উৎপীড়িতের ক্রন্দনরোল by আলফাজ আনাম

বাংলাদেশের সমাজব্যবস্থায় গত এক দশকে বড় ধরনের পরিবর্তন ঘটে গেছে। মূল্যবোধের জায়গাগুলো ধসে পড়েছে। সমাজের অপরাধী চক্রের সাথে ক্ষমতাসীন রাজনীতির মিতালি মানবিক মূল্যবোধে প্রবলভাবে আঘাত হানছে। যৌন নিপীড়নকারী, খুুনের মামলার আসামি, ব্যাংক ডাকাত, অন্যের সম্পদ দখলকারী ভূমিদস্যুরা হয়ে পড়েছে সমাজের নিয়ন্তা। ক্ষমতাসীন দলের পুঁচকে মাস্তানের সামনে পড়লে পাড়া-মহল্লার সবচেয়ে প্রবীণ মুরব্বি মানুষটি পর্যন্ত কাঁচুমাচু করে দ্রুত স্থান ত্যাগ করছেন। আগে মুরব্বি দেখলে মাস্তানেরাই দূরে চলে যেত। এখন হয়েছে উল্টো। কারণ, সম্মান হারানোর ভয়। এই মাস্তানদের হাতে এখন অনেক টাকা। তারা মোটরসাইকেল নিয়ে রাস্তায় দাপিয়ে চলে। রাজনৈতিক দিবসগুলোতে মাথায় পট্টি বেঁধে মহড়ার আয়োজন চলে। স্কুল-কলেজগামী ছাত্রীদের সামনে এরা মূর্তিমান আতঙ্ক। এদের ‘বড় ভাই’রা গাড়িতে চলেন। ব্যাংক থেকে নামে-বেনামে টাকা তুলে তারা হয়েছেন কোটিপতি। একাধিক খুনের মামলার আসামিও হয়েছেন বিনা ভোটে মাননীয় সংসদ সদস্য। তারা রাজনীতিরও নিয়ন্তা ও হর্তাকর্তা। এই বড় ভাইদের ডাকে এবার সাতই মার্চে ক্ষমতাসীন দলের সমাবেশে ছোট ভাইয়েরা সদলবলে মাথায় পট্টি বেঁধে রাজপথে নেমে এসেছিলেন। কিন্তু এদের হাতে রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে নারীরা নানাভাবে উৎপীড়নের শিকার হয়েছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে কমপক্ষে পাঁচজন নারী সেদিন তাদের ওপর নিপীড়নের ভয়াবহ বিবরণ দিয়েছেন। এদের একজন ভিকারুননিসা নূন কলেজের ছাত্রী অদিতি বৈরাগী। বিপর্যস্ত এই ছাত্রী ফেসবুকে লিখেছেন- ‘আমি এই শুয়োরদের দেশে থাকব না। জয় বাংলা বলে যারা মেয়ে মলেস্ট করে, তাদের দেশে আমি থাকব না। থাকব না। থাকব না...। ছাত্রছাত্রীরা প্রতিদিন দেশকে মায়ের সাথে তুলনা করে গাইছে, মা তোর বদনখানি মলিন হলে, ও মা, আমি নয়ন জলে ভাসি। সে দেশ এখন হয়ে পড়েছে অদিতির মতো ছাত্রীদের চোখে ‘শুয়োরের দেশ!’ স্বদেশের প্রতি কতটা বিতৃষ্ণা ও ক্ষোভ তৈরি হলে তরুণ শিক্ষার্থীরা এমন করে ভাবতে পারে তা সহজেই অনুমান করা যায়। অদিতির কাছে তার এই প্রিয় দেশ কেন শুয়োরের বলে মনে হচ্ছে? কারা দেশটিকে এ অবস্থায় নামিয়ে এনেছে?
