পরীক্ষায় নতুন দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ by মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার
বাংলাদেশের দুর্নীতি হ্রাস-বৃদ্ধির
গতিধারা পর্যালোচনা করলে দেখা যায়, এ দেশে এক সরকার যতটা দুর্নীতি করে,
পরবর্তী সরকার দুর্নীতি করে তার চেয়ে বেশি। সরকারি দলের নেতা-মন্ত্রীদের
দুর্নীতি দেখে বিরোধীদলীয় নেতা-কর্মীরা প্রণোদিত হন এবং পরে তারা ক্ষমতায়
এলে নতুন করে সেসব দুর্নীতিসহ আরও বেশি করে দুর্নীতি করেন। দুর্নীতিবাজদের
শাস্তি না হওয়ায় দুর্নীতি চর্চার এ গতিধারায় পরিবর্তন আসছে না। মাঝে অবশ্য
২০০৭-২০০৮ সালে মইনুদ্দীন-ফখরুদ্দীনের দুই বছরের অসাংবিধানিক, সেনা-সমর্থিত
সরকার সন্দেহভাজন দুর্নীতিবাজদের কতিপয় তালিকা করে শত শত রাজনৈতিক
নেতা-কর্মীকে গ্রেফতার করে দুর্নীতিবাজদের হৃদয়ে একটি ঝাঁকি দিয়েছিল। এতে
কালোবাজারি, চোরাকারবারি ও ঘুষখোরদের মধ্যে কাঁপন ও ত্রাস সৃষ্টি হয়েছিল।
কিন্তু প্রকৃতপক্ষে মাইনাস টু থিওরি কার্যকর করার অভিপ্রায়ে, রাজনীতি দমনের
উদ্দেশ্যে দুর্নীতি দমনের কার্যক্রম পরিচালনা করায় ওই সরকারের দুর্নীতি
দমনের উদ্যোগ ব্যর্থ হয়। এ প্রক্রিয়ায় শত শত রাজনৈতিক নেতাকে দুর্নীতির
অভিযোগে গ্রেফতার করে তাদের প্রায় কাউকেই শাস্তি দিতে না পারায়
দুর্নীতিবাজদের গ্রেফতার-জেল-জুলুমের লাজ-লজ্জা ভেঙে যাওয়ার কারণে পরে
নির্বাচিত সরকারের আমলে এসব দুর্নীতিবাজ নতুন উদ্যমে দুর্নীতি চর্চায়
আত্মনিয়োগ করেন।
মহাজোট আমলে রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা ও আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। এ আমলে দেশে দুর্নীতি বৃদ্ধির প্রমাণ, ২০১৪ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ ১৬তম থেকে ১৪তম স্থানে নেমে গেছে। অবশ্য বাংলাদেশে যে দুর্নীতি বাড়ছে সে বিষয়টি অনুধাবন করতে দুর্নীতির ধারণা সূচক দেখা লাগে না। যারা একটু চোখ-কান খোলা রাখেন, সচিবালয় বা বিভিন্ন সরকারি অফিসে কাজকর্ম করতে যান, তারা জানেন প্রতিটি সরকারি অফিসে দুর্নীতি কীভাবে শিকড় গেঁড়ে বসেছে। ঘুষের ফুয়েল না দিলে কোনো সরকারি অফিসে ফাইল নড়ে না। ২০১৪ সালের টিআইর দুর্নীতির সূচক বাংলাদেশকে সতর্ক সংকেত দিয়েছে। সরকারের উচিত টিআইর সমালোচনা না করে দুর্নীতি
বৃদ্ধিকে স্বীকার করে বর্ধিত দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে অধিকতর মনোযোগী হওয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ দেশে সরকারি দল থেকে টিআই রিপোর্টকে অবাস্তব বলে প্রত্যাখ্যান করা এবং বিরোধী দল থেকে ওই একই রিপোর্টকে স্বাগত জানানো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
৫ জানুয়ারির ব্যতিক্রমী নির্বাচনের পর নতুন সরকারের আমলে ওইসব দুর্নীতি আরও বর্ধিত মাত্রা পায়। এ বর্ধিত দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অবশ্য এ সরকারের কাছ থেকে দুর্নীতি দমনে সাফল্য আশা করা সঙ্গত নয়। কারণ, যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে সে নির্বাচনই দুর্নীতিমুক্ত ও অবাধ ছিল না। হয়তো সে কারণে সাম্প্রতিককালে নতুন নতুন খাতে দুর্নীতি চর্চার সূচনা হচ্ছে। যেমন- মহাজোট আমলে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি চর্চা হয়। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ৩৩৮ জন বিদেশী ব্যক্তিত্ব এবং ১০টি প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেয়ার যে শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করে, সে প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়। এই সম্মাননা প্রদানকালে তাদের একটি করে মূল্যবান ক্রেস্ট, সনদপত্র ও উপহার প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একেকটি সম্মাননা ক্রেস্ট তৈরিতে এক ভরি সোনা ও ৩০ ভরি জার্মান রুপা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থাকলেও এ ক্রেস্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় জড়িত চরম দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তামা, পিতল, নিকেল ও দস্তা ব্যবহার করে ক্রেস্ট বানিয়ে বরাদ্দকৃত সোনা-রুপা আত্মসাৎ করেন। কয়েকশ বিদেশী সম্মানিত অতিথি এই নকল ক্রেস্ট নিয়ে নিজ নিজ দেশে চলে যাওয়ার পর বিষয়টি ধরা পড়লে জুলিয়ান ফ্রান্সিস নামের একজন অতিথির একটি ক্রেস্ট এনে আণবিক শক্তি কমিশনে পরীক্ষা করার পর জানা যায়, আলোচ্য ক্রেস্টে সোনা বা রুপার কোনো অস্তিত্ব নেই। দুর্নীতিবাজরা এমন একটি মহতী উদ্যোগকে বিতর্কিত করে জাতীয় মানসম্মান ভূলুণ্ঠিত করে।
মহাজোট সরকারের আমলে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের সম্মানিত করে চাকরি দেয়ার নামে ব্যাপক দুর্নীতি করা হয়। ১৯০ জনকে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরি দেয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি বিষয়টি তদন্ত করিয়ে ওই প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি খুঁজে পায়। ওই তদন্তে দেখা যায়, যাদের মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে চিহ্নিত করে চাকরি দেয়া হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের বয়স ছিল ২ থেকে শুরু করে ১২-১৪ বছর পর্যন্ত। দুই বছর বয়সে তাদের যেখানে মায়ের কোলে থাকার কথা, সেখানে তারা মুজিবনগর সরকারে কীভাবে কাজ করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তথাকথিত মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীর সনদপত্র পেতে একেকজনের ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার একজন মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে সুবিধাভোগী, যার বয়স ১৯৭১ সালে ছিল ৮ বছর ৫ মাস ১২ দিন, তদন্ত কমিটিকে বলেন, আমি মুজিবনগর কর্মচারী নই। যুদ্ধকালে ভারতেও যাইনি। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি চক্রের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে কাগজ সংগ্রহ করেছি। আর কাগজ সংগ্রহ করতে আমার ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। অন্যরা কেউ ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ করেছে। নিয়োগ পেতে আমার মোট খরচ হয়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। মুজিবনগর কর্মচারী নিয়ে বিরাট একটি চক্র সারা দেশে টাকার বিনিময়ে কাজ করছে।
