ফিরে দেখা-৭ জুন যেভাবে জড়িয়ে আছে সত্তায় by মেসবাহউদ্দীন আহমেদ
৭ জুন শিল্পাঞ্চলগুলোতেই হরতাল সফল হয়। '৬৯-এর গণআন্দোলন, '৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিক-কর্মচারীদের অংশগ্রহণের বীজ মূলত এ সময় এভাবেই বপন হয়ে যায়। ইতিপূর্বে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ এত অধিক ছিল না
৭ জুন_ কত কী মনে পড়িয়ে দিতে থাকে একসঙ্গে! মনে পড়তে থাকে ১৯৬৬'র তুমুল রাজনৈতিক আলোড়নের দিনগুলোকে, সেসব দিনের অস্থিরতা, তপ্ততা ও অনিশ্চয়তাকে। ৬ দফা দাবি আদায়ের সংগ্রামের সূচনাতেই বঙ্গবন্ধু তার সহকর্মীদেরসহ গ্রেফতার হন, ক্রমে ধীরে ধীরে আন্দোলনে ভাটা পড়া ধরে। কিন্তু নিঃশব্দে ছড়িয়ে পড়তে থাকে ত্রাস, ভয়ভীতি চারদিকে। উদ্বেগ-আশঙ্কা সকলের মনে। আওয়ামী নেতাকর্মীদের অনেকে এখানে-ওখানে সরে থাকে গ্রেফতারের ভয়ে। অনেকে পত্রিকায় বিবৃতি দিয়ে দল ত্যাগ করে। পাকিস্তানের গোয়েন্দা বিভাগ ও পুলিশ তখন আন্দোলন দমন করার জন্য সক্রিয়। সভা করার অনুমতি সহজে পাওয়া যায় না। মিছিল ছত্রখান করে দেওয়ার জন্য পুলিশ সদা তৎপর। অগত্যা উপায় না দেখেই ৭ জুন হরতাল ডাকে আওয়ামী লীগ।
জনসমর্থন থাকলেও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি তখন '৬৯-এর পরবর্তীকালের মতো শক্তিশালী ছিল না। ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ওপর দল ছিল অনেকখানি নির্ভরশীল। দীর্ঘকাল সামরিক শাসনের ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক অবস্থা ভালো থাকার কথা নয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ কিছুটা নেতৃত্বশূন্যও হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা আতাউর রহমান খান তখন আওয়ামী রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। ৬ দফার বিষয়েও আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে বিরোধ ছিল। আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতা যেমন অ্যাডভোকেট জহিরউদ্দিন, আবদুস সালাম খান ৬ দফা সমর্থন করেননি। এই ঢাকা শহরেই দু'একটি ছাড়া কোনো ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কমিটি ছিল না। কারাগারের বাইরে অবস্থানরত নেতাদের মধ্যে সক্রিয় ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, আমেনা বেগম, আবদুল মান্নান, মোল্লা জালালউদ্দিন, ময়েজউদ্দিন আহমেদসহ কতিপয় নেতা। ঢাকা শহরে তখন সক্রিয় ছিলেন গাজী গোলাম মোস্তফা, আনোয়ার চৌধুরী, কমলাপুরের সফি প্রমুখ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সভায় তখন কোরাম হওয়াই কঠিন ছিল। ভয়ে অনেকে আসতেন না। ১৫/ক পুরানা পল্টনের ক্ষুদ্র তিন রুমের কার্যালয় প্রায় ফাঁকা থাকত।
