চুনাপাথর-নতুন মজুদ নিয়ে আশাবাদ by মুশফিকুর রহমান
ভূতাত্ত্বিক জরিপ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক দেশের উত্তরাঞ্চলের জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলায় চলমান খনন কূপে পাওয়া তথ্যের ভিত্তিতে একটি নতুন চুনাপাথরের সঞ্চয়ক্ষেত্র আবিষ্কারের ঘোষণা দিয়েছেন। তিনি অনুমান করেছেন যে নতুন চুনাপাথরের ক্ষেত্রটি দেশে আবিষ্কৃত চুনাপাথরের সঞ্চয়ক্ষেত্রগুলোর মধ্যে ‘বৃহত্তম’।
প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, পাঁচবিবির খননকূপ ৪৫৬ দশমিক ৬ মিটার গভীরে চুনাপাথরের স্তর স্পর্শ করেছে। এখনো খনন অব্যাহত রয়েছে। তিনি আরও আশা করেছেন, এই ক্ষেত্র থেকে চুনাপাথর উত্তোলন দেশের জন্য লাভজনক হবে। এক মাসের মধ্যে পাঁচবিবি চুনাপাথরের ক্ষেত্রে এর মজুদ নিশ্চিত হওয়া যাবে বলে মহাপরিচালক আশাবাদ জানিয়েছেন।
দেশে এখন ভারতের মেঘালয় থেকে চুনাপাথর আমদানি করে সুনামগঞ্জের লাফার্জ সিমেন্ট কারখানার চাহিদা মেটানো হয়। তা ছাড়া দেশের অন্যান্য (প্রায় ১৫টি) সিমেন্ট কারখানার প্রায় ২০ মিলিয়ন টন উৎপাদনক্ষমতা চাহিদা পূরণের জন্য ক্লিংকার আমদানি করা হয়। খনি থেকে উত্তোলিত সিমেন্টের জন্য উপযোগী চুনাপাথর নির্দিষ্ট কারখানায় নির্ধারিত মান ও পরিমাণের কাদামাটির সঙ্গে মিশিয়ে এক হাজার ৪৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে পুড়িয়ে ক্লিংকার তৈরি করা হয়। ফলে দেশে চুনাপাথরের বড় সঞ্চয়ক্ষেত্র খুঁজে পেলে তা সিমেন্টশিল্প বিকাশে সহায়ক হবে বলে সংগত আশাবাদ তৈরি হয়।
ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা স্থানে চুনাপাথরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ১৯৫৯ সালে বগুড়ার কুচমায় তেল অনুসন্ধান কূপ খনন করতে গিয়ে এক হাজার ৭৭৪ মিটার গভীরে প্রথম চুনাপাথরের স্তর চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে নাটোরের সিংড়ায় দুই হাজার ১২৬ মিটার, বগুড়ার কূপে এক হাজার ৭৬৬ মিটার এবং জয়পুরহাট-পাহাড়পুরে ষাটের দশকে ৪১০-৫৪১ মিটার গভীরে চুনাপাথরের স্তর চিহ্নিত করা হয়। জয়পুরহাটের চুনাপাথর মজুদ এবং তার মান আকর্ষণীয় বিবেচনায় ক্ষেত্রটির বিস্তারিত আর্থকারিগরি সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে। সত্তরের দশকে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে জয়পুরহাটে চুনাপাথর খনি ও সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের উদ্যোগও নেওয়া হয়। তবে ৬ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার চিহ্নিত খনির জন্য জয়পুরহাটে মাটির ৫১৫-৫৪১ মিটার গভীরে ২৭০ মিলিয়ন টন উন্নত মানের চুনাপাথরের মজুদ নিশ্চিত হওয়া গেলেও সেখানে খনি উন্নয়ন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেনি। জয়পুরহাটে চুনাপাথরের খনি উন্নয়ন করতে সেখানে পুরু পানিবাহী ও ভঙ্গুর কাদাবালির স্তর অতিক্রম করে ভূগর্ভস্থ খনি নির্মাণ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এ জন্য ব্যয়বহুল ফ্রিজিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে খনির জন্য কমপক্ষে দুটি ‘শ্যাফট’ নির্মাণসহ ভূগর্ভস্থ খনি নির্মাণ ও পরিচালনার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে হতো। পেট্রোবাংলা পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে চুনাপাথরের মতো তুলনামূলক সস্তা খনিজের জন্য ব্যয়বহুল ভূগর্ভস্থ খনি নির্মাণ ও পরিচালনায় আগ্রহী বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।
