হুমায়ূন পাঠের ক্রিয়া মিথস্ক্রিয়া by হামিদ কায়সার

হবে না। ওর আর হবে না। লেখক হাসান জামিল যখন বুঝে গেল ব্যাপারটা, এ-যাত্রায় অন্তত লেখালেখিটা ওর আর হচ্ছে না, সে পাঠক এবং বোদ্ধা-সমালোচক উভয় সম্প্রদায়ের দ্বারাই চূড়ান্তভাবে প্রত্যাখ্যাত হয়েছে, ওর আর লেখালেখির অধিকার নেই, এবার হাত গুটিয়ে বসে থাকার পালা এবং অচিরেই কোন একটা ব্যবসা-বাণিজ্যের ধান্দা


করা, তখনই ঘটলো ঘটনাটা এবং অবিশ্বাস্য তো বটেই, ওর জন্য অভাবনীয়ও, একটি খ্যাতনামা সাপ্তাহিকের সম্পাদক নিজে ফোন করে ওর কাছে ঈদসংখ্যার জন্য একটি সুখপাঠ্য উপন্যাস চাইল এবং বললো যে, আপনি তো আবার সিরিয়াস টাইপের লেখক, আমাদের পাঠক কিন্তু ওসব গিলতে পারে না। সহজ করে একটা প্রেমের উপন্যাস লিখে দিন, বারো হাজার শব্দের মধ্যে। পারলে হুমায়ূন আহমেদের মতো লেখেন। পাঠক যেন হুমড়ি খেয়ে পড়ে।
ফোনটা রাখার পর হাসান জামিল চুপচাপ কতক্ষণ ঠা-া হয়ে বসে রইলো। সত্যিই তাহলে দেশের সবচেয়ে জনপ্রিয় এবং উঁচুমানের সাপ্তাহিকটি ওর কাছে ঈদসংখ্যার জন্য উপন্যাস চাইল? এটাও বিশ্বাস করতে হবে? লেখালেখির সেই সূচনালগ্ন থেকেই তো মনের মধ্যে সূক্ষ্ম একটা স্বপ্ন উঁকি মারত, ঈদসংখ্যা দেখে দেখে, কবে এই বহুবর্ণিল ঢাউস সংখ্যায় ওরও একটা লেখা জায়গা পাবে। না, পায়নি। তারুণ্য পেরিয়ে মাঝ আকাশে নেমে গেছে লেখালেখির বয়স, ঈদসংখ্যা তো ঈদসংখ্যা, সাধারণ সংখ্যাগুলোতেও কেউ ওর লেখা চায় না। দেশের শীর্ষস্থানীয় দৈনিক কালাকালে একটা গল্প পড়ে আছে প্রায় দু’বছর হলো, ছাপেও না, ছাড়েও না। ওদিকে লিটলম্যাগওয়ালাদের কাছে তো সে আগে থেকেই বুর্জোয়াদের দালাল হিসেবে চিহ্নিত। পত্রপত্রিকা এভয়েড করে যে শুধুমাত্র বইমেলাকে কেন্দ্র করে লেখালেখির চর্চা করে যাবে, সে আশায়ও গুড়েবালি! পাঠকরা ওকে চরমভাবে প্রত্যাখ্যান করেছে। প্রত্যাখ্যান মানে কী প্রত্যাখ্যান! ডানগাল বামগাল কষে থাপ্পড়! ওর বইমেলায় ৪০ কপিও চলে কিনা সন্দেহ! তাই চারদিকের অবস্থা বিবেচনা করে সে যখন সিদ্ধান্তটা নিয়েই ফেলেছে, আর একটা পৃষ্ঠাও লিখবে না। জোচ্চুরি ছেচ্চুরি করে শুধু দু’হাতে টাকা কামাবে, তারপর অঢেল টাকার মালিক বনে যাওয়ার পর যা হয় অবস্থা বুঝে একজন গোস্ট রাইটার যোগাড় করা যাবে। তখনই সাপ্তাহিক প্রেরণার সম্পাদক আকাদ্দস চৌধুরীর এই ফোন। না-লেখার সিদ্ধান্তে অবিচল থাকাটা বুঝি একটু কঠিনই হয়ে যাচ্ছে। বরং নতুনভাবে খানিকটা উদ্দীপনাও ফিরে আসছে, শেষবারের মতো একবার চেষ্টা করে দেখা যাক না। ক্ষতি কি! আকাদ্দস চৌধুরী যখন ওকে একটা লিফট্ দিতে চাইছে, এই বলটাকে না পেঁচিয়ে সোজা গোলপোস্টের দিকে মেরে দিলেই তো হয়! লিখে ফেললেই হলো হুমায়ূন আহমেদের মতো একটা উপন্যাস, আকাদ্দস চৌধুরীর পরামর্শ মতো!
প্রেরণার সার্কুলেশন প্রায় পঞ্চাশ হাজারের কাছাকাছি। প্রায় পঞ্চাশ হাজার পাঠকের মধ্যে যদি পঁচিশ হাজার পাঠকেরও মন জয় করে নেয়া যায়, বইমেলায় বই বেরুলে, ধরা যাক পঁচিশ হাজারের অর্ধেকই ধরলাম, সাড়ে বারো হাজার পাঠক ওর বই খুঁজবে। খারাপ কি! সাড়ে বারো হাজার পাঠক কি সোজাকথা? এরপর তো প্রকাশকদের কাছে সে পরম আরাধ্য হয়ে উঠবে। তাই রিস্ক নেয়া যাবে না, কোনমতেই রিস্ক নেয়া চলবে না। প্রথম চান্সেই শটটা মেরে দিতে হবে। প্রেরণাতে ওর লেখাটা যেন পাঠককে চুম্বকের মতো টানে, যেন পাঠক এরপর ওর লেখা পড়ার জন্য চাতক পাখির মতো অধীর হয়ে থাকে, লিখতে হলে সেভাবেই লিখবে। কিন্তু সেভাবে যদি লেখাটা না আসে! যদি বিষয়বস্তু সেই আগের মতোই প্রতিবাদসর্বস্ব হয়ে যায়, শুধু জীবনের রুদ্র কঠিন বাস্তবতাই ফুটে ওঠে, যা পাঠ করে পাঠক নিজেও চাবুকাঘাত অনুভব করবে! কার দায় ঠেকেছে পয়সা দিয়ে বই কিনে শুধু শুধু চটকনা খাওয়ার! হাসান জামিলের লেখা মানেই চাবুক, প্রতিবাদ! মার্ক্সীয় দৃষ্টিভঙ্গি নেই ঠিকই, বিপ্লবের তেজও অনুপস্থিত। তবু সেসব লেখা ওর আশপাশের মানুষকে বড় বেশি বিদ্ধ করে। কেন যেন সমাজের অসঙ্গতির বিরুদ্ধে ওর কলম বড় বেশি নির্মম হয়ে ওঠে, তাই যে-ই পড়ে সে-ই শত্রু বনে যায়। অথচ সে যে খারাপ লেখে তাও নয়। কোন কোন সমালোচক তো ওর লেখার বিষয় ও ভঙ্গির মুহুর্মুহু প্রশংসা করে। কিন্তু চাই না আমি সেই গুটিকয়েক সমালোচক, আমি চাই বৃহৎ এক পাঠকগোষ্ঠী, সেই পাঠকগোষ্ঠী যদি পেয়ে যাই, তাহলে সকাল ৮টা থেকে রাত ১০টার চাকরিটাও করতে হবে না, যেটা ওর লেখালেখির স্বপ্নটাকে ধূলিসাত করে দিয়েছে!
