‘হামলার জন্য তাজউদ্দিন ১৫টি গ্রেনেড দেন’

২০০৪ সালের ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় প্রধান অভিযুক্ত জঙ্গি সংগঠন হরকাতুল জিহাদের নেতা মুফতি আবদুল হান্নান। তিনি ২০০৭ সালের ১ নভেম্বর এই ঘটনায় দোষ স্বীকার করে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে যে জবানবন্দি দিয়েছেন, তা তুলে ধরা হলো:


আমি স্বেচ্ছায় দোষ স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি করছি যে, আমি ১৯৭৯ সালে গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসা থেকে কোরআন হেফ্জ শেষ করি। একই বছর বরিশাল জেলার শর্শিনা মাদ্রাসায় ছয় মাস পর্যন্ত পড়াশোনা করি। তারপর একই বছর আমি ভারতের দারুল উলুম দেওবন্দ মাদ্রাসায় ভর্তি হয়ে ১৯৮৭ সাল পর্যন্ত পড়াশোনা করি এবং টাইটেল পাস করি। এরপর একই সময়ে আলীগড় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামিক স্টাডিজ বিষয়ে এমএ সম্পন্ন করি। ওই বছরই আমি দেশে ফিরি। একই বছর পাকিস্তানের করাচির জামেয়া বিন নূরিয়া কওমি মাদ্রাসা থেকে মুফতি কোর্স সম্পন্ন করি। ওই বছরই রমজানের ছুটিতে রাশিয়ার বিরুদ্ধে মুজাহিদদের পক্ষে আফগানিস্তানের খোস্ত শহরে প্রথমে ১৫ দিনের প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি এবং ১৫ দিন যুদ্ধে অংশগ্রহণকালে আমার বাঁ হাতে মিসাইলের আঘাতে গুরুতর জখমপ্রাপ্ত হই। ওই অবস্থায় আমাকে পেশোয়ারে কুয়েত আল হেলাল হাসপাতালে চিকিত্সা করানো হয়। চিকিত্সা শেষে আবার করাচি গিয়ে আমি আমার শিক্ষা কোর্স সম্পন্ন করি। ১৯৯২ সালের ডিসেম্বরে আমি দেশে ফিরি এবং কোটালীপাড়ায় আদর্শ ক্যাডেট মাদ্রাসা স্থাপন করি। একই সঙ্গে আল ফারুক ইসলামিক ফাউন্ডেশন নামে একটি জনসেবামূলক এনজিও প্রতিষ্ঠা করি। ১৯৯৪ সালে হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামের আমির মুফতি শফিকুর রহমান, সেক্রেটারি মুফতি আবদুল হাই ও আবদুর রউফ গওহরডাঙ্গা মাদ্রাসায় আসেন। তাঁরা সাংগঠনিক সভা করেন। সেখানে আমাকেও ডাকেন। তখন তাঁরা একটি জেলা কমিটি গঠন করেন। আমাকে থানা কমিটির প্রচার সম্পাদক করা হয়।
এরপর ২০০০ সালে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকাকালে কোটালীপাড়ার কলেজ ময়দানে ২১ জুলাই এক জনসভার জন্য দিন ধার্য ছিল। কিন্তু ১৯ ও ২২ জুলাই দুটি ড্রামভর্তি তথাকথিত বিস্ফোরক দ্রব্য পাওয়া যায়, যাতে কোনো ডেটোনেটর ছিল না। যার একটি ৭৬ কেজি এবং দ্বিতীয়টি ৮২ কেজি ওজনের। এ সময় আমাকেসহ আরও ৩০০ লোকের বিরুদ্ধে প্রাথমিক মামলা করা হয়। আমার চার ভাই, চার ভগ্নিপতি ও চার বোনকে তখন গ্রেপ্তার করে ১২ মাস হাজতে রাখা হয়। সে কারণে আমি গা ঢাকা দিয়ে ঢাকার বাড্ডার আনন্দনগরে প্রকৌশলীর বাড়ির চতুর্থ তলায় বাসা ভাড়া নিই। এরপর আহসান উল্লাহ কাজল হরকাতুল জিহাদের ঢাকা মহানগরের সাংগঠনিক সম্পাদক হিসেবে ডিআইটিতে কর্নেল সাহেবের চারতলা বাড়ির তৃতীয় তলা ভাড়া নেন। সেখানে মাওলানা মোসাদ্দেক বিল্লাহ একটি মক্তব পরিচালনা করতেন। তাঁরই