জলবায়ু পরিবর্তন ও বাংলাদেশ by ইকবাল আজিজ
বিংশ শতাব্দী পার হয়ে একবিংশ শতাব্দীতে এসেছি আমরা। কিন্তু গত প্রায় চার দশক ধরে পৃথিবীর জলবায়ু ও পরিবেশের যে পরিবর্তন হয়েছে, তা চোখে পড়ার মতো। বিজ্ঞান ও যন্ত্রসভ্যতা একদিন মানুষকে একটি আধুনিক ও কল্যাণমুখী পৃথিবী গড়তে উৎসাহিত করেছিল।
কিন্তু কিছু বিপথগামী মানুষের লোভ ও হটকারিতা আমাদের চিরপরিচিত এ সজীব, সবুজ, সুন্দর পৃথিবীকে ধীরে ধীরে মানুষের বসবাসের অনুপযুক্ত করে তুলেছে। তাদের কারণেই বদলে যাচ্ছে পৃথিবীর পরিবেশ ও জলবায়ু। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ হচ্ছে। সেই সাথে বৈশ্বিক তাপ বৃদ্ধি পাওয়ায় সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বাড়ছে। এর ফলে বাংলাদেশসহ কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন। কেউ কেউ মনে করেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশ হবে সবচেয়ে তিগ্রস্ত দেশ। বাংলাদেশ একটি ছোট দেশ; কিন্তু এর জনসংখ্যা কানাডা ও অস্ট্রেলিয়ার মোট জনসংখ্যার অনেক বেশি। বাংলাদেশে খুব সীমিত জায়গার মধ্যে অনেক বেশি সংখ্যক মানুষকে বসবাস করতে হয়। আর এই জনসংখ্যার ৪০ শতাংশেরও বেশি দারিদ্র্যসীমার নিচে বসবাস করে। সুতরাং যে কোন আন্তর্জাতিক সঙ্কট কিংবা প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলার মতা এখানকার মানুষের খুব কম। পৃথিবীর জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশের গরিব মানুষের অসুবিধা হবে সবচেয়ে বেশি। এই পরিবর্তনের অন্যতম আভাস হিসাবে ইতোমধ্যে বাংলাদেশের কিছু কিছু উপকূলীয় এলাকায় জলভূমিতে লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। লবণাক্ততার কারণে এখানে অনেক কৃষি জমিতেই চাষাবাদ তিগ্রস্ত হচ্ছে। উপকূলীয় এলাকা বসবাসের অনুপযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। এ কারণে উপকূলীয় এলাকা থেকে রাজধানী ঢাকা ও অন্যান্য শহরে বিপুল সংখ্যক মানুষের আগমন বৃদ্ধি পেয়েছে। এরা শহরে কেবলমাত্র বস্তির সংখ্যাই বাড়াচ্ছে ও নানাবিধ সমস্যার সৃষ্টি করছে।
সুতরাং বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবীর কিছু বড় ও ধনী রাষ্ট্রের জন্য ভবিষ্যতের সমস্যা হলেও বাংলাদেশের জন্য তা সমকালীন বাস্তবতা। আমরা শৈশবে ও কৈশোরে বাংলাদেশে যে ধরনের জলবায়ু ও পরিবেশ দেখেছিলাম, তা অনেকখানি বদলে গেছে। বর্ষায় অনেক সময় বৃষ্টি হয় না, শীতের সময় কখনও শীত কখনও উষ্ণতা। মানুষের তৈরি বাঁধ কিংবা অন্যান্য কারণে বাংলাদেশের নদীতে এখন গ্রীষ্মেকালে পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। ষাট দশকের শুরুতে আমার ছেলেবেলায় রাজশাহীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর প্রচণ্ড স্রোত ও উত্তাল ঢেউ আমাকে প্রকৃতির বিপুল শক্তির কথা মনে করিয়ে দিত। এমনকি বৈশাখ মাসেও পদ্মার প্রবাহ ছিল বেশ জীবন্ত। সকাল-সন্ধ্যায় নদীর তীরে মানুষ বেড়াতে যেত। প্রায়শই নদীর পানিতে কালো রঙের শুশুকের ডিগবাজি দেখতাম, মনে হতো একটি রহস্যময় জলের প্রাণী শরীর দেখিয়ে হঠাৎ ডুবে গেল জলের গভীরে। বড় হয়ে জেনেছি, বঙ্গদেশের এই অতি পরিচিত নদীর শুশুক হলো মিঠা পানির ডলফিন। যে নদীর পানি বিশুদ্ধ ও সজীব, কেবলমাত্র সেখানেই এই ডলফিন বাস করতে পারে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের অনেক নদীতে পানি নেই কিংবা অবিরত বর্জ্য ফেলার কারণে নদীর পানিও বিষাক্ত হয়ে গেছে; তাই আমাদের সেই পরিচিত শুশুক বা ডলফিন এখন বাংলাদেশের নদী থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছে বলা যায়। সামান্য দু একটি শুশুক কালেভদ্রে দেখা যায়। কয়েক মাস আগে কলকাতায় 'পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীতে' কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতর্ীর সাথে দেখা হয়েছিল। কবির আদিনিবাস ফরিদপুরের ভাঙ্গা অঞ্চলে। কথা প্রসঙ্গে কবি তাঁর কিশোরবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, তিনি তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কুমার নদে প্রায়ই শুশুক দেখতেন। জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের নদীগুলোতে এখন যথেষ্টসংখ্যক শুশুক আছে কি না। বললাম, আছে, তবে খুব কম। নাই বললেই চলে। হয়ত জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মিঠা পানির সেই সব শুশুকও বিদায় নিয়েছে। জলবায়ু ও পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাব শুধু প্রকৃতি কিংবা জলচর প্রাণীর ওপরই পড়েনি, বরং তার প্রভাব মানুষের ওপর পড়েছে অনেক বেশি।
একটি কথা সত্যি যে, আগে বা পরে হোক জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবীর সব পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতিকে তিগ্রস্ত করবে। কিন্তু এই তি তাদের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, উন্নয়ন ও সরকারের সমতা অনুযায়ী বিভিন্ন হবে। যেসব প্রাকৃতিক সমস্যা মানুষের জীবনকে দুঃসহ করে তুলবে, তার মধ্যে আছে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও খরা। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যদি এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় কার্যকর পদপে গ্রহণ না করেন, তবে তা অদূর ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে। জলবায়ুর পরিবর্তন মানুষের দারিদ্র্য, খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, আশ্রয় ও সামাজিক নিরাপত্তার সমস্যাকে তীব্রতর করে তুলবে। আগেই বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বিশ্বের গরিব মানুষের জীবনকে বেশি বিপন্ন করবে। বাংলাদেশে দণিাঞ্চলীয় মানুষের জীবনে এই পরিবর্তনের অভিঘাত ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। সরকারী ও বেসরকারী প্রচারণায় প্রায়শই আসন্ন ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে জনগণকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হচ্ছে।
তবে বিশ্বের বড় ও ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে সরকারীভাবে খুব একটা সোচ্চার নয়। যদিও এসব দেশের কিছু কিছু পরিবেশবাদী সংগঠন এ নিয়ে অনেক আগে থেকেই প্রচারণা চালাচ্ছে। বাংলাদেশসহ কিছু গরিব দেশের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হলেও ধনী ও উন্নত দেশগুলো এ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট কিংবা জোরালো পদপে নিতে এখনও রাজি নয়। তবে বিশ্বের বেশ কিছু পরিবেশবাদী গবেষক ও সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সম্পর্কে বেশ কয়েক বছর ধরে প্রচারণা ও আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