নতুন আশার আলোয় হাসান জামিল নিজের লেখকসত্তার যেন নতুন উদ্বোধনের আয়োজনকে চাক্ষুষ করতে পারল। যে যা ইচ্ছে মনে করুক, আমি শালা হুমায়ূন আহমেদের মতোই লিখব। একবার পাঠকের মন জয় করতে পারলেই হলো, শুধু লেখালেখি করেই জীবন চলার এক পথ বাতলে যাবে। মন্দ কি! অফিস নেই, রোজগারের ধান্দা নেই। সকালে ঘুম থেকে জেগেই লেখালেখির শুরু। সারাদিন যখন খুশি যেমন খুশি লেখ আর লেখ। বিকেল আর সন্ধ্যাবেলা আড্ডা দিয়ে বেড়াও। একেবারে স্বপ্নের মতো জীবন! যেটা অর্জন করেছে কেবল হুমায়ূন আহমেদই। কিন্তু কিভাবে লেখা যাবে সেই পরম সাফল্য পাওয়া মানুষটির মতো! কিভাবে অর্জন করা যাবে তার ভাষা আর ভঙ্গিমাকে। যতটুকু জেনেছে ভদ্রলোক নাকি খুব সহজ ভাষায় লেখেন! খুবই সরল তার উপস্থাপনা। আমিও না হয় সহজ ভাষায় লিখতে চেষ্টা করব! সেটা না হয় করলাম! কিন্তু ভদ্রলোকের লেখার মধ্যে থাকেটা কি! কী জন্য সবাই তৃষিত কাকের মতো তার লেখা পড়ার জন্য হা করে থাকে এবং কেন সে বই না পড়া পর্যন্ত কারও আর অন্য কোন ধ্যানজ্ঞান থাকে না। সবচেয়ে আগে দরকার ভদ্রলোকের বইটই কিছু পড়ে দেখা।
এত বছরের জীবনে এখনও হুমায়ূন আহমেদের কোন বই ওর পড়া হয়ে ওঠেনি। ইচ্ছে করেই পড়েনি। সে এ জেনারেশনের একজন সিরিয়াস রাগী লেখক, হুমায়ূন আহমেদের বই পড়লে যদি পথভ্রষ্ট হওয়ার ভয় থাকে? শুনেছে ভদ্রলোকের লেখায় নাকি ধনী কন্যারা সহজেই গরিব গোবেচারা টাইপের ছেলেদের প্রেমে পড়ে যায়! এই মিথ্যে কল্পনাবিলাসিতার মানেটা কি! ওর বিশ বছরের ঢাকার জীবনে বড়লোকের মেয়েতো কম দেখল না! সবই শালায় খালি তেলা মাথায় তেল দেয়! গরিব ছেলেদের সঙ্গে প্রেম তো করেই না, উল্টো প্রেমের প্রতারণা করে। ভার্সিটিতে দেখেছে কোন গরিব ছেলে মেধাবী হলেই হলো, ধনীর সুন্দরী দুলালীরা প্রেম প্রেম ভাব দেখিয়ে নোটটোট কী সুন্দর হাতিয়ে নেয়। পরীক্ষার পাট চুকল তো, প্রেমও পালাল। আর সেখানে হুমায়ূন আহমেদ নাকি চিন-পরিচয় হওয়ার প্রায় সঙ্গে সঙ্গে ধনীর সুন্দরী কন্যাকে অসহায় গরিব যুবার প্রেমে একেবারে দিশেহারা করে তোলেন। এটাকে প্রবঞ্চনা ছাড়া আর কী বলা যাবে! হাসান জামিল যদি ঢাকার অন্তত একজন সুন্দরীর সহবত পেত, তার বিশ্বাস সে দেশের একজন বড় কবি হতে পারত। প্রেমহীনতার কারণেই তো সে আজ গদ্যের গহীন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া এক দিগভ্রান্ত পথিক।
কারণ কি শুধু এটাই? দূর থেকে হুমায়ূন আহমেদকে সবসময়ই ওর জোকার টাইপের লেখক মনে হয়েছে। ওর স্ত্রী রেবা প্রথম প্রথম কোত্থেকে কোত্থেকে হুমায়ূন আহমেদের বই এনে বিভোর হয়ে ডুবে থাকত। তখন কেবল নতুন বিয়ে হয়েছে ওদের। সেটেলড্ ম্যারেজ। কোথায় একজন আরেকজনকে বুঝবে, দেখবে। তা না, রেবা সবকিছু বাদ দিয়ে হুমায়ূন আহমেদের নতুন নতুন বই নিয়ে বসে থাকত। আর পড়ে ফ্যাক ফ্যাক করে শুধু হাসত। রাগে গা জ্বলে যেত ওর। ঝাড়তও সে রাগ। আরে কীসব বই পড়ছ তুমি বল তো, তোমার ব্রেনের ধারণ-ক্ষমতা তো আস্তে আস্তে লোপ পাবে। এসব হালকা জিনিসপত্র পড়ে লাভ আছে? সিরিয়াস সাহিত্য পড়ো। বোধ বাড়বে, চিন্তাশক্তি বৃদ্ধি পাবে। রেবা মনে মনে ক্ষেপতো। সেটার বহির্প্রকাশ ঘটতো টিভি দেখার সময়। মাধুরী দিক্ষিতের কোন ছবিই হোক আর নাচের দৃশ্যই হোক, রেবা রিমোট টিপে চ্যানেল ঘুরিয়ে দিত। রাগে কাঁই হয়ে যেত হাসান জামিল। রেবা ঠোঁট টিপে হাসতে হাসতে বলত, এখন কেমন লাগে? তুমি তো আমাকে হুমায়ূন আহমেদ পড়তে দাও না! সেই রেবা যদি এখন ওকে দেখে হুমায়ূন আহমেদ পড়ছে, ওকে তো লাকড়ি দিয়ে পেটাবে।
হাসান জামিল আলস্য ঝেটিয়ে বিছানা ছাড়ল। রেবার চোখ এড়িয়ে বুক শেলফ তন্নতন্ন করে খুঁজল। কোথাও হুমায়ূন আহমেদের একটিও বই নেই, বই যে এক সময় ছিল সে চিহ্ন পর্যন্ত নেই। বড় অভিমানী মেয়ে রেবা। হয়তো অভিমান করেই বাসা থেকে হুমায়ূন আহমেদের সব বই সরিয়ে ফেলেছে। হুমায়ূন আহমেদ পড়ার জন্য বেচারাকে একসময় কম যাতনা সহ্য করতে হয়েছে? বুক শেলফ, খাটের তল, ঘরের ড্রয়ার-দেরাজ যত জায়গা ছিল সব তন্ন তন্ন করে খুঁজেও হুমায়ূন আহমেদের কোন বই পাওয়া গেল না। রেবা কয়েকবার জিজ্ঞেস করল, কী খুঁজছো তুমি বলো তো? প্রথমবার কিছু না বলে পার পেলেও দ্বিতীয়বার আর এড়িয়ে যেতে পারল না। রেবা এসে সোজা সামনে দাঁড়াল, অ্যাই এমন চোরের মতো করছো কেন? কী খুঁজছো আমাকে বললেই তো হয়! খুঁজে বের করে দেই। ও তখন মনে যা এলো তাই বলল, ইনকাম ট্যাক্সের পিন নাম্বারটা কোথায় বলো তো?
