যুদ্ধাপরাধীদের বিচার by বাহাউদ্দীন চৌধুরী
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মাটিতে যু্দ্ধাপরাধীদের বিচার অবশ্যই হবে। এ বিচার শীঘ্রই শুরু হবে। বিডিআর হত্যাকাণ্ডের বিচার ইতোমধ্যে শুরু হয়েছে। অন্যান্য হত্যাকাণ্ডের বিচারেও তাঁর সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। সম্প্রতি রাজধানীর মিরপুর সেনানিবাসে ন্যাশনাল ডিফেন্স কলেজে ন্যাশনাল ডিফেন্স কোর্স-২০০৯-এর সমাপনী
অনুষ্ঠানে তিনি এ কথা বলেন। তবে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে নানা সংশয় সৃষ্টি হয়েছে। অনেকেই মনে করছেন বিচার প্রক্রিয়া শুরু হতে দেরি হবে। দেশে বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সরকার দেশ শাসন করছে, তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়ে নানা অজুহাতে অযথা বিলম্ব জাতি আশা করে না।
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার জন্য সরকারকে বিচারের কিছু কারিগরি দিকে নজর দিতে হবে। কোথায় কোথায় অপরাধ হয়েছিল, কোথায় গণকবর, কোথায় বধ্যভূমি আছে, অপরাধের ধরনগুলো কী কী ছিল এসব বিষয় পুক্মখানুপুক্মখভাবে চিহ্নিত করে লিপিবদ্ধ করতে হবে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দেশবাসী মহাজোটকে ভোট দিয়ে তার প্রতিদান পাওয়ার আশায় বসে আছে। বিচার করেই এই প্রতিদান দিতে হবে।
ঢাকার জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে 'বাংলাদেশের প্রোপটে যুদ্ধাপরাধ' শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা সরকারের উদ্দেশে এসব কথা বলেন। সাংবাদিক হারুন হাবীবের মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও অ্যালবাম প্রকাশ উপল েতিন দিনব্যাপী আয়োজনের শেষ দিনে এই আলোচনা সভা হয়।
আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধের বিচার না হলে নানাভাবে এর পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। বিচার না করার ফল যে ভয়াবহ হয়, তার উদাহরণ আমরা বারবার দেখেছি।' তিনি বলেন, বিচারের দুটি দিক আছে। বিচার করার উদ্দেশ্য শুধু সাজা দেয়া নয়, কী ঘটেছিল তা সাধারণ মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে হবে। বিচার করতে হলে প্রথমে দরকার কোথায় কী কী অপরাধ হয়েছিল, তার পুক্মখানুপুক্মখ বর্ণনা।
সভাপতির বক্তব্যে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সহসভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, 'সরকারের একটি বছর চলে গেছে। আর চার বছর বাকি আছে। এই চার বছরের বিচার হবে কি_ এই প্রশ্ন আমাদের ও জনগণের মধ্যে চলে আসছে।' তিনি বলেন, 'আমরা ফোরাম আবারও আন্দোলনের গতিধারা তৈরি করতে যাচ্ছি। আমরা এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে যাচ্ছি।'
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সরকারের জরুরি কাজের একটি। এই কাজে অবহেলা করা মোটেও উচিত নয়। তিনি বলেন, 'পাকিস্তান এই বিচারের উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করছে। আমাদেরও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, গত ডিসেম্বর মাসে জাতি যে রায় দিয়েছে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার বিষয়ে মহাজোটের অঙ্গীকার। মানুষ আশা করে বসে আছে, তারা তাদের ভোটের প্রতিদান পাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের অধ্যাপক মোঃ সামাদ বলেন, 'দণি কোরিয়ায় একটি যুদ্ধ জাদুঘর আছে। সেখানে যুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলী একেবারে বাস্তবের মতো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমাদের দেশেও কেন এ রকম একটি উদ্যোগ নেবে না সরকার? আমরা আমাদের সন্তানদের কী বলব?
