কী ঘটতে চলেছে ভারত-শাসিত কাশ্মীরে? by শুভজ্যোতি ঘোষ
ভারত-শাসিত কাশ্মীরে ঠিক কী ঘটতে
যাচ্ছে, তা নিয়ে তীব্র জল্পনার মধ্যেই দেশের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ
আজ ভারতের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা ও গোয়েন্দা প্রধানদের সঙ্গে দীর্ঘ
বৈঠক করেছেন।
গত দশদিনে কাশ্মীরে প্রায় বাড়তি পঞ্চাশ হাজার সেনা
মোতায়েন এবং তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের সরিয়ে নেওয়ার পর কাশ্মীরে তীব্র
আতঙ্কের পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছে।
শ্রীনগর থেকে সাধারণ মানুষরাও বিবিসিকে জানাচ্ছেন, এমন 'মানসিক নির্যাতনে'র মুখে তারা কখনও পড়েননি।
দিল্লিতে
সামরিক পর্যবেক্ষক বা নিরাপত্তা বিশ্লেষকরাও কাশ্মীর নিয়ে নির্দিষ্টভাবে
কিছু পূর্বাভাস করতে পারছেন না, তবে সাঙ্ঘাতিক বড় কিছু একটা ঘটতে চলেছে
বলেই তাদেরও অনুমান।
গত বাহাত্তর ঘন্টা বা তারও বেশি সময় ধরে
ভারত-শাসিত কাশ্মীরের শ্রীনগর উপত্যকা বা 'ভ্যালি' বলে পরিচিত অঞ্চলটিতে যে
ধরনের থমথমে উত্তেজনা আর আতঙ্ক বিরাজ করছে, তা কাশ্মীরের স্ট্যান্ডার্ডেও
রীতিমতো নজিরবিহীন।
ভ্যালিতে বাড়তি পঞ্চাশ হাজার সেনা ঠিক কী করতে আনা হল, কেন অমরনাথ
তীর্থযাত্রীদের বা গুলমার্গ-পহেলগাম থেকে পর্যটকদের হুড়োহুড়ি করে ফেরত
পাঠানো হল - এইসব প্রশ্নকে ঘিরে উত্তাল হয়ে রয়েছে কাশ্মীরের জনমন।
কাশ্মীর ইউনিভার্সিটির সিনিয়র প্রফেসর ও শিক্ষাবিদ ড: হামিদা বানো বিবিসি বাংলাকে বলছিলেন, "ভয়ে-আতঙ্কে আমরা তো হতবাক।"
"গত
কদিন ধরে কাশ্মীরিদের ওপর যে ধরনের মনস্তাত্ত্বিক স্ট্রেস ও ট্রমার ভেতর
দিয়ে যেতে হচ্ছে তাতে অনেকেই মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়ছে। এই ক্ষতি
অপূরণীয়।"
"কেনই বা বাড়তি দুলক্ষ সৈন্য এল, কেনই বা তীর্থযাত্রী
বা ট্যুরিস্টদের জোর করে বাসে তুলে সরিয়ে নেওয়া যাওয়া হল তার কোনও জবাবই
পাচ্ছি না আমরা।"
"শোকবিহ্বল কাশ্মীর যেন একটা যুদ্ধবিধ্বস্ত প্রান্তরের চেহারা নিয়েছে, শ্রীনগর আজ খাঁ খাঁ করছে", বলছিলেন প্রোফেসর বানো।
এই অনিশ্চয়তার পটভূমিতেই দিল্লিতে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী অমিত শাহ
আজ লম্বা আলোচনা সেরেছেন জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা অজিত ডোভাল, র-এর
প্রধান সামন্ত গোয়েল, ইন্টেলিজেন্স ব্যুরো-র অধিকর্তা অরবিন্দ কুমার সহ
সিনিয়র কর্মকর্তাদের সঙ্গে।
ভারতের নিরাপত্তা বাহিনীর সূত্রে বলা
হচ্ছে, পাকিস্তানের দিক থেকে বড় মাপের কোনও অনুপ্রবেশ ঘটিয়ে পুলওয়ামার
ধাঁচে আর একটি বড় জঙ্গী হামলা চালানোর চেষ্টা চলছে বলেও তাদের কাছে
গোয়েন্দা তথ্য আছে।
দিল্লিতে ইনস্টিটিউট অব পিস অ্যান্ড কনফ্লিক্ট
স্টাডিজের কর্ণধার ও সাবেক মেজর জেনারেল দীপঙ্কর ব্যানার্জিও বিশ্বাস করেন,
"কাশ্মীরে অবশ্যই বড় কিছু একটা ঘটতে যাচ্ছে - যদিও সেটা ঠিক কী এখনও জানা
নেই।"
"নইলে এত বাড়তি সেনা সেখানে নিয়ে যাওয়া বা উচ্চ-পর্যায়ে এমন জরুরি বৈঠকের দরকার পড়ত না।"
"হয়তো
বড় কোনও হামলার খুব বিশ্বাসযোগ্য গোয়েন্দা তথ্য আছে, সেই জন্যই
তীর্থযাত্রীদের এভাবে সরানো হল। কাশ্মীরে কোর কমান্ডারের কথাতেও সেই ইঙ্গিত
মিলেছে।"
"আবার এই সিদ্ধান্তের পেছনে রাজনৈতিক যোগসূত্রও থাকতে পারে। কাশ্মীরে স্থানীয় নির্বাচন করাতে হবে, বিধানসভা নির্বাচনও সামনেই।"
"আর
সেখানে বিজেপির কাশ্মীর এজেন্ডা বাস্তবায়নের আগে সতর্কতামূলক পদক্ষেপ
হিসেবে বাড়তি সেনা নিয়ে আনা হল, সেটাও একটা ব্যাখ্যা হতে পারে", মনে
করছেন ভারতীয় সেনার অবসরপ্রাপ্ত ওই শীর্ষ কর্মকর্তা।
সরকার কাশ্মীরে তাদের পরবর্তী পদক্ষেপ নিয়ে ধোঁয়াশা রাখলেও সোশ্যাল মিডিয়াতে দুটো সম্ভাবনা নিয়ে জোরালো আলোচনা চলছে।
এক,
বিজেপির বহু পুরনো নীতি অনুসারে সংবিধানের যে ৩৭০ ধারা কাশ্মীরকে বিশেষ
মর্যাদা দেয় তা অর্ডিন্যান্সের মাধ্যমে রাতারাতি বিলোপ করা।
আর
দুই, রাজ্যটিকে জম্মু, কাশ্মীর ও লাদাখ - এই তিনভাগে ভাগ করে ফেলা, যাতে
কাশ্মীরের স্বতন্ত্র স্বীকৃতি আপনা থেকেই বাতিল হয়ে যায়।
দিল্লি ইউনিভার্সিটির রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ও নিরাপত্তা বিশ্লেষক উজ্জ্বল
কুমার সিং বিবিসিকে বলছিলেন, "সাংবিধানিক দৃষ্টিকোণে পার্লামেন্টে সাধারণ
গরিষ্ঠতা থাকলেই কিন্তু একটা রাজ্যকে ভেঙে দুই বা তিন টুকরো করা যায়, যদি
কোনও সরকার তা চায়।"
"কিন্তু কাশ্মীরের ক্ষেত্রে বিষয়টা তো আইনি
সিদ্ধান্ত নয়, একটা রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। তারপরেও সেখানে যে পরিমাণ
বিল্ড-আপ হয়েছে, তাতে এই সম্ভাবনাও উড়িয়ে দেওয়া যাচ্ছে না।"
"আর একটা জিনিস হল, তীর্থযাত্রী ও পর্যটকদের সরিয়ে নেওয়ার পর ভ্যালিতে শুধু কিন্তু এখন কাশ্মীরিরাই রয়েছেন।"
"ভারতের
নাগরিক হিসেবে তাদের নিরাপত্তার প্রতিও রাষ্ট্র সমান যত্নবান হবে এটাই আশা
করা উচিত, কিন্তু সেই ছবিটা আমরা দেখতে পাচ্ছি না", বলছেন অধ্যাপক সিং।
ফলে কাশ্মীর ভ্যালির প্রায় সত্তর লক্ষ মানুষ এখন দিন কাটাচ্ছেন চরম এক অনিশ্চয়তা আর অজানা আতঙ্কেই।
No comments