মন্তব্য প্রতিবেদন-জাতীয় হিসাবে মেলে না জীবনের হিসাব by টিটু দত্ত গুপ্ত
বাংলাদেশে বার্ষিক মাথাপিছু আয় ৫৩ হাজার ২৪৫ টাকা আর ব্যয় ৫১ হাজার ৪৫৫ টাকা। বিয়োগ করলে মাথাপিছু সঞ্চয় থাকে বছরে এক হাজার ৭৮৯ টাকা। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষার হিসাবে, ভোগব্যয় বাড়ায় গত অর্থবছরে জাতীয় সঞ্চয় ২ শতাংশ কমেছে।
জীবনযাত্রার খরচ বাড়ার কারণে ব্যক্তিগত ও পারিবারিক আয়-ব্যয়ের ফারাক বাড়ছে, যার প্রতিফলন ঘটেছে জাতীয় হিসাবে। আজ বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী মূল্যস্ফীতি ও বাজেট ঘাটতি নিয়ন্ত্রণে রেখে প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের কথা বলবেন। ভর্তুকি, সামাজিক ও অবকাঠামো খাতে ব্যয় বাড়ানোর প্রস্তাব দেবেন। রাজস্ব আয়ের প্রবৃদ্ধি ধরে এবং দেশি-বিদেশি ঋণের প্রাক্কলন দিয়ে বার্ষিক আয়-ব্যয়ের হিসাব মিলিয়ে দেবেন। কিন্তু তাতে কি মিলবে সাধারণ মানুষের প্রতিদিনকার যাপিত জীবনের প্রত্যাশার হিসাব?
অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এ হিসাব মেলে না। এ দেশের কোনো সরকারই প্রতিবছর বাজেট ঘোষণায় যে জাতীয় হিসাব তুলে ধরে, তার সঙ্গে পরে আর মেলে না ব্যক্তিজীবনের আয়-ব্যয়ের হিসাব। বর্তমান সরকারও এ হিসাব মেলানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তা মেলেনি।
আজ বাজেট ঘোষণার পর সামষ্টিক অর্থনীতিবিদরা বলবেন সামষ্টিক অর্থনীতির কথা। প্রবৃদ্ধি, বাজেট ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, সরকারের ব্যাংক ঋণ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হারের হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ পুনর্ব্যক্ত করবেন। সমাজ ও উন্নয়নবিদরা বলবেন মানুষে মানুষে, অঞ্চলে অঞ্চলে সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা। ব্যবসায়ীরা হিসাব করবেন শুল্ক-কর ছাড় দিয়ে বাজেটকে কতখানি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-বান্ধব করা হলো। কিন্তু জীবনযাত্রার লাগামহীন ব্যয় বৃদ্ধিতে নাকাল সাধারণ মানুষের চাওয়া থাকবে একটাই- নতুন অর্থবছরের জাতীয় বাজেট যেন নতুন করে তাদের পারিবারিক বাজেটের গরমিলটা আরো না বাড়ায়।
আন্তর্জাতিক একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুণ্ডু বলেন, বাজেটে সাধারণ মানুষের স্বার্থ প্রতিফলিত হয় না। এ খাতে এত বরাদ্দ, ওই খাতে এত বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে মানুষের কিছু যায়-আসে না। আগের বছর দেওয়া বরাদ্দের কতখানি খরচ হয়েছে, তাতে কি লাভ হয়েছে, না হলে কেন হয়নি- এসব ব্যাখ্যা যদি বাজেটে থাকত, তাহলেও কিছুটা কাজ হতো। মানুষের নিজের আয়-ব্যয়ের হিসাবই মিলছে না, সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব শুনে তাদের কী হবে?
গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের প্রধান ড. রাশেদ আল-মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাজেটে সাধারণ মানুষ দেখে কোন জিনিসের দাম বাড়ল, কোন জিনিসের কমল, তার জীবনযাত্রা সহজ হলো, না আরো জটিল হলো। তাদের কাছে বাজেটের আর বিশেষ কোনো অর্থ নেই। আর অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে এবারের বাজেট হবে আইএমএফের নজরদারিতে থাকা একটি রাজস্ব পরিকল্পনা, যাতে সংস্থাটির সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের প্রয়াস থাকবে। তিনি বলেন, আইএমএফের প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার জন্য তাদের নির্দেশিত পথে চালানো হবে আর্থিক ব্যবস্থাপনা, এতে বিনিয়োগ ও অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিধারা ব্যাহত হবে। আইএমএফ নির্দেশিত ব্যয় সংকোচনের পথ ধরে সংকটাপন্ন গ্রিস ও আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা যায়নি। এখন অর্থমন্ত্রীকে বেছে নিতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির পথে চলবে, না কি সংকোচনের পথে।
দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপের মধ্যে ক্ষমতায় আসা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের এক নম্বর প্রতিশ্রুতিই ছিল চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখা। বলা হয়েছিল, দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুদদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। 'ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ' গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। ২০০৯-১০ সালের বাজেট বক্তৃতায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। তবে বিশ্বমন্দার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম কমে যাওয়ার সুফল এমনিতেই বাংলাদেশ পেয়েছিল। অনিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থাকে বাগে আনার জন্য প্রাইস কমিশন গঠন এবং প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়নের যে ঘোষণা বাজেটে তিনি দিয়েছিলেন, তিন বছরেও সেগুলোর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ হয়নি। কৃষকদের জন্য শস্যবীমা চালুর কথা থাকলেও তা হয়নি। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত করা যায়নি। সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা না বাড়ায় সরকার ধান কিনতে পারছে না। ফলে ভালো ফলন পেয়েও ধানের দাম পাচ্ছেন না কৃষক। পেঁয়াজ, হলুদ, আদা ও রসুনের ফলন বাড়িয়ে আমদানি ব্যয় কমিয়ে দিয়েছেন কৃষকরা। কেবল পেঁয়াজ আমদানি বাবদই কৃষকরা বাঁচিয়ে দিয়েছেন প্রায় ২৫ কোটি ডলার। যে পেঁয়াজের আমদানি দর গত বছরের শুরুতে টনপ্রতি ১২০০ ডলারে উঠেছিল, সে পেঁয়াজ টনপ্রতি দুই হাজার টাকায় বিক্রি করতেও কৃষকদের কষ্ট হয়েছে। দাম বাড়লে বাজারে হাহাকার পড়ে যায়। আর ফসল ফলিয়ে কৃষক দেখেন, বাজারে তাঁর পণ্যের চাহিদা নেই। একই অবস্থা হলুদ, রসুন, আদা ও আলুর ক্ষেত্রেও। ধান, পাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু কৃষিপণ্যের নূ্যনতম দাম নির্ধারণ করে দেওয়া ও এগুলোর আমদানি বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার জন্য সংরক্ষণ সুবিধা ও সমন্বিত বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার দাবিও জানান তাঁরা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত সার্বিক জ্বালানি নীতিমালা গ্রহণ করার কথাও ছিল ইশতেহারে। তিন বছর মেয়াদি ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়িত করার প্রতিশ্রুত দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তেল ও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান, উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা, জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে কয়লানীতি প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছিল। এসব প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন অর্থমন্ত্রীর পরপর তিনটি বাজেটেই ছিল। অনেক ক্ষেত্রে কাজ চললেও পুরোপুরি সুফল এখনো আসেনি।
নির্বাচনী ইশতেহার উদ্ধৃত করে নিজের প্রথম বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ২০১৩ সালে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ও ২০১৭ সালে ১০ শতাংশে উন্নীত করে ২০২১ সাল নাগাদ তা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১৩-১৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের অতিরিক্ত ২৮ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এ বিপুল পুঁজি জোগাড়ে সরকারের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এত ঋণ নেওয়া সম্ভব নয়। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও সহজ শর্তে এ ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই তিনি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে যৌথ বিনিয়োগে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন। পিপিপি খাতে বিনিয়োগের জন্য দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে একটি অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল গঠনের ঘোষণাও ছিল ২০০৯ সালের বাজেট বক্তৃতায়। এই পিপিপি নিয়ে ব্যক্তি খাতেও বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিন বছরেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এ বছর মাত্র একজন প্রধান নির্বাহী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ব্যাপারে এরপর অর্থমন্ত্রী আর উচ্চবাচ্য করেননি।
