ফাঁসির আদেশ বহাল by কবির হোসেন
আপিল বিভাগের চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসি বহাল রয়েছে জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মুহাম্মদ কামারুজ্জামানের। সোমবার সুপ্রিমকোর্টের আপিল বিভাগের জ্যেষ্ঠ বিচারপতি এসকে সিনহার নেতৃত্বাধীন চার বিচারপতির বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠের মতের ভিত্তিতে এই রায় ঘোষণা করেন। বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন- বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহ্হাব মিঞা, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি এএইচএম শামসুদ্দিন চৌধুরী। সর্বোচ্চ আদালতের এ রায়ের মধ্য দিয়ে মামলার চূড়ান্ত নিষ্পত্তি হল।
এর আগে গত বছরের ৯ মে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামান আপিল করেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রমাণিত হওয়া ৫ অভিযোগের ওপর সোমবার সকাল ৯টার পর আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন।
মাত্র দেড় মিনিটে দেয়া আপিল বিভাগের এই সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়, আসামি কামারুজ্জামানের আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হল। এক নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হল। দুই ও সাত নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা বহাল রাখা হল।
তিন নম্বর অভিযোগে দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে সব বিচারপতিই একমত। তবে আসামিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল। চার নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের ভিত্তিতে তার সাজা বহাল রাখা হল এবং এই অভিযোগে তার সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দেয়া হল।
আপিল বিভাগের এই সংক্ষিপ্ত রায় পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রায়ে কামারুজ্জামনকে সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে সব বিচারপতি একমত হতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা এক নম্বর অভিযোগ একাত্তরে বদিউজ্জামানকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন দণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ খালাস দিয়েছেন। দ্বিতীয় অভিযোগে শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে অমানবিক নির্যাতনের দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ১০ বছরের সাজা বহাল রয়েছে। তৃতীয় অভিযোগে সোহাগপুর গ্রামে (বর্তমানে বিধবা পল্লীতে) গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। চতুর্থ অভিযোগে গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে। সপ্তম অভিযোগে দারা ও টেপা মিয়াকে অপহরণ এবং পরে দারাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রয়েছে আপিলের এই রায়ে।
আপিলের এই রায়ের ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত এই আলবদর নেতাকে ফাঁসির কাষ্ঠেই যেতে হবে বলে নিশ্চিত করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর কত দ্রুত তার ফাঁসি কার্যকর হবে তা মূলত নির্ভর করছে আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাওয়ার ওপর। যদিও এ রায় রিভিউ (পুনর্মূল্যায়নের) আবেদনের সুযোগ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পাশাপাশি রায় রিভিউয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৯৯ ভাগ রায় পরিবর্তন না হওয়ার নজির রয়েছে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসি হয়েছিল। ওই ফাঁসি কার্যকর করা হয় একই বছরের ১২ ডিসেম্বর রাতে।
আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তবে এই রায় রিভিউয়ের (পুনর্মূল্যায়নের) আবেদনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আসামির রিভিউ করার আর কোনো সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি না। এর আগে কাদের মোল্লার পক্ষ থেকে রিভিউ করেছিল, তা খারিজ করে দেন আদালত। এক্ষেত্রে রিভিউয়ের আর কোনো স্কোপ নেই।’
