যেভাবে আমরা চার খলিফা হয়ে গেলাম by নূরে আলম সিদ্দিকী
এ
কথা সর্বজনবিদিত এবং সর্বজনীনভাবে স্বীকৃত- সত্তরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ
বিজয়ের পরপরই বাংলার মানুষ আমাদের চার খলিফা বলে অভিহিত করে। কে, কেন,
কীভাবে এই খলিফা শব্দটি উদ্ভাবন করে আমাদের নামের বিপরীতে ব্যবহার শুরু
করে- সেটি আজও আমার কাছে সত্যিকার অর্থে অজানা। যে-ই এটি উদ্ভাবন করুক না
কেন- এটা সারা বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষের কাছে মরুভূমির নিষ্কলুষ
সূর্যোদয়ের মতো শুধু ছড়িয়ে পড়েইনি সকলের হৃদয়কে বিস্ময়করভাবে আপ্লুত করে
এবং নিমিষেই এই খলিফা নামটি সবার মুখে এমনকি সংবাদমাধ্যমে উচ্চারিত ও
প্রচারিত হতে থাকে। আমার জানা মতে, এটার একটা উৎস হতে পারেন বঙ্গবন্ধু।
তিনি যেটা নিজ মুখে রাজনীতিতে সংবিধানিক দায়-দায়িত্বের খাতিরে বলতে পারতেন
না বা পাকিস্তানিরা তাকে বিচ্ছিন্নতাবাদী উস্কানিদাতা হিসেবে চিহ্নিত করতে
পারে; জনমনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করতে পারে এই কারণে অনেক কথা তার
হৃদয়তন্ত্রিতে ঝংকৃত হলেও তিনি প্রকাশ্যে বিবৃত করা থেকে বিরত থাকতেন। সেই
কথাগুলো আমাদের কণ্ঠে প্রকাশ্যে ও নিঃসঙ্কোচে প্রতিষ্ঠিত হতো। উদাহরণস্বরূপ
২৩শে মার্চ পাকিস্তান দিবস হিসেবে সারা দেশে উদযাপিত হতো। প্রত্যেকটি গৃহে
সামরিক ও বেসামরিক, সরকারি ও বেসরকারি অফিসে, যানবাহনে, ছোট-বড় প্রতিটি
ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠানে পাকিস্তানের পতাকা উত্তোলিত হতো। আমরা একাত্তরের
২২শে মার্চ পত্রিকায় এক যৌথ বিবৃতিতে ঘোষণা দিলাম ২৩শে মার্চে তখনকার পূর্ব
পাকিস্তানে কোথাও পাকিস্তানের পতাকা উড়বে না বরং মানচিত্র খচিত লালসবুজের
পতাকাটি উড়াতে হবে। তখন সামরিক বাহিনীর অভ্যন্তরে সেনা সদর এবং ঊর্ধ্বতন
সেনাধ্যক্ষদের কার্যালয় ও বাসস্থান ছাড়া সর্বত্রই যেমন- সচিবালয়, প্রাদেশিক
প্রধান বিচারালয়, প্রধান বিচারপতির বাসভবন সর্বত্রই পাকিস্তানের পতাকার
পরিবর্তে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়। এমনকি সকল গাড়িতে, বাড়িতেও এর
ব্যতিক্রম হয়নি। ওইদিন পল্টন ময়দানে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীন বাংলার পতাকা
উত্তোলন করা হয়। ছাত্রনেতৃচতুষ্টয় বিভিন্ন ব্রিগেডের অভিবাদন গ্রহণ করেন।
ছাত্রলীগ কর্তৃক সৃষ্ট বিভিন্ন ব্রিগেড সামরিক কায়দায় মঞ্চে দণ্ডায়মান
ছাত্র নেতৃচতুষ্টয়কে অভিবাদন জানিয়ে পল্টন ময়দানের একটি নির্দিষ্ট স্থানে
অবস্থান নেয়। আমার যতদূর মনে পড়ে আমরা মঞ্চে দণ্ডায়মান থাকা অবস্থায় মন্টু,
খসরু ও ইনুর নেতৃত্বে পতাকা উত্তোলিত হয় এবং নারী ও পুরুষের বিভিন্ন
ব্রিগেডের আমরা অভিবাদন গ্রহণ করি। সে এক অভূতপূর্ব ও অভাবনীয় ঘটনা। সারা
পল্টন ময়দান এবং বঙ্গবন্ধু এভিনিউজুড়ে এক মহা জনসমুদ্র। কিন্তু জনসমুদ্রটি
পরম উচ্ছ্বাসে বারবার গর্জে উঠছিল। অভিবাদন পর্ব শেষ হলে আমরা মঞ্চ থেকে
নেমে আসি এবং মিছিল সহকারে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের দিকে
অগ্রসর হতে থাকি। তখন মোবাইল না থাকলেও বঙ্গবন্ধুকে কর্মসূচিটি অবহিত করে
