মত ও মন্তব্য-হারিয়ে যাওয়া ডলার, কুড়িয়ে পাওয়া তিন মানবতাবাদী by হারুন হাবীব

প্রীতিভাজন ডা. খালেদ শামসুল ইসলাম ডলার শেষ পর্যন্ত পৃথিবী থেকে বিদায় নিলেন। ঢাকা মহানগরীর সড়ক তাঁকে ছিনিয়ে নিল। আপাদমস্তক প্রগতিশীল এবং বিরল সাংগঠনিক ক্ষমতার অধিকারী ডা. ডলার মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক সংগঠন 'একাত্তরের যাত্রী'র প্রতিষ্ঠাতা সাধারণ সম্পাদক ছিলেন।


এই সহযাত্রীকে স্মরণ করতে ২ জুন জাতীয় জাদুঘরে একটি স্মরণসভার আয়োজন করা হয়েছিল। আমার লেখাটি একদিকে যেমন স্নেহাস্পদ ডা. ডলারের প্রতি আমার কষ্ট ও যন্ত্রণা লাঘবের ব্যর্থ চেষ্টা, একই সঙ্গে এই ঢাকা নগরীর তিন তরুণ-তরুণীর অনন্য মানবিকতা প্রদর্শনের প্রতি গভীর শ্রদ্ধা-ভালোবাসা জানানোর সামান্য আকুতি।
৪৬ বছর বয়স্ক ডা. ডলার আমাদের সড়ক হত্যাযজ্ঞের একমাত্র শিকার নন, সর্বশেষও নন। প্রতি দিনরাতে যন্ত্রদানবের গ্রাসে হারিয়ে যাচ্ছে মানুষ, অসংখ্য-অগণিত মানুষ, ধ্বংসপ্রাপ্ত হচ্ছে একের পর এক পরিবার। এ শোক যেন বাংলাদেশের বিধিলিপি! কোনোই প্রতিকার নেই, কোনোই শেষ নেই এ নির্মমতার! ঘর থেকে বেরিয়ে কেউ ঘরে ফিরবেন, নাকি লাশ হয়ে, ক্ষতবিক্ষত হয়ে হাসপাতালে মৃত্যুর সঙ্গে লড়বেন- কারো জানা নেই তা। এমন দুর্ভাগ্যজনক মৃত্যুর ঘটনা আর কোনো দেশে আছে কি না আমি জানি না।
আমার স্নেহধন্য ডা. ডলার কোনো এক যন্ত্রদানবের আঘাতে মিরপুরের কোনো এক সড়কে সংজ্ঞাহীন পড়ে ছিলেন। তা কতক্ষণ, কেউ আমরা জানি না। কত মানুষ, কত পথচারী ওঁর সংজ্ঞাহীন দেহটি পড়ে থাকতে দেখেছে, কেউ কষ্টে চোখ ফিরিয়ে নিয়েছে, কিন্তু কেউ সাহস করে এগিয়ে আসেনি। পাছে থানা-পুলিশের যন্ত্রণা সইতে হয়, মামলা-মোকদ্দমায় জড়াতে হয়। ব্রিটিশ আমলে তৈরি আইনটার আজও কোনো পরিবর্তন ঘটেনি। সাধারণ মানুষের ভয় যে খুব অসংগত- সেটিও তো নয়।
কিন্তু শত দ্বিধাদ্বন্দ্বের মধ্যেও মানবতার চিরন্তন আবেগ উপেক্ষা করতে পারেনি তিনজন নবপ্রজন্মের মানুষ। ওরা রিকশা দিয়ে যাচ্ছিল। হঠাৎ চোখে পড়ে অচেতন পড়ে আছে একজন মানুষ- কান ও নাক দিয়ে রক্ত ঝরছে। অসংখ্য পথচারী সে দৃশ্য দেখছে, কেউ সাহায্য করতে এগিয়ে আসছে না! কিন্তু ওরা তিনজন হৃদয়বিদারক সে দৃশ্য উপেক্ষা করতে পারেনি। মনুষ্যত্বের টানে রিকশা ছেড়ে দ্রুত ওরা অচেনা সংজ্ঞাহীন লোকটিকে মিরপুরের একটি হাসপাতালে নিয়ে যায়- যাতে ওঁর চিকিৎসা হয়, ওঁ বাঁচে।
না, আমাদের প্রিয় ডলারকে শেষ পর্যন্ত বাঁচানো যায়নি। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে ওঁর মাথায় অস্ত্রোপচার করা হয়েছে, এরপর উন্নত চিকিৎসার জন্য ওঁকে এ্যাপোলো হাসপাতালে নিয়েছে ওঁর পরিবার। সেখানেও অস্ত্রোপচার হয়েছে। লাখ লাখ টাকা দিতে হয়েছে হাসপাতালের বিল। কিন্তু বাঁচানো যায়নি ডলারকে। ৫ মে ডলার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন।
