কে জানত এ বিদায় হবে অনন্তকালের! by ইমাম হোসাইন মামুন
মানুষের প্রতিটি মুহূর্তই শেষ মুহূর্ত। কে কখন চলে যাবে না ফেরার দেশে কেউই বলতে পারে না। সে চিরন্তন সত্য বাণীকে মেনে নিয়ে চলে গেলেন একই মেডিকেল কলেজের ১১ জন শিক্ষার্থীসহ ৫০টি তাজা প্রাণ।
এক বই প্রকাশের সর্বশেষ কাজে শেষবার যখন ঢাকা যাচ্ছি, যাওয়ার আগে রুমমেটকে দেখিয়ে টাকাটা আমার ড্রয়ারে রেখে বললাম- ‘ঢাকা পৌঁছে অ্যাকাউন্ট নম্বর দিলে সেখানে টাকাটা পাঠিয়ে দিস। সড়ক দুর্ঘটনায় আমি মারা গেলেও টাকাটা প্রকাশক বরাবর পৌঁছে দিস। তাতে অন্তত বই প্রকাশ থামবে না। টাকাসহ কিছু হয়ে গেলে হয়তো টাকাটা হারাব। এমনিতেই এ টাকা আমার না। বন্ধুর কাছ থেকে ধার নেয়া। আমি মরে গেলেও আমার নামটা ছাপার অক্ষরে বেঁচে থাকবে আমার প্রিয়জনদের হাতে’। সত্যিকারার্থেই টাকা আমি পকেটে করে নেইনি। ঢাকা পৌঁছে আরেক ছোট ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে নিয়েছি ১৯ হাজার টাকা। রুমমেট পাঠিয়েছে নির্দেশনা মোতাবেক। এভাবে প্রতিবার যখন সিলেট থেকে ঢাকা যাই, হোস্টেল থেকে বের হওয়ার আগে চারদিক একবার দেখে যাই। হতে পারে এ দেখাই শেষ দেখা। হোস্টেলের ডাইনিং-ক্যান্টিনে বকেয়া বিল থাকলে তা পরিশোধ করে যাই পাই পাই করে। ক্যান্টিনে আমার বাকি হিসাব খাতায় লিখা হয় না। আমি মুখে যে হিসাব বলি তাই নির্দ্বিধায় মেনে নেন ক্যান্টিনচালক। কখনো হিসেব সন্দেহভাজন মনে হলে ২০-৩০ টাকা বেশি দিয়ে বলি- 'ভাই, আমার কেন জানি মনে হয় টাকা একটু বেশ-কম হতে পারে। এই নিন, এই টাকাটাও রাখুন। তবুও আপনার কাছে হিসেবে গরমিল মনে হলে বলুন, আরো দেব'। আমার কথা শুনে ক্যান্টিনচালক হাসেন, হাসতে হাসতে বলেন - ‘এমনভাবে বলছেন মনে হয় আর ফিরবেন না সিলেটে! যান মিয়া। কিসের পাওনা? হিসাবের বাইরে দিয়েও আর কিসের দাবি? আমার পক্ষ থেকে আর কোনো দাবি নেই। আপনি বেশি দিছেন। আপনিও কোনো দাবি রাইখেন না। আল্লাহর হাওলা’। আমি শেষবারের মতো তাকেও একবার দেখে যাই। হতে পারে এ দেনাই শেষ দেনা।
দুই বাবার সঙ্গে আমি যেসব কারণে রাগ দেখাই তার অন্যতম কারণ- বাসে উঠলে কত নম্বর সিটে বসেছি? জানালার পাশে না ভেতরে সিটে? বাসের নম্বর কত? কোর্স নম্বর কত? ট্রেনে উঠলে কত নম্বর বগি, পাশে কে বসেছে? তার বাড়ি কই? তিনি কী করেন? ইত্যাদি প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন আমায়। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে বলি- শুধু শুধু এত চিন্তা করবেন না তো! মরে গেলে কফিন পৌঁছে যাবে আমার স্থায়ী ঠিকানায়। অর্ধ্বমৃত থাকলে আহত-শরীর পৌঁছে যাবে নিকটস্থ কোনো হাসপাতালে। পৃথিবী এখনও মানবশূন্য হয়ে যায়নি যে, আহত কাউকে দেখেও কেউ পাশ কেটে চলে যাবে। ঢাকা থেকে সিলেট ফেরার পথে একবার আমাদের সামনের বাসটি একটি ইটবোঝাই স্থির ট্রাকের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লেগে পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। আহতদের বের করেছে এলাকাবাসীরাই। কেউ লুঙ্গি গিট্টু দিয়ে, কেউ প্যান্ট ভাঁজ করে রক্তাক্ত শরীরগুলো বাস থেকে বের করেছে। রাস্তার পাশের বাড়ির মহিলারা পানি আর পাটি নিয়ে এসেছে আহতদের জন্য। সে বাসে আমার মেডিকেলের এক সহপাঠীও ছিল। তার কিছু হয়নি। শুধু সামান্য পা কেটেছে কাচের আঘাতে। তার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম। সে বাসে উঠলে আমিও থাকতে পারতাম নিহতের মিছিলে।
তিন আমার চাচা দুজন। দুজনই প্রবাসী। আমাদের ওই অঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারই সচ্ছল জীবনযাপন করে থাকে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে। কারো ভাই, কারো চাচা, কারো বাপ। প্রতিটি ঘরের কেউ না কেউ প্রবাসে আছেই। ছোটবেলায় দেখতাম চাচারা ছুটি শেষে দেশত্যাগ করতে গিয়ে একধরনের মুমূর্ষু পরিস্থিতির সৃষ্টি করতেন। কান্নাকাটি করে মূর্ছাগত হতেন দাদি। সবার কাছে মাপ-শাপ নিয়ে একধরনের আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করতেন সবাই। ছোট মাথায় তখন ঢুকত না, প্লেনে করে বিদেশ যাবে এতে কান্নাকাটির কী আছে? এত আনন্দেরই। অনেক দিন দেখা হবে না এজন্য হয়তো সামান্য মন খারাপ হতে পারে! একটা সময় যখন বুঝ হয়েছে- সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ফেরার সম্ভাবনা থাকলেও বিমান দুর্ঘটনায় ফেরার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তখন থেকে আমিও যোগ দিয়েছে আশাহতের মিছিলে। মেঝো চাচাকে আমি বেশি ভয় পেতাম ছোটবেলায়। তিনিও আমায় একটু-আধটু শাসন করতেন। সারা দিন তার চোখের আড়ালে থাকতে চাইলেও বিদায়বেলা ঠিকই তার কোলে উঠে কান্নাজুড়ে দিতাম। হতে পারে এ কান্নাই শেষ কান্না চাচার চোখে। বড় ভাই যখন ওমান যাচ্ছেন তখন আমি দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। ১৮ পার হওয়া ওই আমি এলিফ্যান্ট রোডে সিএনজি থেকে নেমে ভাইকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম। হতে পারে এ কাঁদাই দুই সহোদরের শেষ কাঁদা।
