মালয়েশিয়ায় বাঙালী by মুনতাসীর মামুন

(পূর্ব প্রকাশের পর) অনেকে ধরা পড়ছে। তাদের আইনি সাহায্য দরকার। এবং সে জন্য টাকারও দরকার। দূতাবাস একজন আইনজ্ঞ ঠিক করে দেবে। তিনি এ সব কাজ করবেন। টাকাটাও সরকার দেবে। ‘একজন অপরাধ করবে, তাকে ছাড়াবার ব্যবস্থা করতে হবে সরকারকে, এটি কেমন যুক্তি?’ জিজ্ঞেস করি আমি।


তারা যুক্তির খুব একটা ধার ধারেন না। প্রবাসীরা কি বাংলাদেশের জন্য যথেষ্ট করছে না? করছে। কিন্তু যদি বলি নিজের জন্যই তো করছে। যে টাকা তারা পাঠাচ্ছেন তা তো তারাই খরচ করছেন। সরকার তো তাতে ভাগ বসাছে না। সেই যুবকটি অভিযোগ করেই চলছেন। আমরা চুপ করে থাকি। কোন দেশে আমি দেশের দূতাবাসের প্রশংসা শুনিনি। অভিযোগ প্রায় ক্ষেত্রে একতরফাই হয়।
‘এই যে দেখেন,’ একজন একটি পত্রিকা এনে আমার হাতে দেয়।
পত্রিকার নাম সাপ্তাহিক বাংলার কথা। সম্পাদক মোঃ আযাদ। বেশ রঙচঙে। ছাপা কিন্তু ঢাকায়। অন্যান্য দেশের বাংলা পত্রিকার মতো দেশের সংবাদপত্রেরই অধিকাংশ খবর। দু’একটি মালয়েশিয়ার। যেমন প্রথম পৃষ্ঠায় মালয়েশিয়ার বাংলাদেশীদের নিয়ে কয়েকটি খবর। উপ- শিরোনাম ‘মালয়েশিয়া ৬-পি নামে প্রতারণা॥ লাখ লাখ রিঙ্গিত নিয়ে পলাতক ওমর আকাশ। খবরের একাংশÑ “মালয়েশিয়ার ৬-পি নামে প্রবাসী বাংলাদেশীদের কাছ থেকে লাখ লাখ রিঙ্গিত হাতিয়ে আত্মগোপন করে আছে বাংলাদেশী এক প্রতারক। ওই প্রতারকের নাম ওমর আকাশ। জানা যায়, তার কোম্পানির নামে শত শত বাংলাদেশী শ্রমিক কাজ করত। তাদের পারমিট ও ভিসা করে দেওয়া বাবদ প্রায় ৭২ জানের কাছ থেকে মালয়েশিয়া রিঙ্গিত হাতিয়ে নিয়ে হঠাৎ উধাও হয়ে যায় ...।”
দ্বিতীয় খবরÑ “মালয়েশিয়ায় অপহরণ করে মুক্তিপণ দাবি। ১০ বাংলাদেশী গ্রেফতার ॥” .... এবার মালয়েশিয়ার গিয়ে অপহরণ করে মুক্তিপণ আদায়ের মতো জঘন্য অপরাধে জড়িয়ে পড়েছে কতিপয় প্রবাসী বাংলাদেশী। মালয়েশিয়ায় অপহরণের সঙ্গে জড়িত এ রকম একটি গ্রুপের সব সদস্যকে গ্রেফতার করেছে মালয়েশিয়া পুলিশ। এদের মধ্যে ১০ জনই বাংলাদেশী, অপর একজন ইন্দোনেশীয় মহিলা। সিলেঙ্গরের পুলিশ কর্মকর্তা বলেন, ওই গ্রুপের হাতে অপহৃত চারজন বাংলাদেশী ও দুইজন মিয়ানমারের নাগরিককে উদ্ধার করেছে পুলিশ।” ‘মালয়েশিয়ায় যুবদল নেতার মেয়ের জন্মদিন পালিত’Ñসংবাদটিও বড়সড় সচিত্র। একটি