অর্থমন্ত্রীর ‘সেটিসফাইড’ প্রশাসন- সর্বনিম্ন বেতন ৮,২০০ সর্বোচ্চ ৮০,০০০
সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতভাগ বেতন বাড়ানোর সুপারিশ করে জাতীয় বেতন কাঠামোর প্রতিবেদন অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিতের কাছে জমা দিয়েছেন পে-কমিশনের সভাপতি মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। এতে সর্বনিম্ন বেতন ৮২০০ ও সর্বোচ্চ বেতন সচিবদের ৮০ হাজার টাকা করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এ ছাড়া সিনিয়র সচিবদের ৮৮ হাজার টাকা, মন্ত্রিপরিষদ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের সর্বোচ্চ ১ লাখ টাকা বেতনের সুপারিশ করা হয়েছে। কোন কর্মকর্তাকে অতিরিক্ত দায়িত্ব দেয়া হলে তাকে ৪০০০ টাকা ভাতা দেয়ার সুপারিশ করেছে পে-কমিশন। প্রতিবেদন জমা দেয়ার পর ফরাসউদ্দিন নতুন বেতন কাঠামোতে কি কি সুপারিশ করা হয়েছে, ওই ব্যাপারে ব্রিফিং করেন। অর্থমন্ত্রী পে-কমিশনের প্রতিবেদনের বিষয়ে সাংবাদিকদের বলেন, রিপোর্ট দেখলাম। আমাদের ইচ্ছা আছে যাচাই-বাছাই শেষে আগামী বছরের ১লা জুলাই থেকে বাস্তবায়ন প্রক্রিয়া শুরু করা যাবে। ব্রিফিংয়ে মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন জানান, নতুন বেতন কাঠামোতে ১৬টি ধাপ করার সুপারিশ করা হয়েছে, বর্তমানে ২০টি ধাপ আছে। ৬ সদস্যের পরিবারকে একক ধরে করা নতুন বেতন কাঠামোতে সর্বনিম্ন বেতন স্কেল ৮২০০ টাকা এবং সর্বোচ্চ ৮০ হাজার টাকা নির্ধারিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। এতে ধাপ ‘১’-এর সরকারি কর্মকর্তাদের বেতন হবে নির্ধারিত ৮০ হাজার টাকা আর ১৬তম ধাপধারীদের বেতন স্কেল হবে ৮২০০ টাকা। এ ছাড়া সরকারি চাকরিতে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে যোগদানকারীদের স্কেল হবে ২৫ হাজার টাকা। তিনি জানান, পদোন্নতি হোক বা না হোক সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন ১৫ বছরে দ্বিগুণ করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া সচিবদের ৮০ হাজার টাকার সঙ্গে আরও ৪০০০ টাকা অতিরিক্ত দেয়া, সিনিয়র সচিবদের বেতন ৮৮ হাজার টাকা এবং কেবিনেট সচিব ও প্রধানমন্ত্রী কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের বেতন এক লাখ টাকা করার সুপারিশ করা হয়েছে। এ বেতন কাঠামো কার্যকর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে মহার্ঘ্য ভাতা বিলুপ্ত বলে গণ্য হবে। ফরাসউদ্দিন জানান, বাংলাদেশ ব্যাংকের জন্য আলাদা বেতন কাঠামো করা যেতে পারে। তবে সে ক্ষেত্রে জাতীয় বেতন কাঠামোর ধাপগুলো যেন বজায় রাখা হয় সেটি সরকার বিবেচনা করবে। সরকারি চাকরিজীবীদের আবাসন সঙ্কট মেটাতে কিছু আবাসন নির্মাণ প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে ফ্ল্যাট তৈরির প্রস্তাব দিয়েছে কমিশন। এ ছাড়া ১০ বা ২০ সরকারি চাকরিজীবী মিলে গ্রুপ করে জমি কিনে ফ্ল্যাট নির্মাণ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে ৫০ মাসের মূল বেতনের সমান ঋণ দেয়ার কথা বলা হয়েছে। কমিশন মনে করে এ কার্যক্রম গ্রহণ করা হলে ম্রিয়মাণ আবাসন খাতে প্রাণের সঞ্চার ঘটবে। ফরাসউদ্দিন জানান, পেনশন বর্তমান ৮০ থেকে ৯০ শতাংশে উন্নীত করা যায় কিনা, সেটি বিবেচনার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ছাড়া স্বেচ্ছা অবসরের চাকরির বয়স ২৫ বছর থেকে কমিয়ে ২০ বছর করা এবং কল্যাণ ফান্ডকে পুনর্গঠিত করে বীমা, পেনশন ও কল্যাণ ফান্ড ব্যবস্থাপনা নামে তিনটি আলাদা বিষয় করার সুপারিশ করা হয়েছে। ফরাসউদ্দিন বলেন, রাজধানীর দৈনিক বাংলায় থাকা সরকারি জমি থেকে ২০-২৫ কাঠা জমি বিক্রি করে একটি ব্যাংক গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। এ ব্যাংকের নাম ‘সমৃদ্ধির সোপান ব্যাংক’ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। ব্যাংকের পরিশোধিত মূলধন হবে ৪০০ কোটি টাকা। ব্যাংকটি উন্নয়ন ও বাণিজ্যিক ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে। এ ব্যাংক থেকে ‘এক অঙ্কে’ সুদে ঋণ দেয়া সম্ভব হবে বলেও মনে করছে কমিশন। সরকারি চাকরি আকর্ষণীয় না হলে আগামী দিনের প্রবৃদ্ধি নিশ্চিত করা সম্ভব হবে না এমনটা উল্লেখ করে ফরাসউদ্দিন বলেন, একটি স্থায়ী বেতন ও চাকরি কমিশন গঠনের সুপারিশ করা হয়েছে। নতুন এ বেতন কাঠামোর সুপারিশগুলো বাস্তবায়ন করলে সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন গড়ে ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ বাড়বে। ফরাসউদ্দিন বলেন, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের বেতনের জন্য সপ্তম কমিশন যে প্রস্তাব দিয়েছিল তখন বাজেটের গড় অনুপাত ছিল ১৫ ভাগ। আর বর্তমান জাতীয় বাজেটের গড় অনুপাত হচ্ছে ১৪.