এদিকে, সুনামগঞ্জের টাকেরঘাট ও সংলগ্ন এলাকায় ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৫০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত প্রায় ১৪ মিলিয়ন টন মজুদ আবিষ্কৃত হয় গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। ১৯৬৫ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগে উন্মুক্ত খনি নির্মাণ করে ছাতক সিমেন্ট কারখানার জন্য টাকেরঘাট খনি থেকে চুনাপাথর তোলা শুরু হয়, যা ১৯৯৫ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৯৭২-১৯৯৫ পর্যন্ত এই খনি থেকে সাত লাখ ৪১ হাজার টন চুনাপাথর উত্তোলিত হয়েছে, যা ছাতক সিমেন্ট কারখানাকে উৎপাদনক্ষম রাখতে সহায়তা করেছে ।
দেশের একমাত্র সচল এবং চুনাপাথর থেকে ক্লিংকার ও সিমেন্ট তৈরির কারখানা সুনামগঞ্জের লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কোম্পানি। এই কারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য কারখানা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ‘নংট্রাই চুনাপাথর খনি’ থেকে চুনাপাথর তুলে কনভেয়র বেল্টে পরিবহন করে ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের কারখানায় আনা হয়। চুনাপাথর খনির মালিকও লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ। নংট্রাই খনির চুনাপাথরের মজুদ প্রায় ২০৭ মিলিয়ন টন। দুই মিলিয়ন টন চুনাপাথর থেকে লাফার্জের সুনামগঞ্জ সিমেন্ট কারখানায় বছরে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন টন ক্লিংকার তৈরি করা হয়, যা একই কারখানায় সিমেন্ট তৈরিতে ব্যবহূত হয় (আংশিক ক্লিংকার লাফার্জ অন্যদের সরবরাহ করে এবং বছরে এক মিলিয়ন টন সিমেন্ট উৎপাদন করে)।
সিমেন্ট তৈরির জন্য উপযোগী চুনাপাথরে ৪৩-৪৯ শতাংশ ক্যালসিয়াম অক্সাইড ও ৯-১৫ শতাংশ সিলিকা থাকা প্রয়োজন। চুনাপাথরের মজুদ চিহ্নিত করা গেলেই যে খনি উন্নয়নের উপযোগী হবে, এমনটি স্বতঃসিদ্ধ নয়। এ জন্য মজুদের পরিমাণ, গুণগত মান, গভীরতা নির্ণয়সহ সামগ্রিক আর্থকারিগরি সমীক্ষা আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে সম্পাদন করা জরুরি। কেবল তার পরই আগ্রহী বিনিয়োগকারী মজুদ এলাকায় খনি নির্মাণ ও চুনাপাথর উত্তোলনের বিষয়টি বিবেচনার জন্য মনে করতে পারে। সেই পটভূমিতে পাঁচবিবির চুনাপাথর মজুদ বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনের জন্য আকর্ষণীয় হবে কি না, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
দেশে এখন ভারতের মেঘালয় থেকে চুনাপাথর আমদানি করে সুনামগঞ্জের লাফার্জ সিমেন্ট কারখানার চাহিদা মেটানো হয়। তা ছাড়া দেশের অন্যান্য (প্রায় ১৫টি) সিমেন্ট কারখানার প্রায় ২০ মিলিয়ন টন উৎপাদনক্ষমতা চাহিদা পূরণের জন্য ক্লিংকার আমদানি করা হয়। খনি থেকে উত্তোলিত সিমেন্টের জন্য উপযোগী চুনাপাথর নির্দিষ্ট কারখানায় নির্ধারিত মান ও পরিমাণের কাদামাটির সঙ্গে মিশিয়ে এক হাজার ৪৫০ ডিগ্রি সেন্টিগ্রেড তাপে পুড়িয়ে ক্লিংকার তৈরি করা হয়। ফলে দেশে চুনাপাথরের বড় সঞ্চয়ক্ষেত্র খুঁজে পেলে তা সিমেন্টশিল্প বিকাশে সহায়ক হবে বলে সংগত আশাবাদ তৈরি হয়।