সিরিজ শুরু করেছে পত্রিকা ‘সফল যারা কেমন তারা’ নামে। এই সিরিজের ১ম পর্বে আছে মোঃ লিটন আজিজ দেওয়ানের বিবরণ। এসেছিলেন ১৯৮৮ সালে শ্রমিক হয়ে। এখন সফল ব্যবসায়ী, মালয়েশিয়া শ্রমিক লীগের সভাপতি। “বর্তমানে তিনি মালয়েশিয়াতে বিয়ে করে তিন ছেলে এক মেয়ে নিয়ে সুখে শান্তিতে বসবাস করে আসছেন।”
‘বাংলার কথা’ উল্টেপাল্টে এসব খবরে চোখ বোলাচ্ছি। হাশেম ভাই কথা চালিয়ে যাচ্ছেন, মাঝে মাঝে রবিউল ভাই, তবে, তাদের তেমন কিছু বলতে হচ্ছে না। যুবকরাই বিভিন্ন অভিযোগ করে যাচ্ছেন। ‘এই নেন আরেকটি পত্রিকা’ এক তরুণ পত্রিকা সম্পর্কে আমার ঔৎসুক্য থেকে বাইরে এক বাঙালী দোকান থেকে একটি পত্রিকা এনে দিল, নামÑপ্রবাসীর কথা। একই রকম রঙচঙে পত্রিকা এবং ঢাকা থেকে মুদ্রিত। ধরে নিলাম একটি আওয়ামী সমব্যথী,অন্যটি বিএনপি সমব্যথী। তবে এই পত্রিকারও প্রথম শিরোনামÑ ‘পিতা-পুত্রের প্রতারণার খবরে মালয়েশিয়ায় তোলপাড়।’ রোমেল ও তার পিতা শ্রমিকদের আনার ব্যাপারে প্রতারণা করেছেÑ এটিই মূল বিষয়।
শ্রমিক নিয়ে এই প্রতারণা বাঙালী অনেকে করছে। তবে, এর সঙ্গে মালয়েশিয়া পার্টনার থাকা অস্বাভাবিক নয়। মালয়েশিয়ায় যেসব প্রতারণা হচ্ছে তার বড় অংশ শ্রমিক ব্যবসা নিয়ে। জানি না সরকার কী ভাবে তা বন্ধ করবে। ভাগ্যান্বেষীরা সচেতন না হলে এই প্রতারণা ঠেকানো মুশকিল। তবে, ভাগ্যান্বেষী সব সময় ঝুঁকি নেবেই। কারণ ভাগ্য বদলাতে হলে তো ঝুঁকি নিতেই হয়।
হাশেম ভাই আলোচনা অন্য প্রসঙ্গে নিতে চান। অভিযোগ আর কত ভাললাগে। শুনতে ভাল লাগে অভিবাসীদের ইতিবাচক খবর।
‘এখান থেকে পত্রিকা বেরোয় কয়টা?’ জিজ্ঞেস করেন হাশেম ভাই।
‘দুইটা’ জবাব দেন একজন। বাঙালী চরিত্রের ইতিবাচক এই একটি দিক। যেখানে বাঙালী আছে সেখানেই বাংলা পত্রিকা বের হচ্ছে। বিশেষ করে লন্ডন ও নিউইয়র্ক তো বাংলা পত্রিকায় জমজমাট। অনেক পত্রিকা লাভজনকও হয়ে উঠছে।
বিকেলের রোদ মরে আসছে। তাপ কমছে খানিকটা। উঠতে হয়। কোন কথা না বলেই উঠে দাঁড়াই। একজন বলে, ‘চলেন স্যার, আমার রেস্টুরেন্টে। একটু চা খেয়ে যাবেন।’ রাজি হই। আমরা তিনজন ওই যুবকের সঙ্গে বেরিয়ে আসি। ড্রাইভার আমাকে নিচু গলায় জানান, ‘উনি এখানে ভাল ব্যবসায়ী। রেস্টুরেন্ট আছে কয়েকটা।’