পূর্বেই বাংলাদেশের পতাকাটি গ্রহণ করার জন্য প্রস্তুত থাকতে বলা হয়েছিল।
তখন রাস্তায় চলমান ও প্রবহমান জনতা স্বতঃস্ফূর্তভাবে আমাদের পতাকাবাহী
মিছিলের সঙ্গে যোগদান করে। সে এক বিস্ময়কর দৃশ্য। মিছিল যতই সামনের দিকে
এগুতে থাকে এর কলেবর আশ্চর্যজনকভাবে ততই বৃদ্ধি পেতে থাকে। মিছিলে আমি এমন
ভদ্রলোককেও অবলোকন করেছি যার হাতে ছিল চিকিৎসকের ব্যবস্থাপত্র (ডাক্তারের
প্রেসক্রিপশন)। যিনি ওষুধের দোকান থেকে ওষুধ কেনার জন্য ফুটপাথ দিয়ে চলতে
চলতে আমাদের মিছিলের সমুদ্রে মিশে গিয়েছিলেন। ঘটনাচক্রে ওই চলমান মিছিলে
আমার ডানপাশে তিনি স্থান করে নেন এবং বজ্রকণ্ঠে স্লোগান দিতে থাকেন।
মিছিলের এক পর্যায়ে আমি অত্যন্ত কৌতূহলী হৃদয়ে তার হাতে প্রেসক্রিপশন দেখে
তাকে প্রশ্ন করে জানতে পারলাম যে, তিনি ওষুধ কেনার জন্য ওষুধের দোকানের
দিকে যাচ্ছিলেন কিন্তু এই উচ্ছ্বসিত আবেগপ্রবণ পতাকা মিছিল দেখে তার হৃদয়
এতোখানি আপ্লুত এবং উত্তেজিত হয়ে পড়ে যে, তিনি তার হাতে থাকা
প্রেসক্রিপশনের কথা বেমালুম ভুলে গিয়ে মিছিলের স্রোতে মিশে যান। আমরা
ক্রমেই বৃদ্ধিপ্রাপ্ত মিছিলের সীমাহীন কলেবরটি নিয়ে ৩২ নম্বরে পৌঁছাই এবং
ছাত্রলীগের সভাপতি হিসেবে বাংলাদেশের পতাকাটি আনুষ্ঠানিকভাবে মুজিব ভাইয়ের
হাতে অর্পণ করি। তিনি স্বাধীনতা আন্দোলনের শুধু মূর্ত প্রতীক ছিলেন না।
পহেলা মার্চ স্বাধীন বাংলা কেন্দ্রীয় ছাত্র-সংগ্রাম পরিষদ গঠনের প্রাক্কালে
আমি যে শপথ বাক্যটি পাঠ করাই সেই শপথবাক্যের মধ্যে বঙ্গবন্ধুকে স্বাধীনতার
স্থপতি ও চলমান আন্দোলনের প্রধান সিপাহশালার হিসেবে লাখ লাখ জনতার
উচ্চারিত শপথবাক্যে ঘোষণা করি। মজার বিষয়টি ছিল এই ছাত্র নেতৃচতুষ্টয়
ইতিমধ্যেই চার খলিফা হিসেবে সর্বজনীন স্বীকৃতি লাভ করে ফেলেছে। শুধু
ছাত্রসমাজই নয় প্রান্তিক জনতা আন্দোলনমুখর মানুষের দৃপ্ত হৃদয় এমনকি
সংবাদমাধ্যমগুলোও চার খলিফা নামটি প্রয়োগ করতে শুরু করেছে। যে বা যারাই
আমাদেরকে চার খলিফা হিসেবে অভিষিক্ত করে থাকুক না কেন এর সর্বজনীন স্বীকৃতি
এত ত্বরিত ব্যাপ্তি লাভ করে যা আজও আমাকে বিস্ময়াভিভূত করে। আমি যতটাই
বিস্ময়াভিভূত হই না কেন তবুও আমি নিশ্চিত যে, বঙ্গবন্ধুর অব্যক্ত কথাগুলো ও
কর্মসূচিগুলো আমাদের মাধ্যমেই মানুষের কাছে পৌঁছাতে এবং প্রান্তিক জনতাও
অবলীলাক্রমে ও স্বতঃস্ফূর্তভাবে সেই কর্মসূচি পালন করতো। আমি আগেই বলেছি
২৩শে মার্চ যে কর্মসূচি প্রদত্ত হয়েছিল মিরপুর ও মোহাম্মদপুরে অবাঙালি
এলাকায় সেটি প্রতিপালিত হয়নি অর্থাৎ বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলিত হয়নি। খবরটি
আমরা জানার পরে ২৩শে মার্চই বিবৃতি দিলাম পাকিস্তানের পরিবর্তে বাংলাদেশের
পতাকা যারা উত্তোলিত করেনি তাদের গ্যাস ও পানির সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেয়া
হোক। ওয়াসা, বৈদ্যুতিক বিভাগ এবং তিতাস গ্যাস নির্দেশটি পুরোপুরি পালন করলে
ওই অবাঙালি এলাকাটি পুরোপুরি বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পয়ঃসংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে
পড়লে তারাও বঙ্গবন্ধুর কাছে গিয়ে আমাদের মাধ্যমে চলমান মুক্তিযুদ্ধের
প্রক্রিয়ায় সংযুক্ত হতে এবং আত্মসমর্পণ করতে অভিপ্রায় ব্যক্ত করে পতাকা
উত্তোলন করার ঘোষণা দিয়েছিল। অবাঙালিরা তাদের প্রতিশ্রুতি রেখেছিল কিনা
সেটি ইতিহাসের পাতায় অজানাই রয়ে গেল। তার কারণ ২৫শে মার্চের রাতেই সামরিক
আক্রমণ নিরীহ ও নিরস্ত্র জনতার ওপর শুরু হয়ে গেল। আক্রমণটি পাকিস্তানিদের
সুপরিকল্পিত, নৃশংস, পাশবিক হলেও অত্যন্ত অদূরদর্শী ও অর্বাচীন সিদ্ধান্ত
ছিল। হয়তো আক্রমণটি পরিচালনা করার সময় বাংলাদেশের মানুষের ঐক্য ও প্রতীতি
এবং বজ্রকঠিন শপথ সম্পর্কে তারা ওয়াকিবহাল ছিল না। যদি ওয়াকিবহাল থাকতো
তাহলে তারা ঐক্যবদ্ধ বাঙালির শক্তিকে এতোবড় মূর্খের মতো অবহেলা করতে পারতো
না।
এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে আমাদের ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে দুটি ধারা একটি গণতান্ত্রিক আরেকটি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। একটি থেকে আরেকটি প্রকট থেকে প্রকটতর হতে হতে প্রায় আত্মঘাতী সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে এসেছিল। দলের অভ্যন্তরে বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিকরা সাংঘাতিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল যা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বললেও ভুল হবে না। কিন্তু সাধারণ ছাত্র এবং প্রান্তিক জনতার কাছে তাদের আবেদনটি তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তার মূল কারণ ছিল আমাদের গণতান্ত্রিক মহলটির সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল যে, যেকোনো বৈপ্লবিক কর্মসূচি ও সাংঘর্ষিকতা সৃষ্টি করার আগে আমাদের একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ম্যান্ডেট প্রয়োজন। এই ম্যান্ডেট ছাড়া আমাদের নির্দেশনা সর্বজনীনভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য তো হবেই না; বিশ্ব জনমতের কাছেও বিচ্ছিন্নতাবাদীর পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সত্যিকার অর্থে নির্বাচনের ফলাফল ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৫টি আমাদের দিকে আসবে এই ধারণাটি বঙ্গবন্ধুরও ছিল না। এমনকি আমরা যারা প্রচণ্ডভাবে নির্বাচনী ম্যান্ডেটে বিশ্বাস করতাম তারাও ৩০০ আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫১টি আসন পেলেই বর্তে যেতাম। এটা সারা পাকিস্তানের জন্য একটি বিস্ময়কর, অবিস্মরণীয়, অভাবিত বাঙালি ঐক্যের ফসল যে, দ্বি-জাতি তত্ত্বের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি সেই দ্বি-জাতি তত্ত্বের মাধ্যমে বাঙালি-বাংলাদেশের উদ্ভব। কারণ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে রাজনীতি খুবই স্পষ্ট রূপ নিয়ে নেয় এবং রাজনীতির ধারাও মারাত্মকভাবে স্পষ্ট রূপ নেয়। চলমান আন্দোলন সে সময় স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবি থেকে পুরোপুরি স্বাধীনতায় মোড় নেয় বাঙালি। সরাসরি স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে, তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি। পিণ্ডি না ঢাকা। ঢাকা-ঢাকা। আইয়ুব না মুজিব। মুজিব-মুজিব। পদ্মা মেঘনা যমুনা। তোমার আমার ঠিকানা। তুমি কে আমি কে। বাঙালি বাঙালি।