ধারণা করা হয়েছিল, সম্প্রতি কোপেনহেগেনে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোন দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি স্বারিত হবে। কিন্তু তিন দিনের অচলাবস্থার পর শেষ পর্যন্ত একটি অঙ্গীকারনামার মধ্য দিয়ে এই সম্মেলন সমাপ্ত হয়। পরিবেশবাদীরা কোপেনহেগেনে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলনকে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ বলে বর্ণনা করেছেন। সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার লড়াইয়ে অর্থায়নের ব্যাপারে অগ্রগতি হলেও আর কোন বিষয়ে তেমন অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ ব্যাপারে একটি 'সমাঝোতা প্রস্তাব' উত্থাপন করেন। সম্মেলনের শেষ মুহূর্তে ব্যাপক তর্কবির্তক শেষে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। পরিবেশবাদী সংগঠন 'ফ্রেন্ডস অব দি আর্থ ইন্টারন্যাশনালের' সভাপতি রিকো ব্যাসেই বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কোপেনগেহেন সম্মেলন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। উন্নত দেশগুলো 'কার্বন নিঃসরণের ব্যাপারে' কোন সুস্পষ্ট পদপে নিতে না পারায়, তা বিশ্বের লাখ লাখ গরিব মানুষের ুধা, দুর্দশা ও প্রাণহানির আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্মেলনের এই শোচনীয় ব্যর্থতার জন্য উন্নত দেশগুলোকেও ভুগতে হবে।" সমঝোতা প্রস্তাবে অনেক ফাঁক থাকার কথাও কেউ কেউ বলেছেন। আফ্রিকার একজন পরিবেশবিদ কোপেনহেগেন সম্মেলনকে জাতিসংঘের ব্যর্থতা বলেও অভিহিত করেছেন। অক্সফামের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটাকে কোনো চুক্তিই বলা যায় না। আগামী বছরের মধ্যে কোন চুক্তিতে পেঁৗছানোর ব্যাপারে কোন সময়সীমার কথা প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি। পাশাপাশি এখানে কোন আইনি বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক কোপেনহেগেন সম্মেলন একেবারে ব্যর্থ হয়েছে এমনটাও বলা যায় না। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দুই ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে রাখতে পৃথিবীর সব দেশই একমত হয়েছে। এ ল্যে অনেক দেশই কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট ওবামার সমঝোতা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিযোজন মতা বাড়াতে উন্নত দেশগুলো তাদের পর্যাপ্ত ও নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দেবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজন মেটাতে উন্নত দেশগুলো ২০২০ নাগাদ যৌথভাবে প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি ডলার দেয়ার ল্যমাত্রা ঠিক করেছে। বিশ্বে বনভূমি ধ্বংস ও বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় গ্রীনহাউস গ্যাসের মাত্রা বাড়ছে_ বিষয়টি সমঝোতা প্রস্তাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, বন সংরণের জন্য তিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে।
কোপেনহেগেন শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিদেনপ েএই সত্যটি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, উন্নত দেশগুলো এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতাকে সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে। আর বাংলাদেশ যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, সুতরাং বাংলাদেশকে পরিস্থিতির মোকাবেলায় তার নিজস্ব উদ্যোগ অব্যাহত রাখতেই হবে। সম্প্রতি প্রায়ই একটি দুঃসংবাদ আমরা শুনতে পাই, বাংলাদেশের উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী হুমকির সম্মুখীন। পাঁচ বছর আগে টেকনাফের উপকূলভাগে ব্যাপকসংখ্যক প্যারাবন ও ক্যাওড়া গাছ দেখেছিলাম। অনেক সময় সে সব গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। কখনওবা অবহেলার কারণে সেসব গাছ মরে যাচ্ছে। জরুরীভিত্তিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী রা করতে হবে। পরিবেশ সংরণে আমাদের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সাথে সর্বণিক আলোচনা অব্যাহত রাখা দরকার। এই দুটি দেশে অতি দ্রুত শিল্পায়ন ঘটছে। এছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশের মধ্যে চীন ও ভারত অন্যতম। তারা বলেছে, শিল্পোন্নয়নের স্বার্থে ও প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখতে তাদের প েআপাতত কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব না। তবে পৃথিবীতে কোন সিদ্ধান্তই স্থায়ী নয়। বাংলাদেশকে তার পরিবেশগত স্বার্থ রায় এই দুটি দেশের সাথে আলোচনা ও যোগাযোগ অব্যাহত রাখতেই হবে।
বাংলাদেশে পানি, বাতাস ও মাটিকে দূষণমুক্ত রাখার ল্যে প্রতিমুহূর্তে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে। এছাড়া সমুদ্রের আগ্রাসন থেকে উপকূলভাগ রার জন্য এখন থেকেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দরকার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটের মোকাবেলা বাংলাদেশ ও আরো কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রের প েনিজেদের অবস্থান ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ সঙ্কটের মোকাবেলায় উন্নত বিশ্ব থেকে যে অর্থ পাবে, তা অবশ্যই সুপরিকল্পিতভাবে খরচ করতে হবে আমাদের মাতৃভূমি ও জনগণকে রার জন্য। এ ব্যাপারে সামান্য অস্বচ্ছতা বা অনিয়ম আমাদের জন্য ব্যাপক বিপর্যয় বয়ে আনবে।
সুতরাং বিশ্বব্যাপী জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবীর কিছু বড় ও ধনী রাষ্ট্রের জন্য ভবিষ্যতের সমস্যা হলেও বাংলাদেশের জন্য তা সমকালীন বাস্তবতা। আমরা শৈশবে ও কৈশোরে বাংলাদেশে যে ধরনের জলবায়ু ও পরিবেশ দেখেছিলাম, তা অনেকখানি বদলে গেছে। বর্ষায় অনেক সময় বৃষ্টি হয় না, শীতের সময় কখনও শীত কখনও উষ্ণতা। মানুষের তৈরি বাঁধ কিংবা অন্যান্য কারণে বাংলাদেশের নদীতে এখন গ্রীষ্মেকালে পানির প্রবাহ নেই বললেই চলে। ষাট দশকের শুরুতে আমার ছেলেবেলায় রাজশাহীর পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া পদ্মা নদীর প্রচণ্ড স্রোত ও উত্তাল ঢেউ আমাকে প্রকৃতির বিপুল শক্তির কথা মনে করিয়ে দিত। এমনকি বৈশাখ মাসেও পদ্মার প্রবাহ ছিল বেশ জীবন্ত। সকাল-সন্ধ্যায় নদীর তীরে মানুষ বেড়াতে যেত। প্রায়শই নদীর পানিতে কালো রঙের শুশুকের ডিগবাজি দেখতাম, মনে হতো একটি রহস্যময় জলের প্রাণী শরীর দেখিয়ে হঠাৎ ডুবে গেল জলের গভীরে। বড় হয়ে জেনেছি, বঙ্গদেশের এই অতি পরিচিত নদীর শুশুক হলো মিঠা পানির ডলফিন। যে নদীর পানি বিশুদ্ধ ও সজীব, কেবলমাত্র সেখানেই এই ডলফিন বাস করতে পারে। পরিবেশ বিপর্যয়ের কারণে বাংলাদেশের অনেক নদীতে পানি নেই কিংবা অবিরত বর্জ্য ফেলার কারণে নদীর পানিও বিষাক্ত হয়ে গেছে; তাই আমাদের সেই পরিচিত শুশুক বা ডলফিন এখন বাংলাদেশের নদী থেকে প্রায় বিদায় নিয়েছে বলা যায়। সামান্য দু একটি শুশুক কালেভদ্রে দেখা যায়। কয়েক মাস আগে কলকাতায় 'পশ্চিমবঙ্গ বাংলা আকাদেমীতে' কবি নীরেন্দ্রনাথ চক্রবতর্ীর সাথে দেখা হয়েছিল। কবির আদিনিবাস ফরিদপুরের ভাঙ্গা অঞ্চলে। কথা প্রসঙ্গে কবি তাঁর কিশোরবেলার স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বললেন, তিনি তাঁর বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে যাওয়া কুমার নদে প্রায়ই শুশুক দেখতেন। জানতে চাইলেন, বাংলাদেশের নদীগুলোতে এখন যথেষ্টসংখ্যক শুশুক আছে কি না। বললাম, আছে, তবে খুব কম। নাই বললেই চলে। হয়ত জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে নদীর পানির লবণাক্ততা বৃদ্ধি পেয়েছে। তাই মিঠা পানির সেই সব শুশুকও বিদায় নিয়েছে। জলবায়ু ও পরিবেশ পরিবর্তনের প্রভাব শুধু প্রকৃতি কিংবা জলচর প্রাণীর ওপরই পড়েনি, বরং তার প্রভাব মানুষের ওপর পড়েছে অনেক বেশি।
