চলে গেলেন আমাদের কালের নায়ক by মুনির হাসান
চলে
গেলেন আমাদের কালের নায়ক স্যার স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। সকাল বেলায় খবরটা
প্রথম শুনেছি প্রথম আলোর সম্পাদক (বিদেশ সংস্করণ) সেলিম খানের মুখে। তিনি
ফোন করে বললেন, আপনার গুরু চলে গেছেন! প্রথমেই আমার মনে হলো, আরে, আমার তো
আগেই ভাবা উচিত ছিল স্টিফেন হকিং পৃথিবীতে আসার জন্য যেমন অন্য একটি দিন
বেছে নিয়েছেন, তেমনি যাবেনও অনন্য দিনে। সেই হিসাবে আজকের দিনটা আমার
হিসাবে থাকা দরকার ছিল। কারণ, আজ মহাবিজ্ঞানী আলবার্ট আইনস্টাইনের জন্মদিন!
আইনস্টাইনের জানানো দুনিয়ার সবচেয়ে সফল লোকটা যে এদিনকেই তাঁর
মহাপ্রস্থানের দিন হিসেবে বেছে নেবে, তাতে আর আশ্চর্য কী! আমাদের জানা
দুনিয়ায় দুটি শক্তিশালী তত্ত্ব হলো আইনস্টাইনের আপেক্ষিতার বিশেষ ও সাধারণ
তত্ত্ব এবং কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। প্রায় ১০০ বছরের অধিক কাল ধরে বিজ্ঞানীরা
চেষ্টা করছেন এই দুটিকে ছাঁদনাতলায় নিয়ে জোড় বাঁধতে। সেই সাফল্যের প্রথম
কাজটি করেছেন হকিং। এবং তাঁর কারণেই আমরা এখন জানি কৃষ্ণবিবর আসলে ‘কৃষ্ণ’
নয়, বরং সেখান থেকে বের হয়ে আসছে কণা স্রোত। আর ওই কণাস্রোতের নাম দেওয়া
হয়েছে হকিং বিকিরণ! হকিং জন্মেছেন ১৯৪২ সালের ৮ জানুয়ারি, গ্যালিলিও
গ্যালিলির মৃত্যুর ৩০০ বছর পর, ইংল্যান্ডের অক্সফোর্ড শহরে। ওই দিনের কি
কোনো মাহাত্ম্য আছে? না, দিনের মাহাত্ম্য বা এ রকম কোনো অলৌকিকতার ধার
ধারতেন না হকিং। তাঁর সোজাসাপ্টা জবাব হলো, খোদ লন্ডনেই কমপক্ষে আরও ২০০
শিশুর জন্ম হয়েছে ওই দিন! ডাক্তার পিতার খায়েশ ছিল স্টিফেনকেও তিনি ডাক্তার
বানাবেন। তাই হকিং যখন ঘোষণা করলেন, তিনি পড়তে চান পদার্থবিদ্যা কিংবা
গণিত, তখন পুত্রের ভবিষ্যৎ ভেবে আতঙ্কিত হলেন ফ্রাঙ্ক। তাঁর ধারণা ছিল, ওই
সব পড়লে স্টিফেনকে আজীবন বেকার থাকতে হবে। স্বভাবের দিক থেকে ছোটবেলা থেকেই
হকিং ছিলেন খুব দুরন্ত। ঘরের জিনিসপত্র ভাঙচুর করাটা রীতিমতো অভ্যাসে
দাঁড়িয়ে গিয়েছিল। হকিং রেডিও খুলে তার ভেতরটা দেখতেন বোঝার জন্য নয়। হকিং
আসলে আর সব বাচ্চার মতোই কাজটি করতেন। স্কুলের শিক্ষকেরা তাঁকে সাধারণের
ওপরে স্থান দিতেন। আর দশজনের সঙ্গে তাঁর একটি পার্থক্য সে সময় ছিল, হকিং
কেন জানি উচ্চাঙ্গসংগীত পছন্দ করতেন! সেন্ট অ্যালবা থেকে অক্সফোর্ডে পড়তে
এসে হকিং মোটামুটি জনপ্রিয় ছাত্র হয়ে ওঠেন। স্বভাবের কারণে। ছাত্রটি বাচাল ও
