এক যুগ ধরে শিকলে বাঁধা বাসন্তীর জীবন
এনজিওকর্মী
বাসন্তী রানীর বয়স এখন ৩১ বছর। চুরির অভিযোগে তাকে পায়ে শিকল দিয়ে গাছের
সাথে বেঁধে রাখা হয়েছে এক যুগ ধরে। পরিবারের দাবি তাকে ছেড়ে দেয়া হলে কারো
কিছু চুরি গেলে অথবা কিছু হারালে চুরি না করলেও তাকে স্থানীয় লোকজন চোর বলে
সাব্যস্ত করে। সে জন্যই তারা তাকে বেঁধে রাখেন। বাসন্তী দেবীগঞ্জ উপজেলার
ডুবা ইউনিয়নের লক্ষ্মীরহাট ডাঙ্গাপাড়া গ্রামের হরিপদ কর্মকারের বড় মেয়ে।
জানা যায়, গত ৫ ফেব্রুয়ারি সোমবার রাতে বাসন্তী রানীকে বেঁধে রাখার বিষয়টি
সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকের মাধ্যমে প্রকাশিত হয়। হরিপদ কর্মকারের দুই
মেয়ে ও এক ছেলে। তিনি পেশায় একজন কামার। তার সহায় সম্বল বলতে ভিটেবাড়ির আট
শতক জমি। ২০০৫ সালে বাসন্তী রানীর বড় বোন গীতা রানী এক মুসলমান ছেলেকে বিয়ে
করে ধর্ম পরিবর্তন করেন। পরে শ্বশুর বাড়ির লোকজনের নির্যাতনে মারা যান
তিনি। সে সময় বাসন্তী রানী অষ্টম শ্রেণীর ছাত্রী। বড় বোনের এমন ঘটনায়
মানসিকভাবে ভেঙে পড়েন বাসন্তী। তারপর তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠান
ব্র্যাকে কিশোরী স্বাস্থ্য পরিচর্যা সংক্রান্ত প্রকল্পে চাকরি নেন। চাকরির
জন্য রাজশাহীতে যান ট্রেনিংয়ে। এক মাস ট্রেনিং শেষে ফিরে আসেন বাড়িতে। এ
সময় পরিবারের সদস্যরা তার মধ্যে অস্থিরতা লক্ষ্য করেন। মাঝে মধ্যে তিনি
অসুস্থ হয়ে পড়লে তার শরীরে খিচুনি দেখা দিত। পরিবারের লোকজন জানান, তাকে
মানসিক রোগের চিকিৎসক ছাড়াও ওঝা, কবিরাজ দেখানো হয়েছে। বিভিন্ন প্রকার ওষুধ
খাওয়ানোর পর থেকে তার মাথার সমস্যা শুরু হয়। এরপর থেকে ‘তার মাথা খারাপ
হয়েছে’ এবং ‘সুযোগ পেলেই মানুষের বাসায় চুরি করে’ এমন সব অপবাদ দেয়া শুরু
হয়। এ কারণে ২০০৬ সাল থেকে তাকে পায়ে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখছে পরিবারের
লোকজন। তবে এরইমধ্যে তাকে পাবনা মানসিক হাসপাতালে নেয়া হয়েছে এবং সেখানকার
চিকিৎসক তাকে মানসিকভাবে সুস্থ জানিয়ে ফিরিয়ে দিয়েছেন। সরেজমিন হরিপদ
কর্মকারের বাড়িতে দেখা যায়, একটি কাঁঠাল গাছের সাথে পায়ে শিকল দিয়ে বাসন্তী
রানীকে বেঁধে রাখা হয়েছে। এ সময় ছবি তুলতে গেলে তিনি সাংবাদিকদের পরিচয়
জানতে চান।
পরে তিনি সাংবাদিকদের সাথে ভালোভাবে কথা বলেন এবং নিজেকে সুস্থ
দাবি করেন। লেখাপড়া জানার কথা জিজ্ঞেস করায় তিনি কাগজ-কলম চেয়ে নিয়ে সুন্দর
হাতের লেখায় নিজের নাম ও ঠিকানা লিখে দেন। তার সাথে কথা বলার সময় সেখানে
প্রতিবেশীদের ভিড় লেগে যায়। প্রতিবেশীদের অনেকেই জানান, বাসন্তী রানী
সম্পূর্র্ণ সুস্থ। প্রতিবেশী শিউলি বলেন, বাসন্তীকে দিয়ে তার ছোট ভাইয়ের বউ
প্রতিদিন সকালে গৃহস্থলীর কাজ করান। অসুস্থতার জন্য তিনি ভালো করে কাজ
করতে পারেন না। তারপর বেঁধে রাখা হয় সারাদিন। বাসন্তীর বাবা হরিপদ কর্মকার
বলেন, ‘বাসন্তীর মাঝে মধ্যে মৃগি রোগীর মতো খিচুনি হতো। তাকে মানসিক
চিকিৎসক ছাড়াও কবিরাজ, ওঝার ওষুধ খাইয়েছি। বেশি ওষুধ খাওয়ার পর মাথা খারাপ
হয়ে যায়। ছেড়ে দিলে চুরি করে। মানুষের অভিযোগের জন্য আমরা থাকতে পারি না।
এজন্য প্রায় ১১ বছর ধরে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে।’ বাসন্তীর ছোট ভাই রতন রায়
বলেন, ‘বাসন্তী ব্র্যাকের একটি প্রকল্পে চাকরি করত। রাজশাহীতে ট্রেনিং থেকে
আসার পর তার নামে নানা অভিযোগ উঠে। এ সময় স্থানীয় একটি এনজিওতে (গ্রামীণ
ব্যাংক) চুরির অপবাদ দেয়া হয় তাকে। পরে গ্রাম্য এক সালিস বৈঠকে তাকে সামলে
রাখতে বলা হয়। এরপর থেকে তাকে বেঁধে রাখা হচ্ছে। এর মধ্যে তাকে পাবনা
মানসিক হাসপাতালে নিলে সেখানকার চিকিৎসক তাকে মানসিকভাবে সুস্থ বলে ফিরিয়ে
দিয়েছেন। দেবীডুবা ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুর রাজ্জাক জানান, বাসন্তী রানীকে
এতদিন ধরে শিকল দিয়ে বেঁধে রাখার বিষয়টি তিনি জানতেন না। এখন খোঁজখবর
নিচ্ছেন। তাকে শিকল মুক্ত করার ও প্রয়োজনীয় চিকিৎসার ব্যবস্থা করার আশ্বাস
দেন তিনি।
No comments