একটি কথা সত্যি যে, আগে বা পরে হোক জলবায়ুর পরিবর্তন পৃথিবীর সব পরিবেশ, সমাজ ও অর্থনীতিকে তিগ্রস্ত করবে। কিন্তু এই তি তাদের ভৌগোলিক অবস্থান, অর্থনৈতিক অবস্থা, উন্নয়ন ও সরকারের সমতা অনুযায়ী বিভিন্ন হবে। যেসব প্রাকৃতিক সমস্যা মানুষের জীবনকে দুঃসহ করে তুলবে, তার মধ্যে আছে ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, দীর্ঘস্থায়ী বন্যা, ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস, সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধি ও খরা। বিশ্ব নেতৃবৃন্দ যদি এখনই জলবায়ু পরিবর্তনের মোকাবেলায় কার্যকর পদপে গ্রহণ না করেন, তবে তা অদূর ভবিষ্যতে সারা পৃথিবীর অস্তিত্বের জন্য হুমকি সৃষ্টি করবে। জলবায়ুর পরিবর্তন মানুষের দারিদ্র্য, খাদ্য, পানি, স্বাস্থ্য, জ্বালানি, আশ্রয় ও সামাজিক নিরাপত্তার সমস্যাকে তীব্রতর করে তুলবে। আগেই বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত বিশ্বের গরিব মানুষের জীবনকে বেশি বিপন্ন করবে। বাংলাদেশে দণিাঞ্চলীয় মানুষের জীবনে এই পরিবর্তনের অভিঘাত ইতোমধ্যে পড়তে শুরু করেছে। সরকারী ও বেসরকারী প্রচারণায় প্রায়শই আসন্ন ভয়াবহ বিপদ সম্পর্কে জনগণকে হুঁশিয়ার করে দেয়া হচ্ছে।
তবে বিশ্বের বড় ও ধনী দেশগুলো জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে নিজেদের দায়িত্ব নিয়ে সরকারীভাবে খুব একটা সোচ্চার নয়। যদিও এসব দেশের কিছু কিছু পরিবেশবাদী সংগঠন এ নিয়ে অনেক আগে থেকেই প্রচারণা চালাচ্ছে। বাংলাদেশসহ কিছু গরিব দেশের অস্তিত্ব হুমকির সম্মুখীন হলেও ধনী ও উন্নত দেশগুলো এ বিষয়ে কোন সুস্পষ্ট কিংবা জোরালো পদপে নিতে এখনও রাজি নয়। তবে বিশ্বের বেশ কিছু পরিবেশবাদী গবেষক ও সংস্থা জলবায়ু পরিবর্তনের বিপদ সম্পর্কে বেশ কয়েক বছর ধরে প্রচারণা ও আন্দোলন চালিয়ে আসছে।
ধারণা করা হয়েছিল, সম্প্রতি কোপেনহেগেনে জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক বিশ্ব সম্মেলনে ঐকমত্যের ভিত্তিতে কোন দীর্ঘমেয়াদী চুক্তি স্বারিত হবে। কিন্তু তিন দিনের অচলাবস্থার পর শেষ পর্যন্ত একটি অঙ্গীকারনামার মধ্য দিয়ে এই সম্মেলন সমাপ্ত হয়। পরিবেশবাদীরা কোপেনহেগেনে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক সম্মেলনকে শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ বলে বর্ণনা করেছেন। সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার লড়াইয়ে অর্থায়নের ব্যাপারে অগ্রগতি হলেও আর কোন বিষয়ে তেমন অগ্রগতি অর্জিত হয়নি। মার্কিন প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা এ ব্যাপারে একটি 'সমাঝোতা প্রস্তাব' উত্থাপন করেন। সম্মেলনের শেষ মুহূর্তে ব্যাপক তর্কবির্তক শেষে প্রস্তাবটি গৃহীত হয়। পরিবেশবাদী সংগঠন 'ফ্রেন্ডস অব দি আর্থ ইন্টারন্যাশনালের' সভাপতি রিকো ব্যাসেই বলেন, "জলবায়ু পরিবর্তনের বিষয়ে কোপেনগেহেন সম্মেলন শোচনীয়ভাবে ব্যর্থ হয়েছে। উন্নত দেশগুলো 'কার্বন নিঃসরণের ব্যাপারে' কোন সুস্পষ্ট পদপে নিতে না পারায়, তা বিশ্বের লাখ লাখ গরিব মানুষের ুধা, দুর্দশা ও প্রাণহানির আশঙ্কা বাড়িয়ে দিয়েছে। সম্মেলনের এই শোচনীয় ব্যর্থতার জন্য উন্নত দেশগুলোকেও ভুগতে হবে।" সমঝোতা প্রস্তাবে অনেক ফাঁক থাকার কথাও কেউ কেউ বলেছেন। আফ্রিকার একজন পরিবেশবিদ কোপেনহেগেন সম্মেলনকে জাতিসংঘের ব্যর্থতা বলেও অভিহিত করেছেন। অক্সফামের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, এটাকে কোনো চুক্তিই বলা যায় না। আগামী বছরের মধ্যে কোন চুক্তিতে পেঁৗছানোর ব্যাপারে কোন সময়সীমার কথা প্রস্তাবে উল্লেখ করা হয়নি। পাশাপাশি এখানে কোন আইনি বাধ্যবাধকতা রাখা হয়নি।
