পোশাক খাত আর বিনিয়োগে হতাশা কাটেনি by এমএম মাসুদ ও হামিদ বিশ্বাস
গত
৫ই জানুয়ারির নির্বাচনের পর আপাত দৃষ্টিতে দেশে স্থিতিশীল পরিবেশ দৃশ্যমান
হলেও বছর জুড়ে দেশের সার্বিক অর্থনীতিতে ছিল চরম আস্থার সঙ্কট। এ সময়ে
দেশে ছিল না কোন উত্তপ্ত রাজনৈতিক কর্মসূচি, হরতাল-অবরোধ, নৈরাজ্য ও
ব্যাংকে টাকার অভাব। বিনিয়োগের জন্য ছিল উদ্যোক্তাও। কিন্তু গতি ছিল না
শুধু বিনিয়োগে। অন্যদিকে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরী পোশাকশিল্পে
বিপর্যয় থেমে থাকেনি। সার্বিক অর্থনীতিতে শতকারা ৮০ ভাগ অবদান রাখা এ
শিল্পের বছর কেটেছে অনেকটা হতাশায়। চলতি বছরে ৪৫০ গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে। এর
মধ্যে বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত ২৮০টি এবং এর বাইরে ১৭০টি। এর মধ্যে প্রায় ৫
শতাংশই ভাল মানের কারখানা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, উচ্চ সুদ আর বেপরোয়া সার্ভিস
চার্জ আঘাত করছে বিনিয়োগে। দীর্ঘ সময় ধরে দেশে বিনিয়োগ না হওয়া, ঋণ সরবরাহ
কমে যাওয়া, রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক প্রভাব, রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাওয়া ও
বাজারে ডলারের সরবরাহ হ্রাস। ফলে সার্বিক অর্থনীতিতে এসবের দুষ্ট প্রভাব
পড়েছে বলে তারা মনে করেন। এ ছাড়া উদ্যোক্তাদের আস্থার সঙ্কট।
গ্যাস-বিদ্যুতের অপ্রতুলতা। অবকাঠামো দুর্বলতা তো আছেই। ব্যাংকে জমছে অলস
টাকার পাহাড়। আর কেন্দ্রীয় ব্যাংকে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের নতুন নতুন
রেকর্ড সৃষ্টি হচ্ছে প্রতিনিয়তই। এ অবস্থা দীর্ঘ সময় ধরে চলতে থাকলে দেশের
অর্থনীতি ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে গিয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা করেছেন
উদ্যোক্তারা। সরকারের পক্ষ থেকে বিনিয়োগ বাড়ানোর জন্য নানা উদ্যোগ নেয়ার
কথা বলা হলেও বাস্তবে কোন কিছুই করা হচ্ছে না। তারা বলেছেন, বিনিয়োগ
অর্থনীতিতে ‘রক্ত সঞ্চালনে’র ভূমিকা পালন করে। বিনিয়োগ বাড়ানো না গেলে
অর্থনীতিতে গতি আসবে না। এর জন্য ঋণের সুদের হার কমাতে হবে। ব্যাংকগুলোর
মাত্রাতিরিক্তি সার্ভিস চার্জের লাগাম টেনে ধরতে হবে। এসব ব্যাপারে
শিল্পবান্ধব পদক্ষেপ নেয়ার কথা বলা হলেও বাস্তবে তার কিছুই হচ্ছে না। ফলে
ব্যবসায়িক কর্মকা-েও গতি লক্ষ্য করা যায়নি বছর জুড়ে। এ প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয়
ব্যাংকের সাবেক গভর্নর ড. সালেহউদ্দিন আহমেদ বলেন, অর্থনীতিতে এখন বড়
সমস্যা হচ্ছে আস্থাহীনতা। তিনি বলেন, দীর্ঘ সময় ধরে এ অবস্থা চলতে থাকলে
বেকারের সংখ্যা বেড়ে যাবে। তখন অর্থনীতি এ ভার বহন করতে পারবে না।
অর্থনীতিতে কোন সঙ্কটই একদিনে আসে না। আগে থেকে আগাম বার্তা দিতে থাকে।
যেটা এখন দেয়া হচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা এ বার্তা গ্রহণ না করলে ভুল করবে।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পক্ষ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের পর্যালোচনামূলক এক আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে বিনিয়োগে উৎসাহ পাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা। এর প্রধান কারণ হিসেবে তারা চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই দায়ী করেছেন। সংস্থাটির মতে, দেশের অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির একটি যোগসূত্র আছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশের অর্থনীতিও গতি হারায়। মূলত বছর জুড়ে এমন পরিস্থিতিই দেখা গেছে।
