শতভাগ বৃদ্ধির সুপারিশ
সরকারি
কর্মকর্তা-কর্মচারীদের শতভাগ বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করেছে অষ্টম পে-কমিশন।
এতে সর্বোচ্চ ৮০ হাজার ও সর্বনিু ৮ হাজার ২শ’ টাকা বেতন স্কেলের সুপারিশ
করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ সচিব ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের মুখ্য সচিবের
বেতন এক লাখ টাকা নির্ধারণের সুপারিশ করা হয়েছে। সিনিয়র সচিবদের বেতন ৮৮
হাজার টাকার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। বেতন বৃদ্ধির হারের সঙ্গে পেনশন বৃদ্ধির
সুপারিশও করা হয়েছে। এছাড়া সরকারি চাকরি থেকে স্বেচ্ছা অবসরের বয়স ২৫ থেকে
কমিয়ে ২০ বছর নির্ধারণের প্রস্তাব করেছে। পে-কমিশনের চেয়ারম্যান বাংলাদেশ
ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন রোববার সকালে অর্থমন্ত্রীর কাছে
এ প্রতিবেদন জমা দেন। কমিশনের রিপোর্ট পেয়ে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল
মুহিত বলেন, আগামী ১ জুলাই থেকে প্রায় ১৩ লাখ সরকারি চাকরিজীবী নতুন স্কেলে
বেতন পাবেন। নতুন কাঠামো কার্যকর করতে সরকারের বেতন বাবদ খরচ বাড়বে ৬৩
দশমিক ৭ শতাংশ। এজন্য প্রয়োজনীয় অর্থ সরকারের আছে। নতুন বেতন স্কেল
বাস্তবায়নের জন্য মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে প্রধান করে কমিটি গঠনের প্রক্রিয়া
শুরু হয়েছে। এ কমিটি কমিশনের সুপারিশ পর্যালোচনার পর প্রতিবেদন তৈরি করবে।
মন্ত্রিসভার বৈঠকে অনুমোদনের পর কার্যকর হবে নতুন বেতন। সেক্ষেত্রে নতুন
বেতন কার্যকরের সময় পে-কমিশনের সুপারিশ কিছুটা হেরফের হতে পারে। পে-কমিশন
বেতন কাঠামোয় ২০টির পরিবর্তে এবার ১৬টি গ্রেডের সুপারিশ করেছে। এতে বর্তমান
৮ম ও ৯ম গ্রেডকে একীভূত করে নতুন ৮ম গ্রেডের বেতন ধরা হয়েছে। একইভাবে
বর্তমান ১২ ও ১৩ নম্বর গ্রেড এক করে নতুন ১১তম গ্রেড নির্ধারণ করা হয়।
বর্তমান স্কেলের ১৭ ও ১৮ নম্বর গ্রেড একীভূত করে নতুন ১৫ নম্বর গ্রেড
নির্ধারণ এবং বর্তমান ১৯ ও ২০নং গ্রেড এক করে নতুন ১৬ নম্বর গ্রেড তৈরির
সুপারিশ এসেছে।
অষ্টম গ্রেডে মূল বেতন ২৫ হাজার টাকার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, সরকারি চাকরির প্রতি মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্যই এটা করা হয়েছে। সর্বোচ্চ বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ মূলত মেধা আকর্ষণের জন্য। তিনি বলেন, নতুন এ কাঠামোয় সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ গ্রেডে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। আর মাঝের গ্রেডগুলোতে বেতন বাড়বে বিভিন্ন পর্যায়ে। সেই সঙ্গে বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা ও আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