বলতে কী, একাত্তরের যাত্রী একদিকে যেমন প্রিয় সহযাত্রীর স্মৃতিতর্পণ করেছে, একই সঙ্গে খোঁজ করে বের করেছে সেই তিন মানবতাবাদী তরুণ-তরুণীকে- মাহমুদা আক্তার রোজী, মোস্তাক আহমেদ তুষার ও জান্নাতুল ফেরদৌস ববিকে। এই দুর্ভাগা দেশে যেখানে মনুষ্যত্বের বড়ই আকাল, যেখানে সুবচন, সভ্যতা ও সহজাত মানবিক আবেদন অবাধ্য নদীর ভাঙনের মতো প্রতিনিয়ত জনপদ গ্রাস করে, সেখানে এই তিন ছাত্রছাত্রীর অনন্যসাধারণ মানবিকতা আমাদের অনুপ্রাণিত করেছে। একাত্তরের যাত্রীর পক্ষ থেকে আমরা নবীন এই বন্ধুদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়েছি, সম্মাননা প্রদান করেছি। এ কারণে যে এতে যদি দুর্ভাগা এ সমাজের চোখ খোলে, লজ্জা হয়, হারানো মনুষ্যত্ব জাগ্রত হয়।
সেদিনের স্মরণসভাটি আমাদের সবাইকে অশ্রুসিক্ত করেছিল। সভাপতির আসনে থেকেও নিজেকে সংবরণ করতে ব্যর্থ হচ্ছিলাম আমি, যখন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল মান্নান, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সিনিয়র সভাপতি গোলাম কুদ্দুস, স্বাস্থ্য ও পরিবারকল্যাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব এস এম আশরাফুল ইসলাম, সাবেক অতিরিক্ত আইজিপি ও সংস্কৃতিকর্মী মালিক খসরু, একাত্তরের যাত্রীর অন্যতম কর্ণধার স্থপতি ও লেখক শামীম আমিনুর রহমান, জাতীয় জাদুঘরের উপ-পরিচালক ড. নীরু শামসুন্নাহার, ডা. মোসতাক আহমেদ ও প্রয়াত ডলারের ছোটবোন নাজনীন সুলতানা তাঁদের বক্তব্য রাখছিলেন।
একাত্তরের যাত্রীর পক্ষ থেকে আনুষ্ঠানিক একটি শোকগাথা পাঠ করতে হয়েছে আমাকে। এই শোকগাথায় সড়ক দুর্ঘটনায় হারিয়ে যাওয়া ডা. ডলারের মৃত্যু আমাদের কতটা শোকাচ্ছন্ন, বিধ্বস্ত এবং হতবিহ্বল করেছে- তা বর্ণনার চেষ্টা করেছি। আমরা আমাদের প্রিয় মুখোচ্ছবিটা কেবলই দেখার চেষ্টা করছি- দিনের ঢাকার সশব্দ যান্ত্রিকতায়, রাতের মহানগরীর ঝলমলে আলোতে, নীল আকাশ, চাঁদ ও তারার দিকে তাকিয়ে উড়ন্ত মেঘের পানে চোখ রেখে। না, আমাদের প্রিয় ডলার আর ফিরে আসবেন না।
একাত্তরের যাত্রী নামের যে সংগঠনকে আঁকড়ে ধরে আমরা গর্ববোধ করি, যে সংগঠন স্বল্পকালেই আলোচিত এক জাতীয় সাংস্কৃতিক সংগঠনের তালিকায় নাম তুলেছে, তার প্রাণপুরুষ ছিলেন হঠাৎ হারিয়ে যাওয়া কীর্তিমান এই মানুষটি। একাত্তরের যাত্রী গঠন করা হয়েছিল মহান মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আবিষ্কার ও এর অবিকৃত উপস্থাপন; নতুন প্রজন্মকে