তবে জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক কোপেনহেগেন সম্মেলন একেবারে ব্যর্থ হয়েছে এমনটাও বলা যায় না। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বৃদ্ধির হার দুই ডিগ্রী সেলসিয়াসের নিচে রাখতে পৃথিবীর সব দেশই একমত হয়েছে। এ ল্যে অনেক দেশই কার্বন নিঃসরণ হ্রাসের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে। এছাড়া প্রেসিডেন্ট ওবামার সমঝোতা প্রস্তাবে বলা হয়েছে, জলবায়ু পরিবর্তনের বিরূপ প্রভাব মোকাবেলার জন্য উন্নয়নশীল দেশগুলোর অভিযোজন মতা বাড়াতে উন্নত দেশগুলো তাদের পর্যাপ্ত ও নিয়মিত আর্থিক সহায়তা দেবে। উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রয়োজন মেটাতে উন্নত দেশগুলো ২০২০ নাগাদ যৌথভাবে প্রতিবছর ১০ হাজার কোটি ডলার দেয়ার ল্যমাত্রা ঠিক করেছে। বিশ্বে বনভূমি ধ্বংস ও বনাঞ্চল কমে যাওয়ায় গ্রীনহাউস গ্যাসের মাত্রা বাড়ছে_ বিষয়টি সমঝোতা প্রস্তাবে স্বীকার করে নেয়া হয়েছে। সিদ্ধান্ত নেয়া হয়েছে, বন সংরণের জন্য তিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দেয়া হবে।
কোপেনহেগেন শীর্ষ সম্মেলন অনুষ্ঠানের মধ্য দিয়ে নিদেনপ েএই সত্যটি সুস্পষ্ট হয়েছে যে, উন্নত দেশগুলো এখন জলবায়ু পরিবর্তনের বাস্তবতাকে সুস্পষ্টভাবে উপলব্ধি করে। আর বাংলাদেশ যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ, সুতরাং বাংলাদেশকে পরিস্থিতির মোকাবেলায় তার নিজস্ব উদ্যোগ অব্যাহত রাখতেই হবে। সম্প্রতি প্রায়ই একটি দুঃসংবাদ আমরা শুনতে পাই, বাংলাদেশের উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী হুমকির সম্মুখীন। পাঁচ বছর আগে টেকনাফের উপকূলভাগে ব্যাপকসংখ্যক প্যারাবন ও ক্যাওড়া গাছ দেখেছিলাম। অনেক সময় সে সব গাছ কেটে ফেলা হচ্ছে। কখনওবা অবহেলার কারণে সেসব গাছ মরে যাচ্ছে। জরুরীভিত্তিতে বাংলাদেশের উপকূলীয় সবুজ বেষ্টনী রা করতে হবে। পরিবেশ সংরণে আমাদের দুই বৃহৎ প্রতিবেশী ভারত ও চীনের সাথে সর্বণিক আলোচনা অব্যাহত রাখা দরকার। এই দুটি দেশে অতি দ্রুত শিল্পায়ন ঘটছে। এছাড়া পৃথিবীর সবচেয়ে বেশি কার্বন নিঃসরণকারী দেশের মধ্যে চীন ও ভারত অন্যতম। তারা বলেছে, শিল্পোন্নয়নের স্বার্থে ও প্রবৃদ্ধির হার ধরে রাখতে তাদের প েআপাতত কার্বন নিঃসরণ হ্রাস করা সম্ভব না। তবে পৃথিবীতে কোন সিদ্ধান্তই স্থায়ী নয়। বাংলাদেশকে তার পরিবেশগত স্বার্থ রায় এই দুটি দেশের সাথে আলোচনা ও যোগাযোগ অব্যাহত রাখতেই হবে।
বাংলাদেশে পানি, বাতাস ও মাটিকে দূষণমুক্ত রাখার ল্যে প্রতিমুহূর্তে তৃণমূল পর্যায়ে প্রচারণা অব্যাহত রাখতে হবে। এছাড়া সমুদ্রের আগ্রাসন থেকে উপকূলভাগ রার জন্য এখন থেকেই সুদূরপ্রসারী পরিকল্পনা দরকার। ইউরোপীয় ইউনিয়ন অবশ্য জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্কটের মোকাবেলা বাংলাদেশ ও আরো কয়েকটি দ্বীপরাষ্ট্রের প েনিজেদের অবস্থান ঘোষণা করেছে। বাংলাদেশ সঙ্কটের মোকাবেলায় উন্নত বিশ্ব থেকে যে অর্থ পাবে, তা অবশ্যই সুপরিকল্পিতভাবে খরচ করতে হবে আমাদের মাতৃভূমি ও জনগণকে রার জন্য। এ ব্যাপারে সামান্য অস্বচ্ছতা বা অনিয়ম আমাদের জন্য ব্যাপক বিপর্যয় বয়ে আনবে।
No comments