ফরাসউদ্দিন বলেন, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগে মেধার গুরুত্ব, উপযুক্ত বেতন-ভাতার মাধ্যমে দক্ষতা, সততা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, চাকরির ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ পদোন্নতি, পদায়ন, প্রশিক্ষণ ও মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলোয় নজর দেয়া হলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তারা ভূমিকা রাখতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, অষ্টম কমিশনের সুপারিশের ৪টি বিশেষ দিক রয়েছে। এগুলো হচ্ছে বেতন স্কেল সুপারিশের ভিত্তি ছয় বছর ধরা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৬ বছরের জন্য প্রণীত হয়েছে। প্রথমবারের মতো সরকার চার সদস্যের পরিবার থেকে ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য বেতন কাঠামো সুপারিশ করা হয়েছে। ছয় সদস্যের মধ্যে বাবা ও মা, দুই সন্তান এবং স্বামী-স্ত্রী। এতে দুই সন্তানের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যয় হিসেবে ধরা হয়েছে।
কমিশনের মূল সুপারিশগুলোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ইবি (ইফিশিয়েন্সি বার) তুলে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বিভাজন সৃষ্টিকারী শ্রেণীকরণ রোধ করা হয়েছে। অনেক জটিলতা ও মামলা-মোকদ্দমার উৎস সিলেকশন বি ও টাইম স্কেলের বিলুপ্ত ঘটিয়ে মূলত পদোন্নতির মাধ্যমে পরবর্তী উচ্চতর ধাপে ওঠার ব্যবস্থার সুপারিশ আছে। এছাড়া ২টি গ্রেডে টাকার অংকের পার্থক্য বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতি বছর জুলাইতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, চতুর্থ থেকে ১৬তম গ্রেড পর্যন্ত শতকরা ৫ ভাগ চক্রবৃদ্ধি হারে বার্ষিক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। পদোন্নতি হোক বা না হোক চাকরির মেয়াদ ১৫ বছর হলে বেতন দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে কমিশন অন্যান্য দেশের বেতন-ভাতার চিত্র ব্যক্তি খাতের সঙ্গে তুলনা করে সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করেছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিু বেতনের অনুপাত ধার্য করা হয়েছে ১ দশমিক ৯০৭৬, যা গত কয়েকটি কমিশন একইভাবে রেখেছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কমিশনের সুপারিশ যতটুকু কার্যকর হবে তাতে ব্যয় বাড়বে ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বাজেট ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে, সে অনুপাতে বেতন-ভাতা, অবসর-ভাতা, সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান মিলে খরচ শতকরা ১৪ দশমিক ২ ভাগ বাড়বে। যেটা আগের কমিশন ১৫ শতাংশ করেছিল।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছে তাই নতুন করে ভাতা সৃষ্টির প্রয়োজন হবে না। বিদ্যমান ভাতা নির্দিষ্ট অংকে ও হারের মধ্যে সর্বোচ্চ সীমারেখা বেঁধে দেয়া উচিত বলে কমিশন মনে করে। প্রেষণসহ সব রকমের ভাতা বাতিল, ডেপুটেশন ও বিশেষ ভাতা না রাখার কথা বলেছে।