তিনি আরও বলেন, বিশেষ আইনে এ বিচার হচ্ছে। সাংবিধানিকভাবে এ আইন প্রটেকটেড। সংবিধানের ১০৫ আর্টিকেল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলেছিলাম, এখনও তা বলছি। কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে না, আর রিভিউ চলবে না। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত মাঝের সময়টি জেল কর্তৃপক্ষ ও সরকারের বিষয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অন্যদিকে রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কামারুজ্জামানের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা মর্মাহত। আমরা রায় রিভিউয়ের আবেদন করব। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে রিভিউ করার অধিকার আছে।’ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ শুরু হয়। ওই বছর ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে রাজধানীর পল্লবী থানায় দায়ের করা একটি মামলায় একই বছর ২৯ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে। বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আটক রয়েছেন এই বদর নেতা।
২০১২ সালের ৪ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিচার শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৮ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। আর আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন পাঁচজন। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে গত বছরের ৯ মে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় বেসামরিক নেতাদের ওপরও বর্তায়। কারণ, অধস্তন বা প্রকৃত অপরাধীদের ওপর তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে।
এটা প্রমাণিত যে, অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে দুটি আলবদর ক্যাম্পে বা আলবদর সদস্যদের মাধ্যমে অথবা আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্প থেকে। আলবদর ক্যাম্পগুলোতে বা আলবদর সদস্যদের ওপর কামারুজ্জামানের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল। আলবদরকে মনে করা হতো পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতের অ্যাকশন সেকশন। কামারুজ্জামান অপরাধ করতে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের পরিচালনা করেছেন, পরিকল্পনা করেছেন, পরামর্শ, উস্কানি ও নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। তাই এসব অপরাধের দায় কামারুজ্জামান এড়াতে পারেন না। ওই রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ৬ জুন আপিল দায়ের করেন কামারুজ্জামান।
২ হাজার ৫৬৪টি মূল ডকুমেন্টসহ ১০৫ পৃষ্ঠার আপিল আবেদন করা হয়। আপিল আবেদনে ১২৪টি গ্রাউন্ড (যুক্তি) তুলে ধরে আসামিপক্ষ। আপিল দায়েরের পর কামারুজ্জামানের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, একাত্তরের মূল ভিকটিম এবং ভিকটিমদের পরিবারের সদস্যদের বাদ দিয়ে শোনা সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন। এটা একটি বিভ্রান্তমূলক, স্ববিরোধী রায়।
তিনি বলেন, মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত একাত্তরে ‘বিজয়গাথা’ বইটিকে বলা হয়েছে অনির্ভরযোগ্য। কিন্তু একই ঘটনার উপর শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ নির্ভরযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল, যা এক ধরনের স্ববিরোধী। এসব যুক্তি তুলে ধরে ট্রাইব্যুনালের দণ্ড থেকে আসামির খালাস চাওয়া হয়। আর ট্রাইব্যুনালের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় কোনো আপিল করেননি।
চলতি বছরের ৫ জুন থেকে কামারুজ্জামানের দায়ের করা আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। ১৬ কার্যদিবস শুনানি নিয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এর এক মাস ১৬ দিনের মাথায় সোমবার কামারুজ্জামানের করা আপিলের রায় ঘোষণা করা হল। এটি আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তৃতীয় রায়। কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা ছাড়াও জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চূড়ান্ত রায়ে আপিল বিভাগ আমৃত্যু জেল দিয়েছেন।
যাদের আপিল বিচারাধীন : ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ১১টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এতে ১২ জন আসামি বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত হয়েছেন। আইনের এই বিধান অনুসরণ করে গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আবদুল আলীম আপিল করেন। এর মধ্যে আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় গোলাম আযম ও আবদুল আলীম মারা গেছেন। তাই তাদের আপিল অকার্যকর হয়ে গেছে। এছাড়া কাদের মোল্লাকে আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড, সাঈদীকে আমৃত্যু জেল ও কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিল বিচারাধীন রয়েছে। এবার মুজাহিদের মামলায় করা আপিলের ওপর শুনানি শুরু হবে। আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু, মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান পলাতক থাকায় তারা কোনো আপিল করেননি। এছাড়া সময় হাতে থাকায় নিজামী ও মীর কাসেম আলীর আপিল দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