আমি কীভাবে বলব? আমার কাছে দিয়েছ?
মনে তো হচ্ছে তোমার কাছেই দিয়েছিলাম।
তো আমাকে বললেই হতো। এমন চোরের মতো করছ কেন? হঠাৎ ওটার কী দরকার হলো?
না মানে...। আমতা আমতা করতে লাগল হাসান জামিল। সেই কারণটার জন্যই তো বলতে চাইছি না।
ঠিক আছে না বললে!
না বলে শেষে কোন্ বিপদে পড়তে হয়, কে জানে! মেয়েরা যা সন্দেহপ্রবণ! হাসান জামিল বলল, না মানে লোন তুলতে চাইছিলাম। জানো, আজকাল লোন তুলতেও ইনকাম ট্যাক্সের পিন নাম্বার দরকার হয়।
ইমপসিবল! লোন তুলতে তোমাকে কিছুতেই দেব না!
এত কথা থাকতে কেন যে লোনের কথা পেড়েছিল। নিজের ওপর বিরক্তিতে হাসান জামিল গজরাতে থাকে।
ব্যাংকগুলো একেবারে শুষে নেয়। লাইফ পুরো হেল করে দেয়। মনে নেই তোমার?
হাসান জামিল চুপ করে থাকে। শুধু শুধু তর্ক করার কোন মানে হয় না। কিন্তু রেবা অত সহজে ছাড়ার পাত্র নয়। পিন নাম্বার তো পাবেই না। দেখি এবার তুমি কিভাবে লোন তোল।
হাসান জামিলকে চুপচাপ দেখে আর কিছু বলে না রেবা। কাজে চলে যায়। একটু পর কাজ থেকে ফিরে এসেই ধরল, আচ্ছা, তোমার হঠাৎ লোন নেয়ার দরকার পড়লো কেন বলো তো?
ওহ্! কান ঝালাপালা হবার জোগাড়! কাজের কাজ কিছুই হলো না! কাল যা হোক, অফিসে যাওয়ার আগে কোন দোকান থেকে হুমায়ূন আহমেদের একটা উপন্যাস কিনে নিলেই হলো!

২.
সাগর পাবলিশার্স এখনো খোলেনি। এত সকালে এই ৯টার সময় খোলার কথাও নয়। আচ্ছা, সোজা বাংলাবাজার চলে গেলে কেমন হয়? প্রতীক প্রকাশনীতে? ওরাই তো সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস সমগ্র বের করেছে। পড়বেই যখন, প্রথম বই দিয়ে শুরু করা যাক না! ঢুকতে তো হবে হুমায়ূন আহমেদের একেবারে আত্মার গভীরে। তা না হলে কিভাবে সেই স্টাইল সেই বিষয়কে ধরা যাবে? একটা দিন অফিসে যেতে না হয় একটু বিলম্বই হলো। যে সুযোগ এসেছে, কাজে লাগাতে পারলে অফিসই উল্টো তোমার পিছে দৌড়াবে একদিন। একটা সিএনজি থামিয়ে উঠে বসল হাসান জামিল।
প্রতীক প্রকাশনী থেকে হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস সমগ্র প্রথম খ- কিনে যখন মতিঝিলে ওর অফিসে ঢুকল, তখন ১১টা বাজে বাজে।
দেরি করে অফিসে আসায় নিজেকে কেমন চোরের মতো লাগছিল। আমরিন ইসলাম অভয় দিয়ে বলল, না, আপনাকে কেউ খোঁজেনি। আজকে মনে হয় কাজের লোডটা কম। মনে মনে স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলল হাসান জামিল। কাজের লোড কম হলেই ভালো। হুমায়ূনের উপন্যাস যদি আজই শুরু করে দেয়া যায়, তাহলে দু’তিন দিনের মধ্যেই লেখাটা আরম্ভ করা যাবে। ব্যাগের ভেতর থেকে হুমায়ূন আহমেদের বইটা বের করার জন্য মন উশখুশ করতে লাগল। মাত্র এক মাস সময় দিয়েছে ওকে লেখার জন্য। ওকেই বোধহয় সবচেয়ে দেরিতে বলেছে। হয়তো বলতই না। লেখক বোধহয় কম পড়েছে! আজকাল তো ঈদসংখ্যার অভাব নেই। এখন দয়া দেখিয়ে ওকে নেয়া হচ্ছে! সমস্ত অবহেলার উত্তর আমি দেব! একবার হিট হয়ে যাই না আগে! এরপর পায়ে ধরলেও তো লেখা পাবি না! তুর্কি নাচনটা দেখাতে হবে প্রকাশকদের সঙ্গে! সবার দ্বারে দ্বারে কম ঘুরেছে ও! একেক শালা তো কথা পর্যন্ত বলতে চায় না! তুমি যত উপেক্ষা করেছো, তত উপেক্ষার তীর ফিরে যাবে তোমার দিকে, তত বেশি বিদ্ধ হবে তুমি! না কবিতার লাইন ওর আসে না। আসে প্রেমে পড়লে! বহুদিন প্রেমে পড়া হয় না। বহুদিন প্রেমহীন বহুদিন উপেক্ষায়। আজ কেমন যেন কবিতার উঁকিঝুঁকি! কবিতা তোমাকে দিলাম আজকে ছুটি! আমি এখন গদ্যের গহন অরণ্যে হারিয়ে যাওয়া এক দিগভ্রান্ত পথিক।