আসলে দেশের তরুণদের সব আশা নিভে যাচ্ছে। তারা দেখছে মাস্তানতন্ত্র তাদের বর্তমান ও ভবিষ্যৎ ধ্বংস করে দিচ্ছে। কেউ এ দেশে এখন আর নিরাপদ নয়। লেখাপড়া শিখেই বা কী হবে, যে দেশে পরীক্ষার আগে প্রশ্নফাঁস হয়ে যায়। ক্লাসের সবচেয়ে খারাপ ছাত্রটি এভাবে গোল্ডেন জিপিএ পাচ্ছে। মন্ত্রী পরামর্শ দেন ‘সহনীয়’ মাত্রায় ঘুষ গ্রহণের। এমন দেশের ভবিষ্যৎ আছে কি? ভালো আর মন্দের পার্থক্য তো সমাজ থেকে উঠে যাচ্ছে। যে যত বড় অপরাধী, সে তত বেশি সম্মানিত ব্যক্তিতে পরিণত হচ্ছে। অপরাধীরা যখন রাজনীতির প্রাণভ্রোমরা হয়ে দাঁড়ায় তখন সমাজে শৃঙ্খলা থাকতে পারে না। নারীর সম্ভ্রম থাকে না। মানুষের সম্পদের নিরাপত্তা থাকে না। স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খাঁন কামাল স্বীকার করেছেন, সাতই মার্চের দিন নারীরা নিপীড়নের শিকার হয়েছেন। ভিডিও ফুটেজ দেখে নাকি তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে। একটি দৈনিককে নিপীড়নের শিকার শিক্ষার্থী জানিয়েছেন, একজন শ্মশ্রুমণ্ডিত পুলিশ সদস্য নিপীড়নকারীদের হাত থেকে মেয়েটিকে উদ্ধার করে বাসে তুলে দিয়েছেন; কিন্তু পুলিশ সে অপরাধীদের গ্রেফতারের চেষ্টা করেনি। আসলে পুলিশের পক্ষে এমন সাহস দেখানোও আজকাল বিপজ্জনক। ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র ও যুবসংগঠনের হাতে দেশের বিভিন্ন স্থানে পুলিশের মার খাওয়ার রেকর্ড কম নয়। কারণ, পুলিশ তো ক্ষমতাসীনদের ছত্রছায়ায় চাকরি করেন। তারা প্রজাতন্ত্রের কর্মচারী থেকে যেন হয়ে পড়েছেন ক্ষমতাসীন দলের নিয়ন্ত্রিত বাহিনী; যারা অপরাধীদের ধরার চেয়ে বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের ধরার দিকে বেশি মনোযোগী। বিরোধী রাজনৈতিক দলের নেতাকর্মীদের দমনপীড়ন এখন তাদের প্রধান কর্তব্য। ফলে ‘দাড়িওয়ালা ট্রাফিক পুলিশ’ অপরাধীদের ধরার চেষ্টা না করলেও বিবেকের তাড়নায় নিপীড়িত একজন কিশোরীকে সরিয়ে নিয়ে গেছেন। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘সাতই মার্চের নারী নিপীড়নের দায় ক্ষমতাসীন দলের নয়, সরকারের।’ খুবই ভালো কথা। দেশের মানুষের নিরাপত্তা দেয়ার কথা সরকারের, দলের নয়; কিন্তু যারা সমাবেশে এসেছিলেন, তারা তো তার দলের নেতাকর্মী। কেন এই জঘন্য অপরাধীরা চিহ্নিত হওয়ার পরও এদের ধরতে দেরি হচ্ছে? সরকারের মন্ত্রীদের চেয়েও এ দেশের নারীবাদী ও বুদ্ধিজীবীরা নারী নিপীড়ন নিয়ে বিস্ময়কর ও রহস্যময় নীরবতা পালন করছেন। হেফাজতের সমাবেশে একজন নারী সংবাদকর্মী লাঞ্ছিত হওয়ার পর প্রগতিবাজ নারীবাদীরা শোরগোল বাধিয়ে দিয়েছিলেন; কিন্তু ক্ষমতাসীন দলের সমাবেশে যখন একজন নয়, অনেক নারী নিপীড়নের শিকার হলেন তখন তারা নিশ্চুপ। নাকি নারী নিপীড়নের রাজনৈতিক রূপ আছে? দৃশ্যত, সেকুলার পরিচয়ে নারী নিপীড়নকারী নারীবাদীদের চোখে অপরাধী বিবেচিত হচ্ছে না যতটা অপরাধী হয়ে থাকেন একজন মাদরাসাছাত্র। অথচ হেফাজতের সেই সমাবেশে কোনো যৌন হয়রানির ঘটনা ঘটেনি, বরং একজন নারী সংবাদকর্মীর পেশাগত কাজে বাধা দেয়ার অভিযোগ তোলা হয়েছিল। দেশের নারীবাদী আর বুদ্ধিজীবীরা সেকুলার উৎপীড়কদের কেন চোখে দেখতে পাচ্ছেন না?
