গণতন্ত্র, গণমাধ্যম ও দায়বদ্ধতা by রফিকুজজামান রুমান
গণতন্ত্র
ও গণমাধ্যম শব্দ দুটির মধ্যে ‘গণ’ বা জনগণের অংশগ্রহণ বুৎপত্তিগতভাবেই
নিবিড়ভাবে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। আবার গণতন্ত্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের এক ধরনের
সমান্তরাল মিথষ্ক্রিয়াও কার্যকর। অর্থাৎ গণতন্ত্রের জন্য যেমন গণমাধ্যম
দরকার, তেমনি গণমাধ্যমের আক্ষরিক অর্থে গণমাধ্যম হয়ে ওঠার জন্য দরকার
গণতন্ত্রের সঠিক চর্চা। যদিও মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের অন্যতম জাতির পিতা ও
তৃতীয় রাষ্ট্রপতি থমাস জেফারসন ১৭৮৭ সালেই বলে গেছেন, ‘were it left to me
to decide whether we should have a government without newspapers or
newspapers without a government, I should not hesitate a moment to
prefer the latter.’ অর্থাৎ গণতন্ত্রের/সরকারের চেয়েও গণমাধ্যম
গুরুত্বপূর্ণ। গুরুত্বপূর্ণ এই কারণে যে গণমাধ্যম থাকলে গণমানুষের স্বার্থ
থাকে। গণমানুষের স্বার্থ সুরক্ষিত হলে তার স্বাভাবিক প্রবণতাই গণতন্ত্রের
ভিত্তি তৈরি করে দেয়। এ কারণেই গণমাধ্যমকে রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ বলা হয়।
সে যা-ই হোক, গণতন্ত্র ও গণমাধ্যম দুটির ক্ষেত্রেই জনগণের অংশগ্রহণ বা
উপস্থাপন অবিচ্ছেদ্য মৌলিক উপাদান। যদিও বাংলাদেশের প্রায় তিন দশকের
গণতন্ত্রে এবং তার পথ ধরে বিকশিত গণমাধ্যমে জনগণের সত্যিকারের অংশগ্রহণ
কিংবা উপস্থাপন, বলা যেতে পারে, ইতিহাসের সবচেয়ে সংকটকাল অতিক্রম করছে।
গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করার মতো পরিবেশ আছে কিনা সেই বিতর্কে না গিয়ে গণমাধ্যমের দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে এবং সেটা কিছুটা নিরাপদ বৈকি! গণমাধ্যমের মূল কাজ হলো উপযুক্ত ও দরকারি তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করে গণমানুষের স্বার্থ রক্ষা করা। গণমানুষের স্বার্থকে পাহারা দিতে হয় বলেই গণমাধ্যমকে বলা হয় ওয়াচডগ বা প্রহরী। গণমাধ্যম কখনো কখনো গণমানুষের স্বার্থ রক্ষায় যথার্থ ভূমিকা প্রতিপালনে ব্যর্থ কিনা- সেটি বর্তমান সময়ের গণমাধ্যম আলোচনায় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ একটি ডিসকোর্স। জনগণের কথা না বলে বিশেষ শ্রেণি/গোষ্ঠীর কথা বলার কারণে গণমাধ্যমকে ‘শ্রেণিমাধ্যম’ বলেও এক ধরনের প্রপঞ্চ দাঁড় করিয়েছেন যোগাযোগ তাত্ত্বিকগণ। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখলে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। একটি বা একাধিক শ্রেণিগোষ্ঠীর উপস্থাপনার মধ্যেই অধিকাংশ সময় সীমিত থাকে গণমাধ্যমের কর্মপরিধি। সেটি অবশ্য একচেটিয়া গণমাধ্যমেরই সমস্যা নয়। অধিকাংশ মানুষের মনোজগতে বসবাস করা পুঁজিবাদী ভোগসর্বস্ব একটি অর্থব্যবস্থায় গণমাধ্যমকেও ‘মনোযোগ’ দিতে হয় অর্থবৃত্তের চক্রের দিকে। তাকে টিকে থাকতে হয়; টিকিয়ে রাখতে