চট্টগ্রাম ছাত্রলীগ কর্মী মান্না হত্যার নেপথ্যে by মহিউদ্দীন জুয়েল
ছাত্রলীগের ছোট ভাই ছিলেন মিশু। তাকে চড়
মেরেছিল প্রতিপক্ষের লোকজন। কারণ এলাকায় মাদকের ব্যবসা জমজমাট। অন্যদিকে
উঠতি মেয়েদের উদ্দেশ্যে নানা ধরনের কটূক্তি করছে দলের কিছু উচ্ছৃঙ্খল
কর্মী। এসব ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়েছিল মিশু। তাতে চড় খায় সে। তাই বিষয়টি
জানার পর মীমাংসার বৈঠকে অংশ নিতে গিয়েছিল মান্না। সঙ্গে এলাকার আরও বেশ
কয়েকজন বড় ভাই। মোবাইলে ডাক দেয়ায় তাদের অনুরোধ ফেলতে পারেনি সে। কিন্তু কে
জানতো গ্রুপিংয়ে ফাঁদে পড়ে তাকেই লাশ হয়ে বাড়ি ফিরতে হবে শেষমেশ।
চট্টগ্রামে গত রোববার রাতে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের সংঘর্ষে নিহত হয় সিটি
কলেজ ছাত্র মাহমুদুর রহমান মান্না (২৫)। এলাকায় আধিপত্য বিস্তারের ঘটনার
জের ধরে প্রতিপক্ষের কর্মীরা তাকে ধারালো ছুরি দিয়ে কুপিয়ে হত্যা করে।
গতকাল এই বিষয়ে জানতে ঘটনাস্থল হালিশহর আবাসিক এলাকা গেলে বেরিয়ে আসে
চাঞ্চল্যকর নানা তথ্য। স্থানীয়রা জানান, ক্ষতাসীন দলের নাম ভাঙিয়ে
ছাত্রলীগের কিছু নেতা-কর্মী সেখানে কায়েম করেছে সন্ত্রাসের রাজত্ব। যাদের
সবার বিরুদ্ধে উঠেছে চাঁদাবাজি, মাদকসহ নানান অপকর্মে জড়িত থাকার অভিযোগ।
এই ঘটনায় সর্বশেষ গতকাল বিকাল পর্যন্ত পুলিশ সোহেল নামের এক ছাত্রলীগ
কর্মীকে আটক করেছে। অন্যদিকে মামলার হত্যার সঙ্গে জড়িত থাকার ঘটনায় পলাতক
রয়েছে বেশ কয়েকজন।
স্থানীয় সূত্র জানায়, রোববার রাতে ঘটনাটি ঘটে হালিশহর আবাসিক এলাকার এ ব্লকে। নিহত ছাত্রলীগ কর্মী মান্নার গ্রামের বাড়ি চট্টগ্রামের সন্দ্বীপের মুছাপুর এলাকায়। মান্না সরকারি সিটি কলেজের ছাত্র ছিল। ঘটনার দিন রাতে বড় ভাইদের ডাকে সে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়। গত ৬-৭ মাস ধরে সেখানে একুশে ক্লাব নিয়ে ছাত্রলীগের দুই পক্ষের মধ্যে ধাওয়া-পাল্টা ধাওয়া ও হামলা চালানোর ঘটনা ঘটছিল।
তার রেশ ধরে কিছুদিন আগে বিহারি কলোনির মনা ও কাশেম নামের দুই ভাইয়ের সঙ্গে ঝগড়া হয় মিশু নামে মান্নার এক দলীয় ছোট ভাইয়ের। কথা কাটাকাটির একপর্যায়ে তারাসহ বেশ কয়েকজন মিলে মিশুকে চড় মারে। মিশু বিষয়টি এলাকার বড় ভাইদের জানায়। পরে সবাই সিদ্ধান্ত নেয় ঘটনাটি মীমাংসা করা হবে রোববার রাতে। এই মিটিংয়ে মান্নাকে উপস্থিত থাকতে বলা হয়।
রাত ৯টায় বৈঠক চলাকালে হঠাৎ হামলা চালায় মিশুকে মারধরকারী ছাত্রলীগের প্রতিপক্ষের লোকজন। সেখান থেকে প্রাণে বাঁচতে দৌড় দিতেই মান্নাকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় একজন। এরপর মিটিংয়ে আসার অপরাধে ধারালো ছুরি দিয়ে তার পেটে, বুকে ও পিঠে ছুরিকাঘাত করা হয়। পরে রক্তাক্ত অবস্থায় চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে আনা হলে কর্তব্যরত চিকিৎসক তার মৃত্যু হয় বলে জানান।