এটি আরেকটি স্পষ্ট ‘টু নেশন থিউরি’। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে ধর্মের ভিত্তিতে যে দ্বি-জাতিতত্ত্বের জন্ম হয় সেই একইভাবে বাঙালি ও অবাঙালি এটাও দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান উপাদান তৈরি করে। মাত্র ২২ বছরের মাথায় বাঙালি জাতীয় চেতনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই চেতনাটি বাঙালিকে এতখানি ঐক্যবদ্ধ করে যে সত্তরের নির্বাচনের রায়টি তার অভাবনীয় বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এটা পাকিস্তানের সামরিক জান্তাতো বটেই একমাত্র ছাত্রলীগ ছাড়া মুসলিম লীগসহ পাকিস্তানভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দল কল্পনাও করতে পারেনি। এটা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারলে সত্তরের নির্বাচনটি কখনোই তারা দিতো না। আটান্ন সালের সামরিক শাসন জারির মতো গায়ের জোরে, অস্ত্রের মুখে তারা পূর্ব বাংলাকে কলোনি বা শোষণের চারণ ভূমি বানিয়ে রাখতো। অন্যদিকে নির্বাচনে ম্যান্ডেট না পেলে স্বাধীনতার ডাক দেয়াও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব হতো না এবং এদেশে একটি সর্বজনীন নিরঙ্কুশ মুক্তির আন্দোলনও গড়ে তোলা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াতো।
এ লেখায় ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের বিভাজন প্রাসঙ্গিকভাবে বারবার ফিরে আসে এই কারণে যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে পরবর্তীকালে জাসদ করেন তারা সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণে চরম বিরোধী ছিলেন। জনগণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নির্বাচন তাদের কাছে প্রহসন ছিল। নির্বাচনকে পাস কাটিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যেই দেশের স্বাধীনতা অর্জনে তারা বদ্ধপরিকর ছিলেন। যদিও আমরা জানতাম কোনো অবস্থাতেই আমাদের প্রাণের দাবি তারা মেনে নেবে না। পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের চারণক্ষেত্র ও কলোনি হিসেবেই তারা ব্যবহার করবে তবুও ওদেরকে লড়তে হলে ওদের ঔদ্ধত্য, সীমাহীন লিপ্সাকে পরাজিত করতে হলে একটা গণম্যান্ডেট অত্যন্ত প্রয়োজন। যার কোনো বিকল্প ছিল না। আমাদের বিপ্লবী বন্ধুদের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে আমি বলতাম প্রয়োজনে সশস্ত্র বিপ্লবে আমরাও নামবো কিন্তু জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া এ ধরনের বিপ্লবের পদক্ষেপ আত্মঘাতী হবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের কর্মসূচিতে রূপান্তরিত হয়ে অনৈক্যের অস্ত্রাঘাতে আমাদের ঐক্য তো বিনষ্ট হবেই এবং নানারকম খণ্ডিত অবয়বে আমরা চিহ্নিত হবো। আমাদের ঐক্য নিষ্প্রাণ রূপান্তরিত হয়ে প্রাণহীন সত্তায় আমাদের চেতনাবোধকে বহুধা বিভক্ত করবে।