পথিক, তুমি কি পথ খুঁজিয়া পাইবে? পাবে কি হুমায়ূন আহমেদে! আমি তো পথেই আছি, শুধু হুমায়ূন আহমেদের পথরেখা খুঁজে নেব! ব্যাগ থেকে চুপি চুপি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস সমগ্র বের করল হাসান জামিল। কেউ দেখলে কেলেঙ্কারির একশেষ। কম তো আর লেকচার দেয়া হয়নি হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাসের বিরুদ্ধে। এসব তো টিনএজদের জন্য, কোন গভীরতা নেই। জাস্ট পাল্প ফিকশন! এখন যদি কেউ টের পায়, ও সেই হুমায়ূন আহমেদই পড়ছে, কথা শোনাতে কেউ দেড় মিনিটও দেরি করবে না। রক্ষা যে ওর বসার টেবিলটা দেয়ালমুখী। যথাসম্ভব নিজের শরীর দিয়ে আড়াল করে, বইটাকে ঢেকেঢুকে ও খুলে বসল। ভেবেছিল প্রথমে উপন্যাসটা দিয়েই শুরু করবে পাঠ, হলো না। ‘নিজের কিছু কথা’য় এসে আটকে গেল।
হুমায়ূন আহমেদ লিখেছেন, ‘কুড়ি বছর আগের কথা। বর্ষার রাত। বাইরে ঘনঘন বিজলি চমকাচ্ছে। আমি বইপত্র নিয়ে বসে আছি। থার্মেডিনামিক্সের একটি জটিল অঙ্ক যে করেই হোক পড়ে শেষ করতে হবে। হঠাৎ কী যেন হয়ে গেল! কেমিস্ট্রির বইখাতা ঠেলে সরিয়ে দিলাম, লিখতে শুরু করলাম, রাবেয়া ঘুরে ঘুরে সেই কথা কটিই বারবার বলছিল। রুনুর মাথা নিচু হতে হতে থুতনি বুকের সঙ্গে লেগে গিয়েছিল। আমার প্রথম প্রকাশিত উপন্যাস নন্দিত নরকে। ঐ রাতে কেন হঠাৎ উপন্যাস লেখায় হাত দিলাম, কেনইবা এ রকম গল্প মাথায় এলো বলতে পারব না। লেখকরা যখন লেখেন তখন তারা অনেক কিছুই বলতে চান। সমাজের কথা বলেন, কালের কথা বলেন, জীবনের রহস্যময়তার কথা বলেন। লেখার ভেতর আদি প্রশ্নের উত্তর খোঁজেনÑআমরা কোথা থেকে এসেছি? আমরা কারা? আমরা কেনইবা এলাম? আমরা কোথায় যাচ্ছি? নন্দিত নরকে লেখার সময় আমার বয়স উনিশ-কুঁড়ির বেশি নয়। এই বয়সের একজন তরুণ কি এত ভেবেচিন্তে কিছু লেখে? আমার জানা নেইÑ আমি শুধু জানি ঐ রাতে একটি গল্প আমার মাথায় ভর করেছিল। গল্পের চরিত্রগুলো স্পষ্ট চোখের সামনে দেখছিলাম, ওদের কথা শুনতে পাচ্ছিলাম। ভেতরে প্রচ- চাপ অনুভর করছিলামÑযেভাবে ওদের দেখছি হুবহু সেইভাবে ওদের কথা বলতে হবে এবং আজ রাতেই বলতে হবে। এই মানসিক চাপের উৎস কী, আমি জানি না।’
হাসান জামিলও কি জানে? অবশ্য ওর প্রথম লেখার ব্যাপারটা অন্যরকম। একেবারেই অন্যরকম। রাবেয়া নয়, রুনুরা নয়, অন্য কোন মানুষ কিংবা চরিত্র নয়, প্রথম গদ্য লেখার তাগিদটা ও বোধ করেছিল নিজেরই এক ব্যক্তিগত যন্ত্রণা থেকে। তার আগে ও নিজেও জানতো না, কোনদিন গল্প লিখবে অথবা উপন্যাস। স্বপ্ন ছিল কবি হওয়ার। কী এক ঘোরে আচ্ছন্ন হয়ে কবিতায় কবিতায় খাতা ভরে ফেলতো তখন। আর সেসব কবিতা নিয়ে ঘুরে বেড়াত সাহিত্য সম্পাদকদের টেবিলে টেবিলে। সেই কবিতা লেখার দিনেই একদিন বিশ্ববিদ্যালয়ের এক স্যার ওকে নিজের রুমে ঢুকতে দিল না। দিল না তো দিলই না, বাইরে অনেকক্ষণ দাঁড় করিয়ে রাখল। সেটা কোন বেদনার ব্যাপার নয়। কিন্তু বড় ক্লেদকর ব্যাপারটা হলো, ও যাকে মনে মনে ভালোবাসত কামনা করত, স্যার সে মেয়েটির সঙ্গেই ব্যস্ত ছিলেন অন্তরঙ্গ কথা বলায়। নিজেকে তখন হীন মনে হয়েছিল, দীন মনে হয়েছিল অতি। ও তাকিয়েছিল নিজের দিকে, ক্যাম্পাসে এমন একটা পুরনো রংচটা শার্টে ওকে ঠিক মানায় না, তোমার স্যান্ডেলটাও অনেক আগেই বদলে ফেলা উচিত ছিল! বদলে ফেলা তো উচিত ছিল অনেক কিছুই। কিন্তু বাবা যে টাকা দেয় না! কেন দেয় না, সেটাও এক রহস্য! বেশি টাকা পেলে ছেলে বখে যাবে না-কি আরাম আয়েশে অভ্যস্ত হয়ে উঠবে! বাবার অদ্ভুত অদ্ভুত সব ফিলোসফি! নিজের ধান্দা নিজেকেই করতে হবে! একটা পার্ট টাইম চাকরির সম্ভাবনা দেখে, পেটে ক্ষুধা আর মনে ক্ষত নিয়ে ও হাঁটতে হাঁটতেই ছুটে গিয়েছিল তখনকার এক সাপ্তাহিক পত্রিকা অফিসে, শান্তিনগরের মোড়ে।
নির্বাহী সম্পাদক মানুষটি এটা-সেটা প্রশ্ন জিগ্যেস করার সময়ই হঠাৎ সেখানে উপস্থিত হলো বি-গ্রেডের এক চিত্রনায়িকার স্বামী। নির্বাহী সম্পাদক ভদ্রলোক ওর সামনেই তাকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন। কথা বলার এক পর্যায়ে হঠাৎ ওর হাতে দশটা টাকা ধরিয়ে দিয়ে আদেশের সুরে বললেন, গেটের সামনেই একটা পানের দোকান আছে! আমগো দুইজনের জইন্য দুইটা পান নিয়া আসো তো! যাও! আমারটা জর্দা ছাড়া!