ভূতাত্ত্বিক অনুসন্ধানের বিভিন্ন পর্যায়ে নানা স্থানে চুনাপাথরের সন্ধান পাওয়া গেছে। ১৯৫৯ সালে বগুড়ার কুচমায় তেল অনুসন্ধান কূপ খনন করতে গিয়ে এক হাজার ৭৭৪ মিটার গভীরে প্রথম চুনাপাথরের স্তর চিহ্নিত করা হয়। পরবর্তী সময়ে নাটোরের সিংড়ায় দুই হাজার ১২৬ মিটার, বগুড়ার কূপে এক হাজার ৭৬৬ মিটার এবং জয়পুরহাট-পাহাড়পুরে ষাটের দশকে ৪১০-৫৪১ মিটার গভীরে চুনাপাথরের স্তর চিহ্নিত করা হয়। জয়পুরহাটের চুনাপাথর মজুদ এবং তার মান আকর্ষণীয় বিবেচনায় ক্ষেত্রটির বিস্তারিত আর্থকারিগরি সমীক্ষা পরিচালিত হয়েছে। সত্তরের দশকে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে জয়পুরহাটে চুনাপাথর খনি ও সিমেন্ট কারখানা স্থাপনের উদ্যোগও নেওয়া হয়। তবে ৬ দশমিক ৪৭ বর্গকিলোমিটার এলাকার চিহ্নিত খনির জন্য জয়পুরহাটে মাটির ৫১৫-৫৪১ মিটার গভীরে ২৭০ মিলিয়ন টন উন্নত মানের চুনাপাথরের মজুদ নিশ্চিত হওয়া গেলেও সেখানে খনি উন্নয়ন বিনিয়োগকারীদের আকৃষ্ট করেনি। জয়পুরহাটে চুনাপাথরের খনি উন্নয়ন করতে সেখানে পুরু পানিবাহী ও ভঙ্গুর কাদাবালির স্তর অতিক্রম করে ভূগর্ভস্থ খনি নির্মাণ পরিকল্পনা নেওয়া হয়েছিল। এ জন্য ব্যয়বহুল ফ্রিজিং পদ্ধতি প্রয়োগ করে খনির জন্য কমপক্ষে দুটি ‘শ্যাফট’ নির্মাণসহ ভূগর্ভস্থ খনি নির্মাণ ও পরিচালনার চ্যালেঞ্জ বাস্তবায়ন করতে হতো। পেট্রোবাংলা পরবর্তী সময়ে প্রকল্পটি পরিত্যক্ত ঘোষণা করে চুনাপাথরের মতো তুলনামূলক সস্তা খনিজের জন্য ব্যয়বহুল ভূগর্ভস্থ খনি নির্মাণ ও পরিচালনায় আগ্রহী বিনিয়োগকারী খুঁজে পাওয়া সহজ নয়।
এদিকে, সুনামগঞ্জের টাকেরঘাট ও সংলগ্ন এলাকায় ভূপৃষ্ঠ থেকে ১৫০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত প্রায় ১৪ মিলিয়ন টন মজুদ আবিষ্কৃত হয় গত শতকের পঞ্চাশের দশকে। ১৯৬৫ সাল থেকে সরকারি উদ্যোগে উন্মুক্ত খনি নির্মাণ করে ছাতক সিমেন্ট কারখানার জন্য টাকেরঘাট খনি থেকে চুনাপাথর তোলা শুরু হয়, যা ১৯৯৫ পর্যন্ত অব্যাহত থাকে। ১৯৭২-১৯৯৫ পর্যন্ত এই খনি থেকে সাত লাখ ৪১ হাজার টন চুনাপাথর উত্তোলিত হয়েছে, যা ছাতক সিমেন্ট কারখানাকে উৎপাদনক্ষম রাখতে সহায়তা করেছে ।
দেশের একমাত্র সচল এবং চুনাপাথর থেকে ক্লিংকার ও সিমেন্ট তৈরির কারখানা সুনামগঞ্জের লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কোম্পানি। এই কারখানার কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহারের জন্য কারখানা থেকে ১৭ কিলোমিটার দূরে ভারতের মেঘালয় রাজ্যের ‘নংট্রাই চুনাপাথর খনি’ থেকে চুনাপাথর তুলে কনভেয়র বেল্টে পরিবহন করে ২০০৫ সাল থেকে বাংলাদেশের কারখানায় আনা হয়। চুনাপাথর খনির মালিকও লাফার্জ সুরমা সিমেন্ট কারখানা কর্তৃপক্ষ। নংট্রাই খনির চুনাপাথরের মজুদ প্রায় ২০৭ মিলিয়ন টন। দুই মিলিয়ন টন চুনাপাথর থেকে লাফার্জের সুনামগঞ্জ সিমেন্ট কারখানায় বছরে ১ দশমিক ২ মিলিয়ন টন ক্লিংকার তৈরি করা হয়, যা একই কারখানায় সিমেন্ট তৈরিতে ব্যবহূত হয় (আংশিক ক্লিংকার লাফার্জ অন্যদের সরবরাহ করে এবং বছরে এক মিলিয়ন টন সিমেন্ট উৎপাদন করে)।
সিমেন্ট তৈরির জন্য উপযোগী চুনাপাথরে ৪৩-৪৯ শতাংশ ক্যালসিয়াম অক্সাইড ও ৯-১৫ শতাংশ সিলিকা থাকা প্রয়োজন। চুনাপাথরের মজুদ চিহ্নিত করা গেলেই যে খনি উন্নয়নের উপযোগী হবে, এমনটি স্বতঃসিদ্ধ নয়। এ জন্য মজুদের পরিমাণ, গুণগত মান, গভীরতা নির্ণয়সহ সামগ্রিক আর্থকারিগরি সমীক্ষা আন্তর্জাতিক মান অনুসরণ করে সম্পাদন করা জরুরি। কেবল তার পরই আগ্রহী বিনিয়োগকারী মজুদ এলাকায় খনি নির্মাণ ও চুনাপাথর উত্তোলনের বিষয়টি বিবেচনার জন্য মনে করতে পারে। সেই পটভূমিতে পাঁচবিবির চুনাপাথর মজুদ বাণিজ্যিকভাবে উত্তোলনের জন্য আকর্ষণীয় হবে কি না, তা জানতে আমাদের অপেক্ষা করতে হবে।
ড. মুশফিকুর রহমান: খনি প্রকৌশলী, জ্বালানি ও পরিবেশবিষয়ক লেখক।
No comments