চলতি পথে-বিখ্যাত যুদ্ধের বিস্মৃত শহীদ by দীপংকর চন্দ
ধলাই চা-বাগানের নাটমন্দির অতিক্রম করলাম আমরা। আমাদের পায়ের নিচে নুড়ি বিছানো পথ। পথের দুই ধারে সারবাঁধা মাটির ঘর। বাগান কর্তৃপক্ষ প্রতিবছর একটা নির্দিষ্ট সংখ্যা দিয়ে চিহ্নিত করে পুরোনো ছনে আচ্ছাদিত ঘরগুলোকে। যেমন ১৪৩, ১৪৪, ১৪৫...।
‘এই ঘরটিতে থাকতেন মুক্তিযুদ্ধে শহীদ চা-শ্রমিক গুরণা ভর’, আঙুল তুলে ১৪৫ নম্বর ঘরটি দেখালেন তুলসী দাস মাদ্রাজি।
‘গুরণা ভর!’ অবাক কণ্ঠে কৌতূহল ব্যক্ত করি আমি। পূতিগন্ধময় একটা নর্দমা অতিক্রম করে ১৪৫ নম্বর ঘরটির উঠোনের সামনে দাঁড়াই। তারপর তুলসী দাসের কাছে জানতে চাই শহীদ গুরণা ভরের কথা।
তুলসী দাস জানান, গুরণা ভরের জন্ম মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানায় অবস্থিত ধলাই চা-বাগানের শ্রমিক নিবাসে। তাঁর পিতার নাম পরদেশি ভর। অধিকাংশ চা-শ্রমজীবী গোষ্ঠীর মানুষের মতোই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণে ব্যর্থ হলেও ছোটবেলা থেকেই চা-শ্রমিকদের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা ভাবতেন তিনি, ভাবতেন সামাজিক শোষণের শৃঙ্খল মোচনের কথা। এসব ভাবতে ভাবতেই যৌবনে পদার্পণ করলেন তিনি। বিয়ে করলেন তারা ভরকে। কিছুদিন যেতে না-যেতেই সন্তান এল সংসারে। গুরণা ভর সেই সন্তানের নাম রাখলেন জলন্ধর। সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই উত্তাল হলো দেশের পরিস্থিতি। স্বাধীনতার ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তির মন্ত্র তিনি উচ্চারণ করলেন বজ্রকণ্ঠে।
‘দেশ স্বাধীন হলে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চয়ই আসবে! তাঁদের মতো চা-শ্রমিকদের নিশ্চয়ই কেউ নিগৃহীত করবে না তখন!’ গুরণা ভর যথাসাধ্য ভাবলেন। কিন্তু স্বাধীনতা কি ঘরে বসেই অর্জিত হবে? মুক্তি কি বিনা আয়াসেই ধরা দেবে হাতের মুঠোয়? না, সে জন্য যুদ্ধ চাই। প্রয়োজন হলে মাটির ওপর ঢেলে দেওয়া চাই উষ্ণ রক্তের বেগবান ধারা। ভাবতে ভাবতে বাগানের কাজে ইস্তফা দিলেন গুরণা ভর। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ার প্রতিজ্ঞায় ত্যাগ করলেন সংসারের মায়া।
যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য অবশ্য খুব বেশি দূরে যেতে হলো না গুরণা ভরকে। কারণ ধলাই চা-বাগানেই তখন শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। ভারতের সীমান্তও ধলাই বাগানের একেবারে কাছে। অল্প দূরত্বেই ত্রিপুরার কমলপুর থানা। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সাব-সেক্টর ক্যাম্প। গুরণা ভর যোগাযোগ করলেন ক্যাম্পে। ক্যাম্প কমান্ডার গুরণা ভরকে ধলাই সীমান্ত ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের তথ্য সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করলেন।
মৌলভীবাজার জেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ঘাঁটিটি ছিল কমলগঞ্জ থানার এই ধলাই চা-বাগানে। সামরিক ও রণকৌশলগত দিক থেকে ঘাঁটিটির গুরুত্ব ছিল অনেক। তাই ধলাই সীমান্ত ঘাঁটিটি যৌথভাবে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল জেড ফোর্সের অধীন ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানি, ডেল্টা কোম্পানি ও ব্রাভো কোম্পানি।