বর্তমান সরকার নিজেকে শিক্ষাবান্ধব সরকার হিসেবে দাবি করলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস কালচার ছড়িয়ে পড়ায় পরীক্ষা যেন অর্থহীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য সরকারের আমলে যে একেবারেই এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ছিল না এমন নয়। তখন হয়তো কয়েক বছর পর একবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর প্রকাশিত হতো। কিন্তু এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত খবরে পরিণত হয়েছে। এমনকি ছোটদের বড় পরীক্ষা হিসেবে পরিচিত ৩১ লাখ পরীক্ষার্থীর পিইসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলে স্কুলের কোমলমতি শিশুরাও এখন দুর্নীতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে পড়েছে। এটা জাতির জন্য একটি ভয়াবহ সংবাদ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সরকারের তরফ থেকে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি স্বীকারই করা হচ্ছে না। মাননীয় মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা একে কখনও গুজব, কখনও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, আবার কখনও কোচিং সেন্টারের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সাজেশন বলে আমলে নিচ্ছেন না। ফলে প্রশ্ন ফাঁসকারী সিন্ডিকেট নির্বিঘ্নে উৎসাহের সঙ্গে তাদের বিনা পুঁজির এ লাভজনক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
মহাজোট সরকারের পর বর্তমান নতুন সরকার আগের সরকারের দুর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে দুর্নীতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যেমন দলীয় অঙ্গসংগঠন, বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনের দুর্নীতি। তবে হ্যাঁ, দুর্নীতি দমনে সাফল্য না পেলেও বর্তমান সরকার দুর্নীতি চর্চায় বেশ কিছু নতুনত্ব এনেছে। যেমন- এ সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ফ্রড করে টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি চালু হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় একজন ছাত্র যোগ্য না হয়েও ৩-৪ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার হলে বসে অবৈধভাবে বাইরে থেকে প্রযুক্তির অপব্যবহার করে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছে। ফলে এ অবৈধ প্রক্রিয়ায় মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পরাস্ত করে কম মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে। নতুন প্রযুক্তি এলে সুযোগসন্ধানীরা এর অপব্যবহার করবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এ দুর্নীতি দমন করা অসম্ভব ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল ফ্রড করে ধরা পড়া দুর্নীতিবাজদের উল্লেখযোগ্য শাস্তি হয়েছে বলে জানা যায়নি। এ নতুন জালিয়াতিতে জড়িত সিন্ডিকেটগুলোকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এই নতুন জালিয়াত চক্র তাদের বিনা পুঁজির ব্যবসা বাড়াতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নয়া দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ করেছে। এভাবে জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়ার ইসলামী, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ জালিয়াতির বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল জালিয়াতি ধরা পড়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একইভাবে ওই সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়নি। এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনই সবসময় দাপটে থাকে। তাদের সমর্থন না নিয়ে ক্যাম্পাসে অন্য কারও পক্ষে এককভাবে বড় রকম জালিয়াতি করা সম্ভব নয়। কাজেই ডিজিটাল জালিয়াতকে তাদের সিন্ডিকেটসহ পাকড়াও করলে হয়তো সরকারি দল-সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী ধরা পড়ে যেত। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারি দল-সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে অথবা তাদের বিরাগভাজন হতে চায়নি বলেই হয়তো ওদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি না দিয়ে ওদের প্রতি নমনীয় আচরণ করেছে। এর ফলে এ নয়া দুর্নীতি অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায়ও ছড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
পরীক্ষায় ডিজিটাল ফ্রড করা জালিয়াত চক্রগুলোকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তি না দেয়ায় নাগরিক সম্প্রদায়, দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সুশাসনপ্রত্যাশী সুশীল সমাজের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। তারা যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন এবং এই জালিয়াতি অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষায় ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখে মানসিক যাতনা ভোগ করছেন। জালিয়াত চক্রগুলো তো আর কোনটি ভর্তি পরীক্ষা অথবা কোনটি পাবলিক পরীক্ষা তা বাছবিচার করে জালিয়াতি করবে না। তাদের উদ্দেশ্য জালিয়াতি করে অবৈধভাবে মুনাফা অর্জন করা। সম্মানিত পাঠক, আগামী বিসিএস পরীক্ষায় যদি এই ডিজিটাল জালিয়াতি সংক্রমিত হয়, তাহলে জাতির কত বড় সর্বনাশ হবে একবার ভেবে দেখুন। সে ক্ষেত্রে মেধাবীদের পরিবর্তে অমেধাবীরা বিসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে বিভিন্ন ক্যাডারভুক্ত সরকারি পদে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেবেন। আর এ প্রক্রিয়া বাধাহীনভাবে চলতে থাকলে দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে। এই জালিয়াতি রোধে উদ্যোগী না হলে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষা ও সব পাবলিক পরীক্ষা প্রহসনে পরিণত হবে। দেশকে এই সমূহ বিপদ থেকে বাঁচাতে হলে অনতিবিলম্বে সরকারকে পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতিতে জড়িত দুর্নীতির চক্রগুলোকে আইনের আওতায় এনে বিচার করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
মহাজোট আমলে রাজনীতি, প্রশাসন, শিক্ষা ও আর্থিক খাতসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে ব্যাপকভাবে দুর্নীতি ছড়িয়ে পড়ে। এ আমলে দেশে দুর্নীতি বৃদ্ধির প্রমাণ, ২০১৪ সালে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল প্রকাশিত দুর্নীতির ধারণা সূচকে বাংলাদেশ ১৬তম থেকে ১৪তম স্থানে নেমে গেছে। অবশ্য বাংলাদেশে যে দুর্নীতি বাড়ছে সে বিষয়টি অনুধাবন করতে দুর্নীতির ধারণা সূচক দেখা লাগে না। যারা একটু চোখ-কান খোলা রাখেন, সচিবালয় বা বিভিন্ন সরকারি অফিসে কাজকর্ম করতে যান, তারা জানেন প্রতিটি সরকারি অফিসে দুর্নীতি কীভাবে শিকড় গেঁড়ে বসেছে। ঘুষের ফুয়েল না দিলে কোনো সরকারি অফিসে ফাইল নড়ে না। ২০১৪ সালের টিআইর দুর্নীতির সূচক বাংলাদেশকে সতর্ক সংকেত দিয়েছে। সরকারের উচিত টিআইর সমালোচনা না করে দুর্নীতি