এর আগে গত বছরের ৯ মে কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা সাতটি অভিযোগের মধ্যে পাঁচটি প্রমাণিত হওয়ায় মৃত্যুদণ্ডসহ বিভিন্ন মেয়াদে সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল। ওই রায়ের বিরুদ্ধে কামারুজ্জামান আপিল করেন। ট্রাইব্যুনালের রায়ে প্রমাণিত হওয়া ৫ অভিযোগের ওপর সোমবার সকাল ৯টার পর আপিল বিভাগ রায় দিয়েছেন।
মাত্র দেড় মিনিটে দেয়া আপিল বিভাগের এই সংক্ষিপ্ত রায়ে বলা হয়, আসামি কামারুজ্জামানের আপিল আংশিক মঞ্জুর করা হল। এক নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস দেয়া হল। দুই ও সাত নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের ভিত্তিতে ট্রাইব্যুনালের দেয়া সাজা বহাল রাখা হল।
তিন নম্বর অভিযোগে দণ্ড প্রদানের ক্ষেত্রে সব বিচারপতিই একমত। তবে আসামিকে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের ভিত্তিতে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হল। চার নম্বর অভিযোগে সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতির মতের ভিত্তিতে তার সাজা বহাল রাখা হল এবং এই অভিযোগে তার সাজা মৃত্যুদণ্ড থেকে কমিয়ে যাবজ্জীবন দণ্ড দেয়া হল।
আপিল বিভাগের এই সংক্ষিপ্ত রায় পর্যালোচনায় দেখা গেছে, রায়ে কামারুজ্জামনকে সাজা প্রদানের ক্ষেত্রে সব বিচারপতি একমত হতে পারেননি। তার বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আনা এক নম্বর অভিযোগ একাত্তরে বদিউজ্জামানকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনাল যাবজ্জীবন দণ্ড দিলেও আপিল বিভাগ খালাস দিয়েছেন। দ্বিতীয় অভিযোগে শেরপুর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল হান্নানকে অমানবিক নির্যাতনের দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া ১০ বছরের সাজা বহাল রয়েছে। তৃতীয় অভিযোগে সোহাগপুর গ্রামে (বর্তমানে বিধবা পল্লীতে) গণহত্যা ও নারী ধর্ষণের দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ড বহাল রয়েছে। চতুর্থ অভিযোগে গোলাম মোস্তফাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়েছে। সপ্তম অভিযোগে দারা ও টেপা মিয়াকে অপহরণ এবং পরে দারাকে হত্যার দায়ে ট্রাইব্যুনালের দেয়া যাবজ্জীবন কারাদণ্ড বহাল রয়েছে আপিলের এই রায়ে।
আপিলের এই রায়ের ফলে মানবতাবিরোধী অপরাধে দণ্ডিত এই আলবদর নেতাকে ফাঁসির কাষ্ঠেই যেতে হবে বলে নিশ্চিত করছেন সংশ্লিষ্টরা। আর কত দ্রুত তার ফাঁসি কার্যকর হবে তা মূলত নির্ভর করছে আপিলের রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি হাতে পাওয়ার ওপর। যদিও এ রায় রিভিউ (পুনর্মূল্যায়নের) আবেদনের সুযোগ নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। পাশাপাশি রায় রিভিউয়ের আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে প্রায় ৯৯ ভাগ রায় পরিবর্তন না হওয়ার নজির রয়েছে। এর আগে গত বছরের সেপ্টেম্বর মাসে জামায়াতের অপর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লার চূড়ান্ত রায়ে ফাঁসি হয়েছিল। ওই ফাঁসি কার্যকর করা হয় একই বছরের ১২ ডিসেম্বর রাতে।
আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকায় সন্তোষ প্রকাশ করেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তবে এই রায় রিভিউয়ের (পুনর্মূল্যায়নের) আবেদনের ব্যাপারে তিনি বলেন, ‘আসামির রিভিউ করার আর কোনো সুযোগ রয়েছে বলে আমি মনে করি না। এর আগে কাদের মোল্লার পক্ষ থেকে রিভিউ করেছিল, তা খারিজ করে দেন আদালত। এক্ষেত্রে রিভিউয়ের আর কোনো স্কোপ নেই।’
তিনি আরও বলেন, বিশেষ আইনে এ বিচার হচ্ছে। সাংবিধানিকভাবে এ আইন প্রটেকটেড। সংবিধানের ১০৫ আর্টিকেল কাদের মোল্লার ক্ষেত্রে প্রযোজ্য হবে না বলেছিলাম, এখনও তা বলছি। কামারুজ্জামানের ক্ষেত্রেও প্রযোজ্য হবে না, আর রিভিউ চলবে না। রায়ের কপি হাতে পাওয়ার পর থেকে বাস্তবায়ন পর্যন্ত মাঝের সময়টি জেল কর্তৃপক্ষ ও সরকারের বিষয় বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