বিনিয়োগে খরা: দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে মন্দা কাটছে না। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পলিসি পর্যায় থেকে বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে বিনিয়োগ না থাকায় দেশে কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে দেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে ১৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল যথাক্রমে ১১ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ১৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ওই সময়ে এফডিআই বেড়েছে মাত্র ১১%। এ বিনিয়োগের ৫৩ শতাংশই হচ্ছে কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে। স্থানীয় বিনিয়োগের পরিমাণও একেবারে কম। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৪৩২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে ১৫,৪৯৬ কোটি টাকার। এর মধ্যে স্থানীয় বিনিয়োগের প্রস্তাব ১৪,৩২৯ কোটি টাকা ও বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব ১,১৬৬ কোটি টাকা। নিবন্ধন হলেও এসব বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে।
রপ্তানি খাতে শঙ্কা: চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকায় রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের তৈরী পোশাক খাতেও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক অবস্থা বিরাজ করছে। এদিকে গ্যাস সংযোগের অভাবে অনেক শিল্পকারখানা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য নভেম্বরে এসে একটু ইতিবাচক ধারায় প্রবৃদ্ধি চলে এসেছে। ইপিবি’র তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-আগস্ট দুই মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫১৪ কোটি ২২ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র ২.০৭ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের ওই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৫০৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৫% বেশি। তবে গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১২.৬৭ শতাংশ। বেশির ভাগ প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্যে আয় কমেছে।
চাহিদা অনুযায়ী টাকার সরবরাহ কম: বাজারে টাকার চাহিদা আছে কিন্তু সরবরাহ নেই। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও যেসব উদ্যোক্তা চলমান প্রকল্পের জন্য ঋণ নিতে চান তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণের যোগান দেয়া হচ্ছে না। ফলে সেসব উদ্যোক্তাও নতুন করে টাকার সঙ্কটে ভুগছেন। এতে শিল্পের বিকাশ যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি অর্থনৈতিক অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকঋণের সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে অর্থাৎ সিঙ্গেল ডিজিটে নামানোর সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তারা সুদের হার কমানোর ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। কিন্তু বাস্তবে এখনও সুদের হার কমছে না।