চাকরিটা দরকার, ভীষণ দরকার! প্রতি সপ্তাহের শেষের দিকে টাকার টান পড়ে যায়। তখন বন্ধুবান্ধবের কাছে চেয়েচিন্তে ভাত খেতে হয় আর কত রকম ইচ্ছে করে, একটা ভালো শার্ট পরতে, একটা ভালো কলম কিনতে! সপ্তাহ শেষে ঢাকার এক আত্মীয়ের কাছে মফস্বলের বাবার রেখে দেয়া টাকা চাইতে গেলে ১০০-এর বেশি কখনই পাওয়া যেত না! বাবার নাকি অমনই আদেশ! চাকরিটা পেলে আর কারোর কাছেই হাত পাততে হবে না! সে চাকরির আশায় ও পানের দোকান পর্যন্ত ভালোভাবেই যেতে পারল, কিন্তু পানটা কেনার পরই, কোত্থেকে উপচে এসে পড়তে লাগল আত্মসম্মানের স্রোতধারা! নিজেকে মনে হতে লাগল একটা ধিক্কৃত চরিত্র। এই পৃথিবীর সবার অবজ্ঞার পাত্র! কাগজে জড়ানো পান দুটো এবং বাকি পয়সা দারোয়ানের হাতে ধরিয়ে দিয়ে ও নেমে এসেছিল পথে। পেটে ক্ষুধা নিয়েই হাঁটছিল সেদিন, রিকশা ভাড়া পকেটে থাকলে তো! হাঁটতে হাঁটতে আবিষ্কার করেছিলÑ চোখ থেকে নেমে আসছে অবিরল জলের ধারা। এমন গ্লানিবোধে ও কখনো আচ্ছন্ন হয়নি আগে। ক্ষুধা আর মনের যন্ত্রণা নিয়ে হলে এসেই লিখে ফেলেছিল গ্লানি নামের একটি গল্প।
পরদিনই গল্পটা দিয়ে এসেছিল একটা সাপ্তাহিককে। ওকে অবাক করে দিয়ে পরের সপ্তাহেই ছাপা হয়েছিল গ্লানি। ব্যস আর পিছন ফিরে তাকাতে হয়নি। চুটিয়ে গল্প লিখেছে এখানে সেখানে, সাপ্তাহিক, দৈনিক, লিটল ম্যাগাজিনে! বইও বেরিয়েছে তিন-চারটে। গল্প লেখার পাশাপাশি উপন্যাসও লিখেছে এক দুটো। কিন্তু সব লেখাই কি নিজের সত্তার ভাঙচুর নয়? তুমি কি আত্মবিবরে নিজের অন্ধকারেই ডুবে থাকছো না? প্রশ্নটা হঠাৎই এতদিন পর জেগে উঠল হাসান জামিলের। এখানেই বোধকরি হুমায়ূন আহমেদের সঙ্গে ওর একটা মৌল পার্থক্য লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হুমায়ূন আহমেদ যেখানে রাবেয়া-রুনুসহ অন্যান্য অনেক মানুষের কথা ভেবে লিখতে উদ্ধুদ্ধ হয়েছিলেন, সেখানে ওর লেখার উদ্বোধন ঘটেছিল ব্যক্তিগত যন্ত্রণা থেকে। সে কারণেই কি অন্যের কাছে ওর লেখাগুলো আদৃত হলো না?
না না না, সেটা কেন হবে! অন্যের কথা, মানুষের কথা, সময়ের কথাও তো ওর লেখায় এসেছে। ঘুরেফিরেই এসেছে। প্রবলভাবেই এসেছে। সমাজ এবং সময় বলা যায় প্রধান প্রতিপাদ্যই ওর লেখার। কোন কোন সমালোচক তো ওকে মানবিকতার কথাকার বলেও উল্লেখ করেছে। তাহলে? তাহলে পাঠক কেন ওকে গ্রহণ করল না? সেটার উত্তর সম্ভবত হুমায়ূন আহমেদের উপন্যাস পাঠ করলেই মিলবে। ও নন্দিত নরকে খুলে বসল। পড়া মাত্র শুরু করেছে কি করেনি, তখনই কোথা থেকে আদিল রহমান ও জোনায়েদ ঘাড়ের ওপর দাঁড়িয়ে জানতে চাইল, কি ব্যাপার! হাসান ভাই। আজকে এত চুপচাপ। কোন আওয়াজ নেই।
বইটাকে আলগোছে ড্রয়ারের ভিতর চালান করে দিয়ে চেয়ারটা ঘুরিয়ে ওদের দিকে ফিরে বসল। মৃদু একটা হাসি দিয়ে সবকিছুই যে ঠিক আছে, ও যেন বোঝাতে চাইল ওটা।
ধরেছিলেন বস, কাজটা? জোনায়েদ জানতে চাইল। এই তো ধরব। একটু দম নিচ্ছিলাম। আজকেই দিতে হবে? হ্যাঁ। ক্লায়েন্ট আজ বিকেলের মধ্যেই চেয়েছে। নো প্রবলেম, হয়ে যাবে। চলুন না বস, ক্যান্টিনে। চা খেয়ে আসি। আপনি তো মনে হয় আজ চা খাননি। না চলো। অনিচ্ছা সত্ত্বেও উঠল হাসান জামিল। নন্দিত নরকে মনে হয় না আজ অফিসে পড়া যাবে। জোনায়েদ শালাটা কাজ থাকলেই হলো, চ্যাংড়ার মতো পিছনে লেগে থাকে! অথচ পড়াটাও জরুরি। লেখার জন্যই জরুরি। উপন্যাসটা ক্লিক না করলে ওঠার আর কোন চান্স পাওয়া যাবে না। ও কোনভাবেই চায় না, এ্যাভারেজ পাঠকরা আর ওর বই কিনতে ভয় পাক। সবার মধ্যে যেন এই মনোভাবটা কাজ করে, হাসান জামিলের লেখা আমার জন্য। সেটাই একটা বিগ চ্যালেঞ্জ!

৩.
