বিমান দুর্ঘটনায় প্রাণহানি ও আমাদের দায় by মুহাম্মদ ইউসুফ
কাঠমান্ডুতে
ইউএস-বাংলা এয়ারলাইনসের একটি বিমান দুর্ঘটনায় অর্ধশতাধিক প্রাণ হারিয়ে
গেছে। যথারীতি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এতে একসময় বের হয়ে আসবে, হয়
পাইলটের ভুল অথবা টাওয়ারের ভুল কিংবা ইঞ্জিনের ত্রুটি। আপাতদৃষ্টিতে এই
তিনটি ভুলত্রুটির এক বা একাধিককে দায়ী মনে হলেও সামগ্রিকভাবে মুখ্য দায়ী
এখানে অনুপস্থিত। সেই মুখ্য দায়ীকে চিহ্নিত করে ব্যবস্থা নিতে না পারলে
দীর্ঘ মেয়াদে ফলাফল শূন্যই থেকে যাবে। আমরা বলে থাকি, দুর্ঘটনার হাত-পা
নেই, ঘটতেই পারে। ঘটে গেলে খুব একটা কিছু করার থাকে না। এ জন্য
দুর্ঘটনা-পরবর্তী ব্যবস্থার চেয়ে দুর্ঘটনা–পূর্ববতী ব্যবস্থা গুরুত্ব পায়।
রিস্ক ম্যানেজমেন্টের বা ঝুঁকি ব্যবস্থাপনার মাধ্যমে দুর্ঘটনা রোধ করা হয়। এ
ক্ষেত্রে রাষ্ট্রের দায় কী? প্রত্যেক এয়ারলাইনসের পাইলটের দক্ষতা,
ইঞ্জিনের সক্ষমতা ইত্যাদি জনে জনে গিয়ে দেখা? না। জনে জনে দেখার প্রয়োজন
নেই। সেই সুযোগ রাষ্ট্রের নেইও। রাষ্ট্র কেবল দুর্ঘটনার মূল্য নির্ধারণ
দেবে এবং তা আদায়ের মেকানিজম বা ব্যবস্থা নির্ধারণ করে দেবে। মূল্য যত চড়া
হবে, মেকানিজমের কারণে দুর্ঘটনার পরিমাণও কমে আসবে।
অ্যাভিয়েশনের ভাষায় এ
দুর্ঘটনার মূল্যকে ‘ক্যারিয়ার লায়াবিলিটি’ এবং আদায়ের ব্যবস্থাকে
‘অ্যাভিয়েশন ইনস্যুরেন্স’ বলা হয়। উপযুক্ত ক্যারিয়ার লায়াবিলিটি নির্ধারণ
করে দিয়ে ইনস্যুরেন্স বা বিমা নিশ্চিত করাই বিমান দুর্ঘটনা রোধে রাষ্ট্রের
মুখ্য দায়। কোনো বিমান সংস্থাকে লাইসেন্স দেওয়ার অন্যতম শর্ত হলো, এর
‘অ্যাভিয়েশন ইনস্যুরেন্স’ করা থাকতে হবে। অ্যাভিয়েশন ইনস্যুরেন্স কোম্পানি
চুক্তিতে যাওয়ার আগে নিজস্ব এক্সপার্ট দিয়ে বিমানের ইঞ্জিনের ধরন, বয়স,
পাইলটদের দক্ষতা ইত্যাদি বিবেচনায় নিয়ে প্রথমত রিস্ক ম্যানেজমেন্ট করে নেয়।
দ্বিতীয়ত, বিমানটি যে রাষ্ট্রের, সেই রাষ্ট্রের আইন অনুযায়ী ক্যারিয়ার
লায়াবিলিটি তথা দুর্ঘটনায় আহত-নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণের নির্ধারিত অঙ্ক
হিসেবে নেয়। মূলত এই ক্যারিয়ার লায়াবিলিটির জন্য বিমার অঙ্কই বিমান
দুর্ঘটনা রোধে কার্যকর ব্যবস্থা হিসেবে ভূমিকা রাখে। কীভাবে? রাষ্ট্রীয়
আইনে ক্যারিয়ার লায়াবিলিটি তথা আহত-নিহত ব্যক্তির ক্ষতিপূরণের সীমা যদি কম
হয়, বিমা প্রতিষ্ঠান তখন পুরোনো কিংবা মেয়াদোত্তীর্ণ ইঞ্জিনেও বিমা করতে
আগ্রহী হয়। চড়া ক্ষতিপূরণের কভারেজের ক্ষেত্রেই কেবল ইঞ্জিনের বয়স, পাইলটের
দক্ষতা এবং অন্য ঝুঁকিগুলো বিবেচনায় নেওয়া হয়। ঝুঁকি ব্যবস্থাপনা তখন কোনো