এলসি নিচ্ছে না ব্যাংক: ব্যাংকের মূলধনের ২০ শতাংশ নন-ফান্ডেড বা এলসিতে বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তার পরও ব্যাংকগুলো বর্তমানে এলসি খোলার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। গত অর্থবছরে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছিল প্রায় ১৫%। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে এলসি খোলা বেড়েছে ১২% এবং আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১%। সম্প্রতি এটির প্রবৃদ্ধি আরও কমেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল। এসব পণ্যের আমদানি কমলে শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রকট হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ টাকা বিনিয়োগে আসছে না। অন্যদিকে ৩০শে নভেম্বর-২০১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২১.৫০ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
পোশাক খাতের অর্ডার কমছে: রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরী পোশাক খাতে বছর জুড়ে ছিল বিপর্যয়। চলতি বছরে ৪৫০ গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত ২৮০টি এবং এর বাইরে ১৭০টি। এর মধ্যে প্রায় ৫ শতাংশই ভাল মানের কারখানা। প্রতিদিনই প্রায়ই দু-একটি করে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছে দুই লাখ শ্রমিক। নতুন কারখানা চালুর হারও কমছে। বিজিএমইএ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাজ না থাকায় খরচ পোষাতে না পেরে এসব কারখানা বন্ধ হচ্ছে। ফলে রপ্তানি আদেশও কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বড় গার্মেন্ট মালিকরাও। চলতি বছরের প্রথম মাসে পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোঠায় চলে আসে। সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানি ৯.৩ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে শিল্প কঠিন চাপের মুখে পড়েছে এ শিল্প। অবশ্য এখন একটু একটু করে রপ্তানি বাড়ছে। আগে বড় কারখানাগুলো বেশি করে পোশাকের অর্ডার নিয়ে অন্য কারখানায় সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করাতো। তাদের নামে রপ্তানি হতো। কিন্তু বর্তমানে বড় কোম্পানিতেই অর্ডার নেই। ফলে একের পর এক গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যদিও শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সংগঠনটির সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম জানিয়েছেন, নানা উদ্যোগের কারণে এ খাতে যে আস্থা সঙ্কট ছিল তা দূর হয়েছে। এখন ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। তিনি বলেন, কারখানা বন্ধ হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। এক নম্বর কারণ হচ্ছে কমপ্লায়েন্স ইস্যু। পাশাপাশি ব্যাংকের সুদসহ ব্যাংকের সার্ভিস চার্জে মালিকদের খরচ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির কারণে মালিকরা কারখানা চালাতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
বিজিএমইএ মতে, কারখানার সংখ্যা ৫৭৫১টি। আর এর বাইরে ১৭০টির মতো কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফলে তারা ধারণা করছেন ২ লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়েছেন। আর বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে ২০ শতাংশ হচ্ছে শিফট হওয়া এবং ৪০ শতাংশ শেয়ার্ড বিল্ডিং কারখানা। বাকিগুলো সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করা কারখানা। পাশাপাশি নতুন কারখানা চালুর হার কমে আসছে। ২০১৪ সালে নতুন কারখানা হয়েছে ৮০টি। ২০১৩ সালে, যা ১৪০টি এবং ২০১২ সালে ২০০টি। অর্থাৎ নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না।