চার গতকাল বিকালে ঢাকা থেকে নেপালগামী বিমান দুর্ঘটনার খবর যখন শুনি তখন বুকটা সামান্য ভারি হয়ে ওঠে। আহারে জীবন! কারো না কারো জীবনের চাকা থামবে এ ঘটনায়। বিধাতার ইচ্ছা না হলে কোনো যাত্রীরই ফেরার সম্ভাবনা নেই। একটু পর যখন শুনি ওই বিমানে ১৩ জন শিক্ষার্থী আছে যারা জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ থেকে এবারের চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষা শেষ করে মাতৃভূমিতে ফিরছে। ফিরছে পিতৃভূমিতে। মাকে আর জড়িয়ে ধরা হলো না। বাবার বুকে আর যাওয়া হলো না। বাবা-মা ঠিকই জড়িয়ে ধরবেন ছেলমেয়েকে। হয়তো কফিনের ওপর থেকে। অশ্রু গড়িয়ে পড়বে কফিনের ওপরই। নিহত-দগ্ধ দেহ নীরবে সয়ে যাবে স্বজনের আর্তনাদ। তাদের পরীক্ষা দুদিন আগে শেষ হলো মাত্র। খাতাও দেখা শুরু হয়নি হয়তোবা। পরীক্ষক যখন খাতা দেখতে গিয়ে জানবেন এ খাতায় লেখা হাতটি আর ভূখণ্ডে নেই। তার চোখ হতেও হয়তো দু-ফোঁটা উষ্ণজল গড়িয়ে পড়বে খাতার ওপর। আমাদের সঙ্গেও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত কয়েকজন নেপালি শিক্ষার্থী আছে। আমার দেখা অন্যতম সেরা মেধাবীদের একটি জাতি এ নেপালিরা। মেডিকেলের কষ্টসাধ্য পড়াশোনাকে তারা ঠিকই জয় করে নিয়েছ। আমরা যেখানে পাস করতে হিমশিম খাই, তারা সেখানে অনার্স নম্বরকে করে নিয়েছে মামুলি ব্যাপার। ১১টি মেধাবী প্রাণ ঝরে গেল। গোপালগঞ্জ শেখা সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীও ছিল। নাম পিয়াস রায়। সর্বশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসে মাতৃভূমিকে টাটা জানিয়েছিলেন মাত্র পাঁচ দিনের জন্য। কে জানত, এ বিদায় হবে অনন্তকালের! চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষা শেষ করে নেপাল যাচ্ছেন বেড়াতে। তিনিও আর নেই। তার পরীক্ষার ফলাফল আসবে। পাস করে গেলে নামের পাশে ডাক্তার লেখা হবে। তার আগে যুক্ত হবে ‘লেইট’। কুমুদিনি উইমেন্স মেডিকেল কলেজে পঞ্চম বর্ষে অধ্যয়নরত নেপালি শিক্ষার্থী শ্রেয়া ঝা। বছরখানেক পর বাবা-মার কাছে ফিরছিল। সে ফিরেছেও দেশে। তবে লাশ হয়ে। ওই বিমানে কর্মরত বাংলাদেশি কো-পাইলট প্রিথুলা রশিদও আর নেই। মেয়ে হয়ে জন্মানো এখনও অনেক সমাজে অপরাধ। সেখানে জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখে এত দূর এলেন। ফিরবেন লাশ হয়ে। রংপুর মেডিকেল কলেজের ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী, বর্তমানে ওই মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালেরই সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. শাওন সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছেন নেপালে। চল্লিশ শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে আহত অবস্থায় তিনি আইসিউতে ভর্তি আছেন। ভাগ্যসুপ্রসন্ন না হলেও হয়তো তিনিও পাড়ি জমাতেন স্ত্রীর সঙ্গে না ফেরার দেশে। ইউএস-বাংলা ফ্লাইটের ৭১ জন যাত্রীর মধ্যে ৫১ জন আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকা ২১ জনের ভেতরও কয়েকজন হয়তো পাড়ি জমাবেন সংখ্যাগরিষ্ঠের মিছিলে। মৃত্যুটা এমনই। জীবনটা এমনই। নিশ্চিত গন্তব্যে অনিশ্চিত যাত্রা। এবার থেকে বাবা সিট নম্বর, বাসের নম্বর, বগি নম্বর ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলে আর বিরক্ত হব না। সন্তানের লাশটা নিশ্চিন্তে পাওয়ার অধিকার সব বাবাদের আছে।
লেখক: ইমাম হোসাইন মামুন, শিক্ষার্থী, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।
কন্টেন্ট ক্রেডিট: মেডিভয়েস
এক বই প্রকাশের সর্বশেষ কাজে শেষবার যখন ঢাকা যাচ্ছি, যাওয়ার আগে রুমমেটকে দেখিয়ে টাকাটা আমার ড্রয়ারে রেখে বললাম- ‘ঢাকা পৌঁছে অ্যাকাউন্ট নম্বর দিলে সেখানে টাকাটা পাঠিয়ে দিস। সড়ক দুর্ঘটনায় আমি মারা গেলেও টাকাটা প্রকাশক বরাবর পৌঁছে দিস। তাতে অন্তত বই প্রকাশ থামবে না। টাকাসহ কিছু হয়ে গেলে হয়তো টাকাটা হারাব। এমনিতেই এ টাকা আমার না। বন্ধুর কাছ থেকে ধার নেয়া। আমি মরে গেলেও আমার নামটা ছাপার অক্ষরে বেঁচে থাকবে আমার প্রিয়জনদের হাতে’। সত্যিকারার্থেই টাকা আমি পকেটে করে নেইনি। ঢাকা পৌঁছে আরেক ছোট ভাইয়ের অ্যাকাউন্টে নিয়েছি ১৯ হাজার টাকা। রুমমেট পাঠিয়েছে নির্দেশনা মোতাবেক। এভাবে প্রতিবার যখন সিলেট থেকে ঢাকা যাই, হোস্টেল থেকে বের হওয়ার আগে চারদিক একবার দেখে যাই। হতে পারে এ দেখাই শেষ দেখা। হোস্টেলের ডাইনিং-ক্যান্টিনে বকেয়া বিল থাকলে তা পরিশোধ করে যাই পাই পাই করে। ক্যান্টিনে আমার বাকি হিসাব খাতায় লিখা হয় না। আমি মুখে যে হিসাব বলি তাই নির্দ্বিধায় মেনে নেন ক্যান্টিনচালক। কখনো হিসেব সন্দেহভাজন মনে হলে ২০-৩০ টাকা বেশি দিয়ে বলি- 'ভাই, আমার কেন জানি মনে হয় টাকা একটু বেশ-কম হতে পারে। এই নিন, এই টাকাটাও রাখুন। তবুও আপনার কাছে হিসেবে গরমিল মনে হলে বলুন, আরো দেব'। আমার কথা শুনে ক্যান্টিনচালক হাসেন, হাসতে হাসতে বলেন - ‘এমনভাবে বলছেন মনে হয় আর ফিরবেন না সিলেটে! যান মিয়া। কিসের পাওনা? হিসাবের বাইরে দিয়েও আর কিসের দাবি? আমার পক্ষ থেকে আর কোনো দাবি নেই। আপনি বেশি দিছেন। আপনিও কোনো দাবি রাইখেন না। আল্লাহর হাওলা’। আমি শেষবারের মতো তাকেও একবার দেখে যাই। হতে পারে এ দেনাই শেষ দেনা।
দুই বাবার সঙ্গে আমি যেসব কারণে রাগ দেখাই তার অন্যতম কারণ- বাসে উঠলে কত নম্বর সিটে বসেছি? জানালার পাশে না ভেতরে সিটে? বাসের নম্বর কত? কোর্স নম্বর কত? ট্রেনে উঠলে কত নম্বর বগি, পাশে কে বসেছে? তার বাড়ি কই? তিনি কী করেন? ইত্যাদি প্রশ্নবানে জর্জরিত করেন আমায়। মাঝেমধ্যে বিরক্ত হয়ে বলি- শুধু শুধু এত চিন্তা করবেন না তো! মরে গেলে কফিন