হকিংয়ের স্মৃতি, মেরেলিন মনরো ও মহাবিশ্ব by তীব্র আলী
আমি তখন কেমব্রিজ বিশ্বিবদ্যালয়ের এক
নাদান পিএইচডি ছাত্র। সেখানকার এক পুরানা বইয়ের দোকানে একদিন পেয়ে গেলাম
স্টিফেন হকিংয়ের অধ্যাপক জীবনের সূচনা বক্তৃতা, ‘তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার
সমাপ্তি কি সমুখেই?’ (Is the end in sight for theoritical physice?'।
জন্মের বইপোকা আমি, তখনই বুঝতে পারলাম কী বিরল একটা বইয়ের সামনে পড়েছি।
স্টিফেন হকিং মর্যাদাকর লুকাসিয়ান অধ্যাপক পদে যোগ দেয়ার আরম্ভ ছিল এই
বক্তৃতা। (লুকাসিয়ান অধ্যাপকের পদটি একসময় অধিকার করে ছিলেন বিজ্ঞানী
আইজ্যাক নিউটন এবং প্রখ্যাত কোয়ান্টাম পদার্থবিদ পল ডিরাক।) তাঁর ওই
বক্তৃতার প্রথম সংস্করণ ছিল বইটা এবং পরে আর তা আর ছাপা হয়নি। কারও একটা
বিশেষ বক্তৃতার মাধ্যমে কারও অধ্যাপনার ‘উদ্বোধন’ করা ছিল কেমব্রিজের
বহুদিনের ঐতিহ্য। হকিং ওই বক্তৃতা দিয়েছিলেন ১৯৮০ সালে। তিনি সেখানে
ভবিষ্যদ্বাণী করে বলেছিলেন, সুপারগ্র্যাভিট নামের এগার-মাত্রার তত্ত্বটি
তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার বনিয়াদি সমস্যার সমাধান এনে দেবে। বক্তৃতাটি বিশেষ
রকম উশকানিমূলক ছিল। পরে দেখা গেল তাঁর ওই আশাবাদ ছিল একটু আনাড়ির মতোই।
বেশ কয়েক বছর পর আমি যখন কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র, তখন তিনি তাঁর ওই
চিন্তার দ্বিতীয় পর্ব নিয়ে আবার একটা বক্তৃতা দিলেন। আমার স্ট্রিং থিওরির
শিক্ষক ম্যালকম পেরি ছিলেন হকিংয়ের প্রথম দিকের অন্যতম পিএইচডি ছাত্র। আর
আমার পিএইচডির সুপারভাইজরও ছিলেন পেরি। সুতরাং হকিং হলেন আমার বিদ্যায়তনিক
দাদা (যেহেতু তাঁর পিএইচডি ছাত্র ছিলেন আমার সুপারভাইজর)। যাহোক, আমার
গল্পে ফিরে আসি। বইটার দামি ছিল ১০ পাউন্ড বা ওরকম কিছু। আমার গরিব পকেটের
জন্য এটা ছিল একটু বেশিই। তারপরও বইটা আমি কিনলাম এবং আমার জিনিসপত্রের
মধ্যে খুব যত্নে প্যাকেট করে আলাদা রেখে দিলাম। কেমব্রিজে যে গবেষণা
গ্রুপটিতে আমি কাজ করতাম, হকিং ছিলেন সেটার প্রধান। প্রায়ই তাঁকে আমরা
দেখতে পেতাম। তিনি হয়তো শুক্রবারে আমাদের গবেষক গ্রুপের সেমিনারে আসা সবার
দুপুরের খাবারের বিল দিতেন। মজাই হতো। মাগনা পিজা আর মুরগি খাবার লোভে
বিভাগের অনেক ছাত্রছাত্রীই ওইসব সেমিনারে আসতো। বছরে একবার তিনি আমাদের
নিয়ে যেতেন তাঁর প্রিয় থাই রেস্টুরেন্টে। বিভাগী পার্টিগুলোতে ডাকাবুকো
লোকদের সঙ্গে বকবকানিতে ক্লান্ত হয়ে চলে আসতেন ছাত্রছাত্রীদের আড্ডায়। ২০০২
সালে, কেমব্রিজ থেকে স্নাতক করে বেরিয়ে আসার ঠিক আগে আমার সাহস হলো। এক
পার্টির মধ্যে আমি তাঁর সামনে গেলাম এবং ধন্যবাদ জানালাম। তিনি মৃদু হাসলেন
এবং তাঁর তখনকার স্ত্রীর সঙ্গে কিছু কথাবার্তা বলে চলে আসলাম। সেসময়ই এক
পর্যায়ে আমি তাঁর কাছে জানতে চাইলাম, তিনি আমাকে তাঁর সেই প্রথম বক্তৃতার
একটা কপিতে অটোগ্রাফ দেবেন কি না।
তিনি রাজি হলেন এবং দুই কি এক দিনের
মধ্যে আমি বইটি পেলাম। সেটাই ছিল আমার সবচেয়ে দামি পুরস্কার এবং
মহামূল্যবান সংগ্রহ। শুধু তা-ই নয়, তাঁর ব্যক্তিগত সচিব বইটার সঙ্গে
কপিরাইট কাগজে ছাপা তাঁর এক হাসিমুখ ছবিও দিয়ে দিয়েছিলেন। মেরেলিন মনরো’র
আত্মজীবনী হাতে হকিংয়ের দুষ্টুমিভরা হাসির ওই ছবিটি আমার খুব পছন্দের।
স্টিফেন মেরেলিন মনরোকে সত্যিই খুব ভালবাসতেন। কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ে স্টিফেনের
