কানাডিয়ান বধূর গোপন মিশন ফাঁস, তোলপাড় by ওয়েছ খছরু
কানাডায়ও
বেপরোয়া ছিলেন সিদরাতুল মুনতাহার চৌধুরী। মদ খেয়ে করতেন মাতলামি।
ক্যাসিনো-তে গিয়ে কাটাতেন রাতের পর রাত। স্বামী-স্বজনের তোয়াক্কা করতেন না।
বয়ফ্রেন্ড নিয়ে মেতে থাকতেন বার কিংবা পার্টিতে। কানাডা থেকে সিলেটে
ফিরলেও স্বভাব একটুও বদলায়নি। দুই প্রেমিকের সঙ্গে করেছেন ঘর-সংসার। রাতের
পর রাত স্বামী পরিচয়ে তাদের সঙ্গে করেছেন লিভ টুগেদার। এখানেই থেমে থাকেন
নি। টাকার জন্য পাগল হয়ে উঠেছিলেন। এ কারণে কখনও নিজে আবার কখনও প্রেমিকদের
দিয়ে ফোন করিয়ে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করেছেন দেশে থাকা জা এবং কানাডা
থাকা ভাসুরের কাছে। টাকার জন্য তিনি ভাসুরের ছেলে ইসফার ওয়াছিফ চৌধুরীকে
অপহরণেরও হুমকি দিয়েছিলেন। এভাবে সিদরাতুল মুনতাহার চৌধুরীর যন্ত্রণায়
অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছিল ভাসুর বেলাল আহমদ চৌধুরীর পরিবার। এ নিয়ে দুই দফা থানায়
জিডি করার পরও কোন সুরাহা না হওয়ায় অবশেষে কানাডা হাইকমিশনের সহায়তা চান
তারা। কানাডা হাইকমিশন থেকে ফোন পাওয়ার পর সিলেটের মেট্রোপলিটন পুলিশ এ
ঘটনার তদন্তে নামে। তদন্তের একপর্যায়ে তারা পুরো ঘটনার সত্যতা পান এবং এক
এক করে সিদরাতুল মুনতাহার চৌধুরী ও তার প্রেমিক নাজমুল ও রিপনকে গ্রেপ্তার
করে। এ ঘটনা জানাজানি হওয়ার পর সিলেটে তোলপাড় শুরু হয়েছে। বিয়ানীবাজার
উপজেলার কাদিমল্লিক গ্রামের মইজ উদ্দিন চৌধুরীর কন্যা সিদরাতুন মুনতাহার
সঙ্গে গোলাপগঞ্জের রফিপুর গ্রামের কানাডা প্রবাসী মাহবুব উদ্দিন চৌধুরীর
সঙ্গে বিয়ে হয় কয়েক বছর আগে। বিয়ের পর তারা চলে যান কানাডায়। সেখানে বেশ
সুখেই চলছিল তাদের সংসার। এক পর্যায়ে সিদরাতুন মুনতাহার চৌধুরীর আচরণে
পরিবর্তন লক্ষ্য করা যায়। স্বামীকে রেখে মুনতাহার বন্ধু-বান্ধব নিয়ে বেশি
মেতে ওঠেন। কিন্তু তার বেপরোয়া আচরণ মেনে নেননি স্বামী মাহবুব উদ্দিন
চৌধুরী। এ নিয়ে তাদের মধ্যে বিরোধ চলছিল। এই বিরোধ চলার এক পর্যায়ে গত
জুলাই মাসে দেশে চলে আসেন সিদরাতুন মুনতাহার চৌধুরী। দেশে আসার পর তিনি
ওঠেন নগরীর মিয়া ফাজিলচিশত ৩৫ নম্বর বাসা। পুলিশ জানিয়েছে, মুনতাহার ওই
বাসায় উঠলেও পরবর্তীকালে তার প্রেমিক নাজমুলকে নিয়ে নগরীর সাগরদিঘীর পাড়ের
একটি বাসায় ওঠেন। সেখানে তিনি প্রেমিক নাজমুলকে তার স্বামী হিসেবে পরিচয়
দিয়ে বসবাস করেন। তবে, পরিবারের কারও সঙ্গে মুনতাহারের কোন সম্পর্ক ছিল না।