মাঠপর্যায়ের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে জেলা বাজেট চালুর ঘোষণা দিয়েও পরে সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন অর্থমন্ত্রী। আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য জেলাভিত্তিক বাজেট প্রণয়নের দাবি এখনো রয়েছে। কালের কণ্ঠের গোলটেবিল আলোচনায় বরিশাল বিভাগের ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজ এবারও জেলা বাজেটের দাবি জানিয়েছে।
২০০৯ সালের বাজেট বক্তৃতায় সড়ক, রেলপথ, জলপথ ও আকাশপথের সমন্বয়ে ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট পলিসি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে পিপিরি আওতায় বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণ, কর্ণফুলীর ওপর ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেইন সড়কের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথাও বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে অচলাবস্থার অবসান হয়নি। তিন হাজার ৬০১ কোটি টাকার রেলওয়ে সেক্টর ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা এগোয়নি।
পরপর তিনটি বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ও রূপকল্প-২০২১-এর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবারই নবায়ন করেছেন উন্নয়নের প্রাক্কলন। গত অর্থবছর থেকে যোগ হয়েছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। চলতি অর্থবছরের জন্য গত বছরের ৯ জুন তিনি দিয়েছিলেন পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা রক্ষার বাজেট। এর আগের দুই বছরের অর্জন হিসাব করে তিনি বলেছিলেন, 'কোনো কোনো কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং কোনো কোনো কার্যক্রম এখনো শুরু করতে পারিনি।' গত মাসে কালের কণ্ঠের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'বর্তমান সরকারের এটি শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। আমাদের যা করার তা এ বছরই করতে হবে। নতুন বাজেট হবে অঙ্গীকার পূরণের বাজেট।'
এবার অর্থমন্ত্রীর অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি এবং বাস্তবায়ন না করতে পারার স্বীকারোক্তি দেওয়ার সুযোগ কম। সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব প্রতিশ্রুতি গত সাড়ে তিন বছরে পূরণ করা যায়নি, এবারের বাজেটে এর শুরুটা অন্তত অর্থমন্ত্রী করতে পারেন। আগামী বছরের জুনে আরো একটি বাজেট দেওয়ার সুযোগ তাঁর থাকবে, যাতে পুরনো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ধারা তিনি বজায় রাখতে পারবেন। প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে নেওয়া, খাদ্য ও বিদ্যুতে উদ্বৃত্ত হওয়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, পদ্মা সেতু তৈরি, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি পূরণের দায় তখন বর্তাবে পরবর্তী সরকারের ওপর।
আজ বাজেট
অতীত অভিজ্ঞতা বলে, এ হিসাব মেলে না। এ দেশের কোনো সরকারই প্রতিবছর বাজেট ঘোষণায় যে জাতীয় হিসাব তুলে ধরে, তার সঙ্গে পরে আর মেলে না ব্যক্তিজীবনের আয়-ব্যয়ের হিসাব। বর্তমান সরকারও এ হিসাব মেলানোর প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, কিন্তু তা মেলেনি।
আজ বাজেট ঘোষণার পর সামষ্টিক অর্থনীতিবিদরা বলবেন সামষ্টিক অর্থনীতির কথা। প্রবৃদ্ধি, বাজেট ঘাটতি, মূল্যস্ফীতি, সরকারের ব্যাংক ঋণ, বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি বাস্তবায়নের হারের হ্রাস-বৃদ্ধি নিয়ে তাঁদের উদ্বেগ পুনর্ব্যক্ত করবেন। সমাজ ও উন্নয়নবিদরা বলবেন মানুষে মানুষে, অঞ্চলে অঞ্চলে সম্পদের সুষম বণ্টনের কথা। ব্যবসায়ীরা হিসাব করবেন শুল্ক-কর ছাড় দিয়ে বাজেটকে কতখানি বাণিজ্য ও বিনিয়োগ-বান্ধব করা হলো। কিন্তু জীবনযাত্রার লাগামহীন ব্যয় বৃদ্ধিতে নাকাল সাধারণ মানুষের চাওয়া থাকবে একটাই- নতুন অর্থবছরের জাতীয় বাজেট যেন নতুন করে তাদের পারিবারিক বাজেটের গরমিলটা আরো না বাড়ায়।
আন্তর্জাতিক একটি স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা উজ্জ্বল কুণ্ডু বলেন, বাজেটে সাধারণ মানুষের স্বার্থ প্রতিফলিত হয় না। এ খাতে এত বরাদ্দ, ওই খাতে এত বরাদ্দ দেওয়া হয়। এতে মানুষের কিছু যায়-আসে না। আগের বছর দেওয়া বরাদ্দের কতখানি খরচ হয়েছে, তাতে কি লাভ হয়েছে, না হলে কেন হয়নি- এসব ব্যাখ্যা যদি বাজেটে থাকত, তাহলেও কিছুটা কাজ হতো। মানুষের নিজের আয়-ব্যয়ের হিসাবই মিলছে না, সরকারের আয়-ব্যয়ের হিসাব শুনে তাদের কী হবে?