কয়েকটি ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে ভাতার যৌক্তিকীকরণ করতে বলা হয়েছে। বাড়িভাড়া ভাতা আরও যৌক্তিক করার তাগিদ দিয়ে ৩-এর পরিবর্তে ৪ ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা, চট্টগ্রাম বিভাগসহ নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, সাভার ও জেলা শহর এবং অন্যান্য এলাকার ক্ষেত্রে এ প্রস্তাব করা হচ্ছে। এতে সর্বমোট ৪টি ক্যাটাগরি রয়েছে।
গ্রাম পুলিশের স্বল্প বেতনের অর্ধেক আসে সরকারি কোষাগার থেকে। বাকিটা ইউনিয়ন কাউন্সিল দিতে পারে না। যেহেতু সরকারের সংগৃহীত প্রক্রিয়াকরণ ধান, চাল ৯ মাস পর নষ্ট হয়ে যায় এবং বর্তমান খোলাবাজারে চাল বিক্রির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে তাই সংগ্রহকৃত চাল অতি সুলভ মূল্যে গ্রাম পুলিশ সদস্যের কাছে ইস্যু করার বিষয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে।
লোকসানি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি প্রতিষ্ঠান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাত, আর্থিক ও বীমা প্রতিষ্ঠানে আলাদা বেতন কাঠামো সমর্থন করে না এ কমিশন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকে আলাদা বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে সরকার সিদ্ধান্ত নিলে তা কার্যকর করা কমিশন সমর্থন করে। তবে সরকার অনুমোদিত বেতন কাঠামোতে যে গ্রেড বা স্কেলগুলো থাকবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেতন কাঠামোতেও সমপরিমাণ গ্রেড থাকতে হবে।
রিয়েল এস্টেটদের মাধ্যমে সরকারের পুরনো বাড়ি-ঘর ভেঙে অথবা খাস জমি দিয়ে ৬০ থেকে ৪০ ভিত্তিতে আবাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, ১০ থেকে ৩০ জনের গ্র“পকে ৫ বা ১০ কাঠা জমি গৃহনির্মাণের জন্য দেয়া। এক্ষেত্রে ৫০ মাসের বেতনের সমপরিমাণ ঋণ ব্যাংক রেটে দেয়া যেতে পারে। অন্যথায় সাধারণভাবে জমি কেনার প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যাংক রেটে ৫০ মাসের মূল বেতনের সমান ঋণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে।
একইভাবে গাড়ি কেনার ঋণ ১ বছর নিরীক্ষামূলকভাবে প্রাধিকারপ্রাপ্তদের বাইরে তৃতীয় গ্রেড ও তার উচ্চতর কর্মকর্তাদের ২৫ লাখ টাকার ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। নিরীক্ষা সফল হলে চতুর্থ গ্রেডেও সমপরিমাণ ঋণ দেয়া অব্যাহত রাখা যেতে পারে। তবে স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো গাড়ি ঋণ দেয়া হলে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অবশ্যই সংস্থার নিজস্ব আয় থেকে বহন করতে হবে।