‘পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে’
পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেছেন, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ থাকলেও গত এক বছরে দেশের পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশ-বিদেশে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে খাতটি। বিদেশীদের একের পর এক শর্ত, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামো দুর্বলতা, গ্যাস, বিদ্যুৎ সঙ্কটসহ নানা কারণে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে। বিশেষত অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও আইএলও যৌথভাবে সারা দেশে ১৭০৬টি কারখানা পরিদর্শন করে। এতে মাত্র ২৯টি কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর মাধ্যমে প্রমাণ হলো পুরো দেশের চিত্র রানা প্লাজার মতো নয়। সে কারণে ক্রেতারা ফিরে আসছে। ইমেজ সঙ্কট দূর হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০% ইমেজ সঙ্কট দূর হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। মানবজমিনকে আজিম বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহায়তায় প্রণয়ন করা হয় ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লান। এর বাস্তবায়নে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ ও আঞ্চলিক সংস্থা। জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ও বিশ্বব্যাংকের সহায়ক সংস্থা আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এগিয়ে আসে স্বল্প সুদের ঋণ নিয়ে। একই সময় আইএলও এবং আইএফসি যৌথভাবে প্রণয়ন করে বেটার ওয়ার্ক কর্মসূচি। এসব উদ্যোগের ফলে পোশাক খাতে কাঠামোগত পরিবর্তনের কিছুটা হলেও ছোঁয়া লেগেছে। তবে এটি যথেষ্ট নয়, আরও বাড়াতে হবে। কারখানায় কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিও এখন অনেক জোর দেয়া হচ্ছে। এ সময় বাংলাদেশের পোশাক কারখানা পরিদর্শন করতে ইউরোপভিত্তিক ক্রেতারা গঠন করেন অ্যাকর্ড অন বিল্ডিং অ্যান্ড ফায়ার সেফটি ইন বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতারা এ সময় গঠন করেন অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি। এ দু’টি ক্রেতা জোট বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি প্রতিনিধি দলও এগিয়ে এসেছে কারখানা পরিদর্শনে। সবকিছুর প্রভাবে পোশাক খাত অনেকটা স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ফিরে পেয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৫০ বিলিয়নের ঘোষণা কতটা বাস্তবসম্মত জানতে চাইলে শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, সরকার যদি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর নিশ্চয়তা দিতে পারে তবে আমরাও ৫০ বিলিয়নের নিশ্চয়তা দিতে পারবো।
