুর দুধ তৈরি হতে থাকে। শিশুকে যদি সেই দুধ খাওয়ানো না হয় তা হলে সত্মনের ভেতর সেই দুধ জমে গিয়ে অনেকের েেত্রই ব্যাপক বিপর্যয় ঘটতে পারে। তাতে পুঁজ সংক্রমণ, ফোঁড়ার মতো ঘটনাও অনেক সময় ঘটতে দেখা যায়। এ রকম না ঘটলেও যেটা ঘটে সেটা হলো, আসত্মে আসত্মে সত্মনের দুধ সৃষ্টিকারী গ্রন্থির ক্রম সংকোচন ও কর্মবিরতি। স্বাভাবিক প্রক্রিয়াকে অস্বীকার করে অস্বাভাবিক ও সময়ের আগেই কাজ বন্ধ করে দেয়ায় সত্মনের গ্রন্থিতে যে পরিবর্তন সে সময়টা ঘটে যায় তা মোটেই সুস্থ নয় এবং এর পরিণতিও ভাল নয়। এতে যেমন সত্মনের গঠন বিকৃতি ঘটতে পারে, তেমনি ঘটতে পারে এক পর্যায়ে সত্মন ক্যান্সারের মতো ঘটনা।
সনত্মানকে সত্মন্যদান করলে শিশু দুধ পান করার সময় মায়ের শরীরে যে হরমোনের নিঃসরণ ঘটে তা শরীরের প্রসবজনিত পরিবর্তনগুলোকে আগের অবস্থায় ফিরিয়ে আনতে সাহায্য করে যা কিনা সনত্মানকে বুকের দুধ না খাওয়ালে কোনভাবেই সম্ভব নয়। এ ছাড়াও সনত্মানকে সত্মন্যদান করলে সনত্মান ও মায়ের মধ্যে যে আত্মিক ও মানসিক একটি সুনিবিড় সম্পর্ক তৈরি হয় তা-ও আর কোনভাবেই সম্ভব নয়।
আসলে শিশুকে মাতৃদুগ্ধ খাওয়ানোর প েও কৌটার দুধ বা গরম্ন র দুধ খাওয়ানোর বিপ েবলতে গেলে আরও অনেক কথাই বলা যেতে পারে। তবে মূল এবং প্রধান বিষয়গুলো সম্পর্কে বলেই আজ শেষ করছি। প্রকৃতপ েমাতৃদুগ্ধ ও শিশু পরস্পরের সঙ্গে অবিচ্ছেদ্যভাবে জড়িত। এখানে একজনকে অপরজনের কাছ থেকে আলাদা করার কোন প্রশ্ন নেই_ সূর্য যেমন পূর্ব দিকে ওঠে ও পশ্চিমে অসত্ম যায়, এ ব্যাপারটিও যেন সে রকমই একটা অবধারিত ও স্বতঃসিদ্ধ সত্য।
ত্বক, এ্যালার্জি, যৌনরোগ, ডার্মাটোসার্জারি বিশেষজ্ঞ
উত্তরা স্কিন কেয়ার সেন্টার, ঢাকা।

No comments

Powered by Blogger.