গবেষণা সংস্থা উন্নয়ন অন্বেষণের প্রধান ড. রাশেদ আল-মাহমুদ তিতুমীর বলেন, বাজেটে সাধারণ মানুষ দেখে কোন জিনিসের দাম বাড়ল, কোন জিনিসের কমল, তার জীবনযাত্রা সহজ হলো, না আরো জটিল হলো। তাদের কাছে বাজেটের আর বিশেষ কোনো অর্থ নেই। আর অর্থনীতির দৃষ্টিকোণ থেকে দেখতে গেলে এবারের বাজেট হবে আইএমএফের নজরদারিতে থাকা একটি রাজস্ব পরিকল্পনা, যাতে সংস্থাটির সংকোচনমুখী মুদ্রানীতি বাস্তবায়নের প্রয়াস থাকবে। তিনি বলেন, আইএমএফের প্রতিশ্রুত ১০০ কোটি ডলারের ঋণ পাওয়ার জন্য তাদের নির্দেশিত পথে চালানো হবে আর্থিক ব্যবস্থাপনা, এতে বিনিয়োগ ও অর্থনীতির স্বাভাবিক গতিধারা ব্যাহত হবে। আইএমএফ নির্দেশিত ব্যয় সংকোচনের পথ ধরে সংকটাপন্ন গ্রিস ও আয়ারল্যান্ডের অর্থনীতিকে পুনরুদ্ধার করা যায়নি। এখন অর্থমন্ত্রীকে বেছে নিতে হবে, বাংলাদেশের অর্থনীতি প্রবৃদ্ধির পথে চলবে, না কি সংকোচনের পথে।
দ্রব্যমূল্যের দুঃসহ চাপের মধ্যে ক্ষমতায় আসা বর্তমান আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারের এক নম্বর প্রতিশ্রুতিই ছিল চাল, ডাল, তেলসহ নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে জনগণের ক্রয়ক্ষমতার মধ্যে স্থিতিশীল রাখা। বলা হয়েছিল, দেশজ উৎপাদন বৃদ্ধিকে সর্বোচ্চ অগ্রাধিকার দিয়ে সময়মতো আমদানির সুবন্দোবস্ত, বাজার পর্যবেক্ষণসহ বহুমুখী ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। মজুদদারি ও মুনাফাখোরি সিন্ডিকেট ভেঙে দেওয়া হবে, চাঁদাবাজি বন্ধ করা হবে। 'ভোক্তাদের স্বার্থে ভোগ্যপণ্য মূল্য নিয়ন্ত্রণ কর্তৃপক্ষ' গড়ে তোলা হবে। সর্বোপরি সরবরাহ ও চাহিদার ভারসাম্য সৃষ্টি করে দ্রব্যমূল্য কমানো হবে এবং স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠা করা হবে।
অর্থমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিয়ে আবুল মাল আবদুল মুহিতও দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের প্রত্যয় ঘোষণা করেছিলেন। ২০০৯-১০ সালের বাজেট বক্তৃতায় দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ ও কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার ঘোষণা দিয়েছিলেন তিনি। তবে বিশ্বমন্দার কারণে আন্তর্জাতিক বাজারে জ্বালানি তেল ও খাদ্যপণ্যের দাম কমে যাওয়ার সুফল এমনিতেই বাংলাদেশ পেয়েছিল। অনিয়ন্ত্রিত বাজারব্যবস্থাকে বাগে আনার জন্য প্রাইস কমিশন গঠন এবং প্রতিযোগিতা আইন প্রণয়নের যে ঘোষণা বাজেটে তিনি দিয়েছিলেন, তিন বছরেও সেগুলোর বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ হয়নি। কৃষকদের জন্য শস্যবীমা চালুর কথা থাকলেও তা হয়নি। কৃষকদের উৎপাদিত পণ্যের ন্যায্যমূল্যও নিশ্চিত করা যায়নি। সরকারি গুদামের ধারণক্ষমতা না বাড়ায় সরকার ধান কিনতে পারছে না। ফলে ভালো ফলন পেয়েও ধানের দাম পাচ্ছেন না কৃষক। পেঁয়াজ, হলুদ, আদা ও রসুনের ফলন বাড়িয়ে আমদানি ব্যয় কমিয়ে দিয়েছেন কৃষকরা। কেবল পেঁয়াজ আমদানি বাবদই কৃষকরা বাঁচিয়ে