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ৫ বছরের মেয়াদে মোট ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ বীমা রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কমপ্রিহেনসিভ বীমার জন্য সরকার প্রতি চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে মাসে ৪০০ টাকা হারে সাধারণ হসপিটাইলাইজেশন, অ্যাক্সিডেন্ট এবং ১০০ টাকা লাইফ প্রিমিয়াম নিতে পারে। বীমা খাতের উদ্বৃত্ত থেকে ৫০০ শয্যার একটি আধুনিক হৃদরোগ হাসপাতাল সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নির্মাণ করা যেতে পারে। কমিশন মনে করে, বীমা প্রিমিয়াম থেকে যথেষ্ট সঞ্চয় উদ্বৃত্ত হবে। এ খাতে সরকারের খরচ শুধু প্রথম বছরেই হবে। পরে তা অনেকটাই কমে যাবে।
পেনশন সম্পর্কে তিনি বলেন, পেনশনের হার শতকার ৯০ ভাগে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া আনুতোষিক যেটা ২০১৩ সালের নভেম্বরে ২৬ বছর পর ১ টাকায় ২৩০ টাকা করা হয় তা আর বাড়ানো সঠিক হবে না। এছাড়া ছুটি পাওনা সাপেক্ষে পেনশনে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১২ মাসের বদলে ১৮ মাসের বেতন নগদায়ন করার বিষয়ে বিবেচনার জন্য কমিশন সুপারিশ করছে। স্বেচ্ছা অবসর যাওয়ার সময় ২০ বছর করা ও এলপিআর ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনের একটি বড় সুপারিশ হল, যে হারে বেতন বাড়বে সে হারেই পেনশন বাড়ানোর সুপারিশ। তবে যারা সম্পূর্ণ বেতনের টাকা পেনশনকালে নিয়ে গেছেন তাদের চিকিৎসা-ভাতা বৃদ্ধি এবং উৎসব-ভাতা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো সুপারিশ করা সম্ভব হয়নি।
বর্তমান কল্যাণ ফান্ডকে পুনর্গঠিত করে বীমা ব্যবস্থাপনা, পেনশন ফান্ড ব্যবস্থাপনা এবং কল্যাণ ফান্ড ব্যবস্থাপনা করতে বলা হয়। কল্যাণ ফান্ডের দৈনিক বাংলার মোড়ে যে বিরাট ভূমিখণ্ড রয়েছে সেখান থেকে ২০ বা ২৫ কাঠা জমি বিক্রি করে ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন জোগাড় করে ‘সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংক’ স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। এ ব্যাংকটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মালিকানায় হবে। প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে ৪ হাজার টাকার শেয়ার থাকবে। এ ব্যাংকটি একটি উন্নয়ন ও বাণিজ্যিকধর্মী ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে। সম্পূর্ণ পেশাদারি ভিত্তিতে এটা চালানো হবে। কমিশন মনে করে, ব্যাংকটিতে শুরু থেকে নজর দিলে সিঙ্গেল ডিজিটে সুদে ঋণ দেয়া সম্ভব। ব্যাংকে ১০-১২ লাখ লোকের মাঝখান থেকে পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন করা হবে।
চাকরি বিষয়ে ব্যাপক সংস্কার ও পুনর্গঠন ভেবেচিন্তে করাই সমীচীন হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পিরামিড সিস্টেম অবলম্বন করা উচিত হবে। নন-ক্যাডারদের দাবি-দাওয়া বিবেচনা করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। গুচ্ছিকরণের নিরীক্ষা অনেক চিন্তাভাবনা করেই করতে হবে। যারা এক পদে সারা জীবন কাটিয়ে দেন তাদের জন্য নতুন করে অর্গানোগ্রাম সৃষ্টি করা ঠিক হবে। সচিবালয় ও সচিবালয়ের বাইরের কর্মচারী যারা একই বেতনে, একই যোগ্যতায় চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ১৯৯৫ সালের যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
