চারদিক-‘থ্রি’ পাস গ্র্যাজুয়েট by এম আর আলম
‘আমি সেনা কর্মকর্তা হব। আমাদের দেশের ওপর বাইরের শত্রুর কোনো হামলা এলে তা প্রতিহত করব; প্রয়োজনে বুকের রক্ত দেব, যেভাবে এ দেশের স্বাধীনতার জন্য ৩০ লাখ লোক তাঁদের মূল্যবান জীবন উৎসর্গ করেছিলেন।’ এভাবেই কথাগুলো বলল একজন ‘থ্রি’ পাস গ্র্যাজুয়েট।
আসলে ওদের গ্র্যাজুয়েটই বলা হয়। সৈয়দপুর শহরের মুন্সিপাড়া মহল্লার সুইপার কলোনিতে বেড়ে ওঠা দলিত পরিবারের শিশু ওরা। একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা (গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র) ওই হরিজন শিশুদের সমাজের মূলধারায় আনতে কাজ শুরু করেছে। প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষাটা মিলছে ওই হরিজন পল্লিতে স্থাপিত স্কুলেই। যে স্কুলে শিশু শ্রেণী থেকে থ্রি পর্যন্ত পড়ানো হয়। আর থ্রি পাস করলেই গ্র্যাজুয়েট উপাধি। ওই গ্র্যাজুয়েটরা পরে সমাজের মূলধারার স্কুলগুলোতে ভর্তি হয়ে শিক্ষা অব্যাহত রাখার সুযোগটা কাজে লাগাতে পারে। অবশ্য অনেকে লাগাচ্ছেও।
২০০৬ সালে হরিজন তথা দলিত সম্প্রদায়ের শিশুদের শিক্ষার আলো দিতে সৈয়দপুরে এ ধরনের বেশ কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এসব স্কুলে দলিত সম্প্রদায়ের দুই শতাধিক শিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।
মুন্সিপাড়া দলিত স্কুল থেকে গত বছর গ্র্যাজুয়েট হয়েছে রাজ বাসফোর। সে এখন একই এলাকার ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রবল আত্মপ্রত্যয়ী ওই শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ওর কথাই বলা হলো শুরুতে।
ক্লাস থ্রির শিক্ষার্থী অনিতা জানায়, ‘আমি বড় হলে শিক্ষক হব। টাকার জন্য নয়, ওই পেশায় থেকে মানুষের অনেক সেবা করা যায়। আমাদের আপারা তো (শিক্ষক) সেবার মনোভাব নিয়েই আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন। আমাদের বাবা-মা কি ভেবেছিলেন, মেথরের বাচ্চা গ্র্যাজুয়েট হবে? আজ আমরা লেখাপড়া শিখছি, আমরা যে জ্ঞান আহরণ করছি, তাই শিখছে সমাজের অন্য শিশুরাও। এটা তো কম গর্বের কথা নয়।’
গত ৩১ মের কথা। দলিত স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্লাস চলছিল। সেখানে দেখা গেল, ১৮ জন শিশু আপনমনে লেখাপড়া করছে। দুজন নারী শিক্ষক পালা করে তাদের লেখাপড়া দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। ওই ক্লাসের ছাত্র বিজয়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কে? চটজলদি উত্তর, ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ পরে অন্য প্রশ্নের জবাবে বলল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম। তিনি যে বিদ্রোহী কবি, তা-ও জানে শিশুরা। একপর্যায়ে সবাই দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গেয়ে শোনাল। পরে কেউ গাইল দেশের গান, কেউ করল নৃত্য পরিবেশন, আবার কেউ আবৃত্তি।
প্রশ্ন করা হলো অন্যান্য শিক্ষার্থীর কাছেও। ‘বলো তো, বঙ্গবন্ধু কে?’ উত্তরে সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।’
