আলোকের এই ঝরনাধারায় (পর্ব-৮৭)-তোমরা স্বাধীন! by আলী যাকের

৯ নম্বর সেক্টর ঘুরে আরো পাঁচ-ছয়টি যুদ্ধ শেষে বেশ কিছু যুদ্ধ প্রতিবেদন ও সাক্ষাৎকার ধারণ করে আমি ফিরে এলাম আমাদের বেতার ভবনে। সেখানে ফিরে আসতে না আসতেই কবির ভাই বললেন, আমরা যুদ্ধ জয়ের দ্বারপ্রান্তে। অচিরেই যদি পাকিস্তানি সেনাবাহিনী বাংলাদেশে আত্মসমর্পণ করে,


তাহলে তাঁকে কয়েক মিনিটের নোটিশে মুজিবনগর সরকারের সব মন্ত্রী ও গুরুত্বপূর্ণ কর্মচারীদের সঙ্গে হেলিকপ্টারযোগে ঢাকা যেতে হবে। এই মুহূর্তে আমার কর্তব্য কী, জিজ্ঞেস করাতে তিনি বললেন, আমি যেন মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনীর পেছনে পেছনে যশোর রোড দিয়ে যশোরের দিকে যাই। পথে বিভিন্ন গ্রাম ও জনপদ যখন স্বাধীন হবে, সেখানকার অধিবাসীদের সাক্ষাৎকার আমাকে ধারণ করতে হবে টেপরেকর্ডারে। তারপর সেগুলো প্রচার করতে হবে স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে।
১৫ ডিসেম্বর, ১৯৭১। আমি আবার যুদ্ধক্ষেত্রের পথে পা বাড়ালাম। বেনাপোল পার হয়ে আমি বেশ কিছু গ্রামে আমার কাজ শেষ করে যশোর রোডের ওপর এসে দাঁড়িয়েছি। উদ্দেশ্য, ওই রাস্তা ধরে যশোরের দিকে যাব। স্থানটির নাম নাভারণ। ১৫ থেকে ১৬ ডিসেম্বরের অপরাহ্ন পর্যন্ত আমি অক্লান্ত পরিশ্রম করেছি। তারপর ওই অপরাহ্নে প্রচণ্ড ক্লান্তি নিয়ে যশোর রোডের ওপর টেপ রেকর্ডার হাতে পূর্ব দিকে হেঁটে চলেছি। উদ্দেশ্য, যশোর রোডে যদি ভারতীয় সেনাবাহিনীর কোনো গাড়ির দেখা মেলে, তাহলে সেটায় চেপে যশোর যাওয়া যাবে। দুই দিন ধরেই ভারতীয় সশস্ত্রবাহিনী প্রধান জেনারেল মানেক শ, বাংলাদেশে নিয়োজিত পাকিস্তানি সেনাপ্রধান লে. জে. এ এ কে নিয়াজিকে একের পর এক বার্তা দিয়ে চলেছেন নানা সংবাদমাধ্যম মারফত। এ ছাড়া ভারতীয় বিমান বাহিনী লিফলেট ছড়াচ্ছে বাংলাদেশের আকাশ থেকে। এই ঘোষণাগুলোতে পাকিস্তানি বাহিনীকে আত্মসমর্পণ করতে বলা হচ্ছে। ইতিমধ্যে ঢাকা শহরকে চারদিক থেকে ঘিরে ফেলেছে মুক্তিবাহিনী ও মিত্রবাহিনী। ঘোষণায় এও বলা হচ্ছে যে ঢাকা এখন ভারতীয় গোলন্দাজ বাহিনীর কামানের আওতায়। পাকিস্তানি বাহিনী যদি আত্মসমর্পণ না করে তাহলে ঢাকা শহরের ওপর ভারী গোলাবর্ষণ শুরু হবে। সেই সঙ্গে চলবে ভারতীয় বিমান বাহিনীর অবিরাম বোমা বর্ষণ। এ ছাড়া যদি আমাদের দিকের পদাতিক বাহিনী ঢাকা শহরে প্রবেশ করে, তখন ঢাকা শহরের রাস্তায় রাস্তায় যুদ্ধ হবে। তাতেও বিস্তর লোক মারা পড়বে। এসব ভাবছি আর মন আতঙ্কে ভরে যাচ্ছে। ওই শহরে বন্দি অবস্থায় রয়েছে আমার কত আপনজন। তাদের গিয়ে