অষ্টম গ্রেডে মূল বেতন ২৫ হাজার টাকার সুপারিশ করা হয়েছে। এ ব্যাপারে কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, সরকারি চাকরির প্রতি মেধাবীদের আকৃষ্ট করার জন্যই এটা করা হয়েছে। সর্বোচ্চ বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ মূলত মেধা আকর্ষণের জন্য। তিনি বলেন, নতুন এ কাঠামোয় সর্বনিম্ন ও সর্বোচ্চ গ্রেডে ১০০ শতাংশ পর্যন্ত বেতন বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে। আর মাঝের গ্রেডগুলোতে বেতন বাড়বে বিভিন্ন পর্যায়ে। সেই সঙ্গে বাড়িভাড়াসহ অন্যান্য ভাতা ও আর্থিক সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব করা হয়েছে।
ফরাসউদ্দিন বলেন, সরকারি কর্মকর্তা ও কর্মচারীদের নিয়োগে মেধার গুরুত্ব, উপযুক্ত বেতন-ভাতার মাধ্যমে দক্ষতা, সততা ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি, চাকরির ক্ষেত্রে বস্তুনিষ্ঠ পদোন্নতি, পদায়ন, প্রশিক্ষণ ও মৌলিক চাহিদার বিষয়গুলোয় নজর দেয়া হলে দেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নে তারা ভূমিকা রাখতে পারবে।
তিনি আরও বলেন, অষ্টম কমিশনের সুপারিশের ৪টি বিশেষ দিক রয়েছে। এগুলো হচ্ছে বেতন স্কেল সুপারিশের ভিত্তি ছয় বছর ধরা হয়েছে। ২০১৩ সালের ১ জুলাই থেকে ২০১৯ সালের ৩০ জুন পর্যন্ত ৬ বছরের জন্য প্রণীত হয়েছে। প্রথমবারের মতো সরকার চার সদস্যের পরিবার থেকে ছয় সদস্যের পরিবারের জন্য বেতন কাঠামো সুপারিশ করা হয়েছে। ছয় সদস্যের মধ্যে বাবা ও মা, দুই সন্তান এবং স্বামী-স্ত্রী। এতে দুই সন্তানের স্বাস্থ্য ও শিক্ষা ব্যয় হিসেবে ধরা হয়েছে।
কমিশনের মূল সুপারিশগুলোর ব্যাপারে তিনি বলেন, ইবি (ইফিশিয়েন্সি বার) তুলে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। বিভাজন সৃষ্টিকারী শ্রেণীকরণ রোধ করা হয়েছে। অনেক জটিলতা ও মামলা-মোকদ্দমার উৎস সিলেকশন বি ও টাইম স্কেলের বিলুপ্ত ঘটিয়ে মূলত পদোন্নতির মাধ্যমে পরবর্তী উচ্চতর ধাপে ওঠার ব্যবস্থার সুপারিশ আছে। এছাড়া ২টি গ্রেডে টাকার অংকের পার্থক্য বাড়ানোর সুপারিশ করা হয়েছে। প্রতি বছর জুলাইতে বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট, চতুর্থ থেকে ১৬তম গ্রেড পর্যন্ত শতকরা ৫ ভাগ চক্রবৃদ্ধি হারে বার্ষিক বৃদ্ধির প্রস্তাব করা হয়েছে। পদোন্নতি হোক বা না হোক চাকরির মেয়াদ ১৫ বছর হলে বেতন দ্বিগুণ করার প্রস্তাব দেয়া হয়েছে। তবে কমিশন অন্যান্য দেশের বেতন-ভাতার চিত্র ব্যক্তি খাতের সঙ্গে তুলনা করে সামঞ্জস্য আনার চেষ্টা করেছে। সর্বোচ্চ ও সর্বনিু বেতনের অনুপাত ধার্য করা হয়েছে ১ দশমিক ৯০৭৬, যা গত কয়েকটি কমিশন একইভাবে রেখেছে।