‘চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগোতে হবে’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত পরিচালক ও পোশাক খাত বিষয়ক গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, চ্যালেঞ্জিং ও ঘটনাবহুল একটি বছর পার করলো দেশের তৈরী পোশাক খাত। নানা কারণে ২০১৪ সাল ছিল আলোচনায়। ঘটে যাওয়া রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ও তাজরিন ফ্যাশন অগ্নিকা-ের পর অনেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যেই বছর পার করেছে এ খাত। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মানবজমিনকে বলেন, রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তরা মাত্র ৪০% ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। যেখানে বাকি আছে আরও ৬০%। এর জন্য সরকার ও মালিকদের পর্যাপ্ত সহযোগিতার অভাব ছিল। তবে নতুন ন্যূনতম মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন একটি ভাল উদ্যোগ ছিল বলে জানান তিনি। সমাপ্ত বছরে পোশাক খাতের আরেক নেতিবাচক দিক হলো দুর্বল প্রবৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড ইমেজকে অনেকে দায়ী করলেও মূল সঙ্কট ছিল বিশ্বময়। প্রধান আমদানিকারক দেশগুলোর চাহিদা সঙ্কট ছিল। জিএসপি সুবিধা তুলে নেয়ায় সংশ্লিষ্ট পণ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যদিও পোশাক খাতে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। তবে বিষয়টি সারা বছর রাজনৈতিকভাবে কথা চালাচালি হয়েছে বহু। ৫০ বিলিয়ন রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ঘোষণার বাস্তবতা আছে কি না জানতে চাইলে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, লক্ষ্য হিসেবে চিত্তাকর্ষক হলেও চ্যালেঞ্জিং। যদি এটি বাস্তবায়ন করতে হয় তবে প্রতি বছর গড়ে ১৩% রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু সে নিশ্চয়তা দেশ ও দেশের কর্তা ব্যক্তিদের দিতে হবে। অবশ্য বিষয়টি কিভাবে বাস্তবায়ন করবে তারও কোন সঠিক নমুনা অদৃশ্য। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাত উত্তরণমুখী। এখন এটিকে ত্বরান্বিত করা জরুরি। সে জন্য চিহ্নিত সমস্যা ও দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে তুলতে হবে।
সম্প্রতি বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) পক্ষ থেকে ২০১৩-১৪ অর্থবছরের পর্যালোচনামূলক এক আলোচনায় উল্লেখ করা হয়েছে, দেশে বিনিয়োগে উৎসাহ পাচ্ছে না বিনিয়োগকারীরা। এর প্রধান কারণ হিসেবে তারা চলমান রাজনৈতিক অস্থিরতাকেই দায়ী করেছেন। সংস্থাটির মতে, দেশের অর্থনীতির সঙ্গে রাজনীতির একটি যোগসূত্র আছে। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা না থাকলে দেশের অর্থনীতিও গতি হারায়। মূলত বছর জুড়ে এমন পরিস্থিতিই দেখা গেছে।
বিনিয়োগে খরা: দেশী-বিদেশী বিনিয়োগে মন্দা কাটছে না। মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছেন বিদেশী বিনিয়োগকারীরাও। এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করতে পলিসি পর্যায় থেকে বড় ধরনের উদ্যোগ নেয়া হচ্ছে না। অন্যদিকে বিনিয়োগ না থাকায় দেশে কর্মসংস্থানের পথ রুদ্ধ হয়ে পড়ছে। চলতি অর্থবছরের জুলাইয়ে দেশে সরাসরি বিদেশী বিনিয়োগ (এফডিআই) এসেছে মাত্র ১২ কোটি ৩০ লাখ ডলার। একই সঙ্গে পুঁজিবাজারে বিদেশী বিনিয়োগ হয়েছে ১৯ কোটি ৫০ লাখ ডলার। গত অর্থবছরের একই সময়ে এ হার ছিল যথাক্রমে ১১ কোটি ১০ লাখ ডলার এবং ১৬ কোটি ৩০ লাখ ডলার। ওই সময়ে এফডিআই বেড়েছে মাত্র ১১%। এ বিনিয়োগের ৫৩ শতাংশই হচ্ছে কোম্পানিগুলোর অর্জিত মুনাফা থেকে। স্থানীয় বিনিয়োগের পরিমাণও একেবারে কম। বিনিয়োগ বোর্ডের তথ্যানুযায়ী, জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৪৩২টি শিল্পপ্রতিষ্ঠান নিবন্ধিত হয়েছে। এসব প্রতিষ্ঠানের অনুকূলে বিনিয়োগের প্রস্তাব এসেছে ১৫,৪৯৬ কোটি টাকার। এর মধ্যে স্থানীয় বিনিয়োগের প্রস্তাব ১৪,৩২৯ কোটি টাকা ও বিদেশী বিনিয়োগের প্রস্তাব ১,১৬৬ কোটি টাকা। নিবন্ধন হলেও এসব বিনিয়োগ প্রক্রিয়ার মধ্যেই আছে।