সমকাল পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, 'আমরা একাত্তরের চেতনা ভুলে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের ঐক্য চাই না।'
হারুন হাবীব আলোচনায় সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেই হবে। অনেকে হতাশ হয়ে পড়ছে। অবশ্য এ জন্য প্রস্তুতি দরকার। বিচার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ১৯৭১ সালে আমেরিকা, চীনের মতো শক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমরা যুদ্ধ জয় করেছি, এখনও পারব। এর জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে।'
পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো বিশেষত সৌদি আরব সরকারের মারফত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার জন্য তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন আরব দেশে বহুসংখ্যক বাঙালি কাজ করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে। তাদের পাঠানো টাকায় বাংলাদেশে অনেক কাজ হয়। তাই আরব দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সমঝোতার সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি তাদের বোঝাতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎপর হলে এটা কোন কঠিন কাজ নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাছ থেকে আমরা সমর্থন পেয়েছি। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি আর ঝুলিয়ে রাখা ঠিক হবে না। আগামী বছরের মধ্যেই এই বিচার কার্য সম্পন্ন করার চেষ্টা করতে হবে।
কিছুদিন পূর্বে গত চৌদ্দই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস পালিত হয়েছে। একাত্তর সালের এই দিনে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠন আল শামস্্ আল-বদর. বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। জামায়াতে ইসলামীর সহায়তায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তিন ল মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ ল বাঙালি শহীদ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে এই শহীদদের আত্মা হাহাকার করতে থাকবে। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলেছেন, তারা যুদ্ধাপরাধী নয়। কিন্তু একাত্তরে তাদের পত্রিকা সংগ্রামে তাদের দেশদ্রোহী কার্যকলাপের বিবরণ সবিস্তারে প্রকাশিত হয়েছে। এখনও তারা বলছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগিতা করে তারা ভুল করেনি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিরও এতে সমর্থন আছে। বিএনপি তাদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগাবার সুযোগ করে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীকে তাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য করেছে। এতেই মনে হয় তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। জনমতের ভয়ে প্রকাশ্যে বলতে পারে না। তবুও তারা বলেছে, এই বিচার যেন রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক না হয়। কথাটা হাস্যকর। কারণ, রাজনৈতিক কারণেই তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রয়োজন। তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তাদের যারা বর্তমানে সাহায্য-সহযোগিতা করছে তারাও সম অপরাধে অপরাধী। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী
মশিউর রহমান যাদুমিয়াকে সিনিয়র মন্ত্রী করেন, শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করেন। গোলাম আযমকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন; তাকে নাগরিকত্ব দেন। তার স্ত্রী আরও এক ধাপ এগিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানান। কাজেই স্পষ্টতই বিএনপির রাজনীতি মৃত মুসলিম লীগের আদলেই তৈরি হচ্ছে। বিএনপির সাম্প্রতিক কাউন্সিল মিটিংয়ে এ কথা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের পথে যাবে না। ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনীতির পথেই দৃঢ় পদপে নিয়েছে তারা। কাজেই জামায়াতে ইসলামী ও ধমর্ীয় মৌলবাদী জঙ্গীদের সঙ্গে সখ্য স্বাভাবিক। তাদের এই নীতি বাস্তবতা-বিবর্জিত। তরুণ প্রজন্ম ধমর্ীয় মৌলবাদী জঙ্গীদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কারণেই বিএনপি এত কম আসন পেয়েছে। তারা যুগের চাহিদা অনুযায়ী নীতিপরিবর্তন না করলে মুসলিম লীগের মতোই তাদের মৃতু্য অনিবার্য। তবে তারা যদি নিজেদের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে হারিকিরি করে তাহলে কারোর কিছু করার থাকবে না। দেশে অনেক আওয়ামী লীগ বিরোধী লোক আছে। তারা বিএনপিকেই নিজেদের প্লাটফরম মনে করতে চেয়েছে। কিন্তু হতাশ হয়েছে। বাম দলগুলো তেমনভাবে জনসমর্থন সংগ্রহ করতে পারেনি। নানাবিধ তত্ত্বের কচকচানিতে তারা একটি সংঘবদ্ধ প্লাটফরম তৈরি করতে পারেনি। তাদের উচিত হবে একটি বিকল্প প্লাটফরম তৈরির চেষ্টা করা। তা না হলে দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।
