সামাজিক উদ্যোক্তা- ড. ইউনূসের নতুন প্রস্তাব by ড. এম এম আকাশ

(পূর্ব প্রকাশের পর) তাদের মতে এটাই হচ্ছে সমাজে শ্রেণী বিভক্তি ও শোষণের মূল কারণ, তাই তাদের প্রস্তাবিত সমাধানে সর্বাগ্রে এসেছে 'সামাজিক মালিকানার' প্রস্তাব। মনে রাখা উচিত 'রাষ্ট্রীয় মালিকানা' ও 'সামাজিক মালিকানা' এক জিনিস নয়! 'রাষ্ট্রীয় মালিকানা' কতটুকু সামাজিক মালিকানায় পরিণত হবে তা নির্ভর করবে রাষ্ট্রের শ্রেণী চরিত্রের ওপর।


সুতরাং রাষ্ট্রীয় মালিকানা বা 'একদলীয় রাষ্ট্র ব্যবস্থাকেই' মার্কসের প্রস্তাবের সারমর্ম ভেবে কাসিক্যাল বামপন্থীরা ভুল করেছিলেন। অন্যদিকে ড. ইউনূস পুঁজিবাদের অসঙ্গতি দূর করার জন্য ব্যক্তিমালিকানার চরিত্র ও ব্যক্তি উদ্যোগের বৈশিষ্ট্যগুলো অব্যাহত রেখেই 'ব্যক্তিগত বণ্টনকে' সামাজিক চরিত্র প্রদানের এক অসম্ভব 'ইউটোপীয়' প্রস্তাব দিচ্ছেন। শেষ বিচারে এই প্রস্তাবকে বাস্তবায়িত করার দায়িত্ব ব্যক্তির সদিচ্ছার বা পছন্দ-অপছন্দের ওপরেই ছেড়ে দিয়েছেন। অবশ্য আমরা তাঁকে প্রশ্ন করতে পারি যে তাঁর নিজের যে প্রতিষ্ঠানটিকে তিনি এ েেত্র উদাহরণ হিসেবে উপস্থাপন করেছেন (গ্রামীণ ব্যাংক) সেটা কি শুধু তাঁর ব্যক্তিগত সদিচ্ছার কারণেই সৃষ্টি হয়েছিল? সেটির মালিকানার প্রকৃতিই বা কি ধরনের? গ্রামীণ ব্যাংকের যাত্রা কিন্তু শুরু হয়েছিল রাষ্ট্রীয় পুঁজির সঙ্গে সহযোগিতা করেই এবং সেই রাষ্ট্রীয় পুঁজির আরোপিত শর্তানুযায়ী গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানা পরবতর্ীতেও তাই কখনই ব্যক্তিগত মালিকানায় পর্যবসিত হতে পারেনি। ড. ইউনূস এখন রাষ্ট্রকে যতই গালমন্দ করুন না কেন রাষ্ট্র ছাড়া গ্রামীণ ব্যাংকের জন্মগ্রহণই ছিল অসম্ভব। গ্রামীণ ব্যাংক সৃষ্টিতে রাষ্ট্রের প্রকৃত ভূমিকাটি ড. ইউনূসের বয়ানেই শোনা যাক। তিনি লিখেছেন, "গ্রামীণ ব্যাংক হয়ে উঠবে সম্পূর্ণভাবে তার গ্রাহকদের মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠান। বরাবর এই ছিল আমার সাধ ও স্বপ্ন। সেভাবেই আমি আমার বিষয়টি বিবৃত করে গেছি। গ্রামীণ ব্যাংকের গুণগ্রাহী ড. হোসেন তুণি আমাদের জন্য আইন তৈরির কাজে মনোযোগী হয়ে উঠলেন। তিনি ৪০ শতাংশ শেয়ার সরকারকে প্রদান করতে পরামর্শ দিলেন। বাকি ৬০ শতাংশ গ্রাহকদের অধিকারে থাকুক। আমি খুব উৎসাহ না দেখিয়ে রাজি হয়ে গেলাম। ... ঢাকায় ফিরে এলাম। ঘোষণার পুরো বয়ান পড়ে আমি হতভম্ব হয়ে গেলাম। অংশীদারিত্ব সম্বন্ধে যা কথা হয়েছিল তার অনুপাত সম্পূর্ণ উল্টে দেয়া হয়েছে। সরকারের থাকবে ৬০ শতাংশ, গ্রহীতাদের প্রাপ্য হতে চলেছে মাত্র ৪০ শতাংশ। অর্থাৎ 'গ্রামীণ ব্যাংক' একটি সরকারী মালিকানার ব্যাংক হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছে। [প্রাগুক্ত পৃ-১৫৮]