ঝুঁকির বিষয়গুলোর সঙ্গে সমঝোতার কোনো ঝুঁকি নেয় না কোনো বিমা কোম্পানি।
পক্ষান্তরে, নামমাত্র অঙ্কের বিমা দায় থাকলে বিমা প্রতিষ্ঠানেরও অভাব হয়
না। ফলে অদক্ষ পাইলটে মেয়াদোত্তীর্ণ বিমান আকাশে উড়ে বেড়ায়। টাওয়ারের
অদক্ষতাও লাই পায়। কেননা, এই নামমাত্র কভারেজ উশুল করার জন্য বিমা
প্রতিষ্ঠানও টাওয়ার কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে সালিসিতে যাওয়ার ঝক্কিতে যায় না।
আমাদের রাষ্ট্রীয় দায় কতটুকু? আমরা বিভিন্ন সংস্থাকে ফ্লাইট চালানোর
লাইসেন্স দেওয়ার ক্ষেত্রে অ্যাভিয়েশন ইনস্যুরেন্স থাকা নিশ্চিত করি, খুব
ভালো কথা। কিন্তু এটা তো দ্বিতীয় এবং পরের কথা। ইনস্যুরেন্সের কভারেজ সীমা
তথা ক্যারিয়ার লায়াবিলিটি আইনের কী অবস্থা? প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পরে মূলত
কমার্শিয়াল বিমানের প্রাথমিক প্রসার ঘটে। ১৯২৯ সালে বিশ্বের বহু দেশ একত্র
হয়ে ওয়ারশ কনভেনশন প্রণয়ন করে এবং সেখানে দুর্ঘটনা রোধের মেকানিজম হিসেবে
আহত-নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ হিসেবে যাত্রীপ্রতি প্রায় ১২ হাজার ৫০০
মার্কিন ডলার নির্ধারণ করে দেওয়া হয়।
তৎকালীন ব্রিটিশ সরকার সেই কনভেনশনে
সই করে এবং ১৯৩৪ সালে ‘ক্যারিয়েজ বাই এয়ার অ্যাক্ট ১৯৩৪’ নামে ক্যারিয়ার
লায়াবিলিটি অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে তা কার্যকর করে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের
পর বাণিজ্যিক বিমানের ব্যাপক প্রসার ঘটে এবং আকাশ-ভ্রমণের পরিমাণও বেড়ে
যায়। অন্যদিকে কারেন্সির মূল্যমান কমে আসে। ইন্টারন্যাশনাল সিভিল
অ্যাভিয়েশন অর্গানাইজেশনের (আইকাও, ১৯৪৭ সালে সৃষ্ট) উদ্যোগে ১৯৫৫ সালে
‘হেগ প্রটোকল’-এর মাধ্যমে পূর্বের ওয়ারসা কনভেনশন সংশোধন করে যুগোপযোগী করা
হয়। এতে আহত-নিহত ব্যক্তিদের ক্ষতিপূরণ যাত্রীপ্রতি দ্বিগুণ করা হয়, ইউএস
ডলারে যা প্রায় ২৫ হাজার ডলার। তৎকালীন পাকিস্তান সরকার সেই প্রটোকলে সই
করে এবং ১৯৬৬ সালে ‘ক্যারিয়েজ বাই এয়ার অ্যাক্ট ১৯৬৬’ নামে ক্যারিয়ার
লায়াবিলিটি অ্যাক্ট প্রণয়নের মাধ্যমে তা কার্যকর করে। ১৯৭১ সালে স্বাধীন
বাংলাদেশ সৃষ্টির পর আমরা সেই অ্যাক্ট বলবৎ রাখি। ১৯৯৯ সালে এসে আইকাও
দেখল, সংশোধিত ওয়ারসা কনভেনশনের ক্ষতিপূরণের অঙ্ক যুগের সঙ্গে অসামঞ্জস্য
হয়ে পড়েছে। এতে বিমা প্রতিষ্ঠানের দায় পরিশোধের ঝুঁকি কমে যাওয়ায় দুর্ঘটনার
প্রবণতা বেড়ে যাচ্ছে। সুতরাং নতুন করে মন্ট্রিল কনভেনশন প্রণয়ন করে
ক্ষতিপূরণের পরিমাণ যাত্রীপ্রতি ১ লাখ ৭০ হাজার ডলারে উন্নীত করা হয়।