দেশ নানা সমস্যায় কন্টকিত। মহাজোট সরকার সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে বলে মনে হয় না। তাদের এক বছরে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত হয়নি। মানুষ কিছুটা আশাহত হয়েছে। দ্রব্যমূল্য কমাতে পারেনি সরকার। মনে হয়, বিগত সরকারগুলোর মতো তারাও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। দ্রব্যমূল্য কমাতে না পারলে আগামী নির্বাচনে তার ফল ভোগ করতে হবে। তাই সরকারকে এখনই সাবধান হতে হবে। বিদু্যত উৎপাদনের েেত্র অবশ্য সরকার দ্রুত উদ্যোগ নিয়েছেন। আগামী চার বছরের মধ্যে অবস্থার অনেক উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে। আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হওয়া প্রয়োজন। এেেত্র সরকারকে অবশ্যই ক্রসফায়ার বন্ধ করতে হবে। কোন সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না। সরকারকে এই বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। ক্রসফায়ার কোন সমাধান নয়; এটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সাবেক সচিব
যুদ্ধাপরাধীদের বিচার শুরু করার জন্য সরকারকে বিচারের কিছু কারিগরি দিকে নজর দিতে হবে। কোথায় কোথায় অপরাধ হয়েছিল, কোথায় গণকবর, কোথায় বধ্যভূমি আছে, অপরাধের ধরনগুলো কী কী ছিল এসব বিষয় পুক্মখানুপুক্মখভাবে চিহ্নিত করে লিপিবদ্ধ করতে হবে। গত বছরের ডিসেম্বর মাসে দেশবাসী মহাজোটকে ভোট দিয়ে তার প্রতিদান পাওয়ার আশায় বসে আছে। বিচার করেই এই প্রতিদান দিতে হবে।
ঢাকার জাতীয় জাদুঘরের সুফিয়া কামাল মিলনায়তনে 'বাংলাদেশের প্রোপটে যুদ্ধাপরাধ' শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তারা সরকারের উদ্দেশে এসব কথা বলেন। সাংবাদিক হারুন হাবীবের মুক্তিযুদ্ধের দুর্লভ আলোকচিত্র প্রদর্শনী ও অ্যালবাম প্রকাশ উপল েতিন দিনব্যাপী আয়োজনের শেষ দিনে এই আলোচনা সভা হয়।
আইনজীবী আমীর-উল ইসলাম আলোচনায় মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন। তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধের বিচার না হলে নানাভাবে এর পুনরাবৃত্তি হতে থাকে। বিচার না করার ফল যে ভয়াবহ হয়, তার উদাহরণ আমরা বারবার দেখেছি।' তিনি বলেন, বিচারের দুটি দিক আছে। বিচার করার উদ্দেশ্য শুধু সাজা দেয়া নয়, কী ঘটেছিল তা সাধারণ মানুষ ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে জানাতে হবে। বিচার করতে হলে প্রথমে দরকার কোথায় কী কী অপরাধ হয়েছিল, তার পুক্মখানুপুক্মখ বর্ণনা।
সভাপতির বক্তব্যে সেক্টর কমান্ডারস ফোরামের সহসভাপতি ও মুক্তিযুদ্ধের সময় ৮ নম্বর সেক্টরের অধিনায়ক লে. কর্নেল (অব.) আবু ওসমান চৌধুরী বলেন, 'সরকারের একটি বছর চলে গেছে। আর চার বছর বাকি আছে। এই চার বছরের বিচার হবে কি_ এই প্রশ্ন আমাদের ও জনগণের মধ্যে চলে আসছে।' তিনি বলেন, 'আমরা ফোরাম আবারও আন্দোলনের গতিধারা তৈরি করতে যাচ্ছি। আমরা এ জন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রদের মধ্যে যাচ্ছি।'
বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম বলেন, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার সরকারের জরুরি কাজের একটি। এই কাজে অবহেলা করা মোটেও উচিত নয়। তিনি বলেন, 'পাকিস্তান এই বিচারের উদ্যোগের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক অঙ্গনে কাজ করছে। আমাদেরও এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে।'
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণরসায়ন ও অণুপ্রাণ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, গত ডিসেম্বর মাসে জাতি যে রায় দিয়েছে, তার অন্যতম কারণ হচ্ছে, যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করার বিষয়ে মহাজোটের অঙ্গীকার। মানুষ আশা করে বসে আছে, তারা তাদের ভোটের প্রতিদান পাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ বিভাগের অধ্যাপক মোঃ সামাদ বলেন, 'দণি কোরিয়ায় একটি যুদ্ধ জাদুঘর আছে। সেখানে যুদ্ধের সময়কার ঘটনাবলী একেবারে বাস্তবের মতো ফুটিয়ে তোলা হয়েছে। আমাদের দেশেও কেন এ রকম একটি উদ্যোগ নেবে না সরকার? আমরা আমাদের সন্তানদের কী বলব?