২ ভাগ। প্রস্তাবিত বেতন কাঠামোতে ২ সন্তানের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা বাবদ ব্যয়সহ ৬ সদস্যের পরিবারের খরচ বিবেচনায় নিয়ে এবারের বেতন কমিশন তাদের সুপারিশ করেছে, যেখানে আগের কাঠামোতে পরিবারের সদস্য সংখ্যা ধরা হয়েছিল ৪ জন। ফরাসউদ্দিন বলেন, বিভাজন সৃষ্টিকারী শ্রেণী বিভাগ রহিত করা হয়েছে। তার পরিবর্তে গ্রেড এবং ক্লাস দিয়ে পরিচিত হবে। ঔপনিবেশিক আমলের শোষণযন্ত্র ইবি (ইফিশিয়েন্সি বার) তুলে দেয়ার সুপারিশ করা হয়েছে। তিনি বলেন, কমিশনের কার্য অনুসন্ধানে দেখা গেছে, সরকারি চাকুরেদের মধ্যে বিভিন্ন ধরনের নতুন ভাতা প্রদান ও বিদ্যমান ভাতা বাড়ানোর দাবি প্রবল হয়ে উঠেছে। নতুন বেতন কাঠামোতে যেহেতু বেতন যথেষ্ট বৃদ্ধি পাবে তাতে ভাতা বৃদ্ধি সমীচীন হবে না বলে কমিশন মনে করে। কিছু ভাতা যৌক্তিককরণ করার পক্ষে মত দিয়েছে কমিশন। এর মধ্যে বাড়ি ভাড়া ভাতা আরও যৌক্তিক করার সুপারিশ দেয়া হয়েছে। ৪টি স্তরের সুপারিশ করা হয়েছে। ঢাকা মেট্রোপলিটন, চট্টগ্রামসহ বিভাগীয় শহর ও সাভার, নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, জেলা শহর ও অন্যান্য ক্যাটিগরিতে বিভক্ত করার সুপারিশ দেয়া হয়েছে। বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ছাত্র বেতনের একটি অংশ রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেয়ার বিধানকে যৌক্তিক মনে করে কমিশন। এ ছাড়া এমপিওভুক্তির ক্ষেত্রে ৬ মাস পর বাস্তবায়নের সুপারিশ করা হয়েছে। ফরাসউদ্দিন বলেন, গাড়ি কেনার ক্ষেত্রে প্রাধিকারপ্রাপ্তদের বাইরে ৩ গ্রেডের কর্মকর্তাদের ২৫ লাখ টাকা ঋণ দেয়ার চিন্তা করা যেতে পারে। তবে আধা-সরকারি বা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানে অনুরূপ গাড়ির ঋণ দেয়া হলে তার রক্ষণাবেক্ষণ খরচ সেই প্রতিষ্ঠানকে নিজস্ব তহবিল থেকে বহন করতে বলা হয়েছে। মাসে ১০০ টাকা দিয়ে ৫ বছর পর্যন্ত ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত বীমা চালু করা যেতে পারে। বীমার দাবি সরাসরি হাসপাতালে পরিশোধযোগ্য হতে পারে, নগদ প্রদানযোগ্য নয়। এ খাতের অর্থ থেকে ৫০০ শয্যার হৃদরোগ হাসপাতাল নির্মাণ করা যেতে পারে। এতে প্রথম বছর টাকা খরচ হলেও পরে আর তেমন অর্থের প্রয়োজন পড়বে না বলে মনে করে কমিশন। এ ব্যবস্থা নেয়া হলে বীমা খাতে প্রণের সঞ্চার হতে পারে। কমিশন কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ডেপুটেশন বাতিল ও প্রেষণে থাকা কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ভাতা বাতিলের সুপারিশ করেছে। এর আগে সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বেতন বৈষম্য দূর করতে গত বছরের ২৪শে নভেম্বর বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিনকে প্রধান করে ১৭ সদস্যের এ কমিশন গঠন করা হয়। কমিশনের ৬ মাসের মধ্যে রিপোর্ট দেয়ার কথা থাকলে পরে আরও ৬ মাস বাড়িয়ে এক বছর করা হয়। সর্বশেষ ২০০৭ সালে সপ্তম পে-কমিশন গঠন করা হয়। এর রিপোর্টের ভিত্তিতে ২০০৯ সালের জুলাই থেকে সর্বশেষ সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন-ভাতা বাড়ানো হয়। নতুন বেতন কাঠামোর প্রতিবেদন পাওয়ার পর অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত সাংবাদিকদের বলেন, আমরা বেতন কাঠামোটি পর্যবেক্ষণ করবো। আগামী বছরের ১লা জুলাই থেকে এটি কার্যকর করা হবে। আগামী দিনের অর্থনীতি হবে আলাদা ধরনের অর্থনীতি। সেই অর্থনীতির জন্য একটি স্যাটিসফাইড (সন্তুষ্ট) প্রশাসন দরকার। আমরা সেভাবেই এগোচ্ছি।
No comments