শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার কমাতে ‘ওয়াশ’ কার্যক্রম জোরদার করুন by অধ্যাপক ড. মো. আবুল হাশেম খান
স্বাস্থ্যসেবা
কেন্দ্রে নিরাপদ পানি সরবরাহ, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতা
কার্যক্রম শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার অন্তত ২৫ ভাগ কমাতে পারে। আর শুধু শিশুকে
ধরা, খাবার তৈরি ও পরিবেশনের আগে মায়ের হাত ধোয়া কমাতে পারে ৪৪ শতাংশ
শিশুমৃত্যু। তাই শিশু ও মাতৃ মৃত্যুহার কমাতে স্বাস্থ্য কেন্দ্রে উন্নত
চিকিৎসাসেবার পাশাপাশি ‘ওয়াশ’ কার্যক্রম (নিরাপদ পানি সরবরাহ, উন্নত
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম) নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশের জাতীয় স্বাস্থ্যনীতি ও গৃহীত কর্মকৌশলগুলোয় ‘ওয়াশ’ কার্যক্রমের
কথা বলা থাকলেও স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে এ ধরনের সুনির্দিষ্ট কোনো
কার্যক্রম নেই। এক জরিপে জানা গেছে, ৯২ শতাংশ হাসপাতালে নির্বিঘ্ন পানি
সরবরাহ থাকলেও সেটি নিরাপদ কিনা তা পরীক্ষা করা হয় না এবং ৩৬ শতাংশ শৌচাগার
অপরিষ্কার। অধিকাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকে নির্বিঘ্ন পানি সরবরাহ ব্যবস্থা
নেই। ৮৬ শতাংশ কমিউনিটি ক্লিনিকে হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকলেও তা মূলত জমানো
পানি থেকেই হয়। ৩০ ভাগেরও কম টিউবওয়েলের পানি পানযোগ্য। ইউনিসেফ ও
বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার ২০১৫ সালের এক জরিপে দেখা গেছে, বিশ্বের
এক-তৃতীয়াংশেরও বেশি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে নিরাপদ পানির ব্যবস্থা নেই।
এক তৃতীয়াংশেরও বেশি স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে হাত ধোয়ার জন্য সাবানের
ব্যবস্থা নেই এবং প্রতি ৫টি সেবা কেন্দ্রের একটিতে পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা
নেই। বাংলাদেশের অবস্থাও এর বাইরে নয়। ৭২ ভাগ স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা থাকলেও এর ২৫ ভাগ কেন্দ্রে উন্নত পানি সরবরাহ ও
নারী-পুরুষের জন্য আলাদা করা রয়েছে। শহরের হাসপাতালগুলোয় বর্জ্য নিষ্কাশনে
কোনো নিয়মই মানা হয় না- যা রোগীদের পাশাপাশি পরিবেশের জন্যও হুমকি হয়ে
দাঁড়িয়েছে। একই রিপোর্টে দেখা যায়, বাংলাদেশের মাত্র ৫৯ ভাগ জেলা ও উপজেলা
পর্যায়ের হাসপাতালে নিরাপদ সংক্রামক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা রয়েছে। ইউনিয়ন
পর্যায়ের হাসপাতাল ও কমিউনিটি ক্লিনিকগুলোয় এ চিত্র আরও আশঙ্কাজনক (২৪
শতাংশ থেকে ২৫ শতাংশ)। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থার মতে, সংক্রমণ প্রতিরোধ করতে
৬টি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান যেমন সাবান, নিরবচ্ছিন্ন পানি, হাত জীবাণুমুক্ত
করতে অ্যালকোহল মিশ্রিত উপাদান, গ্লাভস এবং জীবাণুমুক্ত ধারালো সার্জিক্যাল
যন্ত্রপাতি সরবরাহ ও ব্যবহার নিশ্চিত করা একান্ত প্রয়োজন। বাংলাদেশে যেসব
স্বাস্থ্য সেবা কেন্দ্রে স্বাভাবিক প্রসবের ব্যবস্থা রয়েছে, এর মাত্র
এক-চতুর্থাংশ জায়গায় সংক্রমণ ঠেকাতে ৬টি অত্যাবশ্যকীয় উপাদান পাওয়া গেছে।
বিশ্বে অ্যান্টিবায়োটিক প্রতিরোধী জীবাণু ছড়ানোর অন্যতম প্রধান কারণ
হাসপাতালের পরিবেশ। বাংলাদেশে নিরাপদ পানি সরবরাহ, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন
ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের অভাবেই ডায়রিয়াসহ বিভিন্ন সংক্রামক
ব্যাধিতে পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশুদের আক্রান্ত হওয়ার হার অনেক বেশি। এছাড়া এ
কার্যক্রমের অভাবে ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণ বাড়ে এবং অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার
বৃদ্ধি পায়। সাবান দিয়ে হাত ধোয়ার মাধ্যমে ডায়রিয়া, নিউমোনিয়াসহ বিভিন্ন
রোগের সংক্রমণের হার কমানো সম্ভব। ৪৮ শতাংশ ডায়রিয়া, ৫০ শতাংশ নিউমোনিয়া
এবং প্রায় ১৬-২১ শতাংশ অন্যান্য শ্বাসতন্ত্রের রোগ কমানো সম্ভব শুধু হাত
ধোয়ার অভ্যাসের মাধ্যমে। বাংলাদেশে নবজাতকের মৃত্যুর জন্য বিভিন্ন সংক্রামক
ব্যাধি অন্যতম প্রধান কারণ। অপর্যাপ্ত ও অপ্রতুল ‘ওয়াস’ অবকাঠামো এবং তা
সেবাদাতা ও সেবা গ্রহীতার সঠিক চর্চার অভাব স্বাস্থ্য খাতে বাংলাদেশের
অর্জনকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলতে পারে। শিশু ও মাতৃমৃত্যু হার কমানোর
ক্ষেত্রে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে হাসপাতালে নিরাপদ পানি সরবরাহ,
উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রম নিশ্চিতের কোনো বিকল্প
নেই। বিশ্বস্বাস্থ্য সংস্থা তাদের গ্লোবাল অ্যাকশন প্ল্যানে ২০৩০ সালের
মধ্যে প্রতিটি স্বাস্থ্য কেন্দ্রে নিরাপদ পানি ও স্বাস্থ্যসম্মত
পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা নিশ্চিতের জন্য লক্ষ্য নির্ধারণ করেছে। স্বাস্থ্য
কেন্দ্রে নিরাপদ পানি সরবরাহ, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতা
কার্যক্রম নিশ্চিতের জন্য জাতীয় কৌশল ও কর্মপরিকল্পনা প্রণয়ন এবং নিরাপদ
পানি সরবরাহ, উন্নত পয়ঃনিষ্কাশন ব্যবস্থা ও পরিচ্ছন্নতা কার্যক্রমের ওপর
জোর দেয়া প্রয়োজন। লাইন ডিরেক্টর, কমিউনিটি বেজড হেলথ কেয়ার (সিবিএইচসি),
স্বাস্থ্য অধিদফতর
No comments