একটি কক্ষে আহসান উল্লাহ সাংগঠনিক কাজ করতেন। পরবর্তী সময়ে পশ্চিম মেরুলে আহসান উল্লাহ একটি বাসা ভাড়া নেন। সেখানে লিটন, হাসান, ওমর ফারুক, আবু বকর যাতায়াত করতেন। এরপর শায়খুল হাদিস আল্লামা আজিজুল হকসহ ৩০০ ওলামাকে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রী থাকা অবস্থায় গ্রেপ্তার করা হয়। বিভিন্ন সময়ে আলেমদের হয়রানি করা হয় এবং ফতোয়া নিষিদ্ধ বলে ঘোষণা করা হয়। এ কারণে মাওলানা আবু তাহের, যিনি হরকাতুল জিহাদ আল ইসলামের ঢাকা মহানগরের সভাপতি; তাঁর ঢাকা মহানগরের অফিস মোহাম্মদপুর সুপার মার্কেটের কাছে নিচতলায় একটি ভাড়া বাড়িতে ২০০৪ সালের ১৮ আগস্ট আমাকে ও আহসান উল্লাহকে সাক্ষাৎ করতে বলেন। আমরা সেখানে গিয়ে সকাল ১০টায় সাক্ষাৎ করি। তখন তিনি আমাকে বলেন, আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে পরামর্শ করেছি এবং আবদুস সালাম পিন্টুর (তত্কালীন উপমন্ত্রী) সঙ্গে আমরা বৈঠক করেছি, যাতে ২১ আগস্ট শেখ হাসিনার জনসভায় হামলা করে তাঁকে মেরে ফেলার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। এরপর আমাকে ও আহসান উল্লাহ কাজলকে আবদুস সালাম পিন্টুর ধানমন্ডির লেকপাড়ের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয়। সেই বাসায় ঢুকে বাঁ পাশের একটি কক্ষে আমাদের বসতে দেওয়া হয়। প্রথমে তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিনের সঙ্গে আমাদের দেখা হয় এবং আমাদের জন্য নাশতার ব্যবস্থা করা হয়। এরপর আবদুস সালাম পিন্টু সেখানে উপস্থিত হন। মাওলানা আবু তাহের তখন আমাকে ও কাজলকে পরিচয় করান। কুশল বিনিময়ের পর তিনি বলেন, আমি গোপালগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত মন্ত্রী হওয়া সত্ত্বেও আমাকে সেখানে মিটিংয়ে আসতে দেওয়া হয়নি। বিভিন্ন সময়ে আলেমদের হয়রানিমূলক জেলে দেওয়া হয়েছে এবং কুকুরের মাথায় টুপি পরানো হয়েছে। শেখ হাসিনা জীবিত থাকলে এ দেশের মুসলমানদের ও সাধারণ জনগণের শান্তি আসবে না। তাই ২১ আগস্টের জনসভা সম্পর্কে যে সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে, সে অনুযায়ী শেখ হাসিনাকে হত্যা না করা পর্যন্ত শান্তি হবে না। এ বিষয়ে যা কিছু প্রয়োজন, সবকিছুর ব্যবস্থা আমি আবু তাহেরের মাধ্যমে করব। তখন তিনি আমাদের সামনে আবু তাহেরকে উপরিউক্ত বিষয়ে জনশক্তি এবং অর্থসংস্থানের আশ্বাস দেন। যেকোনো ধরনের সমস্যার যথাযথ ও প্রশাসনিক সহায়তার ব্যবস্থা তিনি করবেন বলে তখন আশ্বাস দেন।
এরপর আমি ও আহসান উল্লাহ কাজল সেখান থেকে চলে যাই। মাওলানা তাহের পরদিন আহসান উল্লাহ ও আবু জান্দালকে মিরপুর ১ নম্বর পানির ট্যাংকের কাছে মসজিদে আকবর কমপ্লেক্সে যেতে বলেন। সেখানে আবদুস সালাম পিন্টু তাঁর সার্বিক কার্যক্রমের সিদ্ধান্ত ও করণীয় কাজের ধরন বর্ণনার পর আবু জান্দাল ও কাজলকে নির্দেশনা দেন এবং জনসভাস্থলে যাঁরা হামলার দায়িত্ব পালন করবেন, তাঁদের নামের তালিকা দেন। এরপর ২০ আগস্ট তাঁদের পিন্টু সাহেবের বাসায় যেতে