কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল -আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায় by মেহেদী হাসান ও হাবিবুর রহমান
জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি
জেনারেল মুহম্মদ কামারুজ্জামানের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে। সুপ্রিম
কোর্টের আপিল বিভাগের চার সদস্যের বেঞ্চ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এর আগে
ট্রাইব্যুনালের দেয়া মৃত্যুদণ্ডের রায় বহাল রাখেন। বিচারপতি সুরেন্দ্র
কুমার সিনহার নেতৃত্বে চার সদস্যের আপিল বেঞ্চ গতকাল মুহম্মদ
কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। আন্তর্জাতিক অপরাধ
ট্রাইব্যুনাল-২ কামারুজ্জামানকে দু’টি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড দিয়েছিলেন। গতকাল
আপিল বেঞ্চ এর মধ্যে একটি অভিযোগে (৩ নম্বর অভিযোগÑ সোহাগপুর গণহত্যা) তার
মৃত্যুদণ্ড সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে বহাল রাখেন। আরেকটি অভিযোগে মৃত্যুদণ্ডাদেশ
বাতিল করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। ট্রাইব্যুনালে কামারুজ্জামানের
বিরুদ্ধে সাতটি অভিযোগ আনা হয়েছিল। এর মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত
করে সাজা দেন ট্রাইব্যুনাল। ৩ ও ৪ নম্বর অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড, ১ ও ৭ নম্বর
অভিযোগে যাবজ্জীবন ও ২ নম্বর অভিযোগে ১০ বছর কারাদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল।
গতকাল আপিল বিভাগের রায়ে ২ ও ৭ নম্বর অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল প্রদত্ত সাজা
সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে বহাল রাখা হয়। ১ নম্বর অভিযোগ থেকে তাকে খালাস
দেয়া হয়। আপিল বিভাগের রায়ে যে অভিযোগে মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখা হয়েছে সেটিতে
মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে সর্বসম্মতভাবে দোষী সাব্যস্ত করা হয়েছে ও
মৃত্যুদণ্ড দেয়া হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। আর মৃত্যুদণ্ডের যে
অভিযোগ বাতিল করে যাবজ্জীবন করা হয়েছে সেটিতে কামারুজ্জামানকে দোষী
সাব্যস্ত করা হয়েছে সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে। ১৯৭১ সালে হত্যা, গণহত্যাসহ
মানবতাবিরোধী অপরাধে মুহম্মদ কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন
ট্রাইব্যুনাল-২ গত বছর ৯ মে। মৃত্যুদণ্ডের বিরুদ্ধে পরে আপিল করে
আসামিপক্ষ। গত ১৭ সেপ্টেম্বর আপিল শুনানি শেষে রায় অপেক্ষমাণ রাখা হয়। গত
বছর ১৭ সেপ্টেম্বর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের
মোল্লার বিরুদ্ধে প্রধান বিচারপতি মো: মোজাম্মেল হোসেনের নেতৃত্বে পাঁচ
সদস্যের আপিল বেঞ্চ মৃত্যুদণ্ডের চূড়ান্ত রায় ঘোষণা করেন। আবদুল কাদের
মোল্লার বিরুদ্ধে আপিল বিভাগের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হয় গত ৫ ডিসেম্বর।
পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশের পর রিভিউ আবেদন করা যাবে কি যাবে না এ নিয়ে বিতর্ক
চলা অবস্থায় ১০ ডিসেম্বর মঙ্গলবার রাত ১২টার পর ফাঁসি কার্যকরের প্রস্তুতি
নেয়া হয় এবং সরকার ও জেল কর্তৃপক্ষ থেকে ঘোষণাও দেয়া হয়। তবে ওই দিনই রাত
সোয়া ১০টায় সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের চেম্বার বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ
হোসেন ফাঁসি কার্যকর পরদিন বুধবার সকাল ১০টা পর্যন্ত স্থগিত করে আদেশ দেন।
১২ ডিসেম্বর আপিল বিভাগ রিভিউ আবেদন খারিজ করে দেয়ার পর সে রাতেই কার্যকর
করা হয় আবদুল কাদের মোল্লার ফাঁসি। কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে অভিযোগ ও রায় :
রাষ্ট্রপক্ষের আনীত অভিযোগে এবং ট্রাইব্যুনালের রায়ে মুহম্মদ
কামারুজ্জামানকে আলবদর বাহিনীর প্রধান সংগঠক ও তৎকালীন ইসলামী ছাত্রসঙ্ঘের
নেতা হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। এ হিসেবে শেরপুরে পাকিস্তান সেনাবাহিনী,