দুষ্ট, কিন্তু পড়াশোনায় ভালো। কাজেই শিক্ষকেরাও তাঁকে পছন্দ করতেন। ইচ্ছে
ছিল অনার্স শেষে কেমব্রিজে যাবেন। শেষ পরীক্ষায় ভাইভা বোর্ডে ভবিষ্যৎ
পরিকল্পনা বলতে গিয়ে হকিং বললেন, ‘আমি যদি প্রথম শ্রেণি পাই, তাহলে
কেমব্রিজে চলে যাব। নতুবা কিন্তু এখানেই থাকব।’ ভাবখানা এমন, অক্সফোর্ডে
থেকে মাস্টারদের অনেক জ্বালাব! অতএব একটা প্রথম শ্রেণি ও কেমব্রিজ। আজ
হকিংয়ের জন্য এই লেখা লিখতে গিয়ে প্রথমেই মনে হচ্ছে, আর দুই-তিন বছর বাঁচলে
কী ক্ষতি হতো? এমনিতে মোটর নিউরন ডিজিজে আক্রান্ত হওয়ার পর ৫৪ বছর বেঁচে
থাকাটাই একটা রেকর্ড। এমনকি ১৯৬৪ সালে জেন ওয়াইল্ডের সঙ্গে তাঁর প্রথম
বিবাহের সময় বড় কোনো আনুষ্ঠানিকতা ছিল না। কারণ, দুই পরিবারের সবাই জানতেই
লাঠিতে ভর দিয়ে বরের পোশাক পরা ২২ বছরের যুবকটি আর কিছুদিন বাঁচবেন। কিন্তু
প্রকৃতির চিন্তা ছিল ভিন্ন। কারণ, এর কদিন আগেই রেজার পেনরোজের সঙ্গে মিলে
হকিং দেখিয়েছেন তাঁর মেধার প্রথম স্বাক্ষর।
ঈশ্বর যখন নরক বানাচ্ছিলেন
১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান আপেক্ষিতার সমীকরণের সমাধান করেন। তাতে দেখা যায়, এই দুনিয়া ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নিউটনের স্থির দুনিয়া তত্ত্বের লোকজন এতে আঁতকে ওঠেন, খোদ আইনস্টাইনও এই সমাধান নাকচ করেন। কিন্তু ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল দুরবিন দিয়ে সত্যটা দেখে ফেলেন, দুনিয়া আসলেই সম্প্রসারিত হচ্ছে! গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর পরস্পর থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি আপনি পেছনে যান, তাহলে একসময় দেখা যাবে, এই দুনিয়ায় সবকিছু এক বিন্দুতে ছিল। কোনো এক সন্ত্রাসী ঘটনায় সবাই দিগ্বিদিক হয়ে ছুটে চলেছে। এ থেকে উদ্ভব বিগ ব্যাং তত্ত্বের, যা আজকের কসমোলজির প্রাণ। বিগ ব্যাংয়ের সমস্যা অন্যত্র। দুনিয়ার সবকিছুকে এক জায়গায় জড়ো করলে যা হয়, তাতে বিজ্ঞান একটু অস্বস্তিতে পড়ে। কারণ, এক বিন্দুর দুনিয়ার নাম সিঙ্গুলারিটি, যাতে জানা সমীকরণগুলোর ভগ্নদশা। ষাটের দশকে রজার পেনরোজের সঙ্গে হকিং দেখালেন তাঁর প্রথম খেল। বললেন, যতই আপত্তি থাকুক সিঙ্গুলারিটি থেকেই দুনিয়ার শুরু। শুধু তা–ই নয়, বিগ ব্যাং থেকেই সময়ের শুরু। অর্থাৎ, বিগ ব্যাংয়ের আগে বলে কিছু নেই। খ্যাপা, লোকজনের অনেকে হকিংয়ের কাছে জানতে চাইত বিগ ব্যাংয়ের আগে ঈশ্বর কী করেছিলেন? মুচকি হেসে হকিং বলতেন, অবিশ্বাসীদের জন্য নরক বানাচ্ছিলেন!
ঈশ্বর কি পাশা খেলেন?