বৈপ্লবিক তত্ত্বই সম্ভবত পদার্থবিদ্যায় তাঁর মহত্তম অবদান। ব্ল্যাক হোল বা
কৃষ্ণগহ্বর বিষয়ে তাঁর প্রথম দিকের কাজ প্রতিষ্ঠিত করেছিল যে, মহাবিশ্বের
অন্যান্য বৃহত বস্তগত ব্যবস্থার মতোই ব্ল্যাকহোলও তাপগতিবিদ্যার সূত্র মেনে
চলে। ব্ল্যাকহোল বিষয়ে গতানুগতিক বোঝাপড়া ছিল এই, বিপুল মধ্যাকর্ষের জন্য
তারা সবকিছু শুষে নেয় কিন্তু কিছুই নিঃসরণ করে না। ব্ল্যাকহোল ঘিরে থাকে
এমন এক দিগন্ত, যে কাল্পনিক সীমা থেকে কিছুই ফিরে আসে না। একপর্যায়ে
ব্ল্যাকহোলের কাছাকাছি জায়গায় কোয়ান্টাম তত্ত্ব প্রয়োগের মাধ্যমে হকিং
দেখালেন, ব্ল্যাকহোল তাপ বা আলোর বিকীরণ নিঃসরণ করে। এবং এক পর্যায়ে এই
বিকীরণের কারণে কৃষ্ণগহ্বর উবে গিয়ে নাই হয়ে যাবে। তাহলেও, আমাদের
মহাবিশ্বের বাস্তব ব্ল্যাকহোলগুলি সম্পূর্ণভাবে উবে যেত যত সময় লাগবে
ততদিনে মহাবিশ্বই ধ্বংস হয়ে যাবে। এমনকি, কোনো ব্ল্যাকহোলকেও কাছাকাছি সময়ে
উবে যেতে দেখার কথা না। হকিংয়ের এই তত্ত্ব পদার্থবিদ্যার জগতে এক শোরগোল
তুলে ফেলল। কারণ হলো, হকিং একইসঙ্গে দেখিয়েছেন, ব্ল্যাকহোল যখন বিকীরণ করে
তখন ওই বিকীরিত শক্তির (Energy) মধ্যে কোনো গুণ বা তথ্য থাকে না। এটা তখন
নিছক তাপই, আর কিছু না। ফলে কোনো ব্ল্যাকহোল চূড়ান্তভাবে নাই হয়ে যাওয়া
মানে তার ভেতরে থাকা সব তথ্যেরও সম্পূর্ণভাবে মহাবিশ্ব থেকে হারিয়ে যাওয়া।
এই চিন্তা কোয়ান্টাম থিওরির জগতে একটা কূটাভাসের (Paradox) জন্ম দেয়। হকিং
এই কূটাভাসের প্রস্তাবনা এনেছিলেন ১৯৭০ এর দশকে। এখন পর্যন্ত এই সমস্যার
মীমাংসা করা যায়নি। তখন থেকেই তাত্ত্বিক পদার্থবিদ্যার এই শাখা সক্রিয়
গবেষণার বিষয় হয়ে আছে। পিএইচডি গবেষণায় হকিং দেখিয়েছেন, পদার্থবিদ্যার যে
নিয়মগুলি আমরা জানি সেসবকে পেছনের দিকে চালিয়ে গেলে দেখা যায়, মহাবিশ্ব
অবশ্যই এক মহাবিষ্ফোরণের (Big Bang) অনন্য মুহূর্তে সৃষ্টি হয়েছে। এভাবে
তিনি মহাবিষ্ফোরণের তত্ত্বকে প্রথম শক্ত গাণিতিক ভিত্তির ওপর দাঁড় করালেন।
তাহলেও বিগ ব্যাং তত্ত্ব নিয়ে বেশ কিছু যন্ত্রণাকর সমস্যা রয়ে গিয়েছিল এবং
এখনো আছে। ১৯৮০’র দশকে হকিং (অন্যান্য পদার্থবিদের সঙ্গে মিলে) প্রসারমাণ
মহাবিশ্বের মডেল সামনে নিয়ে আসায় বড় ভূমিকা পালন করেন। এখন পর্যন্ত
মহাবিশ্বভাবনার প্যারাডাইম সেটাই আছে। স্টিফেন হকিং এক মহান পদার্থবিদ।
মহাবিশ্ব সম্পর্কে মানুষের চিন্তাভাবনাকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছেন তিনি।
তিনি ছিলেন সৃষ্টিশীল, মজাদার এবং নিজের দৈহিক অক্ষমতাকে জয়কারী এক মানুষ।
কখনোই শারীরিক সীমাবদ্ধতার মধ্যে তিনি সীমিত হননি। আমরা যারা পদার্থবিদ্যা
ভালবাসি, তিনি আমাদের অনুপ্রাণিত করতেন এবং অনেককাল ধরে সেটাই করে যাবেন।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
ড. তীব্র আলী: তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। অ্যালামনাই ঢাকা ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে কানাডার পেরিমিটার ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিকাল ফিজিক্সে গবেষণারত।
ইংরেজি থেকে অনুবাদ ফারুক ওয়াসিফ
ড. তীব্র আলী: তাত্ত্বিক পদার্থবিদ। অ্যালামনাই ঢাকা ও কেমব্রিজ বিশ্ববিদ্যালয়। বর্তমানে কানাডার পেরিমিটার ইনস্টিটিউট অব থিওরিটিকাল ফিজিক্সে গবেষণারত।
No comments