পৌঁছে যাবে আমার স্থায়ী ঠিকানায়। অর্ধ্বমৃত থাকলে আহত-শরীর পৌঁছে যাবে নিকটস্থ কোনো হাসপাতালে। পৃথিবী এখনও মানবশূন্য হয়ে যায়নি যে, আহত কাউকে দেখেও কেউ পাশ কেটে চলে যাবে। ঢাকা থেকে সিলেট ফেরার পথে একবার আমাদের সামনের বাসটি একটি ইটবোঝাই স্থির ট্রাকের সঙ্গে সজোরে ধাক্কা লেগে পাঁচজন ঘটনাস্থলেই নিহত হয়। আহতদের বের করেছে এলাকাবাসীরাই। কেউ লুঙ্গি গিট্টু দিয়ে, কেউ প্যান্ট ভাঁজ করে রক্তাক্ত শরীরগুলো বাস থেকে বের করেছে। রাস্তার পাশের বাড়ির মহিলারা পানি আর পাটি নিয়ে এসেছে আহতদের জন্য। সে বাসে আমার মেডিকেলের এক সহপাঠীও ছিল। তার কিছু হয়নি। শুধু সামান্য পা কেটেছে কাচের আঘাতে। তার জায়গায় আমিও থাকতে পারতাম। সে বাসে উঠলে আমিও থাকতে পারতাম নিহতের মিছিলে।
তিন আমার চাচা দুজন। দুজনই প্রবাসী। আমাদের ওই অঞ্চলের অধিকাংশ পরিবারই সচ্ছল জীবনযাপন করে থাকে বৈদেশিক মুদ্রা দিয়ে। কারো ভাই, কারো চাচা, কারো বাপ। প্রতিটি ঘরের কেউ না কেউ প্রবাসে আছেই। ছোটবেলায় দেখতাম চাচারা ছুটি শেষে দেশত্যাগ করতে গিয়ে একধরনের মুমূর্ষু পরিস্থিতির সৃষ্টি করতেন। কান্নাকাটি করে মূর্ছাগত হতেন দাদি। সবার কাছে মাপ-শাপ নিয়ে একধরনের আবেগঘন পরিবেশের সৃষ্টি করতেন সবাই। ছোট মাথায় তখন ঢুকত না, প্লেনে করে বিদেশ যাবে এতে কান্নাকাটির কী আছে? এত আনন্দেরই। অনেক দিন দেখা হবে না এজন্য হয়তো সামান্য মন খারাপ হতে পারে! একটা সময় যখন বুঝ হয়েছে- সড়ক দুর্ঘটনায় আহত হয়ে ফেরার সম্ভাবনা থাকলেও বিমান দুর্ঘটনায় ফেরার সম্ভাবনা খুবই ক্ষীণ। তখন থেকে আমিও যোগ দিয়েছে আশাহতের মিছিলে। মেঝো চাচাকে আমি বেশি ভয় পেতাম ছোটবেলায়। তিনিও আমায় একটু-আধটু শাসন করতেন। সারা দিন তার চোখের আড়ালে থাকতে চাইলেও বিদায়বেলা ঠিকই তার কোলে উঠে কান্নাজুড়ে দিতাম। হতে পারে এ কান্নাই শেষ কান্না চাচার চোখে। বড় ভাই যখন ওমান যাচ্ছেন তখন আমি দ্বাদশ শ্রেণিতে অধ্যয়নরত। ১৮ পার হওয়া ওই আমি এলিফ্যান্ট রোডে সিএনজি থেকে নেমে ভাইকে জড়িয়ে ধরে অনেক কেঁদেছিলাম। হতে পারে এ কাঁদাই দুই সহোদরের শেষ কাঁদা।
চার গতকাল বিকালে ঢাকা থেকে নেপালগামী বিমান দুর্ঘটনার খবর যখন শুনি তখন বুকটা সামান্য ভারি হয়ে ওঠে। আহারে জীবন! কারো না কারো জীবনের চাকা থামবে এ ঘটনায়। বিধাতার ইচ্ছা না হলে কোনো যাত্রীরই ফেরার সম্ভাবনা নেই। একটু পর যখন শুনি ওই বিমানে ১৩ জন শিক্ষার্থী আছে যারা জালালাবাদ রাগীব রাবেয়া মেডিকেল কলেজ থেকে এবারের চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষা শেষ করে মাতৃভূমিতে ফিরছে। ফিরছে পিতৃভূমিতে। মাকে আর জড়িয়ে ধরা হলো না। বাবার বুকে