না, অফিসে নন্দিত নরকে পড়ার সুযোগ হয়নি হাসান জামিলের। কাজের ব্যস্ততাতেই কেটেছে। বাসায় ফিরেও সুযোগ এলো না। অনেকদিন পর আজ যেন রেবার প্রেমটা একটু বেশি বেশিই উছলে উঠেছে। ছেলেকে পড়ানো বাদ দিয়ে আজ ওকে নিয়েই বসল। এ-বাসার গল্প, ও-ভাবির সংবাদ, অসীম ধৈর্য নিয়ে সাড়ে ৯টা পর্যন্ত অপেক্ষা করল সে। অবশেষে এলে সেই মহালগ্ন। টিভিতে শুরু হলো রাজাকী আয়েগী বরাত হিন্দি সিরিয়াল। নিমেষেই বাকি দুনিয়া ভুলে গেল রেবা।
ড্রয়িংরুমের সোফাসেটে হাসান জামিল নন্দিত নরকে-তে পুরোপুরি সেট হয়ে গেলো। আশ্চর্য সরল আর সত্যিই সম্মোহনীয় এক ভাষা। বর্ণনা এমন সরল হতে পারে, ওর কল্পনাতেও ছিল না। তির তির করে এগিয়ে যায় হাসান জামিল। এতো দেখছি একেবারে বাংলাদেশের মধ্যবিত্ত পরিবারের কমন গল্প। যেখানে ছেলেমেয়ের ঘরের সাথে বাবা-মায়ের ঘরের ব্যবধান থাকে বাঁশের বেড়ার। গভীর রাতে মার উদ্দেশে বাবার আদুরে ডাক শোনা যায়। যে পরিবারে সন্তানের আবদার রক্ষা করতে না পেরে মার মুখটা বাচ্চা খুকীদের মতো হয়ে যায়। অপরাধে মায়ের নাকের ফর্সা পাতলা পাতা তির তির করে কাঁপে। পাঁচ-ছয় পৃষ্ঠা পড়েছে কি পড়েনি অমনি রেবা এসে ঢুকল, চলো চলো খেয়ে নেই।
বইটা সোফার কুশনের নিচে চালান করে দিয়ে হন্তদন্ত ভঙ্গিতে উঠে দাঁড়িয়ে হাসান জামিল বলল, কি ব্যাপার ...কি হলো? মুখটাকে একমুখ রাতের আঁধার বানিয়ে রেবা বলল, আর বলো না। ডিশওয়ালাদের ওখানে মনে হয় লোডশেডিং! নাটকটা আজকে আর দেখা হলো না! মনে মনে লোডশেডিংয়ের চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধার করতে লাগল হাসান জামিল। মেজাজ সামলিয়ে ও খাবার টেবিলে এসে বসল। নন্দিত নরকই পড়ার চান্স পাচ্ছে না, উপন্যাস লেখা শুরু করবে কখন?
ভাগ্য ভালো যে রন্টুকে ঘুম পাড়াতে গিয়ে রেবাও ঘুমিয়ে পড়ল। সচরাচর এটা হয় না ওর। হাসান জামিলের সঙ্গে গল্প করতে করতেই ঘুমায়। আবার ড্রয়িংরুমের সোফাসেটে নন্দিত নরকে পড়ায় ডুবে গেল হাসান জামিল। এ এক চৌম্বক আকর্ষণ! ছেড়ে থাকা যায় না! তীব্র আবেগে বুঁদ হয়ে পড়ায় মগ্ন হয়ে রইল ও। পড়তে পড়তে কখন যে সোফাসেটেই ঘুমিয়ে পড়ল, বলতেও পারবে না, ঘুম ভাঙল রেবার ডাকে, এই! কি ব্যাপার বলো তো? তুমি কি রাতে এখানেই ঘুমিয়েছ?
লাফ দিয়ে উঠে বসল হাসান জামিল। কখন সকাল হয়েছে কে জানে! বুকের ওপর থেকে হুমায়ূন উপন্যাস সমগ্রটা পড়ে গেল নিচে, পড়বি তো পড় একেবারে রেবার পায়ে। বইটা চটজলদি উঠাতে উঠাতে ও বিস্ময়ে হতবাক হয়ে বলল, এটা কী? হুমায়ূন আহমেদ? তুমি হুমায়ূন আহমেদ পড়ছো?
না, মানে লজ্জায় সংকোচে কাঁচুমাচু হয়ে যায় হাসান জামিল। মুখে মৃদু হাসি ফুটিয়ে রেবা বলল, পড়ছো ভালো কথা! চুরি করে পড়ার মানেটা কী!
না, মানে! আর বলতে হয় না রেবাকে কোনকিছু মুখ খুলে। দু’জনের চোখের সামনেই ভেসে উঠল কত স্মৃতি কত বড় বড় কথা, উপদেশের পর উপদেশ, আমার বউ হয়ে তুমি শাবানার সিনেমা দেখে কাঁদো! ছি ছি! আমি বন্ধুবান্ধবের কাছে মুখ দেখাব কিভাবে! টিভিতে শাবানার ছবি দেখে একদিন চোখের জল বাঁধ মানেনি বলে কত কথাই না শুনতে হয়েছিল! দু’দিন বাদেই নিয়ে এলো শাবানা আজমীর খ-হর, জেনেসিস আরও যেন কী কী সব ছবির ভিডিও, নিজে ছাড়তে ছাড়তে বলেছিল, সিনেমা দেখলে শাবানা আজমীর ছবি দেখো! এইসব মিডল ক্লাস সেন্টিমেন্ট থেকে তোমাকে বেরিয়ে আসতে হবে! না পারেনি রেবা! বেরিয়ে আসতে পারেনি। যেমন শাবানার ছবি ছেড়ে ধরতে পারেনি শাবানা আজমীর ছবি, তেমনি হুমায়ূন আহমেদ ছেড়ে আখতারুজ্জামান ইলিয়াস কিংবা হাসান আজিজুল হক কিংবা মাহমুদুল হক কিংবা রশীদ করীমে সহজে আসক্ত হতে পারেনি ও। কী করবে? এক জীবনের অভ্যেস সহজে ছাড়া যায়? রেবার এ ব্যর্থতাকে সহজে মেনে নিতে পারেনি হাসান জামিল। এসব নিয়ে কত রকমের পাগলামিই না করেছে ও! একবার তো সংসার ভাঙারই উপক্রম হয়েছিল। আজ মনে পড়তেই ও সংকোচে লজ্জায় আড়ষ্ট হয়ে থাকে। ওকে স্বাভাবিক করার চেষ্টা করে রেবা, কোনটা পড়লে হুমায়ূন আহমেদের?