সময়ের শুরুর ধারণা জেনে হকিং এগোলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। এরই মধ্যে জানা হয়েছে, বস্তুজগতে এমন বস্তু সম্ভব, যার থেকে দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতযান আলোও বের হতে পারে না—ব্ল্যাকহোল, কৃষ্ণবিবর। ব্ল্যাকহোল কি আসলেই ব্ল্যাক? কিছুই কি সেখান থেকে বের হতে পারে না? হুইলচেয়ারের বিজ্ঞানী ভাবেন। ভাবেন কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব নিয়ে। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটো কোয়ান্টাম রাশির যুগপৎ নিশ্চয়তা নেই। শূন্যস্থানে এই তত্ত্বের প্রয়োগ এরই মধ্যে বলে ফেলেছে শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। সেখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে কণা ও প্রতিকণা, আবার তা লয়ও পাচ্ছে। হকিং এই ঘটনাকে প্রয়োগ করলেন ব্ল্যাকহোলের আশপাশে এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলেন ব্ল্যাকহোল থেকেও বের হয়ে আসছে অবিরল কণাস্রোত। ১৯৭৩ সালে হকিং প্রকাশ করলেন তাঁর ধারণা এবং অচিরেই তা গৃহীত হলো। বিজ্ঞানজগৎ ওই বিকিরণকে অভিহিত করল হকিংয়ের নামে—হকিং রেডিয়েশন। তত দিনে স্টিফেন হকিং কোনোমতে লিখতে পারেন। হুইলচেয়ারেই আসীন। আর তাই ১৯৭৪ সালের রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির শত বছরের নিয়ম ভেঙে সভাপতি খাতা হাতে নিয়ে হাজির হন নতুন সভ্যর সামনে। আর হুইলচেয়ারের সভ্যটি অনেক কষ্টে নিজের নাম স্বাক্ষর করেন-স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। এরপর থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত হকিং পেয়েছেন ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার, যার মধ্যে রয়েছে তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের সর্বোচ্চ সম্মান আলবার্ট আইনস্টাইন পদক। ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে, তাঁর পুরোনো অক্সফোর্ডসহ। রানি এলিজাবেথ তাঁর নাম ঘোষণা করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন কমান্ডার (Commander of the British Empire) হিসেবে। আর ১৯৭৯ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হকিংকে বানাল গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর, একসময় যে পদ অলংকৃত করেছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। ২০০৯ সালে আবারও এই পদে আসীন হোন তিনি। সর্বশেষ এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক।
ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম
১৯৮৮ সালে স্টিফেন হকিংয়ের ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম—ফরম দ্য বিগ ব্যাং টু ব্ল্যাকহোলস’ প্রকাশিত হয়। বিশ্বজুড়ে আজ পর্যন্ত এক কোটি কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। এখনো প্রতি মাসে সারা বিশ্বে এর প্রায় ৫ হাজার কপি বিক্রি হয়। প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকায় ৪০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। ফলে দুটো উল্টো ছাপানো ছবিসহ ওই মার্কিন সংস্করণ সংশোধনের আগেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়! বিজ্ঞানের দুরূহতম বিষয়ের এমন সহজবোধ্য বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি বলে ধারণা করা হয়। যদিও জটিল বিষয়বস্তুর কারণে অনেকেই বেশি দূর এগোতে পারেন না। এই বইয়ের শেষে হকিং তিনজন বিজ্ঞানী সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। গ্যালিলিও, নিউটন ও আইনস্টাইন। দুর্জনেরা বলেন, আগামী দিনের ব্রিফ হিস্ট্রিতে থাকবে চারটি জীবনী। চতুর্থটি হবে হকিংয়ের।
ঈশ্বরের মন
হকিংয়ের কাছে কেউ যদি জানতে চাইত, বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? হকিং বলতেন, ঈশ্বরের মন বুঝতে পারা। কীভাবে? এই বস্তুজগতের নিয়মাবলির সাধারণ, সহজ ও সরল সূত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব হবে সব পেয়েছিল তত্ত্ব। এই যে হকিং কদিন আগেও বেশি মাথা ঘামিয়েছেন কাল্পনিক সময়, ওয়ার্মহোল প্রভৃতি নিয়ে—এ সবকিছুর লক্ষ্যও কিন্তু এক। নিছক কোনো কাগুজে সমীকরণ নয়, এ হচ্ছে সব পেয়েছিল চাবি। এর সাহায্যে মানুষ যেমন পারবে বস্তুজগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৌলিক কণার খবর জানতে, তেমনি সক্ষম হবে দূর মহাকাশের বিশালাকার কৃষ্ণবিবরের আচরণ ব্যাখ্যা করতে। বস্তুজগতে মোট চার ধরনের বল ও তাদের মিথস্ক্রিয়া আমরা অনুভব করছি প্রতিনিয়ত। মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ-চৌম্বক, ক্ষীণ ও সবল পারমাণবিক বল। প্রকৃতি জগতের এই চারটি বলকে একত্র করে একটি সমন্বিত তত্ত্ব দাঁড় করানোই হলো এখনকার তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে সবল, ক্ষীণ ও তড়িৎ-চৌম্বকত্বের এককত্ব প্রমাণিত। বাকি রয়েছে মহাকর্ষ। মহাকর্ষ সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর তত্ত্বটি হলো আইনস্টাইনের সাধারণ তত্ত্ব। অন্যদিকে মাইক্রোওয়ার্ল্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের কণারা মেনে চলে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কাজেই মেলাতে হবে এই দুই তত্ত্বকে, পেতে হবে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির সন্ধান। পরিণয়ের আগে পরিচয়ের পালাটি করিয়ে দিয়েছেন হকিং। ব্ল্যাকহোলের আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাকাশে সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এই জোড় মেলানোর কাজে ব্যস্ত। জ্যামিতিক চিত্রের মাধ্যমে তিনি নিজের চিন্তাকে বিকশিত করতেন, মাত্র দুই আঙুল নাচিয়ে তিনি কম্পিউটারের মাধ্যমে নিজের ভাব প্রকাশ করতেন। ছুটে যাচ্ছেন দেশ থেকে দেশে, লোকেদের শোনান বিজ্ঞানের কথা। বলেন, বিজ্ঞান আর গবেষণাকে ভালোবাসতে, যাতে মানবজাতি এগোতে পারে। কেবল বক্তৃতা নয়, লিখে ফেলেছেন বিজ্ঞানকে সহজ করে বলা বই। ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’–এর কথা আগেই বলেছি। এর বাইরে ‘ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’, ‘ব্রিফার হিস্টরি অব টাইম’, ‘ব্ল্যাকহোল অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স’, ‘গড ক্রিয়েটেড দ্য ইন্টিজার’, ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ প্রভৃতি বই। মেয়ে লুসির সঙ্গে লিখেছেন, ‘জর্জ’স সিক্রেট কি টু ইউনিভার্স’, যেখানে হ্যারি পটারের স্টাইলে বিজ্ঞানের জটিল বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। হকিং অভিনয় করেছেন স্টারট্রেকের ডিসেন্ট এপিসোডে। পিঙ্ক ফ্লয়েডের ‘ডিভিশন বেল’ অ্যালবামের ‘কিপ টকিং’ গানে হকিংয়ের সিনথেসাইজড শব্দ আছে, সেখানে তাঁর সিনথেসাইজড ভয়েস ব্যবহার করা হয়েছে। উজ্জ্বল চোখের অধিকারী গ্যালিলিও-আইনস্টাইনের দুনিয়ার এই মানুষটি হুইলচেয়ারে বসে দীর্ঘদিন পদার্থবিজ্ঞানের জগৎটাকে শাসন করেছেন। মৃত্যুর পরও তাঁকে সেই আসনেই রেখে দেবেন বিজ্ঞানীরা। স্টিফেন হকিং বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে, তাঁর চিন্তা ও মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসায়।
ঈশ্বর যখন নরক বানাচ্ছিলেন
১৯১৬ সালে আইনস্টাইন তাঁর আপেক্ষিকতার সাধারণ তত্ত্ব প্রকাশ করেন। ১৯২২ সালে ফ্রিডম্যান আপেক্ষিতার সমীকরণের সমাধান করেন। তাতে দেখা যায়, এই দুনিয়া ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। নিউটনের স্থির দুনিয়া তত্ত্বের লোকজন এতে আঁতকে ওঠেন, খোদ আইনস্টাইনও এই সমাধান নাকচ করেন। কিন্তু ১৯২৯ সালে এডউইন হাবল দুরবিন দিয়ে সত্যটা দেখে ফেলেন, দুনিয়া আসলেই সম্প্রসারিত হচ্ছে! গ্যালাক্সিগুলো পরস্পর পরস্পর থেকে দ্রুত সরে যাচ্ছে। অর্থাৎ, সময়ের সঙ্গে সঙ্গে যদি আপনি পেছনে যান, তাহলে একসময় দেখা যাবে, এই দুনিয়ায় সবকিছু এক বিন্দুতে ছিল। কোনো এক সন্ত্রাসী ঘটনায় সবাই দিগ্বিদিক হয়ে ছুটে চলেছে। এ থেকে উদ্ভব বিগ ব্যাং তত্ত্বের, যা আজকের কসমোলজির প্রাণ। বিগ ব্যাংয়ের সমস্যা অন্যত্র। দুনিয়ার সবকিছুকে এক জায়গায় জড়ো করলে যা হয়, তাতে বিজ্ঞান একটু অস্বস্তিতে পড়ে। কারণ, এক বিন্দুর দুনিয়ার নাম সিঙ্গুলারিটি, যাতে জানা সমীকরণগুলোর ভগ্নদশা। ষাটের দশকে রজার পেনরোজের সঙ্গে হকিং দেখালেন তাঁর প্রথম খেল। বললেন, যতই আপত্তি থাকুক সিঙ্গুলারিটি থেকেই দুনিয়ার শুরু। শুধু তা–ই নয়, বিগ ব্যাং থেকেই সময়ের শুরু। অর্থাৎ, বিগ ব্যাংয়ের আগে বলে কিছু নেই। খ্যাপা, লোকজনের অনেকে হকিংয়ের কাছে জানতে চাইত বিগ ব্যাংয়ের আগে ঈশ্বর কী করেছিলেন? মুচকি হেসে হকিং বলতেন, অবিশ্বাসীদের জন্য নরক বানাচ্ছিলেন!
ঈশ্বর কি পাশা খেলেন?