আর যাওয়া হলো না। বাবা-মা ঠিকই জড়িয়ে ধরবেন ছেলমেয়েকে। হয়তো কফিনের ওপর থেকে। অশ্রু গড়িয়ে পড়বে কফিনের ওপরই। নিহত-দগ্ধ দেহ নীরবে সয়ে যাবে স্বজনের আর্তনাদ। তাদের পরীক্ষা দুদিন আগে শেষ হলো মাত্র। খাতাও দেখা শুরু হয়নি হয়তোবা। পরীক্ষক যখন খাতা দেখতে গিয়ে জানবেন এ খাতায় লেখা হাতটি আর ভূখণ্ডে নেই। তার চোখ হতেও হয়তো দু-ফোঁটা উষ্ণজল গড়িয়ে পড়বে খাতার ওপর। আমাদের সঙ্গেও সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজে অধ্যয়নরত কয়েকজন নেপালি শিক্ষার্থী আছে। আমার দেখা অন্যতম সেরা মেধাবীদের একটি জাতি এ নেপালিরা। মেডিকেলের কষ্টসাধ্য পড়াশোনাকে তারা ঠিকই জয় করে নিয়েছ। আমরা যেখানে পাস করতে হিমশিম খাই, তারা সেখানে অনার্স নম্বরকে করে নিয়েছে মামুলি ব্যাপার। ১১টি মেধাবী প্রাণ ঝরে গেল। গোপালগঞ্জ শেখা সায়েরা খাতুন মেডিকেল কলেজের এক বাংলাদেশি শিক্ষার্থীও ছিল। নাম পিয়াস রায়। সর্বশেষ ফেসবুক স্ট্যাটাসে মাতৃভূমিকে টাটা জানিয়েছিলেন মাত্র পাঁচ দিনের জন্য। কে জানত, এ বিদায় হবে অনন্তকালের! চূড়ান্ত পেশাগত পরীক্ষা শেষ করে নেপাল যাচ্ছেন বেড়াতে। তিনিও আর নেই। তার পরীক্ষার ফলাফল আসবে। পাস করে গেলে নামের পাশে ডাক্তার লেখা হবে। তার আগে যুক্ত হবে ‘লেইট’। কুমুদিনি উইমেন্স মেডিকেল কলেজে পঞ্চম বর্ষে অধ্যয়নরত নেপালি শিক্ষার্থী শ্রেয়া ঝা। বছরখানেক পর বাবা-মার কাছে ফিরছিল। সে ফিরেছেও দেশে। তবে লাশ হয়ে। ওই বিমানে কর্মরত বাংলাদেশি কো-পাইলট প্রিথুলা রশিদও আর নেই। মেয়ে হয়ে জন্মানো এখনও অনেক সমাজে অপরাধ। সেখানে জীবনযুদ্ধে বিজয়ী হয়ে পাইলট হওয়ার স্বপ্ন দেখে এত দূর এলেন। ফিরবেন লাশ হয়ে। রংপুর মেডিকেল কলেজের ৩৩তম ব্যাচের শিক্ষার্থী, বর্তমানে ওই মেডিকেলে কলেজ হাসপাতালেরই সার্জারি বিভাগের সহকারী রেজিস্ট্রার ডা. শাওন সস্ত্রীক বেড়াতে গিয়েছেন নেপালে। চল্লিশ শতাংশ পোড়া শরীর নিয়ে আহত অবস্থায় তিনি আইসিউতে ভর্তি আছেন। ভাগ্যসুপ্রসন্ন না হলেও হয়তো তিনিও পাড়ি জমাতেন স্ত্রীর সঙ্গে না ফেরার দেশে। ইউএস-বাংলা ফ্লাইটের ৭১ জন যাত্রীর মধ্যে ৫১ জন আর বেঁচে নেই। বেঁচে থাকা ২১ জনের ভেতরও কয়েকজন হয়তো পাড়ি জমাবেন সংখ্যাগরিষ্ঠের মিছিলে। মৃত্যুটা এমনই। জীবনটা এমনই। নিশ্চিত গন্তব্যে অনিশ্চিত যাত্রা। এবার থেকে বাবা সিট নম্বর, বাসের নম্বর, বগি নম্বর ইত্যাদি জিজ্ঞেস করলে আর বিরক্ত হব না। সন্তানের লাশটা নিশ্চিন্তে পাওয়ার অধিকার সব বাবাদের আছে।
লেখক: ইমাম হোসাইন মামুন, শিক্ষার্থী, সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ।
কন্টেন্ট ক্রেডিট: মেডিভয়েস
No comments