হাড়ের ক্ষয় রোগের আধুনিক চিকিৎসা
হাড় মানবদেহের জীবন্ত কোষ। তাই হাড়ের পুষ্টির জন্য রক্ত সরবরাহ একান্ত প্রয়োজন। রক্ত সরবরাহ কমে গেলে পুষ্টির অভাবে হাড়ের কোষের মৃত্যু হয়। রক্ত প্রবাহের স্বল্পতা দ্রুত গতিতে থামানো না গেলে ধীরে ধীরে হাড় ভেঙে যেতে থাকে। সাধারণত উরুর উপরের অংশের হাড়ে এ ধরনের ক্ষয় দেখা যায়। রক্তপ্রবাহের স্বল্পতার কারণে হাড়ের তরুনাস্থি ও জোড়ায় ক্ষয় দেখা দিলে তাকে এভাসকুলার নেকরোসিস, সংক্ষেপে এভিএন বলা হয়। হাড়ের এই সমস্যা অস্টিও নেকরোসিস, এসেপটিক নেকরোসিস বা ইসকেমিক নেকরোসিস নামেও পরিচিত। হাটু কিংবা গোড়ালীর হাড়েও এভাসকুলার নেকরোসিস হতে পারে। উন্নত বিশ্বে ২০-৫০ বছর বয়সের জনগোষ্ঠীর মধ্যে প্রতিবছর প্রায় ২০ হাজার মানুষ এভিএন রোগে আক্রান্ত হয়। স্বাস্থ্যবান মানুষের এভিএন হওয়ার সম্ভাবনা অনেক কম। এভাসকুলার নেকরোসিসের কারণ বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সুস্বাস্থ্যের অভাব কিংবা আঘাতজনিত কারণে এভিএন হতে দেখা যায়। এছাড়া আরো যেসব কারণে এভিএন হতে পারে সেগুলো হলো- এক. উরুর হাড়ের স্থানচ্যুতি বা ভাঙা: আঘাতের ফলে হাড়ের রক্ত সরবরাহ কমে গিয়ে এভিএন সৃষ্টি করে। যেসব রোগীর কোমরের হাড়ের স্থানচ্যুতি থাকে তাদের এভিএনে আক্রান্ত হওয়ার সম্ভাবনা অন্যদের তুলনায় ২০ শতাংশ বা তারও বেশি বেড়ে যায়। দুই. স্টেরয়েডের ব্যবহার: হাঁপানি (অ্যাজমা) বা শ্বাসকষ্ট, রিউম্যাটয়েড আর্থাইটিস বা গিটে বাতের চিকিৎসায় দীর্ঘদিন স্টেরয়েড ব্যবহার করা হয়। দীর্ঘমেয়াদী স্টেরয়েডের ব্যবহারের ফলে ৩৫ শতাংশ রোগী আঘাতজনিত কারণ ছাড়াই এভাসকুলার নেকরোসিস বা এভিএনে আক্রান্ত হতে পারে। চিকিৎসকেদের ধারণা, স্টেরয়েড জাতীয় ওষুধ ব্যবহারের ফলে শরীরের মেদ ভেঙে গিয়ে রক্তনালীতে জমা হয়। এতে রক্তনালী সরু হয়ে হাড়ে রক্ত সরবরাহ কমে যায়। আর এর ফলে সৃষ্টি হয় এভিএন। তিন. অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ: অতিরিক্ত অ্যালকোহল গ্রহণ করলে শরীরের মেদ ভেঙে গিয়ে রক্তনালীতে জমা হয়। ফলে রক্তনালী সরু হয়ে রক্তপ্রবাহ কমে যায়। এ কারণেও এভিএন দেখা দিতে পারে। চার. রক্তজমাট, প্রদাহ ও ধমনীর রক্ত প্রবাহের আঘাতের ফলে হাড়ে রক্ত সরবরাহ কমে গিয়েও এভিএন হতে পারে। এছাড়া বেশ কিছু রোগের কারণেও এভিএন দেখা দিতে পারে। এরমধ্যে রয়েছেÑ উরুসন্ধির অসারতা, বাতজনিত ব্যথা, শিকল সেল