যুবকের নাম জাকির। তার রেস্টুরেন্টে নিয়ে আসেন আমাদের। পেছনের একটি টেবিলে বসি। ম্যানেজার এক মালয়েশীয় মহিলা। অন্য কর্মচারী সব বাঙালী। ক্রেতাও সব বাঙালী। রেস্টুরেন্ট প্রায় ভর্তি। সকাল থেকে রাত অব্দি চলে। চা নাশতা দুপুর বা রাতের খাবার। মাত্র সাত রিঙ্গিতে ডাল ভাত সবজি নিয়ে পেটপুরে খাওয়া যায়।
‘এই রিন্টু, এখানে চা মিষ্টি সিঙ্গারা ...’ এক কর্মীকে ডেকে বলেন জাকির।
‘আরে না না, চা হলেই চলবে,’ বলেন রবিউল ভাই।
‘খান না স্যার খান’, অমায়িক গলায় উত্তর দেয় জাকির। রেস্তোরাঁর ব্যস্ততা দেখে ভালই লাগে। ব্যবসা-বাণিজ্যে যদি বাঙালী ভাল করে তাহলে বাঙালীরই তো লাভ। এক বাঙালী আরেক বাঙালীকে টেনে তুলতে পারবে।
‘জাকিরের ক’দিন হলো বিদেশে’ চায়ে চুমুক দিয়ে জিজ্ঞেস করি। চা’টা বেশ ভালই লাগছে।
‘কম না স্যার,’ হেসে উত্তর দেয় জাকির, ‘১৭ বছর হয়ে গেল। ১৮ বছর বয়সে বের হয়েছি।’
আমি আরও অনেক জায়গায় বাঙালীদের সঙ্গে কথা বলেছি যারা শূন্য থেকে সচ্ছল হয়েছেন। সবার ইতিহাস প্রায় একই রকম। হয়ত বিদেশী পৃষ্ঠপোষক পেয়ে গেছেন, নতুবা প্রচ- পরিশ্রম করেছেন। আরও অনেক বাঙালী উঠে যেতেন যদি পার্টনারশিপ ব্যবসাটা তারা করতে পারতেন। ব্যবসা একটু ভাল হলেই পার্টনারশিপ ভেঙে যায়।
জাকির ১৭ বছর আগে ১৮ বছর বয়সে ঢাকা ছেড়েছিলেন। মাত্র এসএসসি পাস করেছেন তখন। শ্যাম দেশে গিয়েছিলেন প্রথম। সেখান থেকে চলে আসেন মালয়েশিয়ায়। না, কুয়ালালামপুরে কোন কাজ পাননি। যেতে হয়েছিল শহরের বাইরের, কৃষি খামারে। তার কাজ ছিল সবজি বাগানে। থাকা খাওয়া সব মালিকের। বেতন ৪৫০ রিঙ্গিত। জাকির জানিয়েছেন, সে সময়ই ১০০ থেকে ১৫০ রিঙ্গিত জমাতে পারতেন।
তিন বছর সবজি বাগানে কাজ করার পর চলে গেলেন চা বাগানে। সেখানে বেতন ছিল বেশি। ১০০০ রিঙ্গিত পেতেন। সেখানেও কাজ করলেন বছর তিনেক। ‘কিছু টাকা জমিয়ে পাড়ি দিলাম কেএলে [কুয়ালালামপুর]। ঠিক করলাম ব্যবসা করব। আরও তিন পার্টনার নিলাম। শুরু করলাম এই রেস্টুরেন্ট।’
‘কেমন চলে রেস্টুরেন্ট?’ জিজ্ঞেস করেন হাশেম ভাই।
‘আপনাদের দোয়ায় ভালই স্যার,’ জানালেন জাকির। রেস্টুরেন্ট যে ভাল চলছে তা তো দেখতেই পাচ্ছি। ‘এটি ছাড়া,’ বলেন জাকির, ‘আরও দু’টি রেস্টুরেন্ট আছে অমাদের বাঙ্গি ও বুকিবিন্দাসে।’
‘পার্টনারশিপ টিকে থাকবে?’ জানতে চাই আমি।
