সিসার নেশা by ডক্টর তুহিন মালিক
এক. মারাত্মক এক নতুন মাদক সংস্কৃতিতে ভুগছে আমাদের নতুন প্রজন্ম। পাড়া-মহল্লা স্কুল-কলেজ বিশ্ববিদ্যালয় সর্বত্র মাদকের রমরমা বাণিজ্য। এ যেন এক অদ্ভুত আধুনিক মাদক সংস্কৃতিতে ভুগছি আমরা। শহরের অভিজাত রাস্তায় এখন নানা রকমের লাউঞ্জ আর সিসা ক্যাফেতে চলছে নারী-পুরুষের অবাধ সিসা সেবন। অ্যামিউজমেন্ট কাব নামে প্রকাশ্যে চলছে মদের বেচাকেনা। বড়লোকদের আভিজাত্যের কাছে যেন হালাল হয়ে গেছে এ সব কিছু। গভীর রাত পর্যন্ত ছেলেমেয়েরা জম্পেশ আড্ডা দিয়ে রোমান্টিক আলোর মূর্ছনায় সেবন করছে নীল নেশা। সমাজের উঁচু শ্রেণীর কাবগুলো যেন নিরাপদ ও শান্তিতে মদ্যপানের অভয়াশ্রম। এদের জন্য নেই কোনো ড্রাগ, নারকোটিকস, লিকার আইন! সাধ্য আছে কারো এ প্রশ্ন করার?
দুই. পত্রিকার রিপোর্টে উঠে এসেছে এ রকম এক সিসা ভয়াবহতার রোমাঞ্চকর কাহিনী। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, উত্তরা, বেইলি রোড, ধানমন্ডি, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ অন্যান্য অভিজাত এলাকায় একেকটি বারে মাসে গড়ে ১০ লাখ টাকার সিসা বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে বারের মালিকেরা মাসে আট লাখ টাকা আয় করছেন। অর্থাৎ বছরে ৯৬ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন একেকজন। এর জন্য কোনো ট্যাক্স, খাজনা বা শুল্ক পরিশোধ করার আইন নেই। সরকারি কর্তৃপরে কাছ থেকে কোনো নিবন্ধন বা লাইসেন্স নেয়ারও প্রয়োজন নেই তাদের। সিসার সাথে গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা মেশানো হয় বলে রিপোর্টে প্রকাশ। আমাদের দেশের আইনে সিসা নাকি এখনো মাদকই নয়। কেননা ১৯৯০ সালের তফসিলভুক্ত না হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নাকি এ েেত্র কিছুই করার নেই। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ধূমপানের চেয়ে সিসা সেবন মানবদেহের জন্য বেশি তিকর। সিসা সেবনের একটি আসরে যে পরিমাণ ধোঁয়া বের হয়, তা ২০০ সিগারেটের ধোঁয়ার সমান। একবার সিসার ধোঁয়া ফুসফুসে টেনে নিলে যে পরিমাণ নিকোটিন ও কার্বন মনো-অক্সাইড মানুষের দেহে প্রবেশ করে, তা ২০টি সিগারেটের চেয়ে বেশি। তামাকসংবলিত সিসার তিকর প্রতিক্রিয়া তামাকের চেয়েও তিকর।
তিন. দেশের নীতিনির্ধারক ও কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যাপারে যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন দিব্যি। তাদের নাকের ডগায় বসে প্রকাশ্যে বাণিজ্য হচ্ছে এসব মাদকের। বেশির ভাগ েেত্রই তাদের বড় একটা অংশ হচ্ছে এদের সহযোগী। তাদের অনৈতিক আয়ের প্রধান অংশই আসে এই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে কথিত সমাজসেবীদের অনেকেই মাদক ব্যবসায়ে প্রত্য বা পরোভাবে জড়িত। সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রোগীদের ৮০ শতাংশই ইয়াবায় আসক্ত। আশির দশকের শেষ দিকে ফেনসিডিল ছড়িয়ে পড়ে মাদক রাজ্যে। নব্বই দশকের শেষে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম ধরা পড়লেও আজ সেই ইয়াবা নেশার রাজ্যকে শাসন করছে। প্রতিদিন ইয়াবার মারণনেশা গ্রহণ করছে ১২ লাখ মানুষ। দেশে প্রকৃত মাদকসেবীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে এদের মধ্যে বড় অংশ তরুণসমাজ। এদের শতকরা ৮০ জনের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। দেশে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা লাধিক। এদের মধ্যে ১০ শতাংশ নারী। মহিলা ও শিশুদের মাদক ব্যবসায়ের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
চার. দুই বছর আগে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্ট থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কমিটি ১০ দফা সুপারিশে সিসা বারগুলোকে অবৈধ বললেও দৃশ্যত এর বিরুদ্ধে কোনো কার্যক্রম নিতে আমরা দেখিনি। সমাজের উঁচু শ্রেণীর এই সিসাবিলাস আমাদের আইনকে হয়তো এখনো স্পর্শ করতে পারেনি। তবে স্পর্শ করার দায়িত্ব যাদের কাঁধে, তাদের সন্তানেরাও যে এই বিষাক্ত ছোবল থেকে মুক্ত রয়েছে, তা জোর দিয়ে বলা দুরূহ। আমরা কি প্রতিনিয়ত এভাবেই আলো থেকে এক অন্ধকার ঘরের দিকে ধাবিত হতে থাকব? দেশের সমাজপতি বা রাজনীতিবিদদের কি এতে কিছুই করার নেই? কাদের জন্য আমাদের এসব রাজনীতি আর উন্নয়ন। যাদের জন্য আমাদের রাজনীতি তারাই যদি বেঁচে না থাকে তাহলে কিসের স্বার্থে এই উন্নয়ন?