ডিজিজ, রেডিয়েশন থেরাপি, ক্যামোথেরাপি, অগ্ন্যাশয়ের প্রদাহ, গাউচার ডিজিজ এবং বিপাকজনিত কারণে শরীরে ক্ষতিকর মাত্রায় মেদ জমে যাওয়া, রক্তে বুদ বুদ তৈরি হওয়া। কারো দেহে এইডস রোগের সংক্রমন দেখা দিলে তার প্রতিক্রিয়াও এভিএন দেখা দিতে পারে। এভিএন-এর লক্ষণ এভিএনে আক্রান্ত হলে প্রাথমিক অবস্থায় এর কোনো লক্ষণ প্রকাশ পায় না। এক পর্যায়ে আক্রান্ত স্থানে ব্যথা অনুভব হয়। প্রথমদিকে আক্রান্ত হাড়ে চাপ লাগলে রোগী ব্যথা অনুভব করেন। এ সময় হিপ জয়েন্ট, কোমরের পেছনে ও পাশে ব্যথা অনুভূত হয়। রোগী দাঁড়ালে বা হাটলে কোমর থেকে উরু পর্যন্ত ব্যথা অনুভূত হয়। এভিএনের ব্যথা কখনোই হাঁটুর নিচে নামে না। এ পর্যায়ে সঠিক চিকিৎসা না হলে পর্যায়ক্রমে ব্যথা বাড়তে থাকে এবং দীর্ঘস্থায়ী হয়ে পড়ে। এক পর্যায়ে সংযুক্ত জোড়ায় অস্টিও আর্থাইটিস হয়ে হাড় অনড় হয়ে যায় এবং রোগী চলাচলে অক্ষম হয়ে পড়েন। কখনো কখনো কয়েক মাস থেকে কয়েক বছর সময় নিয়ে আক্রান্ত হাড়ের জোড়া বিকল হয়ে যেতে দেখা যায়। এভিএন-এর চিকিৎসা এভিএন চিকিৎসার প্রধান লক্ষ্য হলো আক্রান্ত জোড়া পূর্বের ন্যায় সচল ও কার্যকর করা এবং হাড়ের ক্ষয় বন্ধ করে ব্যথা লাঘব করা। প্রাথমিক অবস্থায় এমআরআই পরীক্ষার মাধ্যমে রোগ নির্ণয় করা জরুরি। রোগ সম্পর্কে নিশ্চিত হওয়ার পর রোগীর বয়স ও স্বাস্থ্যগত অবস্থা বিবেচনায় এভিএনের চিকিৎসা করা হয়। তবে আক্রান্ত স্থান ও রোগের জটিলতার উপরই মূলত চিকিৎসা নির্ভর করে। আর রোগের পর্যায় বা ধাপের ওপর নির্ভর করে চিকিৎসার ফলাফল। এভিএন প্রতিরোধ বা রোগ ঠেকিয়ে রাখা কিংবা বিলম্বিত করার কোন কার্যকরী চিকিৎসা পদ্ধতি আজ পর্যন্ত আবিষ্কৃত হয়নি। এভিএন চিকিৎসার বেশ কয়েকটি ধাপ রয়েছে। এগুলো হলোÑ ক্র্যাচ ব্যবহার করে আক্রান্ত স্থানে কম চাপ দেয়া ও ব্যথানাশক ওষুধ ব্যবহার, চলা-ফেরা কমিয়ে দেয়া। বিলম্বিত রোগ নির্ণয়ের ক্ষেত্রে শারীরিক তৎপরতা কমিয়ে এভিএন নিয়ন্ত্রণ করা যায় না। আর চূড়ান্ত পর্যায়ে অপারেশনের মাধ্যমে রোগীর অবস্থার উন্নতির চেষ্টা করা হয়। অপারেশন বা শল্য চিকিৎসা: এভিএন চিকিৎসায় অপারেশনের দ্বারস্থ হলেও সার্জনরা এখনো কোনো পদ্ধতিকে সার্বজনীন গ্রহণযোগ্য চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে বেছে নিতে পারেননি। এভিএন চিকিৎসায় অপারেশনের ক্ষেত্রে (হাড় ভেঙে যাওয়ার আগে) হাড় প্রতিস্থাপন (বোন গ্রাফট) করে