‘এখনও তো টিকে আছে। ভবিষ্যতের থাকবে আশা করি। ব্যবসা তো কমছে না। আমাদের কর্মচারী সংখ্যাই তো ষাটের মতো।’ জাকিরের বাড়ি গাড়ি সংসার সবই হয়েছে। সে জন্য দেশে তো যেতে হয় মাঝে মাঝে। ‘তাহলে এখানেই থেকে যাবেন?’ জিজ্ঞেস করেন রবিউল ভাই।
‘কী যে বলেন!’ জানায় জাকির, ‘এখানে আছি ভাল লাগে বলে। দেশের মতো গ্যাঞ্জাম নেই। ব্যবসা করি আয় করি খাই দাই। তবে, দেশে তো স্যার ফিরতেই হবে।’
রাত অনেকটা হয়ে গেছে। হোটেলে ফিরতে হবে। তারপর খাওয়ার ব্যাপার আছে। গাড়িতে উঠে রবিউল ভাই বললেন, ‘আমার ব্যাগ।’
না, কোথাও তার ব্যাগ নেই। বললাম ‘রাষ্ট্রদূত দুপুরে খাওয়ালেন যে ঘরে সেখানে ফেলে আসেননি তো?’
রবিউল ভাই কিছুই মনে করতে পারছেন না। দূতাবাস তো বন্ধ হয়ে গেছে। এরপর দু’দিন বন্ধ। চাবি থাকে আরেকজনের কাছে। বললাম, ‘দূতাবাসে যাওয়া যাক।’
‘হ্যাঁ গিয়ে দেখি স্যার,’ ড্রাইভার জানাল, ‘দূতাবাসের কাছেই তো হোটেল।’ ‘দেখেন দেখি, যার কাছে চাবি আছে তিনি আছেন কিনা? থাকলে যেন অপেক্ষা করেন।’ বলি আমি।
‘রবিউল, সব কিছু এক ঝুড়িতে রাখেন কেন?’ হাশেম ভাইয়ের প্রশ্ন।
পাসপোর্ট, ডলারসহ ব্যাগ হারানো মানে আমাদের সফর আরও কয়েকদিন বাড়বে। পাসপোর্ট করাতে হবে। সবার মনই থাকবে নিরানন্দ।
‘স্যার, ওই লোককে পাওয়া গেছে,’ সেলফোন অফ করতে করতে জানালেন ড্রাইভার।
কিছুক্ষণের মধ্যেই পৌঁছিÑদূতাবাসে সব বন্ধ। ড্রাইভার আবার সেলফোনে চাবিওয়ালা লোককে ধরেন। তিনি এসে দরজা খোলেন। গাড়ির মধ্যে আমি বয়োকনিষ্ঠ দেখে বলি, ‘আপনারা বসেন, আমি দেখে আসি।’
রাষ্ট্রদূতের রুমের পাশে একটি বড় রুম। সেখানেই দুপুরে আমরা খেয়েছিলাম। দেয়ালের এক পাশে দেখা গেল রবিউল ভাইয়ের সেই কালো ব্যাগ। রবিউল ভাইয়ের হাতে ব্যাগ গছিয়ে দিয়ে বলি, ‘রবিভাই, আমাদের মতো পুণ্যবান কিছু মানুষ ছিল দেখে ব্যাগটি ফিরে পেলেন। না হলে তো আমাদের পুরো সফরটিই আপনি মাটি করে দিতেন।’
সকালে উঠে ২০ তলার জানালা দিয়ে বাইরে তাকাই। রোদ নেই, আকাশটা মেঘলা। রাস্তা ভিজে ভিজে। গাছের পাতা আরও সবুজ । রাতে বৃষ্টি হয়েছে। টের পাইনি। রোদের তাপ কমে গেছে। রাস্তাঘাট খালি। ভাবলাম, একটু হেঁটেই আসি।