রপ্তানি খাতে শঙ্কা: চলতি অর্থবছরের শুরু থেকেই রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক ধারা অব্যাহত রয়েছে। ইতিমধ্যে ইউরোপীয় ইউনিয়ন ও আমেরিকায় রপ্তানি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। দেশের তৈরী পোশাক খাতেও রপ্তানি আয়ে নেতিবাচক অবস্থা বিরাজ করছে। এদিকে গ্যাস সংযোগের অভাবে অনেক শিল্পকারখানা চালু করা সম্ভব হচ্ছে না। অবশ্য নভেম্বরে এসে একটু ইতিবাচক ধারায় প্রবৃদ্ধি চলে এসেছে। ইপিবি’র তথ্যে দেখা যায়, জুলাই-আগস্ট দুই মাসে রপ্তানি আয় হয়েছে ৫১৪ কোটি ২২ লাখ ডলার, যা গত অর্থবছরের একই সময়ের চেয়ে মাত্র ২.০৭ শতাংশ বেশি। গত অর্থবছরের ওই সময়ে রপ্তানি আয় হয়েছিল ৫০৩ কোটি ৭৭ লাখ ডলার, যা আগের অর্থবছরের চেয়ে প্রায় ১৫% বেশি। তবে গত অর্থবছরের চেয়ে চলতি অর্থবছরের একই সময়ে রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি কমেছে ১২.৬৭ শতাংশ। বেশির ভাগ প্রধান প্রধান রপ্তানি পণ্যে আয় কমেছে।
চাহিদা অনুযায়ী টাকার সরবরাহ কম: বাজারে টাকার চাহিদা আছে কিন্তু সরবরাহ নেই। অর্থনৈতিক মন্দার মধ্যেও যেসব উদ্যোক্তা চলমান প্রকল্পের জন্য ঋণ নিতে চান তাদের চাহিদা অনুযায়ী ঋণের যোগান দেয়া হচ্ছে না। ফলে সেসব উদ্যোক্তাও নতুন করে টাকার সঙ্কটে ভুগছেন। এতে শিল্পের বিকাশ যেমন ব্যাহত হচ্ছে, তেমনি অর্থনৈতিক অগ্রগতিও বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
উন্নয়ন ও বিনিয়োগ বাড়াতে ব্যাংকঋণের সুদের হার ১০ শতাংশের নিচে অর্থাৎ সিঙ্গেল ডিজিটে নামানোর সুপারিশ করেছে অর্থ মন্ত্রণালয়-সংক্রান্ত সংসদীয় স্থায়ী কমিটি। তারা সুদের হার কমানোর ব্যাপারে একমত পোষণ করেন। কিন্তু বাস্তবে এখনও সুদের হার কমছে না।
এলসি নিচ্ছে না ব্যাংক: ব্যাংকের মূলধনের ২০ শতাংশ নন-ফান্ডেড বা এলসিতে বিনিয়োগ করার সুযোগ রয়েছে। কিন্তু তার পরও ব্যাংকগুলো বর্তমানে এলসি খোলার পরিমাণ কমিয়ে দিয়েছে। গত অর্থবছরে আমদানি খাতে ব্যয় বেড়েছিল প্রায় ১৫%। চলতি অর্থবছরের জুলাই-অক্টোবরে এলসি খোলা বেড়েছে ১২% এবং আমদানি ব্যয় বেড়েছে ১১%। সম্প্রতি এটির প্রবৃদ্ধি আরও কমেছে। এর মধ্যে বেশির ভাগই হচ্ছে শিল্পের যন্ত্রপাতি ও কাঁচামাল। এসব পণ্যের আমদানি কমলে শিল্প খাতে নেতিবাচক প্রভাব আরও প্রকট হবে।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য মতে, গত ৩০শে নভেম্বর পর্যন্ত ব্যাংকিং খাতে অলস টাকার পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৯২ হাজার কোটি টাকা। বিপুল পরিমাণ এ টাকা বিনিয়োগে আসছে না। অন্যদিকে ৩০শে নভেম্বর-২০১৪ পর্যন্ত বাংলাদেশ ব্যাংকের বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ দাঁড়িয়েছে ২১.৫০ বিলিয়ন ডলার বা ১ লাখ ৬৮ হাজার কোটি টাকা।