অথবা প্রতিস্থাপন না করে কোর ডিকম্প্রেশন পদ্ধতিটি সর্বাধিক ব্যবহৃত হয়ে আসছে। আর বিলম্বিত পর্যায়ে (হাড় ভেঙে যাওয়া, ফিমোরাল হেড ডিফরমিটি অথবা জটিল অস্টিও আর্থাইটিসের ক্ষেত্রে) হিপ জয়েন্ট প্রতিস্থাপন সর্বাধিক গ্রহণযোগ্য পদ্ধতি। কোর-ডিকম্প্রেশন: গবেষকরা দেখেছেন, কোর-ডিকম্প্রেশনের ফলে হাড়ের অন্তঃচাপ কমে যায় এবং রক্তের সরবরাহ বৃদ্ধি পায়। এতে হাড় ও জয়েন্টের ক্ষয় বন্ধ হয়। হাড় ভেঙে যাওয়ার আগে এভিএনের চিকিৎসা করালে সর্বোচ্চ সুবিধা পাওয়া যায়। কোর-ডিকম্প্রেশনের মাধ্যমে প্রচলিত চিকিৎসার তুলনায় ৯৫ শতাংশ পর্যন্ত সফল চিকিৎসা সম্ভব হয়। ব্যথা নিরাময়ের জন্যও এই পদ্ধতি অত্যাধিক কার্যকর। হাড়-প্রতিস্থাপন: এভিএনের ক্ষেত্রে হাড় প্রতিস্থাপন বা বোন গ্রাফটের ফলে হাড়ের ক্ষয় তুলনামূলক তাড়াতাড়ি বন্ধ হয়। অস্টিওটমি: আঘাতজনিত এভিএনের ক্ষেত্রে বিভিন্ন ধরনের অস্টিওটমি কখনো কখনো সফল হতে দেখা যায়। উরুসন্ধি প্রতিস্থাপন: বিলম্বিত বা দীর্ঘমেয়াদী এভিএনের ক্ষেত্রে বেশিরভাগ রোগীর উরুসন্ধির প্রতিস্থাপন প্রয়োজন হয়। যদিও দীর্ঘদিন উরুসন্ধির প্রতিস্থাপন ব্যথা নিরাময়ের জন্য চমৎকার ফলাফল দিলেও উরুসন্ধি প্রতিস্থাপনের পর রোগীকে নানাবিধ সমস্যা পোহাতে হয়। এরমধ্যে রয়েছেÑ হাড়ের স্থানচ্যুতি, হাড়ের ইনফেকশন, পা ছোট বড় হয়ে যাওয়া, স্নায়ুবিক আঘাত বা প্যারালাইসিস, সার্বক্ষণিক অস্থিরতা এবং হাড় খুলে যাওয়া। ফলে প্রথম অপারেশনের ৮-১০ বছর পর আবারো অপারেশনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিতে পারে। আবার উরুসন্ধির প্রতিস্থাপন অত্যন্ত ব্যয়বহুল হওয়ায় এই পদ্ধতি রোগীর জন্য বড় রকম আর্থিক চাপ বয়ে আনে। কর্টিসন ইনজেকশন: সাময়িকভাবে এভিএনের ব্যথা কমানোর জন্য উরুসন্ধিতে সরাসরি কর্টিসন ইনজেকশন প্রয়োগ করা হয়ে থাকে। প্রয়োগ পদ্ধতি, ব্যয় ও স্বল্পমেয়াদি কার্যকারিতার জন্য এই ইনজেকশন সাধারণত পরিহার করা হয়। লেজার কোর-ডিকম্প্রেশন ও অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন: কোর-ডিকম্প্রেশন এর ক্ষেত্রে প্রযুক্তির নতুন আবিস্কার লেজার কোর-ডিম্প্রেশন। এ পদ্ধতিতে লেজার রশ্মির মাধ্যমে প্রয়োজন অনুযায়ী আক্রান্ত হাড়ে কোর বা ছিদ্র করা হয়। এতে হাড়ের অভ্যন্তরীণ চাপ কমে যায়। পরবর্তীতে এই ছিদ্রের ভিতর দিয়ে অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন (বোনমেরু