সময়ের শুরুর ধারণা জেনে হকিং এগোলেন সম্পূর্ণ ভিন্ন পথে। এরই মধ্যে জানা হয়েছে, বস্তুজগতে এমন বস্তু সম্ভব, যার থেকে দুনিয়ায় সবচেয়ে দ্রুতযান আলোও বের হতে পারে না—ব্ল্যাকহোল, কৃষ্ণবিবর। ব্ল্যাকহোল কি আসলেই ব্ল্যাক? কিছুই কি সেখান থেকে বের হতে পারে না? হুইলচেয়ারের বিজ্ঞানী ভাবেন। ভাবেন কোয়ান্টাম বিজ্ঞানের অনিশ্চয়তার তত্ত্ব নিয়ে। পরস্পর সম্পর্কযুক্ত দুটো কোয়ান্টাম রাশির যুগপৎ নিশ্চয়তা নেই। শূন্যস্থানে এই তত্ত্বের প্রয়োগ এরই মধ্যে বলে ফেলেছে শূন্যস্থান আসলে শূন্য নয়। সেখানে প্রতিনিয়ত তৈরি হচ্ছে কণা ও প্রতিকণা, আবার তা লয়ও পাচ্ছে। হকিং এই ঘটনাকে প্রয়োগ করলেন ব্ল্যাকহোলের আশপাশে এবং আশ্চর্য হয়ে দেখলেন ব্ল্যাকহোল থেকেও বের হয়ে আসছে অবিরল কণাস্রোত। ১৯৭৩ সালে হকিং প্রকাশ করলেন তাঁর ধারণা এবং অচিরেই তা গৃহীত হলো। বিজ্ঞানজগৎ ওই বিকিরণকে অভিহিত করল হকিংয়ের নামে—হকিং রেডিয়েশন। তত দিনে স্টিফেন হকিং কোনোমতে লিখতে পারেন। হুইলচেয়ারেই আসীন। আর তাই ১৯৭৪ সালের রাজকীয় বিজ্ঞান সমিতির শত বছরের নিয়ম ভেঙে সভাপতি খাতা হাতে নিয়ে হাজির হন নতুন সভ্যর সামনে। আর হুইলচেয়ারের সভ্যটি অনেক কষ্টে নিজের নাম স্বাক্ষর করেন-স্টিফেন উইলিয়াম হকিং। এরপর থেকে আশির দশকের শুরু পর্যন্ত হকিং পেয়েছেন ছয়টি আন্তর্জাতিক পুরস্কার, যার মধ্যে রয়েছে তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের সর্বোচ্চ সম্মান আলবার্ট আইনস্টাইন পদক। ছয়টি বিশ্ববিদ্যালয় তাঁকে সম্মানসূচক ডক্টরেট ডিগ্রি দিয়েছে, তাঁর পুরোনো অক্সফোর্ডসহ। রানি এলিজাবেথ তাঁর নাম ঘোষণা করেছেন ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের একজন কমান্ডার (Commander of the British Empire) হিসেবে। আর ১৯৭৯ সালে কেম্ব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয় হকিংকে বানাল গণিতের লুকাসিয়ান প্রফেসর, একসময় যে পদ অলংকৃত করেছিলেন স্যার আইজ্যাক নিউটন। ২০০৯ সালে আবারও এই পদে আসীন হোন তিনি। সর্বশেষ এখন তিনি বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি কেন্দ্রের গবেষণা পরিচালক।
ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম
১৯৮৮ সালে স্টিফেন হকিংয়ের ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম—ফরম দ্য বিগ ব্যাং টু ব্ল্যাকহোলস’ প্রকাশিত হয়। বিশ্বজুড়ে আজ পর্যন্ত এক কোটি কপিরও বেশি বিক্রি হয়েছে। এখনো প্রতি মাসে সারা বিশ্বে এর প্রায় ৫ হাজার কপি বিক্রি হয়। প্রকাশের ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে আমেরিকায় ৪০ হাজার কপি বিক্রি হয়েছিল। ফলে দুটো উল্টো ছাপানো ছবিসহ ওই মার্কিন সংস্করণ সংশোধনের আগেই বাজার থেকে উধাও হয়ে যায়! বিজ্ঞানের দুরূহতম বিষয়ের এমন সহজবোধ্য বই এ পর্যন্ত প্রকাশিত হয়নি বলে ধারণা করা হয়। যদিও জটিল বিষয়বস্তুর কারণে অনেকেই বেশি দূর এগোতে পারেন না। এই বইয়ের শেষে হকিং তিনজন বিজ্ঞানী সম্পর্কে আলোকপাত করেছেন। গ্যালিলিও, নিউটন ও আইনস্টাইন। দুর্জনেরা বলেন, আগামী দিনের ব্রিফ হিস্ট্রিতে থাকবে চারটি জীবনী। চতুর্থটি হবে হকিংয়ের।
ঈশ্বরের মন