২৮ অক্টোবর। ভোররাত। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, চার্লি কোম্পানি ধলাই সীমান্ত ঘাঁটির একটি অংশে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিহত করে এই আক্রমণ। যুদ্ধ হয় প্রচণ্ড। এই দিনের যুদ্ধে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান।
২৯ অক্টোবর। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধ শুরু হলো আবার। কিন্তু এদিন মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই নির্ণয় করতে পারছিলেন না পাকিস্তানি সৈন্যদের সঠিক অবস্থান। প্রমাদ গুনলেন মুক্তিযোদ্ধারা। কারও সাহায্য এ মুহূর্তে ভীষণ প্রয়োজন। গুরণা ভর কাছেই ছিলেন। সবকিছু অনুধাবন করে তিনি এগিয়ে গেলেন বীরদর্পে। হামাগুড়ি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাংকারের ওপর উঠলেন। তারপর জোরে চিত্কার করে পাকিস্তানিদের অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত করলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধারা তুমুল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার। পাকিস্তানিরাও মরিয়া হয়ে গুলি চালাল। গুলিতে প্রথমেই তারা বিদীর্ণ করল গুরণা ভরের বুক। গুরণা ভর শহীদ হলেন সঙ্গে সঙ্গেই। এরপর যুদ্ধ চলল আরও দুই দিন। তীব্র যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের অনন্যসাধারণ নৈপুণ্যে মুক্ত হলো ধলাই সীমান্ত ঘাঁটি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুব দ্রুত দখলদারমুক্ত হলো দেশও। ‘কিন্তু গুরণা ভরের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি তো এলই না, উল্টো তাঁর অবদানের কথাও ভুলে গেল সবাই।’ ম্লান মুখে বললেন তুলসী দাস মাদ্রাজি।
‘গুরণা ভরের এই ঘরে কে থাকেন এখন?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘গুরণা ভরের ভাই দয়াশংকর ভরের বড় ছেলে রাম অবতার ভর বর্তমানে থাকেন এই ঘরটিতে।’ আমাদের কথোপকথনে কৌতূহলী হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন রাম অবতার ভর।
‘কিন্তু গুরণা ভরের স্ত্রী তারা ভর কিংবা তাঁর ছেলে জলন্ধর কোথায় আজ? তাঁরা কি অর্জন করতে পেরেছেন অর্থনৈতিক মুক্তি?’ সন্দেহ জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইলাম আবার।
‘না,’ খানিকটা শ্লেষের সুরে বললেন তুলসী দাস, ‘তাঁরা দুজনই মৃত আজ, অর্থনৈতিক মুক্তির মতো জাগতিক অর্জনের অনেক ঊর্ধ্বে তাঁদের বর্তমান অস্তিত্ব।’
‘গুরণা ভর!’ অবাক কণ্ঠে কৌতূহল ব্যক্ত করি আমি। পূতিগন্ধময় একটা নর্দমা অতিক্রম করে ১৪৫ নম্বর ঘরটির উঠোনের সামনে দাঁড়াই। তারপর তুলসী দাসের কাছে জানতে চাই শহীদ গুরণা ভরের কথা।
তুলসী দাস জানান, গুরণা ভরের জন্ম মৌলভীবাজার জেলার কমলগঞ্জ থানায় অবস্থিত ধলাই চা-বাগানের শ্রমিক নিবাসে। তাঁর পিতার নাম পরদেশি ভর। অধিকাংশ চা-শ্রমজীবী গোষ্ঠীর মানুষের মতোই প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাগ্রহণে ব্যর্থ হলেও ছোটবেলা থেকেই চা-শ্রমিকদের অর্থনৈতিক মুক্তির কথা ভাবতেন তিনি, ভাবতেন সামাজিক শোষণের শৃঙ্খল মোচনের কথা। এসব ভাবতে ভাবতেই যৌবনে পদার্পণ করলেন তিনি। বিয়ে করলেন তারা ভরকে। কিছুদিন যেতে না-যেতেই সন্তান এল সংসারে। গুরণা ভর সেই সন্তানের নাম রাখলেন জলন্ধর। সন্তান জন্ম নেওয়ার পরপরই উত্তাল হলো দেশের পরিস্থিতি। স্বাধীনতার ডাক দিলেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। মুক্তির মন্ত্র তিনি উচ্চারণ করলেন বজ্রকণ্ঠে।
