ঘুষ দুর্নীতির বরপুত্র ছাতকের ওসি শাহজালাল by হাবিব সরোয়ার আজাদ
সুনামগঞ্জের শিল্পনগরী ও প্রবাসী অধ্যুষিত
ছাতক থানা এখন ঘুষ-বাণিজ্য, লুটপাট আর হয়রানির আখড়ায় পরিণত হয়েছে। মামলার
ফাঁদে ফেলে থানার ওসি (অফিসার ইনচার্জ) ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে প্রতি মাসে
লুটে নিচ্ছেন লাখ লাখ টাকা। ঘুষের টাকায় অবৈধ সম্পদের পাহাড় গড়ে তোলা ওসি
শাহজালাল মুন্সীর নানা অপকর্মের বিবরণসহ ইতিমধ্যে দুদকের প্রধান কার্যালয়ে
লিখিত অভিযোগও জমা পড়েছে। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, তদবির করে দ্বিতীয়বারের মতো
ছাতক থানায় যোগদান করেই ওসি শাহজালাল মুন্সী নিয়মিত মাসোয়ারা দিয়ে
প্রভাবশালী মহলের সঙ্গে সখ্য গড়ে তোলেন। প্রবাসী ও ধনাঢ্য ব্যক্তিদের
অনৈতিক সুবিধা দেয়ার পাশাপাশি মাদক ব্যবসায়ী, চোরাচালানি, সন্ত্রাসী,
চাঁদাবাজচক্র, গরুচোর সিন্ডিকেটসহ থানায় আসা মামলার তদবিরবাজ দালালদের
সঙ্গে অচিরেই গাঁটছড়া বেঁধে ফেলেন। মামলা রুজু, তদন্ত, চার্জশিট দেয়া,
চার্জশিট থেকে আসামির নাম বাদ দেয়া, মামলার ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া, গ্রেফতার
বাণিজ্য থেকে শুরু করে নানা উপায়ে ইতিমধ্যে বেপরোয়া ঘুষ-বাণিজ্যের মাধ্যমে
কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। তার গ্রেফতার বাণিজ্য থেকে রেহাই পায়নি এক মা ও
তার কিশোরী কন্যাও। সাজানো চাঁদাবাজির মামলায় ওসির গ্রেফতার বাণিজ্যের জালে
গ্রেফতার হয়ে মা-বাবা ও দুই ভাইয়ের সঙ্গে শনিবার থেকে জেলা কারাগারে আটক
রয়েছে ওই কিশোরী।
ছাতক প্রেস ক্লাবে শনিবার সন্ধ্যায় উপজেলা চেয়ারম্যান ওলিউর রহমান চৌধুরী বকুল এক সংবাদ সম্মেলনে ওসির এমন বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্যের বিষয়টি জনসমক্ষে তুলে ধরেন। লিখিত বক্তব্যে উপজেলা চেয়ারম্যান জানান, লন্ডন প্রবাসী একটি পরিবারের কাছ থেকে মোটা অংকের উৎকোচ নিয়ে এক মামলায় এক কিশোরীসহ একই পরিবারের নিরীহ ৫ জনকে চাঁদাবাজির অভিযোগে গ্রেফতার করে ওসি তার নির্লজ্জ ঘুষ বাণিজ্যের জানান দিয়েছেন সর্বমহলে। ক্ষমতার এমন অপব্যবহারের ঘটনায় ওসির বিরুদ্ধে ছাতকের সাধারণ মানুষের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরাও ক্ষোভে ফুঁসে উঠেছেন। উপজেলার জাউয়াবাজার ইউনিয়নের দেবেরগাঁও গ্রামের বয়োবৃদ্ধ ঈমান আলী, তার কিশোরী কন্যা ও স্ত্রী-পুত্রসহ পরিবারের ৫ জনকে চাঁদাবাজি মামলায় গ্রেফতার করে জেলহাজতে প্রেরণের ঘটনা জন্ম দিয়েছে নানা রহস্য। ওসি মোটা অংকের ঘুষ নিয়ে ঈমান আলীর বসতভিটা দখল করার উদ্দেশ্যে এ কাণ্ড ঘটিয়েছেন। দীর্ঘ প্রায় ৩০ বছর ধরে বসবাসরত ঈমান আলী ও তার পরিবারকে শুক্রবার বিকালে জোর করে বাড়ি থেকে বের করে দিয়ে তালা লাগিয়ে দেয়ার পর তাদের গ্রেফতার করা হয়। ওসি শাহজালাল মুন্সী তার অসৎ উদ্দেশ্য চরিতার্থ করার জন্যই ঈমান আলীর পরিবারের প্রতি চরম অমানবিক আচরণ করেছেন। ওসির এহেন দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারে অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে উপজেলাবাসী। ওসির বিরুদ্ধে এসব অভিযোগ এনে উপজেলা চেয়ারম্যান লিখিত বক্তব্যে প্রশ্ন রাখেন, ঈমান আলীর বসতভিটা নিয়ে আদালতে মামলা চলা অবস্থায় কোন ক্ষমতা বলে ওসি শাহজালাল মুন্সী বিনা তদন্তে বসতঘর তালাবদ্ধ করে তাদের গ্রেফতার করলেন। যে মামলায় এক কিশোরী কন্যাসহ একই পরিবারের ৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়। ওই মামলার অভিযোগপত্র পাঠ করলে ওসি শাহজালাল মুন্সী কতটুকু নির্লজ্জ ও অমানবিক তা অনুধাবন করা যাবে বলে লিখিত বক্তব্যে উল্লেখ করেন উপজেলা চেয়ারম্যান।