আলবদর ও রাজাকার বাহিনী কর্তৃক স্বাধীনতাপন্থী লোকজনকে হত্যা, নির্যাতন,
অপহরণ, গুম, ধর্ষণসহ বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী অপরাধের দায় আনা হয়েছে
কামারুজ্জামানের ওপর। শেরপুরে সংঘটিত বিভিন্ন ধরনের মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ড
তার পরামর্শ ও সহযোগিতায় পরিচালিত হতো বলে ট্রাইব্যুনালের রায়ে উল্লেখ করা
হয়। মুহম্মদ কামারুজ্জামানের বিরুদ্ধে ট্রাইব্যুনালে আনীত সাতটি অভিযোগের
মধ্যে পাঁচটি অভিযোগে সাজা দেয়া হয়। এ পাঁচটি অভিযোগ বিষয়ে ট্রাইব্যুনাল ও
আপিল বিভাগের সিদ্ধান্ত এখানে উল্লেখ করা হলো। ১ নম্বর অভিযোগ :
বদিউজ্জামানকে অপহরণ করে আহমেদনগর আর্মি ক্যাম্পে নিয়ে নির্যাতনের পর গুলি
করে হত্যা। এ হত্যার সাথে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে ট্রাইব্যুনাল
কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। আপিল বিভাগের রায়ে এ অভিযোগ থেকে
তাকে খালাস দেয়া হয়েছে। ২ নম্বর অভিযোগ : শেরপর কলেজের অধ্যক্ষ সৈয়দ আবদুল
হান্নানকে প্রায় উলঙ্গ করে শহরে প্রদণি করানো ও পেটানো হয়। এ অভিযোগে
সংশ্লিষ্টতার দায়ে ট্রাইব্যুনাল ১০ বছর কারাদণ্ড দেন। আপিল বিভাগে এ সাজা
বহাল রাখা হয়েছে। ৩ নম্বর অভিযোগ : ১৯৭১ সালে কামারুজ্জামানের পরামর্শে
পাকিস্তান আর্মি দেশীয় রাজাকার ও আলবদর সদস্যদের সাথে নিয়ে শেরপুরের
সোহাগপুর গ্রামে অভিযান চালায়। অভিযানে ওই গ্রামে দেড় শতাধিক মানুষ নিহত হয়
এবং অসংখ্য নারী ধর্ষণের শিকার হয়। এ গণহত্যার অভিযোগে কামারুজ্জামানকে
মৃত্যুদণ্ড দেন ট্রাইব্যুনাল। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার ভিত্তিতে এ সাজা
বহাল রেখেছেন। ৪ নম্বর অভিযোগ : শেরপুর মোস্তফাবাগ থেকে গোলাম মোস্তফাকে
ধরে আলবদর ক্যাম্পে নেয়া হয়। এরপর তাকে কামারুজ্জামান ও অন্যরা মিলে একটি
ব্রিজের কাছে নিয়ে গুলি করে হত্যা করে। এ অভিযোগে সংশ্লিষ্টতার অভিযোগে
ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে মৃত্যুদণ্ড দেন। আপিল বিভাগ সংখ্যাগরিষ্ঠতার
ভিত্তিতে এ অভিযোগে তাকে দোষী সাব্যস্ত করলেও মৃত্যুদণ্ড বাতিল করে
যাবজ্জীবন দিয়েছেন। ৭ নম্বর অভিযোগ : মুক্তিযুদ্ধ চলাকালে ময়মনসিংহ
গোলাপজান রোডে টেপা মিয়ার বাড়িতে অভিযান চালিয়ে টেপা মিয়া ও তার ছেলে
জহুরুল ইসলাম দারাকে জেলা পরিষদ ডাকবাংলায় অবস্থিত আলবদর ক্যাম্পে নেয়া হয়।
পরদিন সকালে তারা দু’জনসহ সাতজনকে ব্রহ্মপুত্র নদের তীরে নেয়া হয়। এ সময়
টেপা মিয়া নদীতে ঝাঁপ দিয়ে রক্ষা পায় এবং অন্যদের হত্যা করা হয়। এ অভিযোগের
সাথে সংশ্লিষ্টতার দায়ে ট্রাইব্যুনাল কামারুজ্জামানকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড
দেন। গতকাল আপিল বিভাগের সংখ্যাগরিষ্ঠ রায়ে এ দণ্ড বহাল রাখা হয়। মুহাম্মদ
কামারুজ্জামানের আপিল শুনানির জন্য বিচারপতি সুরেন্দ্রকুমার সিনহার
নেতৃত্বে গঠিত চার সদস্যের আপিল বেঞ্চের অপর তিন সদস্য হলেন বিচারপতি আবদুল
ওয়াহহাব মিয়া, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিক ও বিচারপতি এ এইচ এম
শামসুদ্দীন চৌধুরী। ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত দেয়ার অভিযোগে পুলিশের দায়ের করা
মামলায় ২০১০ সালের ২৯ জুলাই কামারুজ্জামানকে গ্রেফতার করা হয়। এর চার
দিনের মাথায় ২ আগস্ট তাকে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে গ্রেফতার দেখানো
হয়। কামারুজ্জামানের সংক্ষিপ্ত পরিচিতি : মুহাম্মদ কামারুজ্জামান ১৯৫২ সালে
শেরপুরে জন্মগ্রহণ করেন। ১৯৬৭ সালে তিনি জিকে স্কুল থেকে প্রথম বিভাগে
এসএসসি পাস করেন। ১৯৭২ সালে নাসিরাবাদ কলেজ থেকে এইচএসসি পাস করেন।
কামারুজ্জামান ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে
প্রথম শ্রেণীতে এমএ পাস করেন। গ্রেফতারের আগ পর্যন্ত তিনি সাপ্তাহিক সোনার
বাংলা পত্রিকার সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এর আগে তিনি দৈনিক
সংগ্রমের নির্বাহী সম্পাদক ছিলেন।
No comments