‘দেশ স্বাধীন হলে জনগণের অর্থনৈতিক মুক্তি নিশ্চয়ই আসবে! তাঁদের মতো চা-শ্রমিকদের নিশ্চয়ই কেউ নিগৃহীত করবে না তখন!’ গুরণা ভর যথাসাধ্য ভাবলেন। কিন্তু স্বাধীনতা কি ঘরে বসেই অর্জিত হবে? মুক্তি কি বিনা আয়াসেই ধরা দেবে হাতের মুঠোয়? না, সে জন্য যুদ্ধ চাই। প্রয়োজন হলে মাটির ওপর ঢেলে দেওয়া চাই উষ্ণ রক্তের বেগবান ধারা। ভাবতে ভাবতে বাগানের কাজে ইস্তফা দিলেন গুরণা ভর। পাকিস্তানি বাহিনীর সঙ্গে সম্মুখ সমরে অবতীর্ণ হওয়ার প্রতিজ্ঞায় ত্যাগ করলেন সংসারের মায়া।
যুদ্ধে যোগ দেওয়ার জন্য অবশ্য খুব বেশি দূরে যেতে হলো না গুরণা ভরকে। কারণ ধলাই চা-বাগানেই তখন শক্ত ঘাঁটি গেড়েছে পাকিস্তানি সৈন্যরা। ভারতের সীমান্তও ধলাই বাগানের একেবারে কাছে। অল্প দূরত্বেই ত্রিপুরার কমলপুর থানা। সেখানে মুক্তিবাহিনীর সাব-সেক্টর ক্যাম্প। গুরণা ভর যোগাযোগ করলেন ক্যাম্পে। ক্যাম্প কমান্ডার গুরণা ভরকে ধলাই সীমান্ত ঘাঁটিতে অবস্থানরত পাকিস্তানি সৈন্যদের তথ্য সংগ্রহের কাজে নিযুক্ত করলেন।
মৌলভীবাজার জেলায় পাকিস্তানি বাহিনীর সবচেয়ে দুর্ভেদ্য ঘাঁটিটি ছিল কমলগঞ্জ থানার এই ধলাই চা-বাগানে। সামরিক ও রণকৌশলগত দিক থেকে ঘাঁটিটির গুরুত্ব ছিল অনেক। তাই ধলাই সীমান্ত ঘাঁটিটি যৌথভাবে আক্রমণ করার সিদ্ধান্ত নিল জেড ফোর্সের অধীন ১ম ইস্টবেঙ্গল রেজিমেন্টের চার্লি কোম্পানি, ডেল্টা কোম্পানি ও ব্রাভো কোম্পানি।
২৮ অক্টোবর। ভোররাত। পূর্বপরিকল্পনা অনুযায়ী, চার্লি কোম্পানি ধলাই সীমান্ত ঘাঁটির একটি অংশে আক্রমণ চালায়। পাকিস্তানি বাহিনী প্রতিহত করে এই আক্রমণ। যুদ্ধ হয় প্রচণ্ড। এই দিনের যুদ্ধে শহীদ হন বীরশ্রেষ্ঠ সিপাহি হামিদুর রহমান।
২৯ অক্টোবর। সূর্যোদয়ের সঙ্গে সঙ্গেই যুদ্ধ শুরু হলো আবার। কিন্তু এদিন মুক্তিযোদ্ধারা কিছুতেই নির্ণয় করতে পারছিলেন না পাকিস্তানি সৈন্যদের সঠিক অবস্থান। প্রমাদ গুনলেন মুক্তিযোদ্ধারা। কারও সাহায্য এ মুহূর্তে ভীষণ প্রয়োজন। গুরণা ভর কাছেই ছিলেন। সবকিছু অনুধাবন করে তিনি এগিয়ে গেলেন বীরদর্পে। হামাগুড়ি দিয়ে কাঁটাতারের বেড়া অতিক্রম করে পাকিস্তানি সৈন্যদের বাংকারের ওপর উঠলেন। তারপর জোরে চিত্কার করে পাকিস্তানিদের অবস্থান সম্পর্কে জ্ঞাত করলেন মুক্তিযোদ্ধাদের। মুক্তিযোদ্ধারা তুমুল বেগে ঝাঁপিয়ে পড়ল এবার। পাকিস্তানিরাও মরিয়া হয়ে গুলি চালাল। গুলিতে প্রথমেই তারা বিদীর্ণ করল গুরণা ভরের বুক। গুরণা ভর শহীদ হলেন সঙ্গে সঙ্গেই। এরপর যুদ্ধ চলল আরও দুই দিন। তীব্র যুদ্ধ। মুক্তিযোদ্ধাদের অনন্যসাধারণ নৈপুণ্যে মুক্ত হলো ধলাই সীমান্ত ঘাঁটি। সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে খুব দ্রুত দখলদারমুক্ত হলো দেশও। ‘কিন্তু গুরণা ভরের কাঙ্ক্ষিত মুক্তি তো এলই না, উল্টো তাঁর অবদানের কথাও ভুলে গেল সবাই।’ ম্লান মুখে বললেন তুলসী দাস মাদ্রাজি।
‘গুরণা ভরের এই ঘরে কে থাকেন এখন?’ জানতে চাইলাম আমি।
‘গুরণা ভরের ভাই দয়াশংকর ভরের বড় ছেলে রাম অবতার ভর বর্তমানে থাকেন এই ঘরটিতে।’ আমাদের কথোপকথনে কৌতূহলী হয়ে বাইরে বেরিয়ে আসেন রাম অবতার ভর।
‘কিন্তু গুরণা ভরের স্ত্রী তারা ভর কিংবা তাঁর ছেলে জলন্ধর কোথায় আজ? তাঁরা কি অর্জন করতে পেরেছেন অর্থনৈতিক মুক্তি?’ সন্দেহ জড়ানো কণ্ঠে জানতে চাইলাম আবার।
‘না,’ খানিকটা শ্লেষের সুরে বললেন তুলসী দাস, ‘তাঁরা দুজনই মৃত আজ, অর্থনৈতিক মুক্তির মতো জাগতিক অর্জনের অনেক ঊর্ধ্বে তাঁদের বর্তমান অস্তিত্ব।’
No comments