নন্দিত নরকে। ছোট্ট জবাব হাসান জামিলের। কেমন লাগছে? পুরোটা শেষ করতে পারিনি। আট-নয় পৃষ্ঠা বাকি আছে। নাস্তা শেষ করেই অদ্ভুত কা- করল হাসান জামিল। বই নিয়ে বসে পড়ল। রেবা অবাক গলায় বলল, তোমার অফিস নেই? শেষ করেই যাই। বেশিক্ষণ লাগবে না।
নন্দিত নরকে পড়তে পড়তে মন কেমন বিষণœ হয়ে উঠল হাসান জামিলের। বিশেষ করে মন্টুর চ্যাপ্টারটা শুরু হওয়ার পর থেকেই মনের ভেতরটা কেমন রিন রিন করছে। সহজ বর্ণনায় কত গভীরতাকেই না ছুঁতে পারেন লেখক অসামান্য কুশলতায়। রাবেয়া যেমন অতিরিক্ত রক্তক্ষরণে মারা গেল, সেদিনই মাছ কাটার বঁটি দিয়ে মাস্টার সাহেবকে খুন করে বসল মন্টু। অথচ খুনের ব্যাপারে না দিল স্বীকারোক্তি না করল অস্বীকার। বোনের ইজ্জত, মাস্টার সাহেবের প্রতি শ্রদ্ধাÑসবকিছু জিইয়ে রেখেই ওর এই ঘৃণা এই প্রতিবাদ। কত কথা যে মনে পড়ে হাসান জামিলের। এই দারিদ্র্যকে আমি চিনি। নন্দিত নরকে উপন্যাসে রাবেয়া রুনু মন্টুদের ফ্যামিলির যে দারিদ্র্য, যে অভাব টানাপোড়েন, বাবা-মার অসহায়ত্বÑ এটা যে পুরো বাংলাদেশের অধিকাংশ ফ্যামিলিরই ঘটনা! যে সময়ে নন্দিত নরকে লেখা হয়েছিল কটা পরিবারের মাসিক আয় স্বাভাবিক বেঁচে থাকার মতো ছিল? প্রত্যেককেই নির্দিষ্ট অর্থে দিনযাপন করতে হয়, এখনো তো প্রায় পরিবারকেই মাসের অর্ধেক যেতে না যেতে হিসাব করে করে, শুধুই কি হিসাব, কঠিন হিসাব করে দিন গুজরান করতে হয়। এ শুধুই কি দারিদ্র্র্যের গল্প? এই শরীর এই দেহ এই যৌবনের কত চাওয়া-পাওয়া, পৃথিবীর সেই সূচনালগ্ন থেকেই, যদি একে বলো পাপ তাহলে পাপ, যদি বলো সম্মোহনÑঅস্বীকার করা যায় না। উপন্যাসে অস্পষ্ট হলেও আমরা উপন্যাসের বর্ণনাকারী উত্তম পুরুষ নায়কের ভাষ্য থেকেই জানতে পারি, হয়তো মাস্টার সাহেবের দ্বারাই রেবার গর্ভে সন্তান এসেছিলÑকিন্তু আশ্চর্য যে, কাউকেই ঠিক দায়ী করতে ইচ্ছে হয় না, মাস্টারকে না, মন্টুকে না, রাবেয়াকে না, প্রত্যেকেই যেন নিয়তির হাতে বন্দি, ক্রীড়নক! সবার প্রতি সহানুভূতিতে মন ভিজে ওঠে। রেবা এসে সামনে দাঁড়ায়, অ্যাই! তুমি আজ অফিসে যাবে না? কটা বাজছে খেয়াল আছে?
গা মুচড়িয়ে উঠে দাঁড়ায় হাসান জামিল, বইটা হাতে নিয়েই। রেবা হাসি লুকাতে মুখ অন্যদিকে ঘুরিয়ে ফেলে।

৪.
নন্দিত নরকের মতো একটা উপন্যাস কি আমি লিখতে পারব? এত সহজভাবে এত সরল বর্ণনায়? অফিসে নিজের টেবিলে বসে বসে ভাবছিল হাসান জামিল। তাও আবার এক রাতের লেখা। এক বসায়। অসম্ভব শক্তিশালী লেখার হাত আর গভীর জীবনবোধ না থাকলে এটা সম্ভব নয়। ওসব থাকলে প্রতীকী অলংকার সাঙ্কেতিকতা এসব আপনা-আপনি চলে আসে। জোর করে কোন কিছু আরোপ করার প্রয়োজন হয় না। এই যে বাগানে হাস্নাহেনা গাছের নিচে মন্টুর সাপ মারার বর্ণনাটা, কত ন্যাচারালভাবে এসেছে আর যখন এই মন্টুর হাতেই মাস্টার সাহেব মারা গেলেন বঁটির কোপে, তখন এই সাপ মারার প্রাসঙ্গিক বর্ণনাটাই কী ভীষণভাবে অসাধারণ হয়ে উঠল! পেয়ে গেল আশ্চর্য এক প্রতীকীমাত্র! কোন বর্ণনাই অপ্রাসঙ্গিক নয়, নয় অপ্রয়োজনীয়, বাহুল্য কথা একটাও নেই। আর কী মুগ্ধ হয়ে পাঠ করতে হয় দুনিয়ার সবকিছু ভুলে গিয়ে!
হাসান জামিল শঙ্খনীল কারাগার খুলে বসল। মুহূর্তেই এটা অফিস না বাসা ভুলে গেল ও। পাতার পর পাতা শেষ করতে লাগল। এটাও নিম্নমধ্যবিত্ত পরিবারের গল্প এবং ছোট ছোট চাওয়া না পাওয়ার সেই যন্ত্রণাগুলো সকরুণভাবে ছুঁয়ে দেয়! কেন ভালো লাগবে না এ দেশের পাঠকের! পাঠক যদি নিজেকে খুঁজে পায়! এ উপন্যাসের মাকে কেমন একটু অন্যরকম লাগছে, যে তার সন্তানদের প্রতি খানিকটা উদাসীন। আর বড় মায়া ধরিয়ে দিতে লাগল রাবেয়া-মন্টুর মতো চরিত্রগুলো, উপন্যাসের উত্তম পুরুষ কথক খোকা। আরেকটা বাচ্চার জন্ম দিতে গিয়ে মায়ের মৃত্যু থমকে দিল হাসান জামিলকে। ও স্তম্ভিত হয়ে বসে রইল সে পাতায়। কতক্ষণ ঝিম মেরে বসেছিল বলতে পারবে না। হঠাৎ ওর ঘোর ভাঙল আমরিন ইসলামের ডাকে, এই আপনি দু’তিন দিন ধরে কী রসে মেতে আছেন বলুন তো! দেখি! একেবারে গায়ের ওপর এসে পড়ে যাচ্ছিল আমরিন। হাসান জামিল কিছুতেই আর নিজেকে রক্ষা করতে পারলো না। বইটা হাতে নিয়ে আমরিনের চোখে রাজ্যের বিস্ময়। ও চেঁচিয়ে ওঠল, আদনান, জাভেদ ভাই, শিরিন! দেখে যান কী দারুণ সারপ্রাইজ!