পোশাক খাতের অর্ডার কমছে: রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরী পোশাক খাতে বছর জুড়ে ছিল বিপর্যয়। চলতি বছরে ৪৫০ গার্মেন্ট বন্ধ হয়েছে। এর মধ্যে গার্মেন্ট মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সদস্যভুক্ত ২৮০টি এবং এর বাইরে ১৭০টি। এর মধ্যে প্রায় ৫ শতাংশই ভাল মানের কারখানা। প্রতিদিনই প্রায়ই দু-একটি করে কারখানা বন্ধ হচ্ছে। এতে বেকার হয়ে পড়েছে দুই লাখ শ্রমিক। নতুন কারখানা চালুর হারও কমছে। বিজিএমইএ সূত্র বিষয়টি নিশ্চিত করেছে। ব্যবসায়ীরা বলছেন, কাজ না থাকায় খরচ পোষাতে না পেরে এসব কারখানা বন্ধ হচ্ছে। ফলে রপ্তানি আদেশও কমে যাওয়ায় বিপাকে পড়েছেন বড় গার্মেন্ট মালিকরাও। চলতি বছরের প্রথম মাসে পোশাক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি শূন্যের কোঠায় চলে আসে। সেপ্টেম্বরে পোশাক রপ্তানি ৯.৩ শতাংশ নেতিবাচক প্রবৃদ্ধি হয়েছে। ফলে শিল্প কঠিন চাপের মুখে পড়েছে এ শিল্প। অবশ্য এখন একটু একটু করে রপ্তানি বাড়ছে। আগে বড় কারখানাগুলো বেশি করে পোশাকের অর্ডার নিয়ে অন্য কারখানায় সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করাতো। তাদের নামে রপ্তানি হতো। কিন্তু বর্তমানে বড় কোম্পানিতেই অর্ডার নেই। ফলে একের পর এক গার্মেন্ট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। যদিও শিল্প মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ বলছে তারা ঘুরে দাঁড়িয়েছে। সংগঠনটির সহসভাপতি শহিদুল্লাহ আজিম জানিয়েছেন, নানা উদ্যোগের কারণে এ খাতে যে আস্থা সঙ্কট ছিল তা দূর হয়েছে। এখন ক্রমেই উন্নতি হচ্ছে। তিনি বলেন, কারখানা বন্ধ হওয়ার অনেকগুলো কারণ আছে। এক নম্বর কারণ হচ্ছে কমপ্লায়েন্স ইস্যু। পাশাপাশি ব্যাংকের সুদসহ ব্যাংকের সার্ভিস চার্জে মালিকদের খরচ বেড়ে গেছে। এ ছাড়া ন্যূনতম মজুরি বৃদ্ধির কারণে মালিকরা কারখানা চালাতে না পেরে কারখানা বন্ধ করে দিচ্ছেন।
বিজিএমইএ মতে, কারখানার সংখ্যা ৫৭৫১টি। আর এর বাইরে ১৭০টির মতো কারখানা বন্ধ হয়েছে। ফলে তারা ধারণা করছেন ২ লক্ষাধিক শ্রমিক বেকার হয়েছেন। আর বন্ধ হওয়া কারখানার মধ্যে ২০ শতাংশ হচ্ছে শিফট হওয়া এবং ৪০ শতাংশ শেয়ার্ড বিল্ডিং কারখানা। বাকিগুলো সাব-কন্ট্রাক্টে কাজ করা কারখানা। পাশাপাশি নতুন কারখানা চালুর হার কমে আসছে। ২০১৪ সালে নতুন কারখানা হয়েছে ৮০টি। ২০১৩ সালে, যা ১৪০টি এবং ২০১২ সালে ২০০টি। অর্থাৎ নতুন করে বিনিয়োগ হচ্ছে না।
‘পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে’
পোশাক মালিকদের সংগঠন বিজিএমইএ সহ-সভাপতি শহীদুল্লাহ আজিম বলেছেন, সমস্যা ও চ্যালেঞ্জ থাকলেও গত এক বছরে দেশের পোশাক খাত ঘুরে দাঁড়িয়েছে। রানা প্লাজা দুর্ঘটনার পর দেশ-বিদেশে কঠিন চ্যালেঞ্জের মধ্যে পড়ে খাতটি। বিদেশীদের একের পর এক শর্ত, শ্রমিকদের মজুরি বৃদ্ধি, ট্রেড ইউনিয়ন গঠন, রাজনৈতিক অস্থিরতা, অবকাঠামো দুর্বলতা, গ্যাস, বিদ্যুৎ সঙ্কটসহ নানা কারণে পরিস্থিতি খারাপ হয়ে গেছে। বিশেষত অ্যাকর্ড, অ্যালায়েন্স ও আইএলও যৌথভাবে সারা দেশে ১৭০৬টি কারখানা পরিদর্শন করে। এতে মাত্র ২৯টি কারখানা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত হয়। এর মাধ্যমে প্রমাণ হলো পুরো দেশের চিত্র রানা প্লাজার মতো নয়। সে কারণে ক্রেতারা ফিরে আসছে। ইমেজ সঙ্কট দূর হয়েছে। এখন পর্যন্ত প্রায় ৯০% ইমেজ সঙ্কট দূর হয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। মানবজমিনকে আজিম বলেন, রানা প্লাজা দুর্ঘটনা-পরবর্তী সময়ে আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থার (আইএলও) সহায়তায় প্রণয়ন করা হয় ন্যাশনাল অ্যাকশন প্লান। এর বাস্তবায়নে আর্থিক ও কারিগরি সহায়তা নিয়ে এগিয়ে