ওখানে থাকাকালে নাজমুলকে দিয়ে তিনি ফোন দেন দেশে অবস্থানরত তার জা মাহবুবা
নুমান চৌধুরীকে। তিনি সিলেট নগরীর শাহী ঈদগাহের ইকবাল মঞ্জিলের
অনামিকা-১০-২ নম্বর বাসার বাসিন্দা। মুনতাহারের কথামতো মাহবুবাকে ফোন করে
১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে নাজমুল এবং জানায়, টাকা না দিলে তার সন্তান
ইসফার ওয়াছিফ চৌধুরী (১০)-কে অপহরণ করে হত্যা করা হবে। ওয়াছিফ-ও কানাডা
প্রবাসী। তবে বর্তমানে মায়ের সঙ্গে সিলেটে অবস্থান করছে। নাজমুল এভাবে বেশ
কয়েকবার মাহবুবাকে ফোন দিয়ে হুমকি দেয়। একই ভাবে মুনতাহারও বিভিন্ন সময় তার
ব্যক্তিগত মোবাইল ফোন থেকে ফোনে হুমকি দেয়। এ সময় মাহবুবা সিলেটের
কোতোয়ালি থানায় একটি জিডি করেন। ওই জিডিতে তিনি মোবাইল নম্বরও উল্লেখ করেন।
প্রথমে মাহবুবাকে হুমকি দেয়ার পর একপর্যায়ে মুনতাহার ও তার প্রেমিক নাজমুল
কানাডায় অবস্থানরত তার ভাসুর বেলাল উদ্দিন চৌধুরীকে ফোন করে। ফোনে সে ১০
লাখ টাকা চাঁদা দাবির পাশাপাশি তার ছেলেকেও হত্যার হুমকি দেয়। এ ঘটনায়ও
মাহবুবা চৌধুরী সিলেটের কোতোয়ালি থানায় আরও একটি জিডি করেন। জিডি দায়েরের
পরও কাজ না হওয়ায় বেলাল উদ্দিন চৌধুরী কানাডা হাইকমিশনের সহায়তা চান। এরপর এ
ব্যাপারে আইনি সহায়তা চেয়ে কানাডা হাইকমিশন থেকে সিলেট মেট্রো পুলিশের
সহায়তা চাওয়া হয় বলে জানিয়েছেন মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ও ওসি মোশারফ হোসেন।
তিনি দু’টি এজাহার ও ডিবিতে দেয়া আবেদন নিয়ে তদন্ত শুরু করেন। তদন্তে
সত্যতা পাওয়া গেলে পুলিশ অভিযানে নামে। কিন্তু পুলিশি তদন্ত শুরু হওয়ার পর
মুনতাহার তার প্রেমিক নাজমুলকে সাগরদিঘীর পাড়স্থ বাসা থেকে বের করে দেয়। এক
পর্যায়ে সে আম্বরখানা এলাকার রিপন নামে আরও একজনের সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে
তোলে। রিপনকে নিয়ে সে ওই এলাকায় বসবাস করে। তবে, রিপন কখনও কাউকে হুমকি
দেয়নি বলে ডিবি জানিয়েছে। সিলেট মেট্রোপুলিন পুলিশের গোয়েন্দা শাখা থেকে
গতকাল এক প্রেস বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়, গোলাপগঞ্জের রফিপুর গ্রামের কানাডা
প্রবাসী বেলাল উদ্দিন চৌধুরীর স্ত্রী ও বর্তমানে নগরীর অনামিকা-১০-২, ইকবাল
মঞ্জিল, শাহী ঈদগাহ, টিবি গেটের বাসিন্দা মাহবুবা নুমান চৌধুরী গত ২৮শে
আগস্ট কোতোয়ালি থানায় একটি জিডি করেন। জিডিতে তিনি উল্লেখ করেন, তিনি বাসায়
অবস্থানকালে তার ব্যক্তিগত মোবাইল নং- ০১৯১৭-৭২২৯৩৮ নম্বরটিতে অজ্ঞাতনামা