বলেন। সে অনুযায়ী ২০ তারিখ বেলা ১১টার দিকে জান্দাল ও কাজল পিন্টু সাহেবের বাসায় যান। তখন আবদুস সালাম পিন্টু ও তাঁর ভাই মাওলানা তাজউদ্দিন মাওলানা তাহেরের উপস্থিতিতে হামলার জন্য ১৫টি গ্রেনেড জান্দাল ও কাজলকে দেন এবং আবু তাহের খরচ বাবদ জান্দাল ও কাজলকে দুই হাজার টাকা দেন। তখন আবু তাহের বলেন, তিনি ২১ আগস্ট সকালে বাড্ডার অফিসে আসবেন। বাকি সিদ্ধান্ত তখন সেখানে অর্থাৎ বাড্ডায় গ্রহণ করা হবে। আমি আহসান উল্লাহ কাজলের কাছ থেকে জানি, আবদুস সালাম পিন্টু শেখ হাসিনার ২১ তারিখের জনসভায় হামলার জন্য ছয়জন লোক দেবেন। তখন পিন্টু কাজলকে ওই ছয়জনের একজনের সঙ্গে পরিচয় করান। এরপর আহসান উল্লাহ কাজল ও মাওলানা আবু তাহেরের তালিকা অনুযায়ী সবাইকে মোবাইল ফোনের মাধ্যমে সংবাদ দেওয়া হয়। পরে ২১ তারিখ সকাল আটটার আগে-পরে হামলার জন্য ধার্য করা অধিকাংশ লোক বাড্ডার বাসায় (কাজলের বাসায়) উপস্থিত হন এবং সেখানে আবু তাহেরও হাজির হন। পরে আমি, তাহের ও কাজল বলি যে, যাঁদের দাড়ি আছে, তাঁরা হামলায় যেতে পারবেন না। তাহের সাহেবের নির্দেশে আমি এই মত বলেছি। তালিকামতে তখন আহসান উল্লাহ কাজল, আবু জান্দাল (নড়াইল), হাসান (মোহাম্মদপুর, ঢাকা), আবু বকর (ফরিদপুর), জুয়েল (নারায়ণগঞ্জ), ফেরদৌস (মিরপুর), রতন (ঝিনাইদহ), মাসুদ (ঝিনাইদহ), আবুল কালাম আজাদ বুলবুল (রাজশাহী), ইকবাল (ঝিনাইদহ), জাহাঙ্গীরকে (কুষ্টিয়া) হামলার দায়িত্ব দেওয়া হয়। ওই তালিকার বাইরে আমি কিছু লোককে আসতে বলি। কিন্তু তাঁরা আসেননি। এ ছাড়া আরও কিছু সাংগঠনিক সদস্য তখন বাড্ডার ওই অফিসে উপস্থিত হন। তাঁদের নিয়ে তখন বিভিন্ন আলোচনা হয়। এরপর তালিকাভুক্ত হামলাকারীদের জনসভার অবস্থা ও ফিল্ডের পরিস্থিতি বুঝে এবং গোলাপ শাহ মাজার মসজিদে অবস্থানকারী অপর ছয়জনের সঙ্গে পর্যায়ক্রমে অপারেশন চালানোর জন্য আদেশ দেওয়া হয়। ওই আদেশ আবু তাহের দিয়েছেন। এরপর তাঁদের ১৫টি গ্রেনেড বুঝিয়ে দেওয়া হয়। জোহরের নামাজের আগে সবাই কাজলের বাসায় খাওয়া-দাওয়া শেষ করেন এবং দ্রুত নামাজ আদায় করেন। এর পরপরই সবাই জনসভার উদ্দেশে রওনা হন। ঘটনার পর আহসান উল্লাহ কাজল আমাকে মোবাইলে ফোন করেন এবং বলেন, কাজ হয়েছে। কাজ শেষে যে যাঁর গন্তব্যে চলে গেছেন। সেদিন আর কারও সঙ্গে আমাদের দেখা হয়নি। ওই গ্রেনেড হামলার দু-তিন দিন পর বাদ জোহর মাওলানা আবু সাঈদ মধ্য বাড্ডার মেফতাহুল উলুম মাদ্রাসায় আসেন। ওই সংবাদ পেয়ে আমি মাদ্রাসায় যাই। পরে আমাকে জিজ্ঞাসা করা হয়, ঘটনা কীভাবে এলোমেলো হয়েছে? আমি তখন বলেছি, আমাকে কেন এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেন। আবু তাহের, আবু জান্দাল, আহসান উল্লাহ কাজল তা জানেন।
ওই গ্রেনেড হামলা ঘটনার বিষয়ে মূল পরিকল্পনাকারী মাওলানা আবু তাহের ও আবদুস সালাম পিন্টু এবং কেন্দ্রীয় কমিটির সিদ্ধান্ত অনুযায়ী আমাকে জড়িত করা হয়েছে এবং সে অনুযায়ী আমি সার্বিক কার্যক্রমে অংশ নিয়েছি। এই আমার বক্তব্য।

No comments

Powered by Blogger.