১৯৬৬'র ৭ জুন হরতাল পালন করার জন্য ছাত্রলীগ নিতে থাকে প্রস্তুতি। দুই সপ্তাহ আগে থেকেই প্রতিদিন ঢাকা শহরে খণ্ড খণ্ড মিছিল করে ছাত্রলীগ। প্রধানত জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের ষাট-সত্তরজন ছাত্র থাকত এসব মিছিলে। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক শক্তি তখন যেমন ছিল দুর্বল, তেমনি ছিল গ্রেফতার হওয়ার ভীতি ও উদ্বেগ। ছাত্র ইউনিয়ন তখন বরং অনেক সক্রিয় ও শক্তিশালী, অনেক দৃপ্ত ও অগ্রসর। হরতাল সফল করার জন্য শিল্পাঞ্চলগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়। এগিয়ে আসেন সিরাজুল আলম খান।
এখনকার মতো তখন কোনো রাজনৈতিক দলের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ছিল না। এসব শিল্পাঞ্চলের ট্রেড ইউনিয়নগুলো মজদুর ফেডারেশন, পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার বা চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে ৬ দফার বিষয়ে কয়েক দফা বৈঠক করছিলেন। ১৯৬৬ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ নেতা ও তেজগাঁও কেমিক্যালসের মালিক সাহাবুদ্দীন চৌধুরীর ফ্যাক্টরিতে বঙ্গবন্ধু নিজে শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন ভুঁইয়া, আনোয়ার হোসেন, সাহাবুদ্দীনের (শ্রমিক নেতা) সঙ্গে একটি বৈঠক করেছিলেন।
টঙ্গী শিল্পাঞ্চলের নেতা তখন শফিকুর রহমান মজুমদার ও কাজী জাফর। সে সময় তারা ভাসানীপন্থি ন্যাপের শীর্ষ নেতা। সেখানকার টেক্সটাইল মিলসহ বড় বড় শিল্পের শ্রমিক ইউনিয়ন তখন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক কারণেই তারা ৬ দফা আন্দোলনের বিরোধী। সেখানে ৬ দফার পক্ষে শ্রমিকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন রুহুল আমিন ভুঁইয়া। তার সমর্থক কিছু ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠক সেখানে ছিল। টঙ্গীর নিশাত জুট মিলের শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের রুহুল আমিন ভুঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। শিল্পাঞ্চলগুলোতে হরতাল সফল করার জন্য গোপন বৈঠক চলেছে নিয়মিত। ছাত্রলীগ নেতারাও বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন।
৫ জুন বিকেলে শ্রমিক নেতা সাহাবুদ্দীন, সিদ্দিক দর্জি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং হরতালের দিনে ছাত্রনেতাদের সাহায্য চান। ৬ জুন আবদুর রাজ্জাক, নুর আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায় পিয়ার আলী দর্জির বাসায় টঙ্গীর নিশাত জুট মিলের মান্নান, তেজগাঁওয়ের সিদ্দিক দর্জি, আবুল খায়ের, আনোয়ার হোসেনসহ কিছু নেতার সঙ্গে হরতালের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেন। ৭ জুন তেজগাঁওয়ে পূর্ণাঙ্গ শ্রমিক ধর্মঘট হয়। আদমজী ও পোস্তগোলায় আংশিক ধর্মঘট হয়। আদমজীতে শ্রমিকরা মিছিল করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।