বৃদ্ধিকে স্বীকার করে বর্ধিত দুর্নীতি নিয়ন্ত্রণে অধিকতর মনোযোগী হওয়া। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ দেশে সরকারি দল থেকে টিআই রিপোর্টকে অবাস্তব বলে প্রত্যাখ্যান করা এবং বিরোধী দল থেকে ওই একই রিপোর্টকে স্বাগত জানানো রেওয়াজে পরিণত হয়েছে।
৫ জানুয়ারির ব্যতিক্রমী নির্বাচনের পর নতুন সরকারের আমলে ওইসব দুর্নীতি আরও বর্ধিত মাত্রা পায়। এ বর্ধিত দুর্নীতি কমানোর ক্ষেত্রে শেখ হাসিনার সরকার তেমন কোনো উদ্যোগ নেয়নি। অবশ্য এ সরকারের কাছ থেকে দুর্নীতি দমনে সাফল্য আশা করা সঙ্গত নয়। কারণ, যে নির্বাচনের মধ্য দিয়ে এ সরকার ক্ষমতায় এসেছে সে নির্বাচনই দুর্নীতিমুক্ত ও অবাধ ছিল না। হয়তো সে কারণে সাম্প্রতিককালে নতুন নতুন খাতে দুর্নীতি চর্চার সূচনা হচ্ছে। যেমন- মহাজোট আমলে মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে সম্পর্কিত নানা ক্ষেত্রে ব্যাপক দুর্নীতি চর্চা হয়। এ সরকার ক্ষমতায় আসার পর মুক্তিযুদ্ধে সহায়তাকারী ৩৩৮ জন বিদেশী ব্যক্তিত্ব এবং ১০টি প্রতিষ্ঠানকে সম্মাননা দেয়ার যে শুভ উদ্যোগ গ্রহণ করে, সে প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়। এই সম্মাননা প্রদানকালে তাদের একটি করে মূল্যবান ক্রেস্ট, সনদপত্র ও উপহার প্রদানের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একেকটি সম্মাননা ক্রেস্ট তৈরিতে এক ভরি সোনা ও ৩০ ভরি জার্মান রুপা ব্যবহারের সিদ্ধান্ত থাকলেও এ ক্রেস্ট তৈরির প্রক্রিয়ায় জড়িত চরম দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তারা তামা, পিতল, নিকেল ও দস্তা ব্যবহার করে ক্রেস্ট বানিয়ে বরাদ্দকৃত সোনা-রুপা আত্মসাৎ করেন। কয়েকশ বিদেশী সম্মানিত অতিথি এই নকল ক্রেস্ট নিয়ে নিজ নিজ দেশে চলে যাওয়ার পর বিষয়টি ধরা পড়লে জুলিয়ান ফ্রান্সিস নামের একজন অতিথির একটি ক্রেস্ট এনে আণবিক শক্তি কমিশনে পরীক্ষা করার পর জানা যায়, আলোচ্য ক্রেস্টে সোনা বা রুপার কোনো অস্তিত্ব নেই। দুর্নীতিবাজরা এমন একটি মহতী উদ্যোগকে বিতর্কিত করে জাতীয় মানসম্মান ভূলুণ্ঠিত করে।
মহাজোট সরকারের আমলে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীদের সম্মানিত করে চাকরি দেয়ার নামে ব্যাপক দুর্নীতি করা হয়। ১৯০ জনকে মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে চিহ্নিত করে তাদের সাব-রেজিস্ট্রার পদে চাকরি দেয়ার প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি হয়। আইন, বিচার ও সংসদবিষয়ক মন্ত্রণালয়সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটি বিষয়টি তদন্ত করিয়ে ওই প্রক্রিয়ায় ব্যাপক দুর্নীতি খুঁজে পায়। ওই তদন্তে দেখা যায়, যাদের মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে চিহ্নিত করে চাকরি দেয়া হয়, ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে তাদের বয়স ছিল ২ থেকে শুরু করে ১২-১৪ বছর পর্যন্ত। দুই বছর বয়সে তাদের যেখানে মায়ের কোলে থাকার কথা, সেখানে তারা মুজিবনগর সরকারে কীভাবে কাজ করেছেন, তা নিয়ে প্রশ্ন ওঠে। তথাকথিত মুজিবনগর সরকারের কর্মচারীর সনদপত্র পেতে একেকজনের ক্ষেত্রে লাখ লাখ টাকা ঘুষ লেনদেন হয়। নোয়াখালীর চাটখিল উপজেলার একজন মুজিবনগর সরকারের কর্মচারী হিসেবে সুবিধাভোগী, যার বয়স ১৯৭১ সালে ছিল ৮ বছর ৫ মাস ১২ দিন, তদন্ত কমিটিকে বলেন, আমি মুজিবনগর কর্মচারী নই। যুদ্ধকালে ভারতেও যাইনি। সংস্থাপন মন্ত্রণালয়ের একটি চক্রের কাছ থেকে টাকার বিনিময়ে কাগজ সংগ্রহ করেছি। আর কাগজ সংগ্রহ করতে আমার ব্যয় হয়েছে ২ লাখ ২০ হাজার টাকা। অন্যরা কেউ ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা খরচ করেছে। নিয়োগ পেতে আমার মোট খরচ হয়েছে ৫ লাখ ২০ হাজার টাকা। মুজিবনগর কর্মচারী নিয়ে বিরাট একটি চক্র সারা দেশে টাকার বিনিময়ে কাজ করছে।