দলিত স্কুলের শিক্ষক সানজিদা ইয়াসমিন বললেন, ‘হরিজনের সন্তান বলে ওদের অবহেলা করবেন না। ওরা অনেক মেধাবী। আমরা মাতৃস্নেহে ওদের পাঠদান করি। অনেক দ্রুত ওরা শিখে নেয় তাদের পাঠ।’ শিক্ষক আরতি রানী পালের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘প্রথম প্রথম ওদের অপরিচ্ছন্ন দেখেছি। পরে তাদের স্বাস্থ্যসচেতনতা সম্পর্কে শিখিয়েছি। এখন আর কেউ অপরিচ্ছন্ন থাকে না। ওরা পড়াশোনা, পোশাক-পরিচ্ছদেও পরিপাটি।’
স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও হরিজন নারীকল্যাণ সমিতির সভাপতি হলেন তুতিয়া বাসফোর। তিনি ওই সম্প্রদায়ের মানোন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রাখছেন জাতীয় পর্যায়ে। এর আগে তিনি জার্মানি সফর করেছেন। তিনি মনে করেন, এই হরিজন শিশুরা এক দিন শিক্ষাদীক্ষায় অনেক বড় হবে। তারা দেশের জন্য কাজ করবে। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে আমাদের সন্তানেরা সেলুনে গিয়ে চুল কাটতে পারত না; স্কুলে গেলে পাশের আসনে কেউ বসতে চাইত না। এখন সময় পাল্টেছে। এখন সমাজের মূলধারার শিশুরা ক্লাসে হরিজন শিশুদের স্বাগত জানাচ্ছে। সমাজসচেতন হয়েছে বলেই হরিজনেরা আজ একই রেস্তোরাঁয় সবাই মিলে চা পান করে।’ সমাজে এখন খুব একটা বৈষম্য নেই বলে জানান তিনি।
গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. আবদুল হাকিম মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেবল গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র নয়, হরিজন শিশুদের মানোন্নয়নে সারা দেশে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। শুধু শিক্ষা নয়, দলিত জনগোষ্ঠীরা যাতে মূলধারায় একাকার হয়ে নিজেদের আর্থসামাজিক বিকাশ ঘটাতে পারে, এ লক্ষ্যে অনেক কর্মসূচি রয়েছে তাঁদের। এতে সাফল্যও মিলছে বলে জানান তিনি।
হরিজন পল্লি থেকে বেরিয়ে আসার সময় আরেকজন গ্র্যাজুয়েট বলে ওঠে, ‘আমাদের অভিভাবকেরা এখনো মদ পান করেন। মাতালেরা কখনোই ভালো কাজ করতে পারেন না। আমরা কখনোই মদ স্পর্শ করব না। যাঁরা মদ পান করেন, তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনুন, তাঁদের বদলে দিন।’
এম আর আলম
সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি
২০০৬ সালে হরিজন তথা দলিত সম্প্রদায়ের শিশুদের শিক্ষার আলো দিতে সৈয়দপুরে এ ধরনের বেশ কয়েকটি স্কুল প্রতিষ্ঠা হয়েছে। এসব স্কুলে দলিত সম্প্রদায়ের দুই শতাধিক শিশু শিক্ষার সুযোগ পাচ্ছে।
মুন্সিপাড়া দলিত স্কুল থেকে গত বছর গ্র্যাজুয়েট হয়েছে রাজ বাসফোর। সে এখন একই এলাকার ইসলামিয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা চালিয়ে যাচ্ছে। প্রবল আত্মপ্রত্যয়ী ওই শিক্ষার্থী ভবিষ্যতে সেনা কর্মকর্তা হওয়ার স্বপ্ন দেখছে। ওর কথাই বলা হলো শুরুতে।
ক্লাস থ্রির শিক্ষার্থী অনিতা জানায়, ‘আমি বড় হলে শিক্ষক হব। টাকার জন্য নয়, ওই পেশায় থেকে মানুষের অনেক সেবা করা যায়। আমাদের আপারা তো (শিক্ষক) সেবার মনোভাব নিয়েই আমাদের শিক্ষা দিচ্ছেন। আমাদের বাবা-মা কি ভেবেছিলেন, মেথরের বাচ্চা গ্র্যাজুয়েট হবে? আজ আমরা লেখাপড়া শিখছি, আমরা যে জ্ঞান আহরণ করছি, তাই শিখছে সমাজের অন্য শিশুরাও। এটা তো কম গর্বের কথা নয়।’