আসে কানাডা, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জাপান, যুক্তরাজ্য ও যুক্তরাষ্ট্রের মতো দেশ ও আঞ্চলিক সংস্থা। জাপানের আন্তর্জাতিক উন্নয়ন সহযোগিতা সংস্থা (জাইকা) ও বিশ্বব্যাংকের সহায়ক সংস্থা আন্তর্জাতিক ফাইন্যান্স করপোরেশন (আইএফসি) এগিয়ে আসে স্বল্প সুদের ঋণ নিয়ে। একই সময় আইএলও এবং আইএফসি যৌথভাবে প্রণয়ন করে বেটার ওয়ার্ক কর্মসূচি। এসব উদ্যোগের ফলে পোশাক খাতে কাঠামোগত পরিবর্তনের কিছুটা হলেও ছোঁয়া লেগেছে। তবে এটি যথেষ্ট নয়, আরও বাড়াতে হবে। কারখানায় কাজের পরিবেশ নিশ্চিত করার বিষয়টিও এখন অনেক জোর দেয়া হচ্ছে। এ সময় বাংলাদেশের পোশাক কারখানা পরিদর্শন করতে ইউরোপভিত্তিক ক্রেতারা গঠন করেন অ্যাকর্ড অন বিল্ডিং অ্যান্ড ফায়ার সেফটি ইন বাংলাদেশ। যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক ক্রেতারা এ সময় গঠন করেন অ্যালায়েন্স ফর বাংলাদেশ ওয়ার্কার সেফটি। এ দু’টি ক্রেতা জোট বাংলাদেশের পোশাক কারখানাগুলো পরিদর্শন করে। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বুয়েট) একটি প্রতিনিধি দলও এগিয়ে এসেছে কারখানা পরিদর্শনে। সবকিছুর প্রভাবে পোশাক খাত অনেকটা স্বাভাবিক প্রবৃদ্ধি ফিরে পেয়েছে। ২০২১ সালের মধ্যে পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি ৫০ বিলিয়নের ঘোষণা কতটা বাস্তবসম্মত জানতে চাইলে শহীদুল্লাহ আজিম বলেন, সরকার যদি গ্যাস, বিদ্যুৎ ও অবকাঠামোর নিশ্চয়তা দিতে পারে তবে আমরাও ৫০ বিলিয়নের নিশ্চয়তা দিতে পারবো।
‘চ্যালেঞ্জ নিয়েই এগোতে হবে’
বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার পর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) অতিরিক্ত পরিচালক ও পোশাক খাত বিষয়ক গবেষক খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, চ্যালেঞ্জিং ও ঘটনাবহুল একটি বছর পার করলো দেশের তৈরী পোশাক খাত। নানা কারণে ২০১৪ সাল ছিল আলোচনায়। ঘটে যাওয়া রানা প্লাজা ট্র্যাজেডি ও তাজরিন ফ্যাশন অগ্নিকা-ের পর অনেকটা চ্যালেঞ্জের মধ্যেই বছর পার করেছে এ খাত। খন্দকার গোলাম মোয়াজ্জেম মানবজমিনকে বলেন, রানা প্লাজায় ক্ষতিগ্রস্তরা মাত্র ৪০% ক্ষতিপূরণ পেয়েছে। যেখানে বাকি আছে আরও ৬০%। এর জন্য সরকার ও মালিকদের পর্যাপ্ত সহযোগিতার অভাব ছিল। তবে নতুন ন্যূনতম মজুরি কাঠামো বাস্তবায়ন একটি ভাল উদ্যোগ ছিল বলে জানান তিনি। সমাপ্ত বছরে পোশাক খাতের আরেক নেতিবাচক দিক হলো দুর্বল প্রবৃদ্ধি। এ ক্ষেত্রে ব্র্যান্ড ইমেজকে অনেকে দায়ী করলেও মূল সঙ্কট ছিল বিশ্বময়। প্রধান আমদানিকারক দেশগুলোর চাহিদা সঙ্কট ছিল। জিএসপি সুবিধা তুলে নেয়ায় সংশ্লিষ্ট পণ্যে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে। যদিও পোশাক খাতে খুব বেশি ক্ষতি হয়নি। তবে বিষয়টি সারা বছর রাজনৈতিকভাবে কথা চালাচালি হয়েছে বহু। ৫০ বিলিয়ন রপ্তানি প্রবৃদ্ধি অর্জনের ঘোষণার বাস্তবতা আছে কি না জানতে চাইলে গোলাম মোয়াজ্জেম বলেন, লক্ষ্য হিসেবে চিত্তাকর্ষক হলেও চ্যালেঞ্জিং। যদি এটি বাস্তবায়ন করতে হয় তবে প্রতি বছর গড়ে ১৩% রপ্তানি প্রবৃদ্ধি প্রয়োজন। কিন্তু সে নিশ্চয়তা দেশ ও দেশের কর্তা ব্যক্তিদের দিতে হবে। অবশ্য বিষয়টি কিভাবে বাস্তবায়ন করবে তারও কোন সঠিক নমুনা অদৃশ্য। সব মিলিয়ে বাংলাদেশের পোশাক খাত উত্তরণমুখী। এখন এটিকে ত্বরান্বিত করা জরুরি। সে জন্য চিহ্নিত সমস্যা ও দুর্বলতাগুলো কাটিয়ে তুলতে হবে।
No comments