ব্যক্তি তার মোবাইল নং- ০১৭৯৮-২৪৩৬৫৭, ০১৭৯৭-৮৫২৪৩৯, ০১৭৬৮-৫১৩২৭৩,
০১৮৫২-২৬১৮৪৬ দ্বারা পর্যায়ক্রমে তাকে ও আমার স্বামী বেলাল চৌধুরীকে
(কানাডা মোবাইল নং- ৬১৩-৮৫১০২০৫, টেলিফোন নং- ৬১৩-৮৬০৫৫১৫) ফোন করে অকথ্য
ভাষায় গালাগাল করে। তারা তার স্বামীর কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে এবং
দেশে এলে তাকে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। একইভাবে বাদীর কাছে ১০ লাখ টাকা চাঁদা
দাবি করে। নতুবা বাদীকে ও তার সন্তান কানাডিয়ান সিটিজেন ইসফার ওয়াছিফ
চৌধুরীকে (১০) অপহরণ করে প্রাণনাশের হুমকি দেয়। থানায় জিডির পর পুলিশের
পক্ষ থেকে কোন ব্যবস্থা না নেয়ায় বাদী ডিবি পুলিশের দ্বারস্থ হন। এসএমপি
ডিবি পুলিশের সিনিয়র সহকারী কমিশনার মল্লিক আহসান উদ্দিন সামীর নির্দেশে এ
ঘটনায় দিলদার হোসেন ওরফে নাজমুল (২৮)-কে গত ১৮ই ডিসেম্বর মৌলভীবাজার সদর
থানা পুলিশের সহায়তায় গ্রেপ্তার করে ডিবি পুলিশ। এ ঘটনায় সে আদালতে
স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেয়। ওই স্বীকারোক্তিতে মুনতাহারকে তার
প্রেমিকা হিসেবে উল্লেখ করে নাজমুল এবং মুনতাহারার প্ররোচনায় সে ফোন করেছে
বলে জানায়। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী গত শুক্রবার শহরতলীর খাদিম এলাকা থেকে
সিদরাতুল মুনতাহার চৌধুরীকে আটক করা হয়। এ ঘটনায় পুলিশ রিপন ওরফে রূপন
নামের আরেক যুবককে আটক করা হলেও ঘটনার সঙ্গে তার কোন সংশ্লিষ্টতা না পাওয়ায়
পুলিশ তাকে ছেড়ে দিয়েছে। এ ঘটনায় কোতোয়ালি থানায় একটি মামলা করা হয়েছে।
সিলেট গোয়েন্দা পুলিশের সহকারী কমিশনার মল্লিক আহসান সামী গতকাল বিকালে
মানবজমিনকে জানিয়েছেন, তদন্তের মাধ্যমে আসামিদের গ্রেপ্তার করা হয়েছে।
গ্রেপ্তারের পর তারা আদালতে স্বীকারোক্তি দিয়েছে। এদিকে, গ্রেপ্তারের পর
মুনতাহার পুলিশের কাছে জানিয়েছিল যে সে আগের স্বামীকে তালাক দিয়ে দেশে এসে
বিয়ে করেছে। কিন্তু পুলিশের কাছে তালাকের কোন কাগজ দেখাতে পারেনি। আর
নাজমুলের সঙ্গে বিয়ে হয়েছে বলে স্বীকার করলেও কোন কাবিননামা দেখাতে পারেনি।
অন্যদিকে, রিপনের সঙ্গে বিয়ের একটি কাগজ পুলিশের কাছে দিয়েছে। পুলিশ সেটি
যাচাই-বাছাই করছে। মামলার তদন্ত কর্মকর্তা ওসি মোশারফ হোসেন জানিয়েছেন,
বক্তব্য মতো মুনতাহার কোন কাগজ দেখাতে পারেনি। সে প্রথমে নাজমুলকে নিয়ে
বসবাস করেছে। পরবর্তীকালে রিপনের সঙ্গে সংসার করেছে। তিনি জানান, এ
ব্যাপারে আরও তদন্ত হলে মূল ঘটনা বেরিয়ে আসবে।
No comments