তিনি আরও বলেন, আগামী ১ জুলাই থেকে কমিশনের সুপারিশ যতটুকু কার্যকর হবে তাতে ব্যয় বাড়বে ৬৩ দশমিক ৭ শতাংশ। বাজেট ক্রমবর্ধমান হারে বাড়ছে, সে অনুপাতে বেতন-ভাতা, অবসর-ভাতা, সরকারি এবং স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান মিলে খরচ শতকরা ১৪ দশমিক ২ ভাগ বাড়বে। যেটা আগের কমিশন ১৫ শতাংশ করেছিল।
মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন বলেন, সরকারি চাকরিজীবীদের বেতন বৃদ্ধি করা হচ্ছে তাই নতুন করে ভাতা সৃষ্টির প্রয়োজন হবে না। বিদ্যমান ভাতা নির্দিষ্ট অংকে ও হারের মধ্যে সর্বোচ্চ সীমারেখা বেঁধে দেয়া উচিত বলে কমিশন মনে করে। প্রেষণসহ সব রকমের ভাতা বাতিল, ডেপুটেশন ও বিশেষ ভাতা না রাখার কথা বলেছে।
কয়েকটি ক্ষেত্রে বেতন বৃদ্ধির সঙ্গে ভাতার যৌক্তিকীকরণ করতে বলা হয়েছে। বাড়িভাড়া ভাতা আরও যৌক্তিক করার তাগিদ দিয়ে ৩-এর পরিবর্তে ৪ ধরনের প্রস্তাব করা হয়েছে। এর মধ্যে ঢাকা মেট্রোপলিটন এলাকা, চট্টগ্রাম বিভাগসহ নারায়ণগঞ্জ, কক্সবাজার, সাভার ও জেলা শহর এবং অন্যান্য এলাকার ক্ষেত্রে এ প্রস্তাব করা হচ্ছে। এতে সর্বমোট ৪টি ক্যাটাগরি রয়েছে।
গ্রাম পুলিশের স্বল্প বেতনের অর্ধেক আসে সরকারি কোষাগার থেকে। বাকিটা ইউনিয়ন কাউন্সিল দিতে পারে না। যেহেতু সরকারের সংগৃহীত প্রক্রিয়াকরণ ধান, চাল ৯ মাস পর নষ্ট হয়ে যায় এবং বর্তমান খোলাবাজারে চাল বিক্রির প্রয়োজনীয়তা ফুরিয়ে গেছে তাই সংগ্রহকৃত চাল অতি সুলভ মূল্যে গ্রাম পুলিশ সদস্যের কাছে ইস্যু করার বিষয়ে বিবেচনা করা যেতে পারে।
লোকসানি স্বায়ত্তশাসিত ও সরকারি প্রতিষ্ঠান পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকিং খাত, আর্থিক ও বীমা প্রতিষ্ঠানে আলাদা বেতন কাঠামো সমর্থন করে না এ কমিশন। তবে বাংলাদেশ ব্যাংকে আলাদা বেতন কাঠামো বাস্তবায়নে সরকার সিদ্ধান্ত নিলে তা কার্যকর করা কমিশন সমর্থন করে। তবে সরকার অনুমোদিত বেতন কাঠামোতে যে গ্রেড বা স্কেলগুলো থাকবে, বাংলাদেশ ব্যাংকের বেতন কাঠামোতেও সমপরিমাণ গ্রেড থাকতে হবে।
রিয়েল এস্টেটদের মাধ্যমে সরকারের পুরনো বাড়ি-ঘর ভেঙে অথবা খাস জমি দিয়ে ৬০ থেকে ৪০ ভিত্তিতে আবাসনের ব্যবস্থা করা যেতে পারে। বিকল্প প্রস্তাবে বলা হয়, ১০ থেকে ৩০ জনের গ্র“পকে ৫ বা ১০ কাঠা জমি গৃহনির্মাণের জন্য দেয়া। এক্ষেত্রে ৫০ মাসের বেতনের সমপরিমাণ ঋণ ব্যাংক রেটে দেয়া যেতে পারে। অন্যথায় সাধারণভাবে জমি কেনার প্রমাণ সাপেক্ষে ব্যাংক রেটে ৫০ মাসের মূল বেতনের সমান ঋণ হিসেবে দেয়া যেতে পারে।
একইভাবে গাড়ি কেনার ঋণ ১ বছর নিরীক্ষামূলকভাবে প্রাধিকারপ্রাপ্তদের বাইরে তৃতীয় গ্রেড ও তার উচ্চতর কর্মকর্তাদের ২৫ লাখ টাকার ঋণ দেয়ার ব্যবস্থা অব্যাহত রাখা যেতে পারে। নিরীক্ষা সফল হলে চতুর্থ গ্রেডেও সমপরিমাণ ঋণ দেয়া অব্যাহত রাখা যেতে পারে। তবে স্বায়ত্তশাসিত ও আধাস্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানগুলো গাড়ি ঋণ দেয়া হলে গাড়ি রক্ষণাবেক্ষণের খরচ অবশ্যই সংস্থার নিজস্ব আয় থেকে বহন করতে হবে।