নির্বাচনের ম্যান্ডেট এবং একমাত্র ম্যান্ডেটই আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের সুবর্ণ সৈকতে পৌঁছে দিতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে রাজনৈতিক ধারা উচ্চারিত স্লোগান আমাদের বিভক্তির এসেন্স আজ যারা ঠাণ্ডা মাথায় বিশ্লেষণ করবেন তাদের নিরপেক্ষ পর্যালোচনায় এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হবে। ১লা মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করি না কেন তার অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস ছিল সত্তরের নির্বাচনে ম্যান্ডেট। অন্যথায় তত্ত্ব ও তাত্ত্বিকতার কষাঘাতে জর্জরিত এবং নেতৃত্বের লড়াইয়ে পাশবিকতায় আমরা শুধু বহুধা খণ্ডিত হতাম না আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন চিরতরে নিঃশেষিত হয়ে যেত।
লেখক: স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক
এখানে অত্যন্ত প্রাসঙ্গিকভাবে উল্লেখ করা যেতে পারে আমাদের ছাত্রলীগের অভ্যন্তরে দুটি ধারা একটি গণতান্ত্রিক আরেকটি বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্র। একটি থেকে আরেকটি প্রকট থেকে প্রকটতর হতে হতে প্রায় আত্মঘাতী সাংঘর্ষিক পর্যায়ে চলে এসেছিল। দলের অভ্যন্তরে বৈজ্ঞানিক সমাজতান্ত্রিকরা সাংঘাতিকভাবে সংখ্যাগরিষ্ঠ ছিল যা প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ বললেও ভুল হবে না। কিন্তু সাধারণ ছাত্র এবং প্রান্তিক জনতার কাছে তাদের আবেদনটি তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি। তার মূল কারণ ছিল আমাদের গণতান্ত্রিক মহলটির সুস্পষ্ট বক্তব্য ছিল যে, যেকোনো বৈপ্লবিক কর্মসূচি ও সাংঘর্ষিকতা সৃষ্টি করার আগে আমাদের একটি নির্বাচনের মাধ্যমে ম্যান্ডেট প্রয়োজন। এই ম্যান্ডেট ছাড়া আমাদের নির্দেশনা সর্বজনীনভাবে মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য তো হবেই না; বিশ্ব জনমতের কাছেও বিচ্ছিন্নতাবাদীর পরিকল্পনা হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সত্যিকার অর্থে নির্বাচনের ফলাফল ৩০০ আসনের মধ্যে ১৬৫টি আমাদের দিকে আসবে এই ধারণাটি বঙ্গবন্ধুরও ছিল না। এমনকি আমরা যারা প্রচণ্ডভাবে নির্বাচনী ম্যান্ডেটে বিশ্বাস করতাম তারাও ৩০০ আসনের মধ্যে সর্বোচ্চ ১৫১টি আসন পেলেই বর্তে যেতাম। এটা সারা পাকিস্তানের জন্য একটি বিস্ময়কর, অবিস্মরণীয়, অভাবিত বাঙালি ঐক্যের ফসল যে, দ্বি-জাতি তত্ত্বের মধ্য দিয়ে পাকিস্তানের সৃষ্টি সেই দ্বি-জাতি তত্ত্বের মাধ্যমে বাঙালি-বাংলাদেশের উদ্ভব। কারণ ঊনসত্তরের গণঅভ্যুত্থানের পর থেকে রাজনীতি খুবই স্পষ্ট রূপ নিয়ে নেয় এবং রাজনীতির ধারাও মারাত্মকভাবে স্পষ্ট রূপ নেয়। চলমান আন্দোলন সে সময় স্বায়ত্তশাসন ও স্বাধিকারের দাবি থেকে পুরোপুরি স্বাধীনতায় মোড় নেয় বাঙালি। সরাসরি স্লোগান উচ্চারিত হতে থাকে, তুমি কে, আমি কে, বাঙালি বাঙালি। পিণ্ডি না ঢাকা। ঢাকা-ঢাকা। আইয়ুব না মুজিব। মুজিব-মুজিব। পদ্মা মেঘনা যমুনা। তোমার আমার ঠিকানা। তুমি কে আমি কে। বাঙালি বাঙালি।