হোটেল থেকে বেরিয়ে ডান দিকে সরু রাস্তা ধরে হাঁটতে থাকি। দু’পাশে গাছের সমারোহ। ‘আমদের সব সময় একটা ইল্যুশনের মধ্যে রাখা হয়েছে’ হাঁটতে হাঁটতে ভাবি। ছোটবেলায় পড়েছি, এশিয়ার বৃহত্তম রেলস্টেশন কমলাপুর, বৃহত্তম বন্দর চট্টগ্রাম। আমাদের দেশের মতো সবুজ দেশ আর নেই। দেশের বাইরে পা দিয়ে দেখি কোনটাই সত্য নয়। এই কুয়ালালামপুরেই গাছের যা সমারোহ তা দেখেই অবাক হতে হয়। ঢাকা তার তুলনায় তপ্ত ধূসর মরুভূমি।
তাপ নেই, বাতাসে হয়ে যাওয়া বৃষ্টি বৃক্ষ আর মাটির গন্ধ। একটু এগোতেই দেখি, ডান পাশে ছেলেদের একটি স্কুল। ক্লাসে শুরু হয়নি, ছেলেরা হৈ হট্টগোল করছে। তার ঠিক উল্টো দিকে যে ফুটপাথ ধরে আমি হাঁটছি সেখানে মেয়েদের স্কুল। মনে হলো, হাইস্কুলই হবে। সবার পরনে ইউনিফর্ম এবং চুল ঢাকা, সে বালিকা কিশোরী যেই হোক না কেন। একটু ভিড় শুধু এখানটায়। বাবা-মা ছেলেমেয়েদের নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। একটু বড়রা হেঁটেই আসছে। স্কুলের দোরগোড়ায় উঁচু ক্লাসের কয়েকটি মেয়ে দাঁড়িয়ে। ছাত্রী যারা আসছে তাদের অভ্যর্থনা জানাচ্ছে। আমি সামনের ফুটপাথে দাঁড়িয়ে থাকি। দেখি এক বাবা মোটরসাইকেলে মেয়েকে নিয়ে আসছেন। স্কুলের গেটের সামনে থামলেন। পেছনের সিট থেকে কিশোরীটি নামল। বাবার হাতে চুমো খেয়ে স্কুলে ঢুকে পড়ল। আরেকটু সামনে যেতে আরেকটি বড় স্কুল। দেখেই বোঝা গেল, এটি শুধু চীনাদের জন্য। চীনা বাবা-মা ছেলেমেয়েকে নামিয়ে দিয়ে যাচ্ছেন। আগের স্কুল দু’টি মালয়েশীয়। আমি অনেকক্ষণ দাঁড়িয়ে দেখলাম। পাশাপাশি তিনটি স্কুল। অন্যদিকে আবাসিক এলাকা। কোন ভিড় নেই, শব্দ নেই। অথচ, ঢাকার ধানম-িতে যেখানে আমি থাকি, সেখানে অগণিত স্কুল-কলেজ যা থাকার কথা নয়। পৃথিবীর কোথাও নেই, কলকাতায়ও। সকাল ন’টা পর্যন্ত ভিড় ভাড়াক্কা হৈচৈ, মনে হয় সদরঘাট নৌ-টার্মিনালে আছি। সরকারী আদেশ। হাইকোর্টের নির্দেশ কোন কিছুতেই কাজ হচ্ছে না। কারণ যারা নির্দেশ পালন করবেন, তাদের স্বার্থ এখানে জড়িত। পরিবর্তন পরিবর্তনের কথা বলেছেন রাজনীতিবিদরা। কিন্তু কোন পরিবর্তনই করতে পারেননি। কারণ তারা নিজেদের পরিবর্তন করতে চাননি।
এই যে এখানে দাঁড়িয়ে আছি, তিনটে স্কুল কিন্তু কেন কোন ভিড় নেই? উল্টো দিকে তো আবাসিক এলাকা! ফুটপাথ ঘুরে বড় রাস্তার দিকে এগোই। গাড়ি চলাচল শুরু হয়েছে। কই কোন ভিড় ভাড়াক্কাতো নেই। একটি গাড়ির চালকও ট্রাফিক সিগন্যাল ভঙ্গ করছে না। বড় রাস্তায় ট্রাফিক পুলিশও তো তেমন দেখলাম না। ঢাকার রাস্তায় নাকি গাড়ি বেশি!