স্বাস্থ্যক্ষেত্রে ৫ বছরের মেয়াদে মোট ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত মৃত্যুজনিত ক্ষতিপূরণ বীমা রাখা যেতে পারে। এক্ষেত্রে কমপ্রিহেনসিভ বীমার জন্য সরকার প্রতি চাকরিজীবীর ক্ষেত্রে মাসে ৪০০ টাকা হারে সাধারণ হসপিটাইলাইজেশন, অ্যাক্সিডেন্ট এবং ১০০ টাকা লাইফ প্রিমিয়াম নিতে পারে। বীমা খাতের উদ্বৃত্ত থেকে ৫০০ শয্যার একটি আধুনিক হৃদরোগ হাসপাতাল সরকারি চাকরিজীবীদের জন্য নির্মাণ করা যেতে পারে। কমিশন মনে করে, বীমা প্রিমিয়াম থেকে যথেষ্ট সঞ্চয় উদ্বৃত্ত হবে। এ খাতে সরকারের খরচ শুধু প্রথম বছরেই হবে। পরে তা অনেকটাই কমে যাবে।
পেনশন সম্পর্কে তিনি বলেন, পেনশনের হার শতকার ৯০ ভাগে উন্নীত করার সুপারিশ করা হয়। এছাড়া আনুতোষিক যেটা ২০১৩ সালের নভেম্বরে ২৬ বছর পর ১ টাকায় ২৩০ টাকা করা হয় তা আর বাড়ানো সঠিক হবে না। এছাড়া ছুটি পাওনা সাপেক্ষে পেনশনে যাওয়া কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ১২ মাসের বদলে ১৮ মাসের বেতন নগদায়ন করার বিষয়ে বিবেচনার জন্য কমিশন সুপারিশ করছে। স্বেচ্ছা অবসর যাওয়ার সময় ২০ বছর করা ও এলপিআর ব্যবস্থায় ফিরে যাওয়ার বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছে। কমিশনের একটি বড় সুপারিশ হল, যে হারে বেতন বাড়বে সে হারেই পেনশন বাড়ানোর সুপারিশ। তবে যারা সম্পূর্ণ বেতনের টাকা পেনশনকালে নিয়ে গেছেন তাদের চিকিৎসা-ভাতা বৃদ্ধি এবং উৎসব-ভাতা বৃদ্ধি করা ছাড়া আর কোনো সুপারিশ করা সম্ভব হয়নি।
বর্তমান কল্যাণ ফান্ডকে পুনর্গঠিত করে বীমা ব্যবস্থাপনা, পেনশন ফান্ড ব্যবস্থাপনা এবং কল্যাণ ফান্ড ব্যবস্থাপনা করতে বলা হয়। কল্যাণ ফান্ডের দৈনিক বাংলার মোড়ে যে বিরাট ভূমিখণ্ড রয়েছে সেখান থেকে ২০ বা ২৫ কাঠা জমি বিক্রি করে ৪০০ কোটি টাকা পরিশোধিত মূলধন জোগাড় করে ‘সমৃদ্ধি সোপান ব্যাংক’ স্থাপনের সুপারিশ করা হয়। এ ব্যাংকটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের মালিকানায় হবে। প্রতিটি সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীর নামে ৪ হাজার টাকার শেয়ার থাকবে। এ ব্যাংকটি একটি উন্নয়ন ও বাণিজ্যিকধর্মী ব্যাংক হিসেবে কাজ করবে। সম্পূর্ণ পেশাদারি ভিত্তিতে এটা চালানো হবে। কমিশন মনে করে, ব্যাংকটিতে শুরু থেকে নজর দিলে সিঙ্গেল ডিজিটে সুদে ঋণ দেয়া সম্ভব। ব্যাংকে ১০-১২ লাখ লোকের মাঝখান থেকে পরিচালনা পর্ষদ নির্বাচন করা হবে।
চাকরি বিষয়ে ব্যাপক সংস্কার ও পুনর্গঠন ভেবেচিন্তে করাই সমীচীন হবে। প্রতিটি ক্ষেত্রে পিরামিড সিস্টেম অবলম্বন করা উচিত হবে। নন-ক্যাডারদের দাবি-দাওয়া বিবেচনা করে উপযুক্ত সিদ্ধান্ত নেয়া যেতে পারে। গুচ্ছিকরণের নিরীক্ষা অনেক চিন্তাভাবনা করেই করতে হবে। যারা এক পদে সারা জীবন কাটিয়ে দেন তাদের জন্য নতুন করে অর্গানোগ্রাম সৃষ্টি করা ঠিক হবে। সচিবালয় ও সচিবালয়ের বাইরের কর্মচারী যারা একই বেতনে, একই যোগ্যতায় চাকরিতে যোগ দিয়েছেন, তাদের ক্ষেত্রে ১৯৯৫ সালের যে বৈষম্যের সৃষ্টি হয়েছিল তা দূর করার সুপারিশ করেছে কমিশন।
No comments