লিখিত বক্তব্যে আরও অভিযোগ করা হয়েছে, ওয়ারেন্টভুক্ত গরুচোর ধরতে আইনশৃংখলা কমিটির সভায় বলা হলেও এসব বিষয়ে গুরুত্ব না দিয়ে ওসি তার ঘুষ বাণিজ্য নিয়ে ব্যস্ত থাকেন সারাক্ষণ। মামলা রুজু ও তদন্তের বিষয়ে ওসি নিজেই থানা ভবনের পেছনে তার কোয়ার্টারে একটি বিশাল বাণিজ্যের দোকান খুলে বসেছেন বলে উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, আলোচিত মুক্তিযোদ্ধার পুত্র রাকিব আলী হত্যা মামলায় ঘুষ না দেয়ার কারণে থানায় অভিযোগ গ্রহণ করেননি ওসি শাহজালাল মুন্সী। তার এহেন কর্মকাণ্ডে সাধারণ জনগণের কাছে সরকার ও পুলিশ বিভাগের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন হচ্ছে বলে মন্তব্য করেন উপজেলা চেয়ারম্যান ওলিউর রহমান চৌধুরী বকুল। ওসির বিরুদ্ধে ঘুষ-দুর্নীতি, স্বজনপ্রীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহারসহ অসংখ্য প্রমাণ থাকা সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় সাধারণ মানুষ বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন। ওসির বিরুদ্ধে খোদ ছাতক থানায় কর্মরত অনেক পুলিশ সদস্যও ক্ষুব্ধ। ওসির বিতর্কিত কর্মকাণ্ডে সায় না দেয়ায় ইতিপূর্বে ছাতক থানা থেকে যখন-তখন বদলি হয়ে যেতে হয়েছে বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা ও কনস্টেবলকে। বর্তমানেও যারা রয়েছেন তারাও ওসির ভয়ে তটস্থ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০১০ সালে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে মহাজোট সরকারের শাসনামলে তদবির করে শাহজালাল মুন্সী ছাতক থানার ওসি হিসেবে বদলি হয়ে আসেন। কিছুদিন যেতে না যেতেই শুরু হয়ে যায় তার বেপরোয়া ঘুষ বাণিজ্য। বিষয়টি পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের নজরে এলে তাকে ২০১২ সালের ৮ সেপ্টেম্বর জেলা পুলিশ লাইনে ক্লোজ করা হয়। পরে বিশ্বনাথ থানায় ওসি (তদন্ত) হিসেবে তাকে বদলি করা হয়। মাত্র ৪ মাসের ব্যবধানে ২০১৩ সালের ১২ জানুয়ারি আবারও তদবির করে ওসি হিসেবে ছাতক থানায় বদলি হয়ে আসেন শাহজালাল মুন্সী। এরপরই সাধারণ মানুষের মধ্যে ভীতি ছড়িয়ে পড়ে। পুনরায় ছাতক থানায় যোগ দেয়ার পর ঘুষ বাণিজ্যের মাধ্যমে প্রতিমাসে লাখ লাখ টাকা হাতিয়ে নেয়ার জন্য তাকে আর পেছন ফিরে তাকাতে হয়নি। শাহজালাল মুন্সী থানায় যোগদানের পর রেকর্ড হওয়া এবং ফাইনাল রিপোর্ট দেয়া, মামলার চার্জশিট থেকে আসামির নাম বাদ দেয়াসহ সব মামলার সুষ্ঠু তদন্ত হলে কয়েক কোটি টাকা ঘুষ লেনদেনের প্রমাণ পাওয়া যাবে বলে অলিউর রহমান চৌধুরী বকুল তার বক্তব্যে দাবি করেছেন। এসব অভিযোগের বিষয়ে ওসি শাহজালাল মুন্সীর বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোনে যোগাযোগ করা হলে তিনি তার বিরুদ্ধে আনা সব অভিযোগ অস্বীকার করেন।
No comments