মালয়েশিয়ার গ্রামেগঞ্জেও তো দেখেছি গাড়ি, কেএলের কথা বাদ দিই। বিদেশে এলে রাজনীতিবিদদের আমলাদের ব্যর্থতাটা চোখে বেশি পড়ে।
অথচ প্রতিদিনই বদলে যাচ্ছে মালয়েশিয়া। এক যুগ আগের মালয়েশিয়া আর এখনকার মালয়েশিয়ার তফাতটা বেশ চোখে পড়ে। এই বদলে যাওয়া দেশটাকে এগিয়ে নিচ্ছে। রাজনৈতিক দ্বন্দ্ব কি নেই?
আছে কিন্তু এখানে দেশবিরোধী কোন শক্তি নেই। কয়েকদিন আগে, বিরোধী দল ধর্মঘট ডেকেছিল, মিছিল করে কিছু ভাংচুর করে ছিল। তার দ- তারা এখন দিচ্ছে। ভাংচুরে দায়দায়িত্ব নিয়ে অনেককে জেলে যেতে হচ্ছে। জরিমানা গুনতে হচ্ছে ক্ষতিপূরণ হিসেবে। অনুমতি ছাড়া মিছিল নিষিদ্ধ করা হয়েছে। সবাই সরকারী এই নির্দেশনা মেনে নিয়েছে। মিডিয়াতে এ নিয়ে কোন হৈচৈ নেই। অর্থাৎ, রাজনীতি করো, কিন্তু জনজীবনে বিশৃঙ্খলায় প্ররোচনা দেয়া যাবেন না। আনোয়ার ইব্রাহিম যাকে মাহাথির হটিয়ে দিয়েছিলেন, মাঝখানে তিনি জনপ্রিয় হয়ে উঠছিলেন, এখন আবার তার জনপ্রিয়তা হ্রাস পচ্ছে। এক মালয়েশীয় বলছিলেন, এর কারণ তিনি ফান্ডামেন্টালিস্টদের সঙ্গে হাত মিলিয়েছেন। তরুণরা এ কারণে ক্ষুব্ধ। অন্যদিকে মাহাথির এখনও জনপ্রিয়। বাঙালীদেরও পছন্দ মাহাথির। হেলাল আলাপের সময় বলছিলেন, ‘দেখা করবেন নাকি মাহাথিরের সঙ্গে?’ আমি অবাক হই, হেলাল এমনভাবে বলছেন, যেন মাহাথির তার পাশের বাসায় থাকেন। একবার ঘড়ি দেখলেন, বললেন, ‘না দেরি হয়ে গেছে। মাহাথির শুক্রবারের নামাজ পড়েন মসজিদে।
[কোন একটা নাম বলেছিলেন, মনে নেই] নামাজ শেষে সবার সঙ্গে মোলাকাত করেন। বাঙালীদের তিনি খুব পছন্দ করেন।’ আরেক বাঙালী বলছিলেন, টুইন টাওয়ার করার উদ্যোগ নিয়েছিলেন মাহাথির। টাওয়ার কমপ্লিট হলে টাওয়ারের মালিক মাহাথিরকে সর্বোচ্চ তলায় একটি অফিস দিয়েছেন। মাহাথির মাঝে মাঝে সেখানে আসেন। লোকজনের সঙ্গে দেখা করেন। অস্বীকার করার উপায় নেই, আজকের মালয়েশিয়ার রূপকার মাহাথির। আর এই রূপান্তরে বাঙালীদেরও একটা অবদান আছে।
যে কুয়ালালুমপুরে এসেছিলাম সে কুয়ালালুমপুর ঠিকই আছে, তবে প্রকৃতি বদলে গেছে। রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার মনোরেল কী নেই? নতুন রাজধানী পুত্রজায়া না দেখলে বোঝা যাবে না এক যুগে রূপান্তরটা কী হয়েছে। পুত্রজায়ার প্রতিটি ইট পরিকল্পিত। ছুটির দিন পর্যটকদের ভিড়ে গমগম করে। দেখার, বিনোদনের