তেজগাঁওয়ে ৭ জুন সকালে রেল যোগাযোগ বন্ধ করার জন্য ভাওয়ালবাগে কাঠের গুঁড়ি ফেলে শ্রমিকরা বাধার সৃষ্টি করেন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জিআরপি পুলিশ কাঠের গুঁড়ি তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকরা বাধা দেয়। পুলিশ গুলি চালালে সেভেনআপের (তাবানী বেভারেজ) শ্রমিক নেতা মনু মিয়া ও আজাদ অ্যালুমিনিয়ামের চাকরিচ্যুত শ্রমিক আবুল হোসেন নিহত হন। শ্রমিক নিহত হওয়ার খবর শুনে হাজার হাজার শ্রমিক তেজগাঁও লেবার ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে জমায়েত হন। সেখান থেকে দশ-বারো হাজার শ্রমিকের মিছিল রুহুল আমিন ভুঁইয়ার নেতৃত্বে ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে রওনা হয়। জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়া ঢাকা শহরে হরতাল সেদিন তেমন সফল হয়নি। তেজগাঁওয়ের এই মিছিলে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতেই সেসব স্থানে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা হাইকোর্টের কাছে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ইপিআর মিছিলকে বাধা দেয়, মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন ভুঁইয়াকে পুলিশ ১৭ জুন গ্রেফতার করে এবং তার ওপর প্রায় ৩৭টি মামলা দেওয়া হয়।
পোস্তগোলা শিল্পাঞ্চলের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। আমি তখন জগন্নাথ কলেজে পড়ি। সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে আমাকে যোগাযোগ রাখতে হয় পোস্তগোলায় শ্রমিকদের সঙ্গে। তাছাড়া ওখানকারই বাহাদুরপুর লেনে অবস্থিত চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যালয়ে চটকল শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে যেতে থাকি আমি। তাদের সংগঠিত করে তুলি হরতাল সফল করার জন্য। কিন্তু পোস্তগোলা ও শ্যামপুর শিল্পাঞ্চলের কোনো সিবিএ আমাদের সমর্থন করেনি।
৭ জুন সন্ধ্যার দিকে পুলিশ আমাকে সূত্রাপুর থানা থেকে রমনা থানায় নিয়ে যায়। ধর্মঘটে কয়েকশ' গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে দুটি ছোট্ট লকআপে রাখা হয়। সেখানে প্রায় পাঁচশ' লোককে এনে রাখা হয়। সেখানেই কোর্ট বসে, বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট উর্দুভাষী হাফিজ সাহেব। সামারি ট্রায়ালের পর গভীর রাতে গ্রেফতারকৃতদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সামারি ট্রায়ালে পুলিশ কর্মকর্তারা বন্দিদের বলে, দোষ স্বীকার করলে কম জেল, না করলে বেশি সময়ের কারাদণ্ড হবে। শাস্তি যেন কম হয় সে কারণে অধিকাংশ বন্দি দোষ স্বীকার করে। আমার নিজেকে দোষী বলে মনে হয়নি, মনে আসেনি রেহাই পাওয়ার কোনো কাতরতা। আমি দোষ স্বীকার করিনি। জেলে অধিকাংশই হয়ে যায় কয়েদি। সেদিন গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং বাংলাদেশ বিমানের সাবেক চেয়ারম্যান তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আল আমীন চৌধুরী।