সুতরাং ড. ইউনূসের ব্যক্তিগত ইচ্ছা যাই থাকুক না কেন প্রথমে গ্রামীণ ব্যাংক প্রধানত সরকারী ব্যাংক হিসেবেই জন্মগ্রহণ করেছিল। পরবতর্ীতে ড. ইউনূস গ্রামীণ ব্যাংককে সরকারী কতর্ৃত্ব থেকে সম্পূর্ণ মুক্ত করে আনার জন্য চেষ্টা তদ্বির অব্যাহত রাখেন। জনাব মুহিতের (অর্থমন্ত্রী) সৌজন্যে ১৯৮৬ সালে গ্রামীণ ব্যাংকের মালিকানায় সরকার আরেক দফা পরিবর্তন আনলেন। এর ফলে গ্রাহকদের মালিকানা বেড়ে দাঁড়াল ৭৫ শতাংশ। বাকি ২৫ শতাংশ রাষ্ট্রায়ত্ত সোনালী ব্যাংক ও কৃষি ব্যাংকের মালিকানায় ন্যস্ত হলো। এইভাবে গ্রামীণ ব্যাংকের প্রধান মালিক হয়ে পড়লেন গ্রামের গরিব নারীরা এবং সরকার হয়ে পড়ল 'জুনিয়ার পার্টনার'।
কিন্তু এ রকম ূমভ রেধশর্টণ কর্পোরেট মালিকানাধীন কোম্পানির চরিত্রটি পরিস্থিতি সাপে েখুবই ভিন্ন ভিন্ন আকার ও তাৎপর্য ধারণ করতে পারে। এসব কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানের এক প্রান্তে থাকেন অসংখ্য ুদে শেয়ার মালিক এবং অন্য প্রান্তে থাকেন তাদের হয়ে যারা কারখানাটি প্রত্যভাবে চালান তারা। কোন কোন েেত্র কোম্পানির প্রধান শেয়ারের অংশটি অল্প দু'-একজনের হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে এবং তখন বাকি অসংখ্য ছোট মালিকদের কোন তোয়াক্কা না করেই ঐ অল্প ব্যক্তিই কোম্পানির সর্বে-সর্বায় পরিণত হন। আবার কখনও কখনও কোম্পানিটির অন্যান্য ুদ্র মালিকের প থেকে একটি পরিচালকমণ্ডলী নির্বাচিত করে দেয়া হয় এবং তারাই তখন মালিকদের এজেন্ট হিসেবে কোম্পানির দেখ-ভালের দায়িত্ব নেন। তাদের মধ্যে থেকেই আবার শেষ পর্যন্ত একজনকে হয়ত ম্যানেজার এক বা কোম্পানির চেয়ারম্যানের দায়িত্ব দেয়া হয় এবং তিনিই তখন সকলের স্বার্থের প্রধান প্রতিনিধিতে পরিণত হন। প্রায়ই ুদে মালিকদের সঙ্গে তাদের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের বা ম্যানেজারের স্বার্থের দ্বন্দ্ব সৃষ্টি হয় এবং অর্থনীতির পরিভাষায় একেই 'প্রিন্সিপাল এজেন্ট প্রবলেম' হিসেবে নামকরণ করা হয়েছে। তাই মালিকানার চরিত্র ব্যাপক ভিত্তিক বা গণতান্ত্রিক হলেই যে প্রতিষ্ঠানটি সামাজিক বা গণতান্ত্রিকভাবে চলবে তা বলা যায় না। এ ধরনের কর্পোরেট ব্যবস্থায় প্রতিনিধিত্বশীল গণতন্ত্রের সব সমস্যাই পদে পদে বিদ্যমান রয়েছে এবং অল্প সংখ্যক এজেন্ট প্রায়ই অসংখ্য প্রিন্সিপালের স্বার্থ উল্টে দিতে পারেন। (চলবে)

No comments

Powered by Blogger.