২. যৌন উৎপীড়কদের মতো অর্থনৈতিক উৎপীড়কেরা এখন বহালতবিয়তে আছেন। ব্যাংকের অর্থ লোপাটের পর অপরাধীরা গৌরবের সাথে গণমাধ্যমে হাজির হয়ে মানুষকে উপদেশ দিয়ে যাচ্ছেন। এর আগে বেসিক ব্যাংকের বহুলালোচিত আবদুল হাই বাচ্চু আবদার করেছেন, ‘তাকে আরেকবার ব্যাংকের চেয়ারম্যান করা হলে লুট হওয়া টাকা ফেরত এনে দেবেন।’ মৌলবাদের অর্থনীতির কিসসা শুনিয়ে রাষ্ট্রায়ত্ত জনতা ব্যাংক লোপাটের খলনায়ক সেকুলার এক অর্থনীতিবিদ এখনো তার জারিগান গেয়ে যাচ্ছেন। জনতা ব্যাংকের চেয়ারম্যান থাকাকালে শিল্পপতি নামধারী এক গাড়িচালককে তিনি পাঁচ হাজার ৪০০ কোটি টাকা ঋণ দিয়েছেন। বিরাট অঙ্কের এই টাকা ফেরত পাওয়ার আর কোনো সম্ভাবনা নেই। অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের মতো, আবুল বারকাত জনতা ব্যাংক শেষ করে দিয়েছেন। তিনি যে মৌলবাদী আর্থিক প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে প্রচারণা চালিয়ে এত বড় পদ বাগিয়ে নিয়েছিলেন, সেসব প্রতিষ্ঠান হাজার হাজার উদ্যোক্তা তৈরি করেছে; গার্মেন্ট, টেক্সটাইল মিলসহ অসংখ্য শিল্পকারখানায় বিনিয়োগ করছে। যারা ওইসব ব্যাংকে আমানত রেখেছেন, তারা মুনাফা পেয়েছেন। সেখানে কোনো গাড়িচালককে হাজার কোটি টাকা ঋণ দিয়ে টাকা লোপাট করা হয়নি। দুর্ভাগ্য হচ্ছে, এরপরও আবুল বারকাতের মতো লোকেরা গলা উঁচু করে সমাজে সম্মানিত বুদ্ধিজীবী হিসেবে গণমাধ্যমে প্রচার পাচ্ছেন। জাতিসঙ্ঘ উন্নয়ন কর্মসূচি (ইউএনডিপি) সাম্প্রতিক প্রতিবেদনে বলেছে, শীর্ষ ১০ শতাংশ ধনী পরিবারের হাতে চলে গেছে এ দেশের মোট আয়ের ৩৮ শতাংশ। লুটপাট ও দুর্নীতির কারণে বৈষম্য বাড়ছে। সংস্থাটি বলছে, আয়ের এত বড় অংশ কিভাবে মাত্র ১০ শতাংশের হাতে কুক্ষিগত হলো, তা বুঝতে বিভিন্ন সময় রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংক থেকে অবাধে ঋণ নিয়ে তা ফেরত না দেয়া, পুঁজিবাজারের কারসাজি, কর ফাঁকি, সরকারি কেনাকাটা ও ব্যয়ে দুর্নীতি, সর্বোপরি ভূমি দখলের ঘটনাগুলোই যথেষ্ট। এ প্রক্রিয়ায় গুটিকয় মানুষের হাতে আয়বণ্টন কেন্দ্রীভূত হওয়ার অর্থ হলো, জাতীয় আয়ে বাকি সবার অংশ কমছে। ইউএনডিপি বলছে, আয়ের কেন্দ্রীভবন এত দ্রুত ঘটছে যে, সম্পদশালী পরিবারগুলো আরো বেশি ধনী হয়ে যাচ্ছ। অন্য দিকে আরো বেশি নাজুক হচ্ছে সবচেয়ে দরিদ্র ও ভঙ্গুর জনগোষ্ঠী। এভাবে একটি দেশে যখন বৈষম্য বাড়তে থাকে, তখন সমাজে নানামাত্রায় অস্থিরতাও বাড়ে। বিপুলসংখ্যক মানুষের মধ্যে হতাশা বাড়তে থাকে।