হকিংয়ের কাছে কেউ যদি জানতে চাইত, বিজ্ঞানের চূড়ান্ত লক্ষ্য কী? হকিং বলতেন, ঈশ্বরের মন বুঝতে পারা। কীভাবে? এই বস্তুজগতের নিয়মাবলির সাধারণ, সহজ ও সরল সূত্র আবিষ্কারের মাধ্যমে। এই তত্ত্ব হবে সব পেয়েছিল তত্ত্ব। এই যে হকিং কদিন আগেও বেশি মাথা ঘামিয়েছেন কাল্পনিক সময়, ওয়ার্মহোল প্রভৃতি নিয়ে—এ সবকিছুর লক্ষ্যও কিন্তু এক। নিছক কোনো কাগুজে সমীকরণ নয়, এ হচ্ছে সব পেয়েছিল চাবি। এর সাহায্যে মানুষ যেমন পারবে বস্তুজগতের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র মৌলিক কণার খবর জানতে, তেমনি সক্ষম হবে দূর মহাকাশের বিশালাকার কৃষ্ণবিবরের আচরণ ব্যাখ্যা করতে। বস্তুজগতে মোট চার ধরনের বল ও তাদের মিথস্ক্রিয়া আমরা অনুভব করছি প্রতিনিয়ত। মহাকর্ষ, বিদ্যুৎ-চৌম্বক, ক্ষীণ ও সবল পারমাণবিক বল। প্রকৃতি জগতের এই চারটি বলকে একত্র করে একটি সমন্বিত তত্ত্ব দাঁড় করানোই হলো এখনকার তত্ত্বীয় পদার্থবিদদের চ্যালেঞ্জ। ইতিমধ্যে সবল, ক্ষীণ ও তড়িৎ-চৌম্বকত্বের এককত্ব প্রমাণিত। বাকি রয়েছে মহাকর্ষ। মহাকর্ষ সম্পর্কে সবচেয়ে সুন্দর তত্ত্বটি হলো আইনস্টাইনের সাধারণ তত্ত্ব। অন্যদিকে মাইক্রোওয়ার্ল্ডের ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র জগতের কণারা মেনে চলে কোয়ান্টাম বলবিদ্যা। কাজেই মেলাতে হবে এই দুই তত্ত্বকে, পেতে হবে কোয়ান্টাম গ্র্যাভিটির সন্ধান। পরিণয়ের আগে পরিচয়ের পালাটি করিয়ে দিয়েছেন হকিং। ব্ল্যাকহোলের আচরণ ব্যাখ্যা করতে গিয়ে মহাকাশে সার্থক প্রয়োগ ঘটিয়েছেন কোয়ান্টাম তত্ত্বের। বিশ্বজুড়ে বিজ্ঞানীরা এই জোড় মেলানোর কাজে ব্যস্ত। জ্যামিতিক চিত্রের মাধ্যমে তিনি নিজের চিন্তাকে বিকশিত করতেন, মাত্র দুই আঙুল নাচিয়ে তিনি কম্পিউটারের মাধ্যমে নিজের ভাব প্রকাশ করতেন। ছুটে যাচ্ছেন দেশ থেকে দেশে, লোকেদের শোনান বিজ্ঞানের কথা। বলেন, বিজ্ঞান আর গবেষণাকে ভালোবাসতে, যাতে মানবজাতি এগোতে পারে। কেবল বক্তৃতা নয়, লিখে ফেলেছেন বিজ্ঞানকে সহজ করে বলা বই। ‘আ ব্রিফ হিস্ট্রি অব টাইম’–এর কথা আগেই বলেছি। এর বাইরে ‘ইউনিভার্স ইন আ নাটশেল’, ‘ব্রিফার হিস্টরি অব টাইম’, ‘ব্ল্যাকহোল অ্যান্ড বেবি ইউনিভার্স’, ‘গড ক্রিয়েটেড দ্য ইন্টিজার’, ‘দ্য গ্র্যান্ড ডিজাইন’ প্রভৃতি বই। মেয়ে লুসির সঙ্গে লিখেছেন, ‘জর্জ’স সিক্রেট কি টু ইউনিভার্স’, যেখানে হ্যারি পটারের স্টাইলে বিজ্ঞানের জটিল বিষয় তুলে ধরা হয়েছে। হকিং অভিনয় করেছেন স্টারট্রেকের ডিসেন্ট এপিসোডে। পিঙ্ক ফ্লয়েডের ‘ডিভিশন বেল’ অ্যালবামের ‘কিপ টকিং’ গানে হকিংয়ের সিনথেসাইজড শব্দ আছে, সেখানে তাঁর সিনথেসাইজড ভয়েস ব্যবহার করা হয়েছে। উজ্জ্বল চোখের অধিকারী গ্যালিলিও-আইনস্টাইনের দুনিয়ার এই মানুষটি হুইলচেয়ারে বসে দীর্ঘদিন পদার্থবিজ্ঞানের জগৎটাকে শাসন করেছেন। মৃত্যুর পরও তাঁকে সেই আসনেই রেখে দেবেন বিজ্ঞানীরা। স্টিফেন হকিং বেঁচে থাকবেন তাঁর কর্মে, তাঁর চিন্তা ও মানুষের প্রতি তাঁর ভালোবাসায়।
No comments