অন্য আলোয় কর্নেল তাহের

সাড়ে তিন দশক পর অন্য এক উপলব্ধি। ৩৬ বছর আগে যাঁকে বসানো হয়েছিল খলনায়কের আসনে, তিনিই আজ নায়ক। ইতিহাসের সত্য বোধ হয় এভাবেই প্রকাশিত হয়। সত্য যে একদিন আলোর মুখ দেখে, সেটা আজ আবার নতুন করে সবার কাছে প্রমাণ হয়ে গেল।


মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সেক্টর কমান্ডার মুক্তিযোদ্ধা কর্নেল তাহেরকে একদিন ফাঁসি দেওয়া হয়েছিল। অভিযোগ আনা হয়েছিল দেশদ্রোহিতার। সাড়ে তিন দশক পর আদালতের রায়ে আজ প্রমাণ হয়ে গেল, কর্নেল তাহের দেশদ্রোহী নন, ছিলেন দেশপ্রেমিক। নিজেদের ক্ষমতা সুসংহত করতেই বিচারের নামে একটি প্রহসন হয়েছিল। সে বিচারের রায়ে এই বীরউত্তম মুক্তিযোদ্ধাকে দেওয়া হয়েছিল ফাঁসির আদেশ। আজ আদালত থেকে রায় পাওয়া যাচ্ছে, হত্যা করা হয়েছিল কর্নেল তাহেরকে।
১৯৭৫ সাল। সময়টা বাংলাদেশের জন্য ছিল অন্য রকম। ১৫ আগস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে হত্যার পর সেনাবাহিনীতে অভ্যুত্থান-পাল্টাঅভ্যুত্থান চলে। এরই একপর্যায়ে জিয়াউর রহমান ক্ষমতা নেওয়ার পর তাহেরসহ ১৭ জনকে সামরিক আদালতে গোপন বিচারের মুখোমুখি করা হয়। ১৯৭৬ সালের ১৭ জুলাই রায়ের পর ২১ জুলাই ভোরে কর্নেল তাহেরের ফাঁসি কার্যকর করা হয়। ১৯৭৬ সালে কথিত আদালতে তাহেরসহ ৩৩ জনকে বিচারের মুখোমুখি করা হয়েছিল। এর মধ্যে মুক্তিযুদ্ধের দুই সেক্টর কমান্ডার কর্নেল তাহের ও মেজর এম এ জলিল এবং তাহেরের ভাই আবু ইউসুফ খান বীর বিক্রমকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। পরে মুক্তিযুদ্ধে বিশেষ অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে মেজর জলিল ও আবু ইউসুফের দণ্ড কমিয়ে যাবজ্জীবন করা হয়। খালাস পান ১৬ জন। তাহেরের মৃত্যুর ৩৪ বছর পর ওই বিচারের বৈধতা চ্যালেঞ্জ করে কর্নেল তাহেরের ভাই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক প্রফেসর মো. আনোয়ার হোসেন, তাহেরের স্ত্রী লুৎফা তাহের এবং সামরিক আদালতের বিচারে যাবজ্জীবন সাজাপ্রাপ্ত ফ্লাইট সার্জেন্ট আবু ইউসুফ খানের স্ত্রী ফাতেমা ইউসুফ গত বছর ২৩ আগস্ট হাইকোর্টে রিট আবেদন করেন।
তাঁদের আবেদনের পর হাইকোর্ট সেই গোপন বিচারের নথি তলব করেন। রিট আবেদনের শুনানিতে আদালত অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে সুপ্রিম কোর্টের কয়েক আইনজীবীর বক্তব্য শোনেন। এর আগে আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন সাংবাদিক লরেন্স লিফশুলজ, ঢাকার তৎকালীন জেলা প্রশাসক এসএম শওকত আলী, বর্তমান জেলা প্রশাসক (ডিসি) মো. মহিবুল হক আদালতে বক্তব্য দেন। তাহেরের সঙ্গে সামরিক আদালতে অভিযুক্ত কয়েকজনও আদালতে বক্তব্য দেন। সবার বক্তব্য শোনার পর আদালতের রায় পাওয়া যায় গত মঙ্গলবার। হাইকোর্ট রায়ে বলেছেন, কর্নেল তাহেরসহ অন্যদের পুরো বিচার ছিল তথাকথিত লোক দেখানো একটি প্রহসনের নাটক। আদালতের মতে, তাহেরকে বিচার করে যে আইনে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয় তখন সে আইনে মৃত্যুদণ্ডের কোনো বিধান ছিল না। এই বিধান করা হয়েছে তাঁর ফাঁসির রায় কার্যকর করার পর ১৯৭৬ সালের ৩১ জুলাই। তাই আইনগতভাবেই ওই দণ্ড ছিল অবৈধ। এ ছাড়া বিচারের সময় আদালতের সামনে এজাহার বা অভিযোগপত্রও ছিল না। এসব বিবেচনায় ওই আদালত ও তার কার্যক্রমই ছিল অবৈধ। আদালত বলেছেন, তাহেরসহ অন্যরা সেনাশাসক জেনারেল জিয়াউর রহমানের ক্ষোভের শিকার হয়েছিলেন বলেই মৃত্যু ও কারাভোগ করেন। তাঁরা জিয়ার স্বৈরশাসন প্রতিষ্ঠায় পাশে না থেকে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছিলেন। তাহেরকে দেশদ্রোহিতার বদলে দেশপ্রেমিক হিসেবে চিহ্নিত করে তাঁকে শহীদের মর্যাদা দিতে সরকারকে নির্দেশ দেওয়ার পাশাপাশি কর্নেল তাহেরের পরিবারকে ক্ষতিপূরণ দেওয়ার বিষয়টি বিবেচনা করতে বলেছেন আদালত।
আদালতের এ রায় কর্নেল তাহেরের পরিবারকে কিছুটা হলেও স্বস্তি দেবে। দেশদ্রোহিতার যে অভিযোগ ছিল তাঁর বিরুদ্ধে, সে অভিযোগ থেকেও তিনি মুক্ত হলেন। এটা কেবল পরিবারের জন্যই নয়, জীবিত সব মুক্তিযোদ্ধা এবং মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের শক্তির জন্যও স্বস্তির বিষয়। বাংলাদেশের রাজনীতির একটি অংশ তাহেরকে যেভাবে দেখত, নতুন প্রজন্ম অন্তত নতুন এক তাহেরকে চিনবে।

No comments

Powered by Blogger.