চারদিকের ডেস্ক থেকে ছুটে এলো ওরা। হাসান জামিলকে ঘিরে দাঁড়াল! আমরিন যেন দারুণ একটা কিছু আবিষ্কার করে ফেলেছে এমন ভঙ্গিতে বলল, হাসান ভাই লুকিয়ে লুকিয়ে হুমায়ূন আহমেদ পড়ছেন।
তাই নাকি? স্ট্রেঞ্জ! যেন অষ্টম আশ্চর্যের কোনকিছু অবলোকন করছে ওরা। আদনান হাসান জামিলের মুখটাকে নিজের দিকে ঘুরিয়ে নিয়ে গভীর কৌতূহলে জানতে চাইল, সবকিছু ঠিক আছে তো?
হাসান জামিল ওদের দিকে তাকিয়ে মিটি মিটি হাসতে লাগলো। শিরীন আবিদ বলে উঠলো, হঠাৎ আপনার এই অধঃপতন!
খট করে কানে কথাটা লাগল হাসান জামিলের। ও মাত্র হুমায়ূন আহমেদের নন্দিত নরকে পাঠ শেষ করেছে। এখন পড়ছে শঙ্খনীল কারাগার। এখনো বুকের ভিতরটা চিনচিন করছে চরিত্রগুলোর জন্য, নাকি নিজেরই জন্য, ঠিক জানে না হাসান। হুমায়ূন আহমেদ পাঠ কেন হবে অধঃপতনের বিষয়! এ কেমন কথা শিরীন আবিদের। জবাব দিতে রুচিতে বাঁধল। দু’কলম ইংরেজি শিখে পড়িস তো মার্কেজ, রুশদী, বিক্রম শেঠ! বাংলাদেশের লেখকদের নাম শুনলেই নাক সিটকাস। তোরা আবার কী মূল্যায়ন করবি হুমায়ূন আহমেদের? ওদের কথাকে পাত্তা না দিয়ে ওদের সামনেই আবারও শঙ্খনীল কারাগার পড়তে লাগল। আর তো পিছুটান নেই। ধরা যখন পড়েই গেছে! এত সহজে ছাড়বার পাত্র নয় শিরীন আবিদ, রহস্যটা কী বলেন তো? হঠাৎ হুমায়ূন আহমেদ?
এমনিই! পড়তে ইচ্ছে করল, পড়ছি। আপনার অসুবিধা আছে? এটা আমার ব্যক্তিগত ব্যাপার।
হুমায়ূন আহমেদ নিয়ে কী সব বলতেন? মনে আছে?
মানুষ বদলাতেই পারে!
ভালো! ভালো। খুব ভালো।
ওদের মধ্যে হাসির হুল্লোড় পড়ে গেল। হাসির হুল্লোড়েই শোনা গেল শিরীন আবিদের গলা, আপনি যেসব লেখকদের পক্ষে ওকালতি করতেন, তাদের কী হবে এখন?
আশ্চর্য ! তাদের আবার কী হবে মানে? এখানে বসে থাকতে আর এক মিনিটেরও রুচি হচ্ছে না হাসান জামিলের। যেন ওরা ওকে একটা কাঠগড়ায় দাঁড় করিয়ে দিতে চাইছে! শ্বাস বন্ধ হয়ে আসতে চায় ওর। হাসান জামিল চেয়ার ছেড়ে উঠল। লম্বা প্যাসেজ পেরিয়ে হাঁটতে হাঁটতে ছোট্ট লনের স্মোকিং জোনে এসে দাঁড়াল!
অফিসে এই একটিমাত্র জায়গা আছে, যেখানে খোলা আকাশ পাওয়া যায়। সামনের জায়গাটা ফাঁকা। গাছপালা, এক টুকরো সবুজ মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে আছে! তাদের কী হবে মানে! পাঠক পাক আর না পাক তাদের জায়গায় তারা ঠিকই অবিস্মরণীয় হয়ে থাকবেন! হাসান জামিল আগেও তাদের সম্পর্কে যে ধারণা পোষণ করতো, এখনো করে! হাসান আজিজুল হক, আখতারুজ্জামান ইলিয়াস, মাহমুদুল হক, রশীদ করীম, রিজিয়া রহমান, শওকত আলী, সৈয়দ শামসুল হক, সেলিনা হোসেন, শহীদুল জহির এবং এদের মতো অনেকেই আছেন, যারা বাংলাদেশের সাহিত্যে একটি শৈল্পিক এবং মানুষের যুগলবন্ধনে মহান ধারার সৃষ্টি করেছেন! লেখাকে শিল্পোত্তীর্ণ করার পাশাপাশি তারা চেয়েছেন এ জাতির বোধ এবং চৈতন্যও একটা উচ্চতর স্থানে গিয়ে পৌঁছাক! লেখাকে তারা পণ্য বানানোর ঘোর বিরোধী! হাসান জামিল তাদের পথ এবং মতের সাথে একটা আত্মার সম্পর্ক খুঁজে পেয়েছে! এবং সেই প্ল্যাটফর্ম থেকেই ঘরে রেবাকেই হোক কিংবা বাইরে শিরীন আবিদদেরকেই হোক, বোঝানোর চেষ্টা করেছে, তোমরা কেউ মার্কেজ পড়ছ, কেউ পড়ছ হুমায়ূন-মিলন, একবারের জন্য অন্তত পড়ে দেখো হাসান আজিজুল হকের গল্পগুলো, মাহমুদুল হকের উপন্যাস, শওকত আলীর প্রদোষে প্রাকৃতজন, রিজিয়া রহমানের উপন্যাস, সৈয়দ শামসুল হকের আধুনিক দেখার চোখ! দেখবে তোমাদের কিছু অন্য ভুবন খুলে গিয়েছে! পাঠক এদের লেখা খুঁজে খুঁজে পড়ে না বলে একটা যন্ত্রণা একটা আক্ষেপ ওর আগেও ছিল এখনো আছে। ও ওদের জন্যে রীতিমতো সবার সাথে যুদ্ধও করেছে! এবং এটা সত্যি যে ও কখনোই হুমায়ূন আহমেদের পক্ষে বলেনি, ব�

2 comments:

  1. লেখাটি অসম্পূর্ণ পোস্ট করা হয়েছে। অনুগ্রহপূর্বক পুরো লেখাটি পোস্ট করা হোক। তা না হলে লেখাটির স্বাদ পুরো পাওয়া যাবে না।

    ReplyDelete
  2. লেখাটি অসম্পূর্ণ পোস্ট করা হয়েছে। অনুগ্রহপূর্বক পুরো লেখাটি পোস্ট করা হোক। তা না হলে লেখাটির স্বাদ পুরো পাওয়া যাবে না।

    ReplyDelete

Powered by Blogger.