দেখতে পাব তো? নাকি গোলার আঘাতে ঢাকা বিধ্বস্ত নগরী হয়ে যাবে? স্বাধীনতা একেবারে দোরগোড়ায় এসে গেছে, এটা বুঝতে পারি। তবুও কী এক অজানা আশঙ্কায় মন ভরে যায় বিষাদে। এমন সময় ঠিক উল্টো দিক থেকে সেনাবাহিনীর একটি জিপ এলো। আমার কাছে এসে জিপটি গতি শ্লথ করল। চালক একজন ভারতীয় সেনা অফিসার। হাসতে হাসতে তিনি আমাকে বললেন, 'এই মাত্র ওয়্যারলেসে খবর পেলাম, ঢাকায় নিয়াজি আত্মসমর্পণ করেছে। Rejoice, You are free. বলেই জিপটি ভুস করে বেরিয়ে গেল। You are free! তোমরা স্বাধীন! কথাটি কানে ভাসতে লাগল। করোটির ভেতরে ঢুকে গেল যেন। আমি স্থাণুর মতো কিছুক্ষণ দাঁড়িয়ে থাকলাম। টেপরেকর্ডারটা আমার হাত থেকে খসে পড়ে গেল রাস্তার ওপর। আমি শুয়ে হাঁটু গেড়ে বসে পড়লাম। আমার দুটি হাতের তালু দিয়ে বাংলার মাটিতে সস্নেহে স্পর্শ করলাম।
তারপর আস্তে আস্তে সেই মাটিতে শুয়ে পড়লাম। গড়াতে শুরু করলাম আমার বাংলার মাটিতে। গড়াতে গড়াতে কখন যে রাস্তা থেকে ঢাল বেয়ে নেমে গেছি ধানক্ষেতের মধ্যে, লক্ষই করিনি। চোখ দিয়ে অঝর ধারায় বয়ে চলেছে আনন্দাশ্রু। আমি হাপুস নয়নে কাঁদছি। সেই অশ্রু গিয়ে মিশছে বাংলার মাটিতে। মনে হলো, এত গাঢ় নীল আকাশ কখনো দেখিনি। এমন টকটকে অস্তগামী সূর্য কখনো দেখিনি যেন আগে। এমন সুখের অপরাহ্ন কখনো আসেনি জীবনে। এখন সুখ আর সুখ চারপাশে। ঘাসের ওপর গজিয়ে ওঠা বনফুল সুখের রসে টইটম্বুর, ঘাসের ডগায় সুখ শিশিরের বিন্দু, শালিক-দোয়েল-ময়নার মুখে সুখের কলকাকলি। হঠাৎ অবসাদে ছেয়ে গেল মন। আজ থেকে তবে আমার দায়িত্ব শেষ। নির্ধারিত কাজের সমাপ্তি। বড্ড ক্লান্ত মনে হলো নিজেকে। সদ্য স্বাধীন বাংলার শিশিরভেজা সবুজ ঘাসে চিত হয়ে শুয়ে আছি আমি। টেপরেকর্ডার, ট্রানজিস্টর ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়ে রয়েছে মহাসড়কে। এখন আর কী আসে-যায়?
পরবর্তী দৃশ্যের উন্মোচন আমার এই কয় মাসের কর্মস্থল স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র ভবনে। প্রাণটা আইঢাই করছে ঢাকা যাওয়ার জন্য। শত্রুমুক্ত আমার প্রিয় শহরটি দেখার জন্য। কিন্তু উপায় নেই। কবির ভাই ঢাকায়, অতএব স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রের ইংরেজি বিভাগের সব দায়িত্ব আমায় পালন করে যেতে হবে। আমাকে তারিখ নির্ধারণ করে দেওয়া হয়েছে জানুয়ারির ৮। সেদিন নির্ধারিত কর্তৃপক্ষের কাছে সব দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে তবেই আমার ছুটি।
(চলবে)

লেখক : সাংস্কৃতিক ব্যক্তিত্ব

No comments

Powered by Blogger.