জননীজন্মভূমির প্রতি অকৃত্রিম ভালোবাসায় শাণিত করা। এ ছিল আমাদের মহত্তম অঙ্গীকার। এ অভিযাত্রায় সর্বাগ্রে ঝাণ্ডা হাতে তুলে নিয়েছিলেন ডা. ডলার- যাঁর মেধা, শ্রম ও ঘামে এ সংগঠন সুসংহত হয়েছে, বিকশিত হয়েছে। নির্দ্বিধায় বলতে পারি, ডা. ডলারের অকাল নিরুদ্দেশ যাত্রা আমাদের জাতীয় নবজাগৃতি ধারার এক বড় ক্ষতি। কারণ তাঁর জীবনের সবটুকু আবেগ, সবটুকু আকুতি দিয়ে বাঙালির শ্রেষ্ঠ অহংকার ধারণ করেছিলেন ডলার- এবং সে অহংকার ছড়িয়ে দিতে নিজেকে সর্বোত্তম নিবেদিত করেছিলেন স্বাধীনতা-উত্তর নতুন রণাঙ্গনের লড়াকু সৈনিক হিসেবে। বয়সের কারণে ডলার জাতির মহান মুক্তিযুদ্ধে অংশ নিতে পারেননি, কিন্তু নতুন প্রজন্মের সামনে জাতীয় অহংকার প্রতিস্থাপনের দুরূহ লড়াইয়ের সাহসী যোদ্ধা হিসেবে নিজেকে উৎসর্গিত করেছিলেন। স্বাধীনতার পরাজিত শত্রুদের হাতে বিকৃত, ক্ষতবিক্ষত, রাহুগ্রস্ত ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করা ছিল তাঁর জীবনের আরাধ্য। তাঁর স্মৃতি আমাদের কাছে দুর্দমনীয় শক্তি ও অহংকার।
মহান একাত্তরের নিখাদ চেতনায় সমুজ্জ্বল এই সহযাত্রীকে আমরা প্রতিশ্রুতি দিয়েছি- যত দিন বাঁচব তত দিন তাঁকে স্মরণ করব। ৩০ লাখ শহীদ, চার লাখ নারীর রক্তমাখা ইতিহাস স্মরণ করে, পাকিস্তানি হানাদার বাহিনী ও তাদের স্থানীয় দোসরদের নির্মমতা প্রতিহত করে বীর বাঙালির রক্ত-চৈতন্যের ভিত্তিভূমির ওপর দাঁড়ানো এই বাংলাদেশের শহর, বন্দর, গ্রাম ও গঞ্জের বাতাসে, ষড়ঋতুর আবাহনে ডা. খালেদ শামসুল ইসলাম ডলার নশ্বর দেহ ধারণ করেও অবিনশ্বর। না, এ আমাদের আবেগ নয়, হৃদয়ের উপলব্ধি।
বিস্ময়ের ব্যাপার হলো- বেপরোয়া এসব চালকের তেমন কোনো শাস্তি নেই, হলেও তা কতটা কার্যকর হয়, সেটিও সবার জানা। নন্দিত চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চন 'নিরাপদ সড়ক চাই' আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁর প্রাণপ্রিয় স্ত্রী মারা গেছেন এই সড়ক দুর্ঘটনায়। তাঁর জানা মতে, একজন ড্রাইভারকেও এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য গুরুদণ্ড দেওয়া হয়নি গেল দুই দশকে। এটি যদি আইনি দুর্বলতা হয়, তাহলে সে আইন কেন আছে? কেন এর পরিবর্তন নেই? এ প্রশ্ন কার কাছে করব?
এর আগে হারিয়ে গেলেন নন্দিত চলচ্চিত্রকার তারেক মাসুদ ও মিশুক মুনীর। চলে গেলেন আমারই কয়েকজন তরুণ সাংবাদিক বন্ধু। অগণিত, অসংখ্য মৃত্যু! কোনো বিচার নেই, প্রতিকার নেই! এ ভয়ংকর বর্বরতা কোনো সভ্য সমাজ মানতে পারে? নাকি মানা সম্ভব?

লেখক : মুক্তিযোদ্ধা, কথাশিল্পী ও সাংবাদিক
e-mail : hh1971@gmail.com

No comments

Powered by Blogger.