পাঁচ. অটোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যের প্রতীক হুক্কা এখন খোদ তুরস্কে নিষিদ্ধ। আর এটাকে সাদরে সম্ভাষণ জানিয়ে আমাদের সিসা আর হুক্কা সেবনের নানারকমের পার্লার, লাউঞ্জ আর ক্যাফের জৌলুশ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর বিরুদ্ধে কথা বলার সাধ্য যেন কারো নেই। কিন্তু কেন নেই? এগুলোর মালিক কারা? এগুলো নিয়ন্ত্রণই বা করে কে? অন্ধকার ঘরের মিটিমিটি আলোর মধ্যে তরুণ-তরুণীদের এ ধরনের ধূম্রসেবন নাকি এ যুগের আধুনিকতা! এই আধুনিকতাই হয়তো একদিন আমাদের অনেক পরিবারকে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। অন্ধকার ঘরের সংস্কৃতি কোনো জাতির জন্য কখনো শুভকর হয়নি। রাষ্ট্রের আগে আমাদের পরিবারেরও এই দায়কে অবশ্যই কাঁধে নিতে হবে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না হলে রাষ্ট্রের দৃঢ়তা আসবে কোত্থেকে? গভীর ঘুমের মধ্যে আছে পুরো জাতি। এমন না হয় যেন ঘুম থেকে জেগে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে আমাদের। আমরা হয়তো ভাবছি আমার সন্তান তো নেশাখোর নয়। আমি কেন ভাবব? সবার অজান্তেই কিন্তু সূচনা হয় মাদকের। ধীরে ধীরে পুরো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অবশ করে দেয় এই মারণনেশা। ধ্বংসই যার একমাত্র পরিণতি।
লেখক : আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com
দুই. পত্রিকার রিপোর্টে উঠে এসেছে এ রকম এক সিসা ভয়াবহতার রোমাঞ্চকর কাহিনী। রাজধানীর অভিজাত এলাকা গুলশান, বনানী, উত্তরা, বেইলি রোড, ধানমন্ডি, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, রাজশাহীসহ অন্যান্য অভিজাত এলাকায় একেকটি বারে মাসে গড়ে ১০ লাখ টাকার সিসা বিক্রি হচ্ছে। বিভিন্ন খরচ বাদ দিয়ে বারের মালিকেরা মাসে আট লাখ টাকা আয় করছেন। অর্থাৎ বছরে ৯৬ লাখ টাকা পর্যন্ত আয় করছেন একেকজন। এর জন্য কোনো ট্যাক্স, খাজনা বা শুল্ক পরিশোধ করার আইন নেই। সরকারি কর্তৃপরে কাছ থেকে কোনো নিবন্ধন বা লাইসেন্স নেয়ারও প্রয়োজন নেই তাদের। সিসার সাথে গাঁজা, হেরোইন ও ইয়াবা মেশানো হয় বলে রিপোর্টে প্রকাশ। আমাদের দেশের আইনে সিসা নাকি এখনো মাদকই নয়। কেননা ১৯৯০ সালের তফসিলভুক্ত না হওয়ায় আইন প্রয়োগকারী সংস্থার নাকি এ েেত্র কিছুই করার নেই। প্রতিবেদনে আরো বলা হয়, ধূমপানের চেয়ে সিসা সেবন মানবদেহের জন্য বেশি তিকর। সিসা সেবনের একটি আসরে যে পরিমাণ ধোঁয়া বের হয়, তা ২০০ সিগারেটের ধোঁয়ার সমান। একবার সিসার ধোঁয়া ফুসফুসে টেনে নিলে যে পরিমাণ নিকোটিন ও কার্বন মনো-অক্সাইড মানুষের দেহে প্রবেশ করে, তা ২০টি সিগারেটের চেয়ে বেশি। তামাকসংবলিত সিসার তিকর প্রতিক্রিয়া তামাকের চেয়েও তিকর।