বর্তমান সরকার নিজেকে শিক্ষাবান্ধব সরকার হিসেবে দাবি করলেও শিক্ষা ক্ষেত্রে কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি দেখাতে পারেনি। তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে ব্যাপক নৈরাজ্য ছড়িয়ে পড়েছে। বিশেষ করে পরীক্ষা পদ্ধতিতে প্রশ্নপত্র ফাঁস কালচার ছড়িয়ে পড়ায় পরীক্ষা যেন অর্থহীন বিষয়ে পরিণত হয়েছে। অন্যান্য সরকারের আমলে যে একেবারেই এ ক্ষেত্রে দুর্নীতি ছিল না এমন নয়। তখন হয়তো কয়েক বছর পর একবার প্রশ্নপত্র ফাঁসের খবর প্রকাশিত হতো। কিন্তু এখন প্রশ্নপত্র ফাঁস নিয়মিত খবরে পরিণত হয়েছে। এমনকি ছোটদের বড় পরীক্ষা হিসেবে পরিচিত ৩১ লাখ পরীক্ষার্থীর পিইসি পরীক্ষার প্রশ্নপত্রও ফাঁস হয়েছে বলে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। এর ফলে স্কুলের কোমলমতি শিশুরাও এখন দুর্নীতির সঙ্গে পরিচিত হয়ে পড়েছে। এটা জাতির জন্য একটি ভয়াবহ সংবাদ। কিন্তু দুঃখের বিষয়, সরকারের তরফ থেকে প্রশ্ন ফাঁসের বিষয়টি স্বীকারই করা হচ্ছে না। মাননীয় মন্ত্রী এবং মন্ত্রণালয়ের কর্মকর্তারা একে কখনও গুজব, কখনও সরকারের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র, আবার কখনও কোচিং সেন্টারের অভিজ্ঞ শিক্ষকদের সাজেশন বলে আমলে নিচ্ছেন না। ফলে প্রশ্ন ফাঁসকারী সিন্ডিকেট নির্বিঘ্নে উৎসাহের সঙ্গে তাদের বিনা পুঁজির এ লাভজনক ব্যবসা চালিয়ে যাচ্ছে।
মহাজোট সরকারের পর বর্তমান নতুন সরকার আগের সরকারের দুর্নীতির ধারাবাহিকতা রক্ষা করছে এবং ক্ষেত্র বিশেষে দুর্নীতি আরও বৃদ্ধি পেয়েছে, যেমন দলীয় অঙ্গসংগঠন, বিশেষ করে ছাত্র সংগঠনের দুর্নীতি। তবে হ্যাঁ, দুর্নীতি দমনে সাফল্য না পেলেও বর্তমান সরকার দুর্নীতি চর্চায় বেশ কিছু নতুনত্ব এনেছে। যেমন- এ সরকারের আমলে প্রথমবারের মতো ডিজিটাল ফ্রড করে টাকা দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার বিষয়টি চালু হয়েছে। এ প্রক্রিয়ায় একজন ছাত্র যোগ্য না হয়েও ৩-৪ লাখ টাকার বিনিময়ে পরীক্ষার হলে বসে অবৈধভাবে বাইরে থেকে প্রযুক্তির অপব্যবহার করে প্রশ্নের উত্তর পেয়ে ভর্তি পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়েছে। ফলে এ অবৈধ প্রক্রিয়ায় মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীদের পরাস্ত করে কম মেধাবী ছাত্র-ছাত্রীরা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হতে পেরেছে। নতুন প্রযুক্তি এলে সুযোগসন্ধানীরা এর অপব্যবহার করবে সেটাই স্বাভাবিক। তবে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ কঠোর পদক্ষেপ গ্রহণ করলে এ দুর্নীতি দমন করা অসম্ভব ছিল না।