সমকাল পত্রিকার ব্যবস্থাপনা সম্পাদক আবু সাঈদ খান বলেন, 'আমরা একাত্তরের চেতনা ভুলে মুক্তিযোদ্ধা ও রাজাকারের ঐক্য চাই না।'
হারুন হাবীব আলোচনায় সঞ্চালকের ভূমিকা পালন করেন। তিনি বলেন, 'যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতেই হবে। অনেকে হতাশ হয়ে পড়ছে। অবশ্য এ জন্য প্রস্তুতি দরকার। বিচার একটি বড় চ্যালেঞ্জ। তবে ১৯৭১ সালে আমেরিকা, চীনের মতো শক্তির বিপরীতে দাঁড়িয়ে আমরা যুদ্ধ জয় করেছি, এখনও পারব। এর জন্য যথাযথ প্রস্তুতি নিতে হবে।'
পাকিস্তান মধ্যপ্রাচ্যের আরব দেশগুলো বিশেষত সৌদি আরব সরকারের মারফত যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না করার জন্য তদ্বির চালিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন আরব দেশে বহুসংখ্যক বাঙালি কাজ করে অনেক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন করে। তাদের পাঠানো টাকায় বাংলাদেশে অনেক কাজ হয়। তাই আরব দেশগুলোর সঙ্গে আমাদের সমঝোতার সম্পর্ক রাখা প্রয়োজন। যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি তাদের বোঝাতে হবে। আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তৎপর হলে এটা কোন কঠিন কাজ নয়। পৃথিবীর অন্যান্য দেশের কাছ থেকে আমরা সমর্থন পেয়েছি। তাই যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের বিষয়টি আর ঝুলিয়ে রাখা ঠিক হবে না। আগামী বছরের মধ্যেই এই বিচার কার্য সম্পন্ন করার চেষ্টা করতে হবে।
কিছুদিন পূর্বে গত চৌদ্দই ডিসেম্বর বুদ্ধিজীবী হত্যা দিবস পালিত হয়েছে। একাত্তর সালের এই দিনে জামায়াতে ইসলামীর অঙ্গ সংগঠন আল শামস্্ আল-বদর. বাহিনী বুদ্ধিজীবীদের বাড়ি থেকে ধরে নিয়ে নির্যাতন করে হত্যা করেছে। জামায়াতে ইসলামীর সহায়তায় পাকিস্তান সামরিক বাহিনী তিন ল মা-বোনের ইজ্জত নষ্ট করেছে। মুক্তিযুদ্ধে ত্রিশ ল বাঙালি শহীদ হয়েছে। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার না হলে এই শহীদদের আত্মা হাহাকার করতে থাকবে। জামায়াতে ইসলামীর নেতারা বলেছেন, তারা যুদ্ধাপরাধী নয়। কিন্তু একাত্তরে তাদের পত্রিকা সংগ্রামে তাদের দেশদ্রোহী কার্যকলাপের বিবরণ সবিস্তারে প্রকাশিত হয়েছে। এখনও তারা বলছে, একাত্তরে মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর সহযোগিতা করে তারা ভুল করেনি। দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপিরও এতে সমর্থন আছে। বিএনপি তাদের মন্ত্রী বানিয়ে তাদের গাড়িতে জাতীয় পতাকা লাগাবার সুযোগ করে দিয়েছে। যুদ্ধাপরাধীকে তাদের স্থায়ী কমিটির সদস্য করেছে। এতেই মনে হয় তারা যুদ্ধাপরাধীদের বিচার চায় না। জনমতের ভয়ে প্রকাশ্যে বলতে পারে না। তবুও তারা বলেছে, এই বিচার যেন রাজনৈতিক প্রতিশোধমূলক না হয়। কথাটা হাস্যকর। কারণ, রাজনৈতিক কারণেই তো যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রয়োজন। তারা রাষ্ট্রদ্রোহী। তারা বাংলাদেশ রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে লড়াই করেছে। তাদের যারা বর্তমানে সাহায্য-সহযোগিতা করছে তারাও সম অপরাধে অপরাধী। বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানই যুদ্ধাপরাধীদের রাজনীতি করার সুযোগ করে দেন। কুখ্যাত যুদ্ধাপরাধী