তিন. দেশের নীতিনির্ধারক ও কর্তাব্যক্তিরা এ ব্যাপারে যেন মুখে কুলুপ এঁটে বসে আছেন দিব্যি। তাদের নাকের ডগায় বসে প্রকাশ্যে বাণিজ্য হচ্ছে এসব মাদকের। বেশির ভাগ েেত্রই তাদের বড় একটা অংশ হচ্ছে এদের সহযোগী। তাদের অনৈতিক আয়ের প্রধান অংশই আসে এই ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে। জনপ্রতিনিধি থেকে শুরু করে কথিত সমাজসেবীদের অনেকেই মাদক ব্যবসায়ে প্রত্য বা পরোভাবে জড়িত। সরকারি মাদকাসক্তি নিরাময় কেন্দ্রে চিকিৎসাধীন রোগীদের ৮০ শতাংশই ইয়াবায় আসক্ত। আশির দশকের শেষ দিকে ফেনসিডিল ছড়িয়ে পড়ে মাদক রাজ্যে। নব্বই দশকের শেষে মাদক হিসেবে ইয়াবা প্রথম ধরা পড়লেও আজ সেই ইয়াবা নেশার রাজ্যকে শাসন করছে। প্রতিদিন ইয়াবার মারণনেশা গ্রহণ করছে ১২ লাখ মানুষ। দেশে প্রকৃত মাদকসেবীর সংখ্যা কত তার সঠিক পরিসংখ্যান নেই। তবে এদের মধ্যে বড় অংশ তরুণসমাজ। এদের শতকরা ৮০ জনের বয়স ১৫ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। দেশে চিহ্নিত মাদক ব্যবসায়ীর সংখ্যা লাধিক। এদের মধ্যে ১০ শতাংশ নারী। মহিলা ও শিশুদের মাদক ব্যবসায়ের নিরাপদ মাধ্যম হিসেবেও ব্যবহার করা হয়।
চার. দুই বছর আগে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে হাইকোর্ট থেকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে নির্দেশ দেয়া হয়। তবে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উচ্চপর্যায়ের কমিটি ১০ দফা সুপারিশে সিসা বারগুলোকে অবৈধ বললেও দৃশ্যত এর বিরুদ্ধে কোনো কার্যক্রম নিতে আমরা দেখিনি। সমাজের উঁচু শ্রেণীর এই সিসাবিলাস আমাদের আইনকে হয়তো এখনো স্পর্শ করতে পারেনি। তবে স্পর্শ করার দায়িত্ব যাদের কাঁধে, তাদের সন্তানেরাও যে এই বিষাক্ত ছোবল থেকে মুক্ত রয়েছে, তা জোর দিয়ে বলা দুরূহ। আমরা কি প্রতিনিয়ত এভাবেই আলো থেকে এক অন্ধকার ঘরের দিকে ধাবিত হতে থাকব? দেশের সমাজপতি বা রাজনীতিবিদদের কি এতে কিছুই করার নেই? কাদের জন্য আমাদের এসব রাজনীতি আর উন্নয়ন। যাদের জন্য আমাদের রাজনীতি তারাই যদি বেঁচে না থাকে তাহলে কিসের স্বার্থে এই উন্নয়ন?
পাঁচ. অটোমান সাম্রাজ্যের ঐতিহ্যের প্রতীক হুক্কা এখন খোদ তুরস্কে নিষিদ্ধ। আর এটাকে সাদরে সম্ভাষণ জানিয়ে আমাদের সিসা আর হুক্কা সেবনের নানারকমের পার্লার, লাউঞ্জ আর ক্যাফের জৌলুশ দিন দিন বেড়েই চলেছে। এর বিরুদ্ধে কথা বলার সাধ্য যেন কারো নেই। কিন্তু কেন নেই? এগুলোর মালিক কারা? এগুলো নিয়ন্ত্রণই বা করে কে? অন্ধকার ঘরের মিটিমিটি আলোর মধ্যে তরুণ-তরুণীদের এ ধরনের ধূম্রসেবন নাকি এ যুগের আধুনিকতা! এই আধুনিকতাই হয়তো একদিন আমাদের অনেক পরিবারকে নিশ্চিত ধ্বংসের দিকে নিয়ে যাবে। অন্ধকার ঘরের সংস্কৃতি কোনো জাতির জন্য কখনো শুভকর হয়নি। রাষ্ট্রের আগে আমাদের পরিবারেরও এই দায়কে অবশ্যই কাঁধে নিতে হবে। পারিবারিক বন্ধন দৃঢ় না হলে রাষ্ট্রের দৃঢ়তা আসবে কোত্থেকে? গভীর ঘুমের মধ্যে আছে পুরো জাতি। এমন না হয় যেন ঘুম থেকে জেগে দেখি সব শেষ হয়ে গেছে আমাদের। আমরা হয়তো ভাবছি আমার সন্তান তো নেশাখোর নয়। আমি কেন ভাবব? সবার অজান্তেই কিন্তু সূচনা হয় মাদকের। ধীরে ধীরে পুরো পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রকে অবশ করে দেয় এই মারণনেশা। ধ্বংসই যার একমাত্র পরিণতি।
লেখক : আইন ও সংবিধান বিশেষজ্ঞ
malik.law.associates@hotmail.com
No comments