এটি আরেকটি স্পষ্ট ‘টু নেশন থিউরি’। পাকিস্তান সৃষ্টির প্রাক্কালে ধর্মের ভিত্তিতে যে দ্বি-জাতিতত্ত্বের জন্ম হয় সেই একইভাবে বাঙালি ও অবাঙালি এটাও দ্বি-জাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বাংলাদেশের স্বাধীনতার প্রধান উপাদান তৈরি করে। মাত্র ২২ বছরের মাথায় বাঙালি জাতীয় চেতনার ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এই চেতনাটি বাঙালিকে এতখানি ঐক্যবদ্ধ করে যে সত্তরের নির্বাচনের রায়টি তার অভাবনীয় বহিঃপ্রকাশ ঘটায়। এটা পাকিস্তানের সামরিক জান্তাতো বটেই একমাত্র ছাত্রলীগ ছাড়া মুসলিম লীগসহ পাকিস্তানভিত্তিক কোনো রাজনৈতিক দল কল্পনাও করতে পারেনি। এটা বিন্দুমাত্র আঁচ করতে পারলে সত্তরের নির্বাচনটি কখনোই তারা দিতো না। আটান্ন সালের সামরিক শাসন জারির মতো গায়ের জোরে, অস্ত্রের মুখে তারা পূর্ব বাংলাকে কলোনি বা শোষণের চারণ ভূমি বানিয়ে রাখতো। অন্যদিকে নির্বাচনে ম্যান্ডেট না পেলে স্বাধীনতার ডাক দেয়াও বঙ্গবন্ধুর পক্ষে সম্ভব হতো না এবং এদেশে একটি সর্বজনীন নিরঙ্কুশ মুক্তির আন্দোলনও গড়ে তোলা দুঃসাধ্য হয়ে দাঁড়াতো।
এ লেখায় ছাত্রলীগের দুটি গ্রুপের বিভাজন প্রাসঙ্গিকভাবে বারবার ফিরে আসে এই কারণে যারা বৈজ্ঞানিক সমাজতন্ত্রে বিশ্বাস করে পরবর্তীকালে জাসদ করেন তারা সত্তরের নির্বাচনে অংশগ্রহণে চরম বিরোধী ছিলেন। জনগণ প্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ গড়ার লক্ষ্যে নির্বাচন তাদের কাছে প্রহসন ছিল। নির্বাচনকে পাস কাটিয়ে সশস্ত্র বিপ্লবের মধ্যেই দেশের স্বাধীনতা অর্জনে তারা বদ্ধপরিকর ছিলেন। যদিও আমরা জানতাম কোনো অবস্থাতেই আমাদের প্রাণের দাবি তারা মেনে নেবে না। পূর্ব পাকিস্তানকে শোষণের চারণক্ষেত্র ও কলোনি হিসেবেই তারা ব্যবহার করবে তবুও ওদেরকে লড়তে হলে ওদের ঔদ্ধত্য, সীমাহীন লিপ্সাকে পরাজিত করতে হলে একটা গণম্যান্ডেট অত্যন্ত প্রয়োজন। যার কোনো বিকল্প ছিল না। আমাদের বিপ্লবী বন্ধুদের সঙ্গে একান্ত কথোপকথনে আমি বলতাম প্রয়োজনে সশস্ত্র বিপ্লবে আমরাও নামবো কিন্তু জনগণের ম্যান্ডেট ছাড়া এ ধরনের বিপ্লবের পদক্ষেপ আত্মঘাতী হবে এবং বিচ্ছিন্নতাবাদের কর্মসূচিতে রূপান্তরিত হয়ে অনৈক্যের অস্ত্রাঘাতে আমাদের ঐক্য তো বিনষ্ট হবেই এবং নানারকম খণ্ডিত অবয়বে আমরা চিহ্নিত হবো। আমাদের ঐক্য নিষ্প্রাণ রূপান্তরিত হয়ে প্রাণহীন সত্তায় আমাদের চেতনাবোধকে বহুধা বিভক্ত করবে।
নির্বাচনের ম্যান্ডেট এবং একমাত্র ম্যান্ডেটই আমাদের কাঙ্ক্ষিত বিজয়ের সুবর্ণ সৈকতে পৌঁছে দিতে পারে। মুক্তিযুদ্ধের আগে ও পরে রাজনৈতিক ধারা উচ্চারিত স্লোগান আমাদের বিভক্তির এসেন্স আজ যারা ঠাণ্ডা মাথায় বিশ্লেষণ করবেন তাদের নিরপেক্ষ পর্যালোচনায় এই সত্যটি প্রতিষ্ঠিত হবে। ১লা মার্চ থেকে শুরু করে ১৬ই ডিসেম্বর পর্যন্ত আমরা যেসব কর্মসূচি গ্রহণ করি না কেন তার অন্তর্নিহিত শক্তির উৎস ছিল সত্তরের নির্বাচনে ম্যান্ডেট। অন্যথায় তত্ত্ব ও তাত্ত্বিকতার কষাঘাতে জর্জরিত এবং নেতৃত্বের লড়াইয়ে পাশবিকতায় আমরা শুধু বহুধা খণ্ডিত হতাম না আমাদের মুক্তিযুদ্ধের স্বপ্ন চিরতরে নিঃশেষিত হয়ে যেত।
লেখক: স্বাধীন বাংলা ছাত্র সংগ্রাম পরিষদের কেন্দ্রীয় আহ্বায়ক
No comments