৭ জুন শিল্পাঞ্চলগুলোতেই হরতাল সফল হয়। '৬৯-এর গণআন্দোলন, '৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিক-কর্মচারীদের অংশগ্রহণের বীজ মূলত এ সময় এভাবেই বপন হয়ে যায়। ইতিপূর্বে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ এত অধিক ছিল না। সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে আমরা ঢাকা নগরের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে ছাত্রলীগ সংগঠিত করতে থাকি, সেভাবেই রুহুল আমিন ভুঁইয়ার অবর্তমানে তেজগাঁওয়ে যোগাযোগ রক্ষা করা, সরাসরি পোস্তগোলা-শ্যামপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকি। স্বাধীন বাংলার নিউক্লিয়াসের একটি সংগঠন পাঠচক্র গড়ে তুলি। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আমিনুল হক বাদশা ও আওয়ামী লীগ নেতা মুন্সীগঞ্জের আবদুল হাই ও অন্যরা। '৬৯-এর গণআন্দোলনের পর বন্দি নেতারা বের হয়ে আসেন, নতুন অনেক লোকও আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অনেকেই যোগ দেয় ভোল পাল্টিয়ে বন্যায় ভাসমান শেওলা ও আবর্জনার মতো। আবার অনেকে যোগ দেয় বেগবান প্রবাহকে এগিয়ে নিতে।
মেসবাহউদ্দীন আহমেদ : জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি ও অঙ্কুর প্রকাশনীর পরিচালক
জনসমর্থন থাকলেও আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক ভিত্তি তখন '৬৯-এর পরবর্তীকালের মতো শক্তিশালী ছিল না। ছাত্র সংগঠন ছাত্রলীগের ওপর দল ছিল অনেকখানি নির্ভরশীল। দীর্ঘকাল সামরিক শাসনের ফলে রাজনৈতিক দলগুলোর সাংগঠনিক অবস্থা ভালো থাকার কথা নয়। হোসেন শহীদ সোহরাওয়ার্দীর মৃত্যুর পর আওয়ামী লীগ কিছুটা নেতৃত্বশূন্যও হয়ে পড়ে। আওয়ামী লীগের অন্যতম শীর্ষ নেতা আতাউর রহমান খান তখন আওয়ামী রাজনীতি থেকে অনেক দূরে। ৬ দফার বিষয়েও আওয়ামী লীগ নেতাদের মধ্যে বিরোধ ছিল। আওয়ামী লীগের অনেক বড় বড় নেতা যেমন অ্যাডভোকেট জহিরউদ্দিন, আবদুস সালাম খান ৬ দফা সমর্থন করেননি। এই ঢাকা শহরেই দু'একটি ছাড়া কোনো ওয়ার্ডে আওয়ামী লীগের কমিটি ছিল না। কারাগারের বাইরে অবস্থানরত নেতাদের মধ্যে সক্রিয় ছিলেন মিজানুর রহমান চৌধুরী, আমেনা বেগম, আবদুল মান্নান, মোল্লা জালালউদ্দিন, ময়েজউদ্দিন আহমেদসহ কতিপয় নেতা। ঢাকা শহরে তখন সক্রিয় ছিলেন গাজী গোলাম মোস্তফা, আনোয়ার চৌধুরী, কমলাপুরের সফি প্রমুখ। আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় কার্যকরী কমিটির সভায় তখন কোরাম হওয়াই কঠিন ছিল। ভয়ে অনেকে আসতেন না। ১৫/ক পুরানা পল্টনের ক্ষুদ্র তিন রুমের কার্যালয় প্রায় ফাঁকা থাকত।
১৯৬৬'র ৭ জুন হরতাল পালন করার জন্য ছাত্রলীগ নিতে থাকে প্রস্তুতি। দুই সপ্তাহ আগে থেকেই প্রতিদিন ঢাকা শহরে খণ্ড খণ্ড মিছিল করে ছাত্রলীগ। প্রধানত জগন্নাথ কলেজ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও ঢাকা কলেজের ষাট-সত্তরজন ছাত্র থাকত এসব মিছিলে। ছাত্রলীগের সাংগঠনিক শক্তি তখন যেমন ছিল দুর্বল, তেমনি ছিল গ্রেফতার হওয়ার ভীতি ও উদ্বেগ। ছাত্র ইউনিয়ন তখন বরং অনেক সক্রিয় ও শক্তিশালী, অনেক দৃপ্ত ও অগ্রসর। হরতাল সফল করার জন্য শিল্পাঞ্চলগুলোকেও অন্তর্ভুক্ত করার পরিকল্পনা ও উদ্যোগ নেওয়া হয়। এগিয়ে আসেন সিরাজুল আলম খান।