মশিউর রহমান যাদুমিয়াকে সিনিয়র মন্ত্রী করেন, শাহ আজিজুর রহমানকে প্রধানমন্ত্রী করেন। গোলাম আযমকে দেশে ফেরার অনুমতি দেন; তাকে নাগরিকত্ব দেন। তার স্ত্রী আরও এক ধাপ এগিয়ে যুদ্ধাপরাধীদের মন্ত্রী বানান। কাজেই স্পষ্টতই বিএনপির রাজনীতি মৃত মুসলিম লীগের আদলেই তৈরি হচ্ছে। বিএনপির সাম্প্রতিক কাউন্সিল মিটিংয়ে এ কথা আবারও প্রমাণিত হয়েছে। বিএনপি অসাম্প্রদায়িক গণতন্ত্রের পথে যাবে না। ধর্মভিত্তিক মৌলবাদী রাজনীতির পথেই দৃঢ় পদপে নিয়েছে তারা। কাজেই জামায়াতে ইসলামী ও ধমর্ীয় মৌলবাদী জঙ্গীদের সঙ্গে সখ্য স্বাভাবিক। তাদের এই নীতি বাস্তবতা-বিবর্জিত। তরুণ প্রজন্ম ধমর্ীয় মৌলবাদী জঙ্গীদের প্রত্যাখ্যান করেছে। তাদের সঙ্গে গাঁটছড়া বাঁধার কারণেই বিএনপি এত কম আসন পেয়েছে। তারা যুগের চাহিদা অনুযায়ী নীতিপরিবর্তন না করলে মুসলিম লীগের মতোই তাদের মৃতু্য অনিবার্য। তবে তারা যদি নিজেদের ভবিষ্যতের কথা না ভেবে হারিকিরি করে তাহলে কারোর কিছু করার থাকবে না। দেশে অনেক আওয়ামী লীগ বিরোধী লোক আছে। তারা বিএনপিকেই নিজেদের প্লাটফরম মনে করতে চেয়েছে। কিন্তু হতাশ হয়েছে। বাম দলগুলো তেমনভাবে জনসমর্থন সংগ্রহ করতে পারেনি। নানাবিধ তত্ত্বের কচকচানিতে তারা একটি সংঘবদ্ধ প্লাটফরম তৈরি করতে পারেনি। তাদের উচিত হবে একটি বিকল্প প্লাটফরম তৈরির চেষ্টা করা। তা না হলে দেশে গণতন্ত্রের ভবিষ্যৎ অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে।
দেশ নানা সমস্যায় কন্টকিত। মহাজোট সরকার সব সমস্যার সমাধান করতে পারবে বলে মনে হয় না। তাদের এক বছরে আশানুরূপ সাফল্য অর্জিত হয়নি। মানুষ কিছুটা আশাহত হয়েছে। দ্রব্যমূল্য কমাতে পারেনি সরকার। মনে হয়, বিগত সরকারগুলোর মতো তারাও ব্যবসায়ী সিন্ডিকেটের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। দ্রব্যমূল্য কমাতে না পারলে আগামী নির্বাচনে তার ফল ভোগ করতে হবে। তাই সরকারকে এখনই সাবধান হতে হবে। বিদু্যত উৎপাদনের েেত্র অবশ্য সরকার দ্রুত উদ্যোগ নিয়েছেন। আগামী চার বছরের মধ্যে অবস্থার অনেক উন্নতি হবে বলে মনে হচ্ছে। আইনশৃক্মখলা পরিস্থিতির আরও উন্নতি হওয়া প্রয়োজন। এেেত্র সরকারকে অবশ্যই ক্রসফায়ার বন্ধ করতে হবে। কোন সভ্য সমাজে এটা চলতে পারে না। সরকারকে এই বিষয়ে দৃঢ় অবস্থান নিতে হবে। ক্রসফায়ার কোন সমাধান নয়; এটা রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস। এটা অবশ্যই বন্ধ করতে হবে।
লেখক : ভাষাসৈনিক, মুক্তিযোদ্ধা, সাংবাদিক ও সাবেক সচিব
No comments