হয়। টিকে থাকতে হয় অর্থ দিয়ে; টিকিয়ে রাখতে হয় সেই অর্থের যোগানকে। ফলে ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়ায়ই অর্থবৃত্তের শ্রেণির কাছে গণমাধ্যমের এক ধরনের আনুগত্য তৈরি হয়। ক্রমান্বয়ে গণমাধ্যম হয়ে ওঠে শ্রেণিমাধ্যম। গণমাধ্যম তা-ই করে যা শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে যায়। সত্যিকারের ‘গণ’ সেখানে অনেকক্ষেত্রেই থাকে উপেক্ষিত। অধিকাংশ সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে থাকে রাজনীতির খবর। এমন রাজনীতি নয় যার সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ওবায়দুল কাদের কী বলেছেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কী বলেছেন (যা বলেন তা জনগণের বিষয় নয়; বরং দলীয় কাদা ছোড়াছুড়ি) এই হয় খবরের উপজীব্য। বিনোদন পাতাগুলো জুড়ে থাকে নায়ক নায়িকাদের এমন সব খবর, যার সঙ্গে জনগণের কোনো উপযোগিতামূলক সম্পর্ক তো থাকেই না; খবর হিসেবেই তা প্রশ্নবিদ্ধ। টেলিভিশনের খবরও এই শ্রেণিকাঠামো থেকে বের হতে পারেনি। সেখানকার জগৎ বরং আরো ঝলমলে! সেখানে ভীষণভাবে তারাদের (Star) আনাগোনা। জনগণের স্বার্থের বয়ানগুলো খুব সামান্যই হয় ‘অন এয়ার।’ খবরে নিউজ ভ্যালুকে পরাজিত করে ‘প্রটোকল’ ভ্যাল্যুই হয়ে ওঠে মূল মাণদণ্ড। ‘বড়দের’ ছোট বিষয়গুলোও খবর হয়; ‘ছোটদের’ বড় বিষয়গুলো থেকে যায় অন্ধকারে। অথচ এই ‘ছোট’রা অর্থাৎ জনগণই গণমাধ্যমের ‘গণ।’ জনস্বার্থের কতো বিষয় চাপা পড়ে যায় অগুরুত্বপূর্ণ/তাৎপর্যহীন অনেক এজেন্ডার কারণে! ক্রিকেটের একটি জয় প্রথম পাতার লিড নিউজ হয়, সাগর-রুনির হত্যা রহস্য নিয়ে কোনো অনুসন্ধানী খবর চোখে পড়ে না। শব্দ দূষণ, খাবারে ভেজাল, জনস্বাস্থ্য, নাগরিক বিড়ম্বনা- এমন অনেক জনসম্পৃক্ত বিষয়ে খবর হয় ইভেন্টভিত্তিক; নিয়মিত খবরের অংশ হয় না।
তথ্য প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি গণমাধ্যমকে অপরিমেয় গতি ও ব্যাপ্তি দিয়েছে যা তথ্য প্রাপ্তিকে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে করেছে সহজলভ্য ও ব্যাপকতর। কিন্তু তথ্য-বিস্ফোরণের এই সময়ে তথ্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তথ্যের উপযোগিতাবোধ। ফ্রেডরিক উইলিয়ামস তার কমিউনিকেশনস বইয়ে বলেছেন, ‘What we need is more wisdom, not more information.’ প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে সমাজ ও জনমানস গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তথ্য-উপযোগিতাবোধের বিবেচনা বাদ দিয়ে গণমাধ্যমকে জনগণের মাধ্যম বানানো কঠিন। তথ্য-উপযোগিতার বিবেচনাকে আরো গঠনমূলক ও কার্যকর করতে হবে। পাঠকের তথ্য-চাহিদা বিনির্মাণে আরো সজাগ ও সচেতন হতে হবে। একজন গণমাধ্যম কর্মীর মূল কাজ সেটিই। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এর প্রয়াত সংবাদিক ডেভিড ব্রোডার ১৯৮৭ সালেই বলে গেছেন, ‘All of us know as journalists that what we are mainly engaged in deciding is not what to put in but what to leave out.’ সাংবাদিক হিসেবে আমাদের কাজ হলো কোন বিষয়টি (খবর হিসেবে) রাখব তা নয়; বরং কোন বিষয়টি বাদ দিব সেই সিদ্ধান্ত নেয়া। কোনো সন্দেহ নেই, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে জনস্বার্থই মূল বিবেচনা। এই বিবেচনাবোধেই গণমাধ্যম সত্যিকারের জনগণের মাধ্যম হয়ে ওঠে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক মূল্যবোধ বিবেচনা বাদ দিয়ে একজন সাংবাদিক খবর নির্ধারণ করতে পারেন না। সমাজের সামষ্টিক উপযোগিতা বিবেচনায় নিয়ে খবর নির্ধারণের/বাছাইয়ের ‘বাস্তবতা’ উপলব্ধি করতে পারা একজন সংবাদকর্মীর জন্য অপরিহার্য।
২০১৭ সালে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট দারুণ একটি স্লোগান নির্ধারণ করেছে। স্লোগানটি হলো ‘অন্ধকারে মরে যায় গণতন্ত্র (Democracy dies in darkness)।’ অন্ধকারে গণতন্ত্র মরে যায়, তার মানে হলো- জনগণকে অন্ধকারে না রাখার দায়িত্ব গণমাধ্যমের। অনেক বাধার মধ্যেও গণমাধ্যমকে এই আলো জ্বালাবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণকে অন্ধকারে রাখার উদাহরণ অনেক। বিদেশি রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তির পরে চুক্তি হয়। জনগণ সেই চুক্তির অন্তর্নিহিত ‘দেনা-পাওনার’ সামান্যই জানতে পারে। সুন্দরবনের রামপালে গড়ে ওঠে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতো বিরোধিতার পরেও রামপাল থেকে সড়ে না আসার কারণ সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনার মূলে কে বা কারা আজও জানা যায়নি। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে অনেক চাপের মুখে তদন্ত করা হলেও কালবৈশাখী ঝড়ের অন্ধকারের মতোই তার প্রতিবেদন হারিয়ে গেছে কোনো এক অন্ধকারে। আজও তা প্রকাশ করা হয়নি। নারায়ণগঞ্জের কিশোর ত্বকীকে কারা হত্যা করেছে আজও ধোঁয়াশা। এই অন্ধকার এদেশের গণমাধ্যম পরিষ্কার করতে পারেনি। এমন অন্ধকারে তাই গণতন্ত্রও পরিপূর্ণ জনগণের তন্ত্র হয়ে ওঠে না।
গণতন্ত্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্কটা একই সঙ্গে পরিপূরক এবং মুখোমুখি। বিষয়টি জটিল বলে আশ্রয় নিতে হয় কৌশলের। তবে সব শেষে জনস্বার্থই মুখ্য। গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যম- দুটোরই দায়বদ্ধতা তাই জনগণের কাছেই।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক
ইমেইল: rafique.ruman@gmail.com
গণতন্ত্র নিয়ে আলোচনা করার মতো পরিবেশ আছে কিনা সেই বিতর্কে না গিয়ে গণমাধ্যমের দিকে দৃষ্টি দেয়া যেতে পারে এবং সেটা কিছুটা নিরাপদ বৈকি! গণমাধ্যমের মূল কাজ হলো উপযুক্ত ও দরকারি তথ্যের প্রবাহ নিশ্চিত করে গণমানুষের স্বার্থ রক্ষা করা। গণমানুষের স্বার্থকে পাহারা দিতে হয় বলেই গণমাধ্যমকে বলা হয় ওয়াচডগ বা প্রহরী। গণমাধ্যম কখনো কখনো গণমানুষের স্বার্থ রক্ষায় যথার্থ ভূমিকা প্রতিপালনে ব্যর্থ কিনা- সেটি বর্তমান সময়ের