মারাত্মক বৈষম্যের এ চিত্র থেকে চারটি পর্যবেক্ষণ দিয়েছে ইউএনডিপি। প্রথমত, বাংলাদেশে আয় বৈষম্য ছয় বছরে প্রকট হয়েছে। দ্বিতীয়ত, এ সময়ে সবচেয়ে দরিদ্র ও নাজুক অংশটি আরো দরিদ্র হয়ে উঠেছে। তৃতীয়ত, সবচেয়ে ধনী অংশ দ্রুত আরো সম্পদশালী হয়ে ওঠায় তাদের মধ্যেই আয় কেন্দ্রীভূত হচ্ছে। চতুর্থত, দারিদ্র্যের মাত্রা গ্রামীণ দরিদ্রদের মধ্যে তুলনামূলক বেশি। দেশের সম্পদ লুটপাটকারীদের সহজেই চেনা যাবে, যারা গত এক দশকে রাষ্ট্রায়ত্ত গুরুত্বপূর্ণ পদে বসে সুবিধা নিয়েছেন বা সুবিধা দিয়েছেন। ব্যাংকের টাকা লোপাটে এখন বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার ‘সবচেয়ে অগ্রগামী’ দেশ। নেপাল, ভুটান, ভারত ও বাংলাদেশের মধ্যে খেলাপি ঋণের হার সবচেয়ে কম নেপালে এবং সবচেয়ে বেশি বাংলাদেশে। নেপালের ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের পরিমাণ গড়ে ১ দশমিক ৭১ শতাংশ। দেশটির সানিমা নামে একটি ব্যাংকের খেলাপি ঋণ মাত্র শূন্য দশমিক ০৩ শতাংশ। অন্য দিকে, বাংলাদেশের রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণের গড় হার ২৫ শতাংশ। তবে দুর্নীতিগ্রস্ত রাষ্ট্রায়ত্ত বেসিক ও বিডিবিএলের খেলাপি ঋণ ৫০ শতাংশের ওপরে রয়েছে। ভুটানের খেলাপি ঋণও নিয়ন্ত্রণের মধ্যে আছে। এই চিত্র থেকে স্পষ্ট, বাংলাদেশের ব্যাংকগুলোর নিয়ন্ত্রণ চলে গেছে প্রশ্রয়প্রাপ্ত কিছু লুটেরা ব্যক্তির হাতে। বাংলাদেশের মানুষ এখন ব্যাংকে টাকা রাখতে ভয় পায়। কারণ, তারা যে আমানত ফিরে পাবে, তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। সাবেক মন্ত্রী ও সংসদ সদস্য মহীউদ্দীন খান আলমগীরের ফারমার্স ব্যাংকে যে আমানতকারীরা টাকা রেখেছিলেন, তারা এখন টাকা ফেরত না পাওয়ার অনিশ্চয়তার মধ্যে আছেন। মহীউদ্দীন খান আলমগীর, আবদুল হাই বাচ্চু কিংবা আবুল বারকাতরা একেকজন অর্থনৈতিক উৎপীড়কের ভূমিকায় অবতীর্ণ হয়েছেন। ৬৪১ বছর আগে ইতিহাসবিদ ও দার্শনিক ইবনে খালদুন লিখেছেন- ‘উৎপীড়ন সভ্যতার ধ্বংস ডেকে আনে’। তিনি আরো লিখেছেন- ‘সম্পদের ব্যাপারে মানুষের ওপর উৎপীড়ন করলে তা সম্পদ উপার্জন ও সংগ্রহে তাদের আকাক্সক্ষাকে খর্ব করে। কারণ, তারা এটাই ভাবে যে, তাদের উপার্জন ও সঞ্চয়ের চরম পরিণতি হলো লুণ্ঠিত হওয়া।’ বাংলাদেশের মানুষ এখন নানাভাবে লুণ্ঠনের শিকার হচ্ছে।
alfazanambd@yahoo.com

No comments

Powered by Blogger.