অন্যদিকে রায় ঘোষণার পর তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কামারুজ্জামানের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেন, ‘ন্যায়বিচার পাইনি। আমরা মর্মাহত। আমরা রায় রিভিউয়ের আবেদন করব। সংবিধানের ১০৫ অনুচ্ছেদ অনুসারে রিভিউ করার অধিকার আছে।’ আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন বর্তমান সরকার দায়িত্ব নেয়ার পর ২০১০ সালে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠনের মধ্য দিয়ে একাত্তরের মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচার কাজ শুরু হয়। ওই বছর ২১ জুলাই কামারুজ্জামানের যুদ্ধাপরাধের তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত দল। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে রাজধানীর পল্লবী থানায় দায়ের করা একটি মামলায় একই বছর ২৯ জুলাই তাকে গ্রেফতার করা হয়। পরে ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় গ্রেফতার দেখানো হয়। সেই থেকে তিনি কারাগারে। বর্তমানে গাজীপুরের কাশিমপুর কারাগারে আটক রয়েছেন এই বদর নেতা।
২০১২ সালের ৪ জুন অভিযোগ গঠনের মধ্য দিয়ে ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের বিচার শুরু হয়। প্রসিকিউশনের পক্ষে তদন্ত কর্মকর্তাসহ মোট ১৮ জন এ মামলায় সাক্ষ্য দেন। আর আসামিপক্ষে সাক্ষ্য দেন পাঁচজন। উভয়পক্ষের যুক্তিতর্ক শেষে গত বছরের ৯ মে রায় দেন ট্রাইব্যুনাল। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, ঊর্ধ্বতন নেতৃত্বের দায় বেসামরিক নেতাদের ওপরও বর্তায়। কারণ, অধস্তন বা প্রকৃত অপরাধীদের ওপর তাদের প্রত্যক্ষ নিয়ন্ত্রণ থাকে।
এটা প্রমাণিত যে, অপরাধগুলো সংঘটিত হয়েছে দুটি আলবদর ক্যাম্পে বা আলবদর সদস্যদের মাধ্যমে অথবা আহম্মেদনগর সেনাক্যাম্প থেকে। আলবদর ক্যাম্পগুলোতে বা আলবদর সদস্যদের ওপর কামারুজ্জামানের দৃঢ় নিয়ন্ত্রণ ছিল। আলবদরকে মনে করা হতো পাকিস্তানপন্থী রাজনৈতিক দল জামায়াতের অ্যাকশন সেকশন। কামারুজ্জামান অপরাধ করতে আলবদর বাহিনীর সদস্যদের পরিচালনা করেছেন, পরিকল্পনা করেছেন, পরামর্শ, উস্কানি ও নৈতিক সমর্থন দিয়েছেন। তাই এসব অপরাধের দায় কামারুজ্জামান এড়াতে পারেন না। ওই রায়ের বিরুদ্ধে একই বছরের ৬ জুন আপিল দায়ের করেন কামারুজ্জামান।
২ হাজার ৫৬৪টি মূল ডকুমেন্টসহ ১০৫ পৃষ্ঠার আপিল আবেদন করা হয়। আপিল আবেদনে ১২৪টি গ্রাউন্ড (যুক্তি) তুলে ধরে আসামিপক্ষ। আপিল দায়েরের পর কামারুজ্জামানের আইনজীবী তাজুল ইসলাম বলেছিলেন, একাত্তরের মূল ভিকটিম এবং ভিকটিমদের পরিবারের সদস্যদের বাদ দিয়ে শোনা সাক্ষীর সাক্ষ্যের ওপর ভিত্তি করে ট্রাইব্যুনাল রায় দিয়েছেন। এটা একটি বিভ্রান্তমূলক, স্ববিরোধী রায়।
তিনি বলেন, মুনতাসীর মামুন সম্পাদিত একাত্তরে ‘বিজয়গাথা’ বইটিকে বলা হয়েছে অনির্ভরযোগ্য। কিন্তু একই ঘটনার উপর শাহরিয়ার কবির সম্পাদিত ‘একাত্তরের ঘাতক ও দালালরা কে কোথায়’ নির্ভরযোগ্য হিসেবে গ্রহণ করেছেন ট্রাইব্যুনাল, যা এক ধরনের স্ববিরোধী। এসব যুক্তি তুলে ধরে ট্রাইব্যুনালের দণ্ড থেকে আসামির খালাস চাওয়া হয়। আর ট্রাইব্যুনালের রায়ে সর্বোচ্চ শাস্তি হওয়ায় রাষ্ট্রপক্ষ এ মামলায় কোনো আপিল করেননি।
চলতি বছরের ৫ জুন থেকে কামারুজ্জামানের দায়ের করা আপিলের ওপর শুনানি শুরু হয়। ১৬ কার্যদিবস শুনানি নিয়ে গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল বিভাগ রায় অপেক্ষমাণ (সিএভি) রাখেন। এর এক মাস ১৬ দিনের মাথায় সোমবার কামারুজ্জামানের করা আপিলের রায় ঘোষণা করা হল। এটি আপিল বিভাগে মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলার তৃতীয় রায়। কাদের মোল্লাকে মৃত্যুদণ্ডের রায় ঘোষণা ছাড়াও জামায়াতের নায়েবে আমীর দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীকে চূড়ান্ত রায়ে আপিল বিভাগ আমৃত্যু জেল দিয়েছেন।
যাদের আপিল বিচারাধীন : ট্রাইব্যুনাল গঠনের পর থেকে এ পর্যন্ত মোট ১১টি মামলার রায় ঘোষণা করা হয়েছে। এতে ১২ জন আসামি বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডিত হয়েছেন। আইনের এই বিধান অনুসরণ করে গোলাম আযম, দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদী, আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ, মুহাম্মদ কামারুজ্জামান, আবদুল কাদের মোল্লা, সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরী ও আবদুল আলীম আপিল করেন। এর মধ্যে আপিল বিচারাধীন থাকাবস্থায় গোলাম আযম ও আবদুল আলীম মারা গেছেন। তাই তাদের আপিল অকার্যকর হয়ে গেছে। এছাড়া কাদের মোল্লাকে আপিলের রায়ে মৃত্যুদণ্ড, সাঈদীকে আমৃত্যু জেল ও কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে। আলী আহসান মোহাম্মদ মুজাহিদ ও সালাহউদ্দিন কাদের চৌধুরীর আপিল বিচারাধীন রয়েছে। এবার মুজাহিদের মামলায় করা আপিলের ওপর শুনানি শুরু হবে। আবুল কালাম আজাদ ওরফে বাচ্চু, মঈনুদ্দীন ও আশরাফুজ্জামান পলাতক থাকায় তারা কোনো আপিল করেননি। এছাড়া সময় হাতে থাকায় নিজামী ও মীর কাসেম আলীর আপিল দায়েরের বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।
No comments