হালিশহর থানা পুলিশ জানায়, হত্যার ঘটনার সঙ্গে জড়িত থাকার অভিযোগে পুলিশ স্থানীয় ছাত্রলীগের কয়েকজন নেতা-কর্মীকে হন্যে হয়ে খুঁজছে। এই ব্যাপারে সোমবার রাতেই থানায় নিহতের পরিবার থেকে একটি মামলা দায়েরের প্রস্তুতির কথা জানান কর্মকর্তারা। তবে পুলিশ প্রাথমিকভাবে মনা, তার ভাই কাশেম, সোহেল, ইউসুফসহ বেশ কয়েকজন ছাত্রলীগ কর্মীর বিরুদ্ধে তদন্ত শুরু করেছে।
ইতিমধ্যে সোহেলকে আটক করা হয়েছে। বাকিরা সবাই পলাতক বলে জানা গেছে। ঘটনার সময় ব্যবহৃত রামদা, ছোরা ও দু’টি চাকু উদ্ধারের জন্য তল্লাশি চলছে বলেও জানান থানার ওসি। এই বিষয়ে ওসি শাহজান কবির মানবজমিনকে বলেন, একুশে ক্লাব নিয়ে বিরোধের জের ধরে ঘটনাটি ঘটেছে। শুনেছি ওরা রাজনীতি করে। তবে রাজনীতির নাম ভাঙিয়ে এসব অপকর্ম করছে বলে লোকজন আমাদেরকে জানান। কিছুদিন ধরেই এলাকাতে মাদকসহ নানা অপকর্ম করে আসছিল উচ্ছৃঙ্খল কিছু ছেলেপেলে। তারাই এমন ঘটনা ঘটিয়েছে।
তিনি আর বলেন, থানায় মামলা দায়েরের প্রস্তুতি চলছে। জানাজা হয়েছে। ঘটনাটি নৃশংস। ছেলেটি তার আত্মীয় স্বজনের বাসায় থেকে পড়ালেখা করতো। এই ঘটনায় অনেকে পলাতক রয়েছে। তাদেরকে খুঁজে বের করার চেষ্টা চলছে।
স্থানীয় ওয়ার্ড কাউন্সিলর মোরশেদ আকতার চৌধুরী বলেন, এই ঘটনায় এলাকায় অনেকের মধ্যে ভয় ঢুকে গেছে। তবে আমরা সতর্ক রয়েছি। নতুন করে কেউ যাতে কোন ধরনের অঘটন ঘটাতে না পারে সে ব্যাপারে ব্যবস্থা নিতে পুলিশকে জানিয়েছি। নিহত মান্না সিটি কলেজের অনার্সের তৃতীয় বর্ষের ছাত্র ছিল। তার আর্থিক অবস্থা তেমন ভাল ছিল না। ঘটনাটি দুঃখজনক।
স্থানীয় মুদি দোকানদার আমান আলী বলেন, ছেলেটিকে যেভাবে ছুরি মেরেছে তাতে তার বাঁচার কোন লক্ষণ ছিল না। পলিটিকস করলে এভাবে মারতে হয় তা জানা ছিল না। কেন যে এসব ছেলে রাজনীতির পাওয়ার দেখায়।
ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ব্যাংকার আসিফ হোসেন আলাপকালে মানবজমিনকে বলেন, প্রথমে গত শনিবার রাতে হালিশহর আবাসিক এলাকায় হাতাহাতিতে জড়ায় দুটি পক্ষ। সেদিন আমি পাশ দিয়ে যাচ্ছিলাম। এরপর রোববার রাতে ছাত্রলীগের দু’টি গ্রুপ গাউসিয়া খেলার মাঠে অবস্থান নেয়। এক পর্যায়ে সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়লে লোকজন বাসায় ঢুকে পড়ে। পরে গিয়ে দেখা যায় মাহমুদুর রহমানের রক্তাক্ত লাশ মাটিতে পড়ে আছে। এলাকার কিছু বখাটে ছেলে রয়েছে। যারা এসব অপকর্ম করছে। এদের জন্য কেউ বাসা থেকে বের হতে পারে না। কিছু বললেই গলা চেপে ধরে।
No comments