গত ৩১ মের কথা। দলিত স্কুলে দ্বিতীয় শ্রেণীর ক্লাস চলছিল। সেখানে দেখা গেল, ১৮ জন শিশু আপনমনে লেখাপড়া করছে। দুজন নারী শিক্ষক পালা করে তাদের লেখাপড়া দেখিয়ে দিচ্ছিলেন। ওই ক্লাসের ছাত্র বিজয়। তার কাছে জানতে চাওয়া হয়, জাতীয় সংগীতের রচয়িতা কে? চটজলদি উত্তর, ‘বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।’ পরে অন্য প্রশ্নের জবাবে বলল জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের নাম। তিনি যে বিদ্রোহী কবি, তা-ও জানে শিশুরা। একপর্যায়ে সবাই দাঁড়িয়ে জাতীয় সংগীত গেয়ে শোনাল। পরে কেউ গাইল দেশের গান, কেউ করল নৃত্য পরিবেশন, আবার কেউ আবৃত্তি।
প্রশ্ন করা হলো অন্যান্য শিক্ষার্থীর কাছেও। ‘বলো তো, বঙ্গবন্ধু কে?’ উত্তরে সবাই সমস্বরে বলে ওঠে, ‘বঙ্গবন্ধু আমাদের একটি স্বাধীন দেশ এনে দিয়েছেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমান।’
দলিত স্কুলের শিক্ষক সানজিদা ইয়াসমিন বললেন, ‘হরিজনের সন্তান বলে ওদের অবহেলা করবেন না। ওরা অনেক মেধাবী। আমরা মাতৃস্নেহে ওদের পাঠদান করি। অনেক দ্রুত ওরা শিখে নেয় তাদের পাঠ।’ শিক্ষক আরতি রানী পালের সঙ্গে কথা বললে তিনি বলেন, ‘প্রথম প্রথম ওদের অপরিচ্ছন্ন দেখেছি। পরে তাদের স্বাস্থ্যসচেতনতা সম্পর্কে শিখিয়েছি। এখন আর কেউ অপরিচ্ছন্ন থাকে না। ওরা পড়াশোনা, পোশাক-পরিচ্ছদেও পরিপাটি।’
স্কুলটির পরিচালনা কমিটির সভাপতি ও হরিজন নারীকল্যাণ সমিতির সভাপতি হলেন তুতিয়া বাসফোর। তিনি ওই সম্প্রদায়ের মানোন্নয়নে জোরালো ভূমিকা রাখছেন জাতীয় পর্যায়ে। এর আগে তিনি জার্মানি সফর করেছেন। তিনি মনে করেন, এই হরিজন শিশুরা এক দিন শিক্ষাদীক্ষায় অনেক বড় হবে। তারা দেশের জন্য কাজ করবে। তিনি বলেন, ‘প্রথম দিকে আমাদের সন্তানেরা সেলুনে গিয়ে চুল কাটতে পারত না; স্কুলে গেলে পাশের আসনে কেউ বসতে চাইত না। এখন সময় পাল্টেছে। এখন সমাজের মূলধারার শিশুরা ক্লাসে হরিজন শিশুদের স্বাগত জানাচ্ছে। সমাজসচেতন হয়েছে বলেই হরিজনেরা আজ একই রেস্তোরাঁয় সবাই মিলে চা পান করে।’ সমাজে এখন খুব একটা বৈষম্য নেই বলে জানান তিনি।
গ্রাম বিকাশ কেন্দ্রের প্রকল্প সমন্বয়কারী মো. আবদুল হাকিম মিয়ার সঙ্গে কথা বলে জানা গেল, কেবল গ্রাম বিকাশ কেন্দ্র নয়, হরিজন শিশুদের মানোন্নয়নে সারা দেশে এখন অনেক প্রতিষ্ঠান কাজ করছে। শুধু শিক্ষা নয়, দলিত জনগোষ্ঠীরা যাতে মূলধারায় একাকার হয়ে নিজেদের আর্থসামাজিক বিকাশ ঘটাতে পারে, এ লক্ষ্যে অনেক কর্মসূচি রয়েছে তাঁদের। এতে সাফল্যও মিলছে বলে জানান তিনি।
হরিজন পল্লি থেকে বেরিয়ে আসার সময় আরেকজন গ্র্যাজুয়েট বলে ওঠে, ‘আমাদের অভিভাবকেরা এখনো মদ পান করেন। মাতালেরা কখনোই ভালো কাজ করতে পারেন না। আমরা কখনোই মদ স্পর্শ করব না। যাঁরা মদ পান করেন, তাঁদের স্বাভাবিক জীবনে ফিরিয়ে আনুন, তাঁদের বদলে দিন।’
এম আর আলম
সৈয়দপুর (নীলফামারী) প্রতিনিধি
No comments