গণমাধ্যম আলোচনায় বেশ তাৎপর্যপূর্ণ একটি ডিসকোর্স। জনগণের কথা না বলে বিশেষ শ্রেণি/গোষ্ঠীর কথা বলার কারণে গণমাধ্যমকে ‘শ্রেণিমাধ্যম’ বলেও এক ধরনের প্রপঞ্চ দাঁড় করিয়েছেন যোগাযোগ তাত্ত্বিকগণ। বাংলাদেশের গণমাধ্যমের দিকে সতর্ক দৃষ্টি রাখলে এর সত্যতা খুঁজে পাওয়া যায়। একটি বা একাধিক শ্রেণিগোষ্ঠীর উপস্থাপনার মধ্যেই অধিকাংশ সময় সীমিত থাকে গণমাধ্যমের কর্মপরিধি। সেটি অবশ্য একচেটিয়া গণমাধ্যমেরই সমস্যা নয়। অধিকাংশ মানুষের মনোজগতে বসবাস করা পুঁজিবাদী ভোগসর্বস্ব একটি অর্থব্যবস্থায় গণমাধ্যমকেও ‘মনোযোগ’ দিতে হয় অর্থবৃত্তের চক্রের দিকে। তাকে টিকে থাকতে হয়; টিকিয়ে রাখতে হয়। টিকে থাকতে হয় অর্থ দিয়ে; টিকিয়ে রাখতে হয় সেই অর্থের যোগানকে। ফলে ‘স্বাভাবিক’ প্রক্রিয়ায়ই অর্থবৃত্তের শ্রেণির কাছে গণমাধ্যমের এক ধরনের আনুগত্য তৈরি হয়। ক্রমান্বয়ে গণমাধ্যম হয়ে ওঠে শ্রেণিমাধ্যম। গণমাধ্যম তা-ই করে যা শ্রেণিস্বার্থের পক্ষে যায়। সত্যিকারের ‘গণ’ সেখানে অনেকক্ষেত্রেই থাকে উপেক্ষিত। অধিকাংশ সংবাদপত্রের প্রথম পাতা জুড়ে থাকে রাজনীতির খবর। এমন রাজনীতি নয় যার সঙ্গে জনগণের সম্পৃক্ততা রয়েছে। ওবায়দুল কাদের কী বলেছেন, মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর কী বলেছেন (যা বলেন তা জনগণের বিষয় নয়; বরং দলীয় কাদা ছোড়াছুড়ি) এই হয় খবরের উপজীব্য। বিনোদন পাতাগুলো জুড়ে থাকে নায়ক নায়িকাদের এমন সব খবর, যার সঙ্গে জনগণের কোনো উপযোগিতামূলক সম্পর্ক তো থাকেই না; খবর হিসেবেই তা প্রশ্নবিদ্ধ। টেলিভিশনের খবরও এই শ্রেণিকাঠামো থেকে বের হতে পারেনি। সেখানকার জগৎ বরং আরো ঝলমলে! সেখানে ভীষণভাবে তারাদের (Star) আনাগোনা। জনগণের স্বার্থের বয়ানগুলো খুব সামান্যই হয় ‘অন এয়ার।’ খবরে নিউজ ভ্যালুকে পরাজিত করে ‘প্রটোকল’ ভ্যাল্যুই হয়ে ওঠে মূল মাণদণ্ড। ‘বড়দের’ ছোট বিষয়গুলোও খবর হয়; ‘ছোটদের’ বড় বিষয়গুলো থেকে যায় অন্ধকারে। অথচ এই ‘ছোট’রা অর্থাৎ জনগণই গণমাধ্যমের ‘গণ।’ জনস্বার্থের কতো বিষয় চাপা পড়ে যায় অগুরুত্বপূর্ণ/তাৎপর্যহীন অনেক এজেন্ডার কারণে! ক্রিকেটের একটি জয় প্রথম পাতার লিড নিউজ হয়, সাগর-রুনির হত্যা রহস্য নিয়ে কোনো অনুসন্ধানী খবর চোখে পড়ে না। শব্দ দূষণ, খাবারে ভেজাল, জনস্বাস্থ্য, নাগরিক বিড়ম্বনা- এমন অনেক জনসম্পৃক্ত বিষয়ে খবর হয় ইভেন্টভিত্তিক; নিয়মিত খবরের অংশ হয় না।
তথ্য প্রযুক্তির বিস্ময়কর অগ্রগতি গণমাধ্যমকে অপরিমেয় গতি ও ব্যাপ্তি দিয়েছে যা তথ্য প্রাপ্তিকে অতীতের যে কোনো সময়ের চেয়ে করেছে সহজলভ্য ও ব্যাপকতর। কিন্তু তথ্য-বিস্ফোরণের এই সময়ে তথ্যের চেয়েও গুরুত্বপূর্ণ হলো তথ্যের উপযোগিতাবোধ। ফ্রেডরিক উইলিয়ামস তার কমিউনিকেশনস বইয়ে বলেছেন, ‘What we need is more wisdom, not more information.’ প্রাসঙ্গিক ও অর্থবহ তথ্য সরবরাহ নিশ্চিত করা না গেলে সমাজ ও জনমানস গঠনে গণমাধ্যমের ভূমিকা প্রশ্নবিদ্ধ হয়। তথ্য-উপযোগিতাবোধের বিবেচনা বাদ দিয়ে গণমাধ্যমকে জনগণের মাধ্যম বানানো কঠিন। তথ্য-উপযোগিতার বিবেচনাকে আরো গঠনমূলক ও কার্যকর করতে হবে। পাঠকের তথ্য-চাহিদা বিনির্মাণে আরো সজাগ ও সচেতন হতে হবে। একজন গণমাধ্যম কর্মীর মূল কাজ সেটিই। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন পোস্ট এর প্রয়াত সংবাদিক ডেভিড ব্রোডার ১৯৮৭ সালেই বলে গেছেন, ‘All of us know as journalists that what we are mainly engaged in deciding is not what to put in but what to leave out.’ সাংবাদিক হিসেবে আমাদের কাজ হলো কোন বিষয়টি (খবর হিসেবে) রাখব তা নয়; বরং কোন বিষয়টি বাদ দিব সেই সিদ্ধান্ত নেয়া। কোনো সন্দেহ নেই, এই সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে জনস্বার্থই মূল বিবেচনা। এই বিবেচনাবোধেই গণমাধ্যম সত্যিকারের জনগণের মাধ্যম হয়ে ওঠে। সমাজ ও রাষ্ট্রের সামগ্রিক মূল্যবোধ বিবেচনা বাদ দিয়ে একজন সাংবাদিক খবর নির্ধারণ করতে পারেন না। সমাজের সামষ্টিক উপযোগিতা বিবেচনায় নিয়ে খবর নির্ধারণের/বাছাইয়ের ‘বাস্তবতা’ উপলব্ধি করতে পারা একজন সংবাদকর্মীর জন্য অপরিহার্য।
২০১৭ সালে বিশ্বের অন্যতম প্রভাবশালী সংবাদপত্র দ্য ওয়াশিংটন পোস্ট দারুণ একটি স্লোগান নির্ধারণ করেছে। স্লোগানটি হলো ‘অন্ধকারে মরে যায় গণতন্ত্র (Democracy dies in darkness)।’ অন্ধকারে গণতন্ত্র মরে যায়, তার মানে হলো- জনগণকে অন্ধকারে না রাখার দায়িত্ব গণমাধ্যমের। অনেক বাধার মধ্যেও গণমাধ্যমকে এই আলো জ্বালাবার প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে। কিন্তু বাংলাদেশের জনগণকে অন্ধকারে রাখার উদাহরণ অনেক। বিদেশি রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানগুলোর সঙ্গে চুক্তির পরে চুক্তি হয়। জনগণ সেই চুক্তির অন্তর্নিহিত ‘দেনা-পাওনার’ সামান্যই জানতে পারে। সুন্দরবনের রামপালে গড়ে ওঠে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। এতো বিরোধিতার পরেও রামপাল থেকে সড়ে না আসার কারণ সম্পর্কে জনগণ অন্ধকারে। বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে রিজার্ভ চুরির ঘটনার মূলে কে বা কারা আজও জানা যায়নি। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি নিয়ে অনেক চাপের মুখে তদন্ত করা হলেও কালবৈশাখী ঝড়ের অন্ধকারের মতোই তার প্রতিবেদন হারিয়ে গেছে কোনো এক অন্ধকারে। আজও তা প্রকাশ করা হয়নি। নারায়ণগঞ্জের কিশোর ত্বকীকে কারা হত্যা করেছে আজও ধোঁয়াশা। এই অন্ধকার এদেশের গণমাধ্যম পরিষ্কার করতে পারেনি। এমন অন্ধকারে তাই গণতন্ত্রও পরিপূর্ণ জনগণের তন্ত্র হয়ে ওঠে না।
গণতন্ত্রের সঙ্গে গণমাধ্যমের সম্পর্কটা একই সঙ্গে পরিপূরক এবং মুখোমুখি। বিষয়টি জটিল বলে আশ্রয় নিতে হয় কৌশলের। তবে সব শেষে জনস্বার্থই মুখ্য। গণতন্ত্র এবং গণমাধ্যম- দুটোরই দায়বদ্ধতা তাই জনগণের কাছেই।
লেখক: বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক ও কলাম লেখক
ইমেইল: rafique.ruman@gmail.com
No comments