পৃথিবীর সব দেশের মতো আমরাও মন্ট্রিল কনভেনশনে সই করি। কিন্তু পৃথিবীর সব
দেশ একটি ক্যারিয়ার লায়াবিলিটি আইন প্রণয়নের মাধ্যমে মন্ট্রিল কনভেনশন
কার্যকর করলেও দুঃখজনকভাবে আমরা তা অদ্যাবধি করিনি। আমাদের চারপাশের ভারত
পাকিস্তান কিংবা শ্রীলঙ্কা নয়, বিশ্বের যেসব দেশে বিমানবন্দরের নামে
ন্যূনতম একটা ফুটবল খেলার মাঠ আছে, তারাও মন্ট্রিল কনভেনশন অনুসমর্থন করেছে
আইন প্রণয়ন করে। অথচ বিগত ১৮ বছরে আমরা তা করতে পারিনি। আমরা পারিনি মাত্র
কয়েক পাতার একটি গেজেট করে একটি ক্যারিয়ার লায়াবিলিটি আইন করতে। এই না
করার পেছনে কোনো যৌক্তিক উত্তরও কেউ দিতে পারবে বলে মনে হয় না।
যদি বলি
কনভেনশনে সই করার পর প্রথম এক যুগ পর্যন্ত আমরা জানতামই না যে একটি আইন করে
কনভেনশনটি কার্যকর করতে হবে, পাল্টা প্রশ্ন বোধ হয় আসবে না। যদি বলি এরপর
আরও অর্ধযুগ ধরে গড়িমসি হচ্ছে আমাদের অহেতুক টেনশনে, তাও পাল্টা প্রশ্ন
আসার সম্ভাবনা কম। টেনশন বলতে কী? ‘এত দিন কেন করা হলো না, না করার পেছনে
নিশ্চয় রাষ্ট্রীয় স্বার্থ থাকতে পারে, করলে রাষ্ট্রীয় স্বার্থ ক্ষুণ্ন হবে
কি না, জরিপ করতে হবে, গ্যাপ অ্যানালাইসিস করতে হবে’ ইত্যাদি ইত্যাদি। অথচ
অ্যাভিয়েশনের ন্যূনতম জ্ঞান থাকলে যে–কেউ বলবে যে এই আইন কেবলই রাষ্ট্রকে
দেয়, কিছু নেয় না। এখানে গ্যাপ অ্যানালাইসিসের কিছু নেই। এটি বিমান
দুর্ঘটনা রোধ এবং রাষ্ট্রের বিমান ভ্রমণে ইচ্ছুক নাগরিকের নিরাপত্তার জন্য
একটি আইন। এই আইন কার্যকর করতে একটাই অদৃশ্য বিরোধী পক্ষ থাকতে পারে,
এয়ারলাইনসগুলো, যারা অল্প পুঁজিতে মেয়াদোত্তীর্ণ বিমান আকাশে ওড়াতে চায়। আজ
এই আইন কার্যকর করতে না পারার কারণে লক্কড়ঝক্কড় বিমান আকাশে ওড়ার সুযোগ
পায়, অদক্ষ পাইলট বিমান চালায়, অদক্ষ টাওয়ার ভুল করেও পার পেয়ে যায়।
যাত্রীরা ঝুঁকি নিয়ে বিমানে চড়তে বাধ্য হয়। কোনোভাবেই বিমান দুর্ঘটনায়
আমাদের মুখ্য দায় অস্বীকার করার সুযোগ নেই। আমার তো মনে হয়, বিমান
দুর্ঘটনার জন্য স্পট তদন্ত টিম গঠন না করে কেন মন্ট্রিল কনভেনশন অনুসমর্থন
বা অনুসমর্থন করা হয়নি, আগে সেই বিষয়ে তদন্ত দল গঠন করা প্রয়োজন। সত্বর এই
কনভেনশন কার্যকর করার লক্ষ্যে কয়েক পাতার একটি ‘ক্যারিয়ার লায়াবিলিটি আইন’
প্রণয়ন করে ভবিষ্যতের দুর্ঘটনা রোধ করা জরুরি।
মুহাম্মদ ইউসুফ: ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট
ই-মেইল: mgstysf@gmail.com
মুহাম্মদ ইউসুফ: ঢাকার শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে কর্মরত ম্যাজিস্ট্রেট
ই-মেইল: mgstysf@gmail.com
No comments