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল ফ্রড করে ধরা পড়া দুর্নীতিবাজদের উল্লেখযোগ্য শাস্তি হয়েছে বলে জানা যায়নি। এ নতুন জালিয়াতিতে জড়িত সিন্ডিকেটগুলোকে চিহ্নিত করে আইনের আওতায় এনে শাস্তির ব্যবস্থা করা হয়নি। এর ফলে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এই নতুন জালিয়াত চক্র তাদের বিনা পুঁজির ব্যবসা বাড়াতে অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ে এ নয়া দুর্নীতির বিকেন্দ্রীকরণ করেছে। এভাবে জাহাঙ্গীরনগর, জগন্নাথ, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, কুষ্টিয়ার ইসলামী, মওলানা ভাসানী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, হাজী দানেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি এবং চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়সহ আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এ জালিয়াতির বিকেন্দ্রীকরণ হয়েছে। এসব বিশ্ববিদ্যালয়ে ডিজিটাল জালিয়াতি ধরা পড়েছে এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মতো একইভাবে ওই সব সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়েও তাদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া হয়নি। এর কারণ খুঁজতে গেলে দেখা যায়, বিশ্ববিদ্যালয় ক্যাম্পাসে সরকারি দলের ছাত্র সংগঠনই সবসময় দাপটে থাকে। তাদের সমর্থন না নিয়ে ক্যাম্পাসে অন্য কারও পক্ষে এককভাবে বড় রকম জালিয়াতি করা সম্ভব নয়। কাজেই ডিজিটাল জালিয়াতকে তাদের সিন্ডিকেটসহ পাকড়াও করলে হয়তো সরকারি দল-সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের অনেক নেতা-কর্মী ধরা পড়ে যেত। সে জন্য বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ সরকারি দল-সমর্থিত ছাত্র সংগঠনের সঙ্গে দ্বন্দ্বে জড়াতে অথবা তাদের বিরাগভাজন হতে চায়নি বলেই হয়তো ওদের আইনের আওতায় এনে শাস্তি না দিয়ে ওদের প্রতি নমনীয় আচরণ করেছে। এর ফলে এ নয়া দুর্নীতি অদূর ভবিষ্যতে অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পরীক্ষায়ও ছড়িয়ে পড়ার আশংকা দেখা দিয়েছে।
পরীক্ষায় ডিজিটাল ফ্রড করা জালিয়াত চক্রগুলোকে গ্রেফতার করে আইনের আওতায় এনে তাদের শাস্তি না দেয়ায় নাগরিক সম্প্রদায়, দেশপ্রেমিক শিক্ষাবিদ, বুদ্ধিজীবী ও সুশাসনপ্রত্যাশী সুশীল সমাজের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়েছে। তারা যথেষ্ট উদ্বেগের মধ্যে রয়েছেন এবং এই জালিয়াতি অন্যান্য পাবলিক পরীক্ষায় ছড়িয়ে পড়ার সমূহ সম্ভাবনা দেখে মানসিক যাতনা ভোগ করছেন। জালিয়াত চক্রগুলো তো আর কোনটি ভর্তি পরীক্ষা অথবা কোনটি পাবলিক পরীক্ষা তা বাছবিচার করে জালিয়াতি করবে না। তাদের উদ্দেশ্য জালিয়াতি করে অবৈধভাবে মুনাফা অর্জন করা। সম্মানিত পাঠক, আগামী বিসিএস পরীক্ষায় যদি এই ডিজিটাল জালিয়াতি সংক্রমিত হয়, তাহলে জাতির কত বড় সর্বনাশ হবে একবার ভেবে দেখুন। সে ক্ষেত্রে মেধাবীদের পরিবর্তে অমেধাবীরা বিসিএস পরীক্ষায় কৃতকার্য হয়ে বিভিন্ন ক্যাডারভুক্ত সরকারি পদে প্রথম শ্রেণীর কর্মকর্তা হিসেবে যোগ দেবেন। আর এ প্রক্রিয়া বাধাহীনভাবে চলতে থাকলে দেশ ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে উপনীত হবে। এই জালিয়াতি রোধে উদ্যোগী না হলে প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভর্তি পরীক্ষা ও সব পাবলিক পরীক্ষা প্রহসনে পরিণত হবে। দেশকে এই সমূহ বিপদ থেকে বাঁচাতে হলে অনতিবিলম্বে সরকারকে পরীক্ষায় ডিজিটাল জালিয়াতিতে জড়িত দুর্নীতির চক্রগুলোকে আইনের আওতায় এনে বিচার করে তাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।
ড. মুহাম্মদ ইয়াহ্ইয়া আখতার : অধ্যাপক, রাজনীতি বিজ্ঞান বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়
No comments