দিয়েছেন প্রায় ২৫ কোটি ডলার। যে পেঁয়াজের আমদানি দর গত বছরের শুরুতে টনপ্রতি ১২০০ ডলারে উঠেছিল, সে পেঁয়াজ টনপ্রতি দুই হাজার টাকায় বিক্রি করতেও কৃষকদের কষ্ট হয়েছে। দাম বাড়লে বাজারে হাহাকার পড়ে যায়। আর ফসল ফলিয়ে কৃষক দেখেন, বাজারে তাঁর পণ্যের চাহিদা নেই। একই অবস্থা হলুদ, রসুন, আদা ও আলুর ক্ষেত্রেও। ধান, পাটের মতো গুরুত্বপূর্ণ আরো কিছু কৃষিপণ্যের নূ্যনতম দাম নির্ধারণ করে দেওয়া ও এগুলোর আমদানি বন্ধ করে দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছেন কৃষি অর্থনীতিবিদরা। একই সঙ্গে কৃষিপণ্যের ন্যায্য দাম নিশ্চিত করার জন্য সংরক্ষণ সুবিধা ও সমন্বিত বাজারজাতকরণ ব্যবস্থার দাবিও জানান তাঁরা।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি সমস্যা সমাধানে দীর্ঘমেয়াদি সমন্বিত সার্বিক জ্বালানি নীতিমালা গ্রহণ করার কথাও ছিল ইশতেহারে। তিন বছর মেয়াদি ক্র্যাশ প্রোগ্রামের আওতায় নতুন বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পাশাপাশি পুরনো বিদ্যুৎকেন্দ্র মেরামত ও রক্ষণাবেক্ষণ, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প বাস্তবায়িত করার প্রতিশ্রুত দিয়েছিল আওয়ামী লীগ। তেল ও নতুন গ্যাসক্ষেত্র অনুসন্ধান, উত্তর ও পশ্চিমাঞ্চলে গ্যাস সরবরাহের ব্যবস্থা, জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে কয়লানীতি প্রণয়ন করার কথা বলা হয়েছিল। এসব প্রতিশ্রুতির প্রতিফলন অর্থমন্ত্রীর পরপর তিনটি বাজেটেই ছিল। অনেক ক্ষেত্রে কাজ চললেও পুরোপুরি সুফল এখনো আসেনি।
নির্বাচনী ইশতেহার উদ্ধৃত করে নিজের প্রথম বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, ২০১৩ সালে জাতীয় আয়ের প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ ও ২০১৭ সালে ১০ শতাংশে উন্নীত করে ২০২১ সাল নাগাদ তা অব্যাহত রাখার লক্ষ্যমাত্রা রয়েছে। এ লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করতে হলে অবকাঠামো উন্নয়নে ২০১৩-১৪ সাল পর্যন্ত বিদ্যমান সরকারি-বেসরকারি বিনিয়োগের অতিরিক্ত ২৮ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন হবে। এ বিপুল পুঁজি জোগাড়ে সরকারের সীমাবদ্ধতা স্বীকার করে অর্থমন্ত্রী বলেছিলেন, অভ্যন্তরীণ উৎস থেকে এত ঋণ নেওয়া সম্ভব নয়। উন্নয়ন সহযোগীদের কাছ থেকেও সহজ শর্তে এ ঋণ পাওয়ার সম্ভাবনা নেই। তাই তিনি পাবলিক-প্রাইভেট পার্টনারশিপের (পিপিপি) মাধ্যমে যৌথ বিনিয়োগে এ ধরনের অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা ঘোষণা করেছিলেন। পিপিপি খাতে বিনিয়োগের জন্য দুই হাজার ১০০ কোটি টাকা বরাদ্দ দিয়ে একটি অবকাঠামো উন্নয়ন তহবিল গঠনের ঘোষণাও ছিল ২০০৯ সালের বাজেট বক্তৃতায়। এই পিপিপি নিয়ে ব্যক্তি খাতেও বেশ আগ্রহ তৈরি হয়েছিল। কিন্তু তিন বছরেও এ বিষয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি হয়নি। এ বছর মাত্র একজন প্রধান নির্বাহী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। ২৮ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের ব্যাপারে এরপর অর্থমন্ত্রী আর উচ্চবাচ্য করেননি।