জিনিসও এত আছে! বাঙালী শ্রমিকদের ঘাম মিশে আছে পুত্রজায়ার ইমারত, রাস্তাঘাটে। কেএলে সার্ভিস সেক্টরের সংখ্যা বাড়ছে এবং সেই বৃদ্ধিতে সহায়তা করেছে বাঙালীরা। মালয়েশিয়া যে সম্প্রতি প্রায় দুই লাখ অবৈধ বাঙালীকে বৈধ করল তা আমাদের স্বার্থে নয়, তাদের স্বার্থে। বাঙালী শ্রমিক না থাকলে শিল্প-কারখানার গতি শ্লথ হয়ে যাবে, সার্ভিস সেক্টরে ধংস নামবে। এখন অবশ্য অনেক নেপালী আসছেন মালয়েশিয়া। চীনা, ভারতীয়, থাই প্রভৃতির কথা না-ই বা বললাম। এভাবে মালয়েশিয়া আরও মেট্রোপলিটান হচ্ছে। গ্লোবালাইজেশন বা গেলোকনায়ন বদলে দিচ্ছে পৃথিবীর সব দেশ। হয়ত দু’তিন যুগ পর এমন সময় আসবে যখন নিজের দেশ বলে নির্দিষ্ট কিছু থাকবে না।
পরিবর্তনের কথা বলছিলাম, তার একটি উদাহরণ দিই। এই পরিবর্তনের পেছনে একটা দৃষ্টিভঙ্গি আছে এবং সেই দৃষ্টিভঙ্গি শুধু নেতৃত্বের নয়, কর্মকর্তা-কর্মচারী সবারই।
আতিউর রহমান বাংলাদেশ ব্যাংকের গবর্নর দেখে আমি আর হাশেম খান তাঁকে পরামর্শ দিয়েছিলাম, বাংলাদেশে ব্যাংকের কারেন্সি মিউজিয়ামটিকে টাকা জাদুঘরে রূপান্তর করতে। এক কথায় উৎসাহী হয়ে উঠলেন আতিউর। নির্বাহী পরিচালক অসীমকে দায়িত্ব দিলেন। শুধু তাই নয়, বললেন, ‘আপনারা কুয়ালালামপুরের মালয়েশীয় স্টেট ব্যাংকের জাদুঘরটিও দেখে আসুন।’
আতিউর যত সহজে বললেন কাজ তত সহজে হলো না। পুরো বিষয়টি বোর্ডে নিতে হলো যার দরকার ছিল না। কারণ একজন সচিব তা চান। মিটিংয়ে আরেক সচিব বললেন, এসবের কী দরকার? যাক প্রকল্প পাস হলো। সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাকে অনুরোধ জানালাম, আপনি মালয়েশীয় স্টেট ব্যাংকে লিখুন আমরা যাব। তা ছাড়া, আপনি সেখানে গেছেন। থাকার ভাল জায়গা আছে। তাদের জানান। দিন দশেক পর জিজ্ঞেস করলাম, ‘ই-মেইল করেছেন?’ বললেন, ‘না’ কারণ? কার্যবিররণী পাননি, তা স্বাক্ষরিত হয়নি। ব্যাংকের সচিব বলছেন, ‘এর দরকার নেই।’ কিন্তু তিনি তা করতে রাজি নন, কারণ তার ওপরওয়ালা যদি মাইন্ড করেন। অথচ তারা সবাই বোর্ড মিটিংয়ে ছিলেন। সবই জানেন। আতিউর ছিলেন বিদেশে সব শুনে ক্ষুব্ধ হলেন। তঁাঁর ক্ষোভের কারণে, আমদের আসার দিন তিনকে আগে ই-মেইল গেল। মাঝে ছিল শনি-রবি। ঢাকা ছাড়ার আগে আর ই-মেইলের উত্তর পাওয়া গেল না।