সেল রিপ্লেসমেন্ট) করা হয়। লেজার স্টিমুলেশনের ফলে হাড়ে দ্রুত নতুন রক্তনালী তৈরি হয়। এতে এভিএন আক্রান্ত স্থানে রক্তপ্রবাহ দ্রুত গতিতে বৃদ্ধি পায় এবং অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপনের ফলে সহজেই হাড়ের নতুন কোষ বা বোন সেল তৈরি হয়। এ কারণে কাটা-ছেঁড়াহীন লেজার কোর-ডিকম্প্রেশন পদ্ধতির মাধ্যমে এভিএন আক্রান্ত রোগী দ্রুত আরোগ্য লাভ করেন। ঢাকায় ইনস্টিটিউট অব লেজার সার্জারি অ্যান্ড হসপিটাল লেজার কোর-ডিকম্প্রেশন পদ্ধতিতে এভিএন রোগের চিকিৎসা প্রদান করে থাকে। এই হাসপাতালে ৪০ জন রোগীর ৬২টি হিপ জয়েন্টের অপারেশনের ওপর একটি গবেষণা কার্যক্রম পরিচালিত হয়েছে। অপারেশনের আগে ও পরে ‘হ্যারিস হিপ স্কোরস-এইচএইচএস এবং ‘ফিসেট অ্যান্ড অ্যালার্ট স্ট্যাজিং মানদণ্ড অনুযায়ী পরিচালিত গবেষণায় কোনো রকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই লেজার কোর-ডিকম্প্রেশন পদ্ধতিতে ৪০.৩ শতাংশ রোগীর ক্ষেত্রে অত্যন্ত সফল, ২১% রোগীর ক্ষেত্রে ভালৈা, ২৯% রোগীর ক্ষেত্রে সন্তুষজনক ফলাফল পাওয়া গেছে। ইনস্টিটিউট অব লেজার সার্জারি অ্যান্ড হসপিটালে লেজার কোর-ডিকম্প্রেশন পদ্ধতিতে এভিএন চিকিৎসার উপর পরিচালিত এই গবেষণাটি অস্ট্রেলিয়ার গোল্ড কোস্ট আর্ন্তজাতিক সম্মেলনে সর্বপ্রথম সাদরে গৃহিত হয়। পরবর্তীতে জার্মান চিকিৎসকরাও এটিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সঙ্গে মূল্যায়ন করেন। গবেষণাটি ফিনল্যান্ডের হেলসিঙ্কিতে অনুষ্ঠিত আন্তর্জাতিক লেজার সার্জারি সম্মেলনে বিশ্বের খ্যাতিমান লেজার বিশেষজ্ঞদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে। সম্প্রতি এই গবেষণাকর্মটি মালয়েশিয়ান জার্নাল অব মেডিক্যাল অ্যান্ড বায়োলজিক্যাল রিসার্চ এবং এশিয়ার বিজনেস কনসোর্টিয়ামের এবিসিজার্নালস-এ প্রকাশিত হয়। এভিএনের নতুন চিকিৎসা পদ্ধতি হিসেবে এটি বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকদের স্বীকৃতি লাভ করে। স্বল্প সময়ে অপারেশন, ন্যূনতম রক্তপাত এবং কোনো রকম কাটা-ছেঁড়া না লাগায় হিপ জয়েন্ট এভিএনের চিকিৎসায় লেজার কোর-ডিকম্প্রেশন পদ্ধতিটি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে দ্রুত জনপ্রিয়তা লাভ করছে। ডা. মোহাম্মদ ইয়াকুব আলী, এমবিবিএস, পিএইচডি পরিচালক, ইনস্টিটিউট অব লেজার সার্জারি অ্যান্ড হসপিটাল ই-মেইল: myalibd@hotmail.com
No comments