এখনকার মতো তখন কোনো রাজনৈতিক দলের ট্রেড ইউনিয়ন সংগঠন ছিল না। এসব শিল্পাঞ্চলের ট্রেড ইউনিয়নগুলো মজদুর ফেডারেশন, পাকিস্তান ফেডারেশন অব লেবার বা চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ছিল। বঙ্গবন্ধু গ্রেফতার হওয়ার আগে শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে ৬ দফার বিষয়ে কয়েক দফা বৈঠক করছিলেন। ১৯৬৬ সালের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগ নেতা ও তেজগাঁও কেমিক্যালসের মালিক সাহাবুদ্দীন চৌধুরীর ফ্যাক্টরিতে বঙ্গবন্ধু নিজে শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন ভুঁইয়া, আনোয়ার হোসেন, সাহাবুদ্দীনের (শ্রমিক নেতা) সঙ্গে একটি বৈঠক করেছিলেন।
টঙ্গী শিল্পাঞ্চলের নেতা তখন শফিকুর রহমান মজুমদার ও কাজী জাফর। সে সময় তারা ভাসানীপন্থি ন্যাপের শীর্ষ নেতা। সেখানকার টেক্সটাইল মিলসহ বড় বড় শিল্পের শ্রমিক ইউনিয়ন তখন পূর্ব পাকিস্তান শ্রমিক ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত। রাজনৈতিক কারণেই তারা ৬ দফা আন্দোলনের বিরোধী। সেখানে ৬ দফার পক্ষে শ্রমিকদের সংগঠিত করার দায়িত্ব নেন রুহুল আমিন ভুঁইয়া। তার সমর্থক কিছু ট্রেড ইউনিয়নের সংগঠক সেখানে ছিল। টঙ্গীর নিশাত জুট মিলের শ্রমিক নেতা আবদুল মান্নান তেজগাঁও শিল্পাঞ্চলের রুহুল আমিন ভুঁইয়ার সঙ্গে যোগাযোগ করতেন। শিল্পাঞ্চলগুলোতে হরতাল সফল করার জন্য গোপন বৈঠক চলেছে নিয়মিত। ছাত্রলীগ নেতারাও বিভিন্ন শিল্পাঞ্চলে দায়িত্ব নিয়ে কাজ করেন।
৫ জুন বিকেলে শ্রমিক নেতা সাহাবুদ্দীন, সিদ্দিক দর্জি প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের একটি হলে সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে আলোচনা করেন এবং হরতালের দিনে ছাত্রনেতাদের সাহায্য চান। ৬ জুন আবদুর রাজ্জাক, নুর আলম সিদ্দিকী ও আবদুল কুদ্দুস মাখন তেজগাঁওয়ের নাখালপাড়ায় পিয়ার আলী দর্জির বাসায় টঙ্গীর নিশাত জুট মিলের মান্নান, তেজগাঁওয়ের সিদ্দিক দর্জি, আবুল খায়ের, আনোয়ার হোসেনসহ কিছু নেতার সঙ্গে হরতালের প্রস্তুতি নিয়ে আলোচনা করেন। ৭ জুন তেজগাঁওয়ে পূর্ণাঙ্গ শ্রমিক ধর্মঘট হয়। আদমজী ও পোস্তগোলায় আংশিক ধর্মঘট হয়। আদমজীতে শ্রমিকরা মিছিল করলে পুলিশের সঙ্গে সংঘর্ষ হয়।
তেজগাঁওয়ে ৭ জুন সকালে রেল যোগাযোগ বন্ধ করার জন্য ভাওয়ালবাগে কাঠের গুঁড়ি ফেলে শ্রমিকরা বাধার সৃষ্টি করেন। সকাল সাড়ে ৮টার দিকে জিআরপি পুলিশ কাঠের গুঁড়ি তুলে নেওয়ার চেষ্টা করলে শ্রমিকরা বাধা দেয়। পুলিশ গুলি চালালে সেভেনআপের (তাবানী বেভারেজ) শ্রমিক নেতা মনু মিয়া ও আজাদ অ্যালুমিনিয়ামের চাকরিচ্যুত শ্রমিক আবুল হোসেন নিহত হন। শ্রমিক নিহত হওয়ার খবর শুনে হাজার হাজার শ্রমিক তেজগাঁও লেবার ওয়েলফেয়ার সেন্টারের সামনে জমায়েত হন। সেখান থেকে দশ-বারো হাজার শ্রমিকের মিছিল রুহুল আমিন ভুঁইয়ার নেতৃত্বে ঢাকার কেন্দ্রস্থলের দিকে রওনা হয়। জগন্নাথ কলেজ ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকা ছাড়া ঢাকা শহরে হরতাল সেদিন তেমন সফল হয়নি। তেজগাঁওয়ের এই মিছিলে ঢাকার দিকে অগ্রসর হতেই সেসব স্থানে গাড়ি চলাচল বন্ধ হয়ে যায়। ঢাকা হাইকোর্টের কাছে ১৪৪ ধারা জারি করা হয়। ইপিআর মিছিলকে বাধা দেয়, মিছিল ছত্রভঙ্গ হয়ে যায়। শ্রমিক নেতা রুহুল আমিন ভুঁইয়াকে পুলিশ ১৭ জুন গ্রেফতার করে এবং তার ওপর প্রায় ৩৭টি মামলা দেওয়া হয়।
পোস্তগোলা শিল্পাঞ্চলের দায়িত্ব ছিল আমার ওপর। আমি তখন জগন্নাথ কলেজে পড়ি। সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে আমাকে যোগাযোগ রাখতে হয় পোস্তগোলায় শ্রমিকদের সঙ্গে। তাছাড়া ওখানকারই বাহাদুরপুর লেনে অবস্থিত চটকল শ্রমিক ফেডারেশনের কার্যালয়ে চটকল শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে নিয়মিত যোগাযোগ করে যেতে থাকি আমি। তাদের সংগঠিত করে তুলি হরতাল সফল করার জন্য। কিন্তু পোস্তগোলা ও শ্যামপুর শিল্পাঞ্চলের কোনো সিবিএ আমাদের সমর্থন করেনি।
৭ জুন সন্ধ্যার দিকে পুলিশ আমাকে সূত্রাপুর থানা থেকে রমনা থানায় নিয়ে যায়। ধর্মঘটে কয়েকশ' গ্রেফতারকৃত ব্যক্তিকে দুটি ছোট্ট লকআপে রাখা হয়। সেখানে প্রায় পাঁচশ' লোককে এনে রাখা হয়। সেখানেই কোর্ট বসে, বিচারক ম্যাজিস্ট্রেট উর্দুভাষী হাফিজ সাহেব। সামারি ট্রায়ালের পর গভীর রাতে গ্রেফতারকৃতদের ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে পাঠানো হয়। সামারি ট্রায়ালে পুলিশ কর্মকর্তারা বন্দিদের বলে, দোষ স্বীকার করলে কম জেল, না করলে বেশি সময়ের কারাদণ্ড হবে। শাস্তি যেন কম হয় সে কারণে অধিকাংশ বন্দি দোষ স্বীকার করে। আমার নিজেকে দোষী বলে মনে হয়নি, মনে আসেনি রেহাই পাওয়ার কোনো কাতরতা। আমি দোষ স্বীকার করিনি। জেলে অধিকাংশই হয়ে যায় কয়েদি। সেদিন গ্রেফতারকৃতদের মধ্যে ছিলেন কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক ও তৎকালীন ছাত্র ইউনিয়ন নেতা মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম এবং বাংলাদেশ বিমানের সাবেক চেয়ারম্যান তৎকালীন ছাত্রলীগ নেতা আল আমীন চৌধুরী।
৭ জুন শিল্পাঞ্চলগুলোতেই হরতাল সফল হয়। '৬৯-এর গণআন্দোলন, '৭১-এর অসহযোগ আন্দোলনে শ্রমিক-কর্মচারীদের অংশগ্রহণের বীজ মূলত এ সময় এভাবেই বপন হয়ে যায়। ইতিপূর্বে কোনো রাজনৈতিক কর্মসূচিতে শ্রমিকদের অংশগ্রহণ এত অধিক ছিল না। সিরাজুল আলম খানের নির্দেশে আমরা ঢাকা নগরের বিভিন্ন স্থানে যেভাবে ছাত্রলীগ সংগঠিত করতে থাকি, সেভাবেই রুহুল আমিন ভুঁইয়ার অবর্তমানে তেজগাঁওয়ে যোগাযোগ রক্ষা করা, সরাসরি পোস্তগোলা-শ্যামপুর, নারায়ণগঞ্জ ও ডেমরায় সাংগঠনিক কার্যক্রম চালিয়ে যেতে থাকি। স্বাধীন বাংলার নিউক্লিয়াসের একটি সংগঠন পাঠচক্র গড়ে তুলি। এর সঙ্গে যুক্ত ছিলেন আমিনুল হক বাদশা ও আওয়ামী লীগ নেতা মুন্সীগঞ্জের আবদুল হাই ও অন্যরা। '৬৯-এর গণআন্দোলনের পর বন্দি নেতারা বের হয়ে আসেন, নতুন অনেক লোকও আমাদের সঙ্গে যোগ দেয়। অনেকেই যোগ দেয় ভোল পাল্টিয়ে বন্যায় ভাসমান শেওলা ও আবর্জনার মতো। আবার অনেকে যোগ দেয় বেগবান প্রবাহকে এগিয়ে নিতে।
মেসবাহউদ্দীন আহমেদ : জাতীয় শ্রমিক জোটের সভাপতি ও অঙ্কুর প্রকাশনীর পরিচালক
No comments