প্রথম দিনই হোটেলে এসে তৈরি হয়ে রওনা হলাম জাদুঘরের উদ্দেশে। আমাদের নেতা দাশগুপ্ত অসীমকে বললাম, ‘ড্রাইভারকে ঠিকানা দিন।’
‘ঠিকানা তো আনিনি।’ জানালেন অসীম।
‘বলেন কী! যেখানে যাব সেখানের ঠিকানা আনেননি।’ বলি আমি।
‘আমি আগে এসেছি, ব্যাংক নিগারাই। সেটিই তো স্টেট ব্যাংক। অসুবিধা হবে না।’ নিশ্চিন্ত মনে জানান অসীম।
ড্রাইভারকে সবাই বোঝালাম ব্যাংক নিগারায় যাব। ড্রাইভার সেখানে নিয়ে গেল। অসীম আবার সেখানে নেমে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কারেন্সি মিউজিয়ামটা কোথায়?’ ড্রাইভার ঠিকানা বুঝে নিল।
রিবাট এক ইমারতের সামনে আমরা নামলাম। মনে হলো এটিই বুঝি স্টেট ব্যাংক বা ব্যাংক নিগারা। অসীম বললেন, ‘জায়গাটা নতুন মনে হচ্ছে। বোধহয় স্টেট ব্যাংক নতুন বিল্ডিংয়ে এসেছে বা এক্সটেনশন হয়েছে।’
লোকজন তেমন নেই। বিরাট রিসেপশনে দু’একজন। খোঁজ নিয়ে জানলাম, হ্যাঁ। এখানেই কারেন্সি মিউজিয়াম। তিন তলায়।
উঠলাম তিন তলায়। একেবারে আধুনিক কায়দায় সাজানো। প্রদর্শনীর জন্য যেমন আছে প্রয়োজনীয় অবজেকটস। ডিজিটাল পদ্ধতিতেও সব কিছু জানা যায়। অনেকক্ষণ ধরে আমরা খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখলাম। দীর্ঘশ্বাস ফেলে বেরিয়ে আসার পর দেখি ওপর তলায় চিত্রকলার গ্যালারি। উৎসাহ নিয়েই গেলাম। আমরা তিনজনই চিত্রকলার সঙ্গে কোন না কোনভাবে জড়িত। বিরাট প্রদর্শনশালা। মালয়েশীয় চিত্রকলার সব নিদর্শনে সাজানো। সেখানেও ঘণ্টা খানেক কাটিয়ে বেরোনোর পর দীর্ঘশ্বাস ফেললাম না। সান্ত¡না পেলাম চিত্রকলায় আমরা এগিয়ে, অনেক এগিয়ে। অসীসকে বললাম, ‘আপনার কর্মকর্তাদের বোঝাতে পারবেন কেন স্টেট ব্যাংক জাদুঘর চিত্রশালা করে এত আধুনিকভাবে?’ অসীম ঘাড় নেড়ে অপারগতা জানালেন। লিফটে নামছি। দোতলায় মোটাসোটা এক মালয়ী ঢুকলেন।
‘গুড মনিং’
‘গুড মনিং’
‘আপনারা এখানে এসেছিলনে?’
‘হ্যাঁ, কারেন্সি মিউজিয়াম দেখতে।’
‘আপনারা কি বাংলাদেশ থেকে এসেছেন?
‘হ্যাঁ, বাংলাদেশ থেকে এসেছি।’
লিফট একতলায় এল। বেরোলাম সবাই।
‘আরে; আপনাদেরই তো খুঁজছি। শুনেছি, আপনারা আসবেন, কিন্তু কখন কোথায় কিছু তো জানাননি।’
লিফটের বাইরে এক তরুণী দাঁড়িয়ে। ভদ্রলোক বললেন, ‘পেয়েছি।’
তরুণীটি বললেন, ‘আমাদের পরিচালকও তো আপনাদের জন্য অপেক্ষা করছেন। অবশ্য তিনি এখন লাঞ্চে, কয়েকজনের সঙ্গে আলাপ করছেন।’

No comments

Powered by Blogger.