মাঠপর্যায়ের জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে জেলা বাজেট চালুর ঘোষণা দিয়েও পরে সে অবস্থান থেকে সরে এসেছেন অর্থমন্ত্রী। আঞ্চলিক বৈষম্য দূর করার জন্য জেলাভিত্তিক বাজেট প্রণয়নের দাবি এখনো রয়েছে। কালের কণ্ঠের গোলটেবিল আলোচনায় বরিশাল বিভাগের ব্যবসায়ী ও নাগরিক সমাজ এবারও জেলা বাজেটের দাবি জানিয়েছে।
২০০৯ সালের বাজেট বক্তৃতায় সড়ক, রেলপথ, জলপথ ও আকাশপথের সমন্বয়ে ইন্টিগ্রেটেড মাল্টিমোডাল ট্রান্সপোর্ট পলিসি বাস্তবায়নের ঘোষণা দিয়েছিলেন অর্থমন্ত্রী। যোগাযোগব্যবস্থার উন্নয়নে পিপিরি আওতায় বেসরকারি খাতকে অন্তর্ভুক্ত করার কথা ছিল। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে মাওয়ায় পদ্মা সেতু নির্মাণ, কর্ণফুলীর ওপর ঝুলন্ত সেতু নির্মাণ ও ঢাকা-চট্টগ্রাম চার লেইন সড়কের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের কথাও বলেছিলেন অর্থমন্ত্রী। পদ্মা সেতুর অর্থায়ন নিয়ে অচলাবস্থার অবসান হয়নি। তিন হাজার ৬০১ কোটি টাকার রেলওয়ে সেক্টর ইমপ্রুভমেন্ট প্রজেক্ট বাস্তবায়নের কথা বলা হলেও বাস্তবে তা এগোয়নি।
পরপর তিনটি বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহার ও রূপকল্প-২০২১-এর উদ্ধৃতি দিয়ে প্রতিবারই নবায়ন করেছেন উন্নয়নের প্রাক্কলন। গত অর্থবছর থেকে যোগ হয়েছে ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা। চলতি অর্থবছরের জন্য গত বছরের ৯ জুন তিনি দিয়েছিলেন পরিকল্পনার ধারাবাহিকতা রক্ষার বাজেট। এর আগের দুই বছরের অর্জন হিসাব করে তিনি বলেছিলেন, 'কোনো কোনো কার্যক্রম চলমান রয়েছে এবং কোনো কোনো কার্যক্রম এখনো শুরু করতে পারিনি।' গত মাসে কালের কণ্ঠের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে অর্থমন্ত্রী বলেন, 'বর্তমান সরকারের এটি শেষ পূর্ণাঙ্গ বাজেট। আমাদের যা করার তা এ বছরই করতে হবে। নতুন বাজেট হবে অঙ্গীকার পূরণের বাজেট।'
এবার অর্থমন্ত্রীর অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির পুনরাবৃত্তি এবং বাস্তবায়ন না করতে পারার স্বীকারোক্তি দেওয়ার সুযোগ কম। সাধারণ মানুষের জীবনের সঙ্গে সম্পৃক্ত যেসব প্রতিশ্রুতি গত সাড়ে তিন বছরে পূরণ করা যায়নি, এবারের বাজেটে এর শুরুটা অন্তত অর্থমন্ত্রী করতে পারেন। আগামী বছরের জুনে আরো একটি বাজেট দেওয়ার সুযোগ তাঁর থাকবে, যাতে পুরনো প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ধারা তিনি বজায় রাখতে পারবেন। প্রবৃদ্ধি ১০ শতাংশে নেওয়া, খাদ্য ও বিদ্যুতে উদ্বৃত্ত হওয়া, ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়া, পদ্মা সেতু তৈরি, পারমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প বাস্তবায়ন করার প্রতিশ্রুতি পূরণের